সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/কে বড়?

কে বড়?

ছেলে

জগৎ-সভায় শ্রেষ্ঠ মোরা যত ছেলের দল,
মোদের নিয়েই বিশ্বমাতার মুখখানি উজ্জ্বল।
আমরা ছেলে, সবার সেরা, সবার প্রধান হই,
বুদ্ধি এবং জ্ঞান-গরিমায় সবার উপর রই।
এই জগতে জ’ন্মে গেছেন শ্রেষ্ঠ যত বীর—
মোদের মাঝেই জন্ম তাঁদের, জানবে সেটা স্থির।
জ্ঞানে গুণে শ্রেষ্ঠ যাঁরা দীপ্ত প্রতিভায়—
যশের আলো ছড়ান যাঁরা বুদ্ধি ও বিদ্যায়,
কত শত মহাপুরুষ, যোগী-ঋষির দল,
মোদের মাঝেই সুপ্ত, তাঁরা ছিলেন অবিরল।

সেই সে সুদূর অতীত হতে বর্তমানের কাল—
মোদের বিরাট কীর্তি-চাকা ঘুরছে সুবিশাল।
আমরা ছেলে, তোমরা মেয়ে, অনেক ব্যবধান,
যুগে যুগে আমরা চালাই বিরাট অভিযান।
অখ্যাত আর অজ্ঞাত দেশ মোদের আবিষ্কার,
বিশাল মরু, বিরাট পাহাড় আমরা যে হই পার।
নিবিড় গভীর অরণ্যে যাই, মরণকে নাই ভয়,
প্রাণের অতুল সাহস দিয়ে বিশ্ব করি জয়।
মরুর দেশে, মেরুর দেশে আমরা চ’লে যাই,
সিন্ধু-তলের রহস্যেরও আভাস মোরা পাই।
শিল্প এবং সাহিত্যেতে মোদের জুড়ি কই?
বিজ্ঞানে ও জ্ঞানে মোরা সবার প্রধান হই।
বর্তমানের এ সভ্যতায় আমরা সবাই মূল,
আমরা ভাঙি, আমরা গড়ি—নাই যে তাতে ভুল।
তোমরা মেয়ে, বিশ্ব ছেয়ে তোমরা কর বাস,
তোমরা কোনো কাজেই লাগো করি না বিশ্বাস।
তোমরা ভীরু গো-বেচারী, নেহাৎ বলহীন,
আমাদেরই অধীন হয়ে কাটাও চিরদিন।
আমরা ছাড়া তোমরা অচল, একান্ত দুর্বল,
রান্না এবং কান্না ছাড়া নাই কিছু সম্বল।

মেয়ে

সত্যি বটে আমরা মেয়ে, তুচ্ছ তবু নই,
যুগে যুগে আমরা সবার শ্রদ্ধা কেড়ে লই।
মেয়ের জাতি, মায়ের জাতি, দেবীর জাতি আর—
আমরা আছি তাইতো আজো চলেছে সংসার।
মোদের খাটো করতে গেলে তোমরা খাটো হও,
মিথ্যে অপমানের বোঝ নিজের কাঁধে বও।

আজকে যাদের দেখ বড়, বিরাট বিরাট লোক,
মোদের কাছে সবাই ঋণী, যতই বড় হোক।
স্নেহ-প্রীতি, দয়া-ক্ষমায় মোদের জুড়ি নেই,
জন্ম লভি আমরা মেয়ে লক্ষ্মীর অংশেই।
বিশ্বমায়ের আমরা প্রতীক, বিশ্বময়ীর রূপ,
বিশ্ব-মাঝে আমরা জ্বালাই কল্যাণেরি ধূপ।
তোমরা ছেলে, অনেক গুণে তোমরা গুণবান্,
সে-সব গুণের অনেকখানি জননীদের দান।
জননীদের সুশিক্ষা আর পবিত্র দীক্ষায়
কত ছেলে ‘মানুষ’ হ’ল, খোঁজ রাখো না তায়?
আমরা মেয়ে, তাই বলে নই নেহাৎ বলহীন,
বীর রমণীর অভাব ধরায় হয় নি কোনোদিন।
পুরাণে আর ইতিহাসে প্রমাণ আছে ঢের,
আর্য-নারীর গুণের কথা বলতে হবে ফের?
তোমরা কঠোর, আমরা কোমল, নই মোরা দুর্বল,
অসাধ্য কাজ করতে পারে মোদের চোখের দল।
কুসুম-কোমল মনে মোদের বজ্র চাপা রয়—
গ’র্জে ওঠে বাজের আগুন যেই প্রয়োজন হয়।
আমরা মেয়ে, কারুর চেয়ে আমরা ছোট নই—
জগৎ মাঝে মোদের কাজে আমরা সেরা হই।
মোদের সহায়তার জোরে তোমরা কর কাজ,
মোদের ছাড়া বিশখানি শ্মশান হ’ত আজ।
আমরা আনি স্বর্গ হতে মন্দাকিনীর জল,
আমরা ফলাই এই দুনিয়ায় অমৃতেরি ফল।

(অভিভাবকের প্রবেশ)

অভিভাবক

তর্ক থামাও, তর্ক থামাও ছেলেমেয়ের দল,
কথায় কেবল কথাই বাড়ে—হয় না কোনো ফল।
ছেলে এবং মেয়ের মাঝে শ্রেষ্ঠ বা কোন্ জন—
তর্ক করে মীমাংসা এর হয় না কদাচন।
ভগবানের সৃষ্টি উভয়, দু’এর পৃথক্ কাজ,
একটি ছাড়া অন্য অচল এই দুনিয়ার মাঝ।
নিজের কাজে উভয় বড়, নাইকো তাতে ভুল,
ছেলে মেয়ে এক বোঁটাতে দুইটি যেন ফুল।
একটি ফুলের অভাব হ’লে অন্যটি হয় ম্লান,
একের তাজা সৌরভেতে অন্যটি পায় প্রাণ।
ছেলে মেয়ে সবাই করে আপন আপন কাজ,
কেউ হেয় নয় কারুর চেয়ে বলতে পারি আজ।
যুগে যুগে ছেলের পাশে মেয়ের সাড়া পাই,
তারাই গড়ে স্বর্গ-নরক, সন্দেহ তার নাই।
কেউ হেয় নয় এই জগতে, তুচ্ছ কেহ নয়,
কারুর কাছে কারুর কভু হয় না পরাজয়।
এগিয়ে চলার দিন এসেছে,—স্বাধীন হ’ল দেশ,
এবার সবার গড়তে হবে নতুন পরিবেশ।
নতুন যুগের ডাক এসেছে—কাটছে আঁধার রাত,
ছেলে মেয়ে সবাই মিলাও হাতের সাথে হাত।
অন্ধকারের বন্ধ-দ্বারে আঘাত হানো জোর—
নতুন আলোর বন্যা নিয়ে আসছে নতুন ভোর।
বাঁচার মত বাঁচতে হলে খাঁচার খোলো দ্বার,
সকল বাঁধন কাটিয়ে ফেল স্বার্থপরতার।

নতুন ধরা গড়তে হলে কেউ যাবে না বাদ,
ছেলে মেয়ে সবাই এসো, করছি আশীর্বাদ।
স্বাধীন দেশের ছেলে মেয়ে, কেউ কারো নয় কম,
সবাই বলে সমরে-বন্দে মাতরম্।

[সকলের একসঙ্গে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি]