সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/গান্ধীজি এসো ফিরে
গান্ধীজি এসো ফিরে
একি, একি হ’ল, নির্মেঘ নভে বজ্র উঠিল জ্ব’লে,
স্থির অবিচল দৃঢ় হিমাচল পড়ে যেন ট’লে টলে,—
পাতালের মহা অনন্তনাগ ওঠে যেন মাথা নাড়ি,
ইতিহাস-পাতে হ’ল কলঙ্কী তিরিশের জানুয়ারি।
মহাগুরু-পাত হ’ল যে হঠাৎ হিংসার দংশনে,
দ্বিতীয় যীশুর মহান্ প্রয়াণ হেরিল জগৎ-জনে।
যমুনার তীরে তীরে,
লক্ষ কণ্ঠ ফুকারিয়া কাঁদে—গান্ধীজি এসো ফিরে!
সাত সাগরের জল যেন আজ জমা হ’ল চোখে চোখে,
হাপুস্ নয়নে কাঁদে জনগণ বাপুজির শোকে শোকে।
দেশবাসী কাঁদে, কাঁদিছে বিদেশী, কাঁদিছে জগৎবাসী,
ত্রিভুবন কাঁদে, এ করমচাঁদে কোন্ রাহু ফেলে গ্রাসি’?
এ করমচাঁদে, এ ধরম-চাঁদে হারায়ে জননী কাঁদে,—
জাতির রক্ত হিম হয়ে গেল সহসা কী অবসাদে!
হের দশদিশি ঘিরে—
নিশির আঁধার ঘনায়ে নামিছে—গান্ধীজি এসো ফিরে।
যুগসঞ্চিত পাপ এ জাতির দুষিত করেছে হিয়া,
সেই পাপ-ঋণ শোধ ক’রে গেলে বুকের রক্ত দিয়া।
বাপুজি, মোদের ক্ষমা কর আজ, যত অপরাধ ভোলো,
তোমার হৃদয়-পরশপাথরে কত লোহা সোনা হ’ল।
প্রেমের চক্ষে কত শত্রুরে নিয়েছ বক্ষে তুলি,
তোমার পরশে ধন্য হ’ল যে রিভলভারের গুলি।
কত কাচ হ’ল হীরে,
অসহায় জাতি ফুঁপায়ে কঁদিছে—গান্ধীজি এসো ফিরে।
মৃত এ ধরায় বাপুজি তুমি যে অমৃতের অধিকারী,
‘ক্ষমা হি পরম ধর্ম’ তোমার পবিত্র-ব্রতধারী;
অহিংসা তব অমোঘ অস্ত্র, ‘সত্যে’ দীক্ষা তব,
চির-জপমালা ‘রাম’-নাম তব, অভিরাম অভিনব।
রাম-রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছ ঘুমে আর জাগরণে,
সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে বিরাজিলে ক্ষণে ক্ষণে।
অগণন জন-ভিড়ে—
তৃষিত আত্মা খুঁজে ফেরে তোমা—গান্ধীজি এসো ফিরে।
পুরুষোত্তম সত্য-তাপস, জাতির জনক তুমি,
তব অবসানে শ্মশান হ’ল যে সারা এ ভারতভূমি।
তুমি নাই নাই, কাহারে জানাই, প্রাণের বেদনা যত,
মুখে নাই ভাষা, বুকে নাই আশা, কাঁদি কাঁদি অবিরত;
কাঁদি কাঁদি আর পথ চলি মোরা অন্ধকারের রাতে,
কে দেখাবে আলো, কে বাসিবে ভালো, কে থাকিবে সাথে সাথে?
করাঘাত করি’ শিরে
সবার কাঁদন জমা হয়ে কাঁদে—গান্ধীজি এসো ফিরে।
ইতিহাস-খ্যাত লাল কেল্লার লাল সে পাষাণরাজি
তব লাল তাজা রক্ত হেরিয়া কালো হয়ে গেল আজি।
জগতের যত রক্ত থামাতে চলেছিলে অভিযানে,
সেই অভিযান শেষ ক’রে গেলে নিজের রক্ত দানে।
দিল্লীর সেই নিধন-যজ্ঞে যে ধোঁয়া উঠিল জেগে
ভারতবাসীর মুখ হ’ল কালি সেই কালো ধোঁয়া লেগে।
ঘিরি তব সমাধিরে
যুগ যুগ ধরি’ কাঁদিবে মানব—গান্ধীজি এসো ফিরে।