সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/কাঙালীচরণ
কাঙালীচরণ
কাঙালীচরণ বাঙালীর ছেলে, গেঁয়ো,
তাই ব’লে নয় আমাদের চেয়ে হেয়।
সেদিন আষাঢ় অন্ধকারের রাতে
ঝিল্লী-মুখর পল্লীর রাস্তাতে
আসছিল সে যে নিজ কুটীরের পানে
আপনার মনে ‘গুন্ গুন্ গুন্’ গানে।
বাদল-বেলার মাদল বাজিছে মেঘে;—
শাঁই শাঁই শাঁই বাতাস ছুটিছে বেগে,
ভাঙন ধরেছে শীতলাক্ষার পাড়ে,
ঝুপঝাপ পাড় ভেঙে পড়ে বারে বারে।
কাঙালীচরণ গুটি গুটি চলে ঘরে,
এখনি আবার পশ্লা নামিবে জোরে।
হঠাৎ ও কি ও, হাহাকার কার দূরে!
কে চেঁচায় ওই করুণ কাতর সুরে?
চমকি কাঙালী থমকি দাঁড়াল ফিরে,
সহসা ছুটিল শীতলাক্ষার তীরে।
ফুলের মতন দুলেদের ছোট টুনি
গিয়েছিল ঘাটে জল নিতে এক্ষুনি,
হঠাৎ কখন ধুপ্ ক’রে পাড় ধ্বসি’
ঝুপ করে টুনি জলেতে পড়েছে খসি।
পড়িয়া দারুণ ঘুর্নি জলের পাকে—
‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চীৎকার করি’ ডাকে।
কেহ নাই, আহা, রক্ষা করিবে আসি,
মৃত্যুর ছবি নয়নে উঠিল ভাসি।
ত্বরিতে কাঙালী ছুটিয়া আসিল তীরে—
‘ভয় নাই’ বলি’ ঝাঁপায়ে পড়িল নীরে।
কল-কল্লোলে জল ওঠে ফুলে ফুলে—
ঘূর্নির পাকে ঢেউ উঠে দুলে দুলে।
ফুঁসিয়া রুষিয়া গর্জিছে ঘিরে ঘিরে;
জোয়ারের তোড়ে একাকার তীরে নীরে।
নিবিড় আঁধার, চারিধার ধোঁয়া-ঢাকা—
থম্থমে গাঢ় মিশ্-কুহেলিকা-মাখা।
কাঙালীচরণ প্রাণপাত করি, শেষে
টুনিরে লইয়া তীরেতে উঠিল ভেসে।
মূৰ্ছিত প্রায় মেয়েটিরে কোলে ক’রে
পৌঁছে দিল সে বিধবা মায়ের ঘরে।
কাঙালীচরণ বাঙালীর ছেলে, গেঁয়ো—
তাই ব’লে নয় আমাদের চেয়ে হেয়।