সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/শিশু-রবির প্রতি বাঙালী শিশু-মহল
শিশু-রবির প্রতি বাঙালী শিশু-মহল
বন্ধু রবি, তোমার নাকি বয়স হ’ল আশি?
বাংলা দেশের আমরা শিশু তোমায় ভালবাসি।
মোদের যত অভিভাবক—বাবা, জ্যাঠা, খুড়ো—
পাকা দাড়ির বহর দেখে তোমায় ভাবে বুড়ো;
কিন্তু মোদের নজরেতে পড়লে ঠিকই ধরা,
আসল বুড়ো নয়কো তুমি, বুড়োর মুখোশ-পরা।
ছদ্মবেশে যতই আঁটো বুড়োর মুখোশখানা,
তুমি শিশু, চির-কিশোর, মোদের সেটি জানা।
সবাই মিলে আমরা জানি, পাড়ার হারু, বিশু,
রবি ঠাকুর বুড়ো ত নয়, মোদের মতই শিশু।
যখন তুমি মাকে নিয়ে চললে বিদেশ ঘুরে,
আমরা তোমায় লক্ষ্য তখন করেছিলাম দূরে।
বর্ষামুখর ছুটির দিনে ঠেস্ দিয়ে চৌকাঠে
মনটি যখন ঘুরত তোমার তেপান্তরের মাঠে,
তখন ওহে কবি-শিশু, আমরা খোকাখুকি,
দ্বারের আশেপাশে এসে দিতাম উঁকিঝুঁকি।
তোমার সাথে ভাব জমাতে ইচ্ছা হ’ত মনে,
সুড়ুৎ করে পালিয়ে যেতে শান্তিনিকেতনে।
বাবা তোমায় রামের মত পাঠিয়ে দিলে বনে,
লক্ষ্মণ-ভাই আমরা হতাম, যেতাম তোমার সনে।
হাজার হাজার লক্ষ্মণ-ভাই থাকলে তোমার কাছে,
থাক্-না সীতা, রাবণ রাজার ভয়টা বা কি আছে।
যখন তুমি ছুটির পরে কাগজ-নৌকা গ’ড়ে
নাম লিখে তায় নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিতে ধ’রে।
আমারা তখন জড় হতাম, পাড়ার ছেলেমেয়ে,
তোমার নজর পড়ত না কি? দেখতে না কি চেয়ে?
মনে কি নাই, আমবাগানে জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ে
আম কুড়াবার ধুম লাগাতাম সারা সকাল ধ’রে,
কোঁচড় তোমার ভ’রে দিতাম উৎসাহেরই সনে—
ছেলেবেলার সে-সব স্মৃতি নাই কি ভোমার মনে?
চিরকালের বন্ধু রবি, তোমায় ভালবাসি,
রথের দিনে বাজিয়েছিলাম তালপাতার এক বাঁশি,
সেই আনন্দে চিত্ত তোমার উঠলো নেচে দুলে,
কত দিনের কথা সেটা, যাই নি আজো ভুলে।
‘বিড়ালছানায় বই পড়াতে ‘চ-ছ-জ-ঝ-ঞ’,
দুষ্ট, বিড়াল উঠত ডেকে ‘মিঞ মিঞ মিঞ’,
আমরা তখন ডাক শুনে তার হতাম সবাই জড়,
তোমার কাছে আসতে মোদের ভয় হ’ত যে বড়।
তুমি মোদের ভালবাসো জানতাম তা মোরা;
তোমার বাড়ির চাকরগুলো বেজায় ছিল কড়া।
বেরিয়ে যখন আসতে তুমি প্রাচীন বটের তলে,
পুকুরধারে হাজির হতাম আমরা দলে দলে।
আবার যখন গলি দিয়ে পাঠশালাতে যেতে
ফেরিওলা চুড়ি নিয়ে হাঁকত দুপুরেতে,
তখন মোরা সঙ্গী হয়ে যেতাম তোমার সনে,
চাঁপা গাছে ডাকত ঘুঘু,—নাই কি তোমার মনে?
বাবার মত বড় হবার বড়ই ছিল আশা,
তাক লাগাবে সকল জনে ভেবেছিলে খাসা,
তুমি কিন্তু বাবার মত হলে না আর বড়,
রইলে শিশু, যতই আশি বছরেতেই পড়।
বন্ধু রবি; তোমার নাকি বয়স হ’ল আশি?
মোদের কাছে শিশু তুমি রইলে বারোমাসই।
বুড়ো বলে তোমায় মোরা ভাবতে পারি না যে,
তোমার আসন রইল স্থায়ী মোদের আসর মাঝে।
তুমি শিশু চির-কিশোর, বন্ধু তুমি জানি,
শিশু বুড়ো সবাই করে তোমায় টানাটানি।
তোমায় নিয়ে টাগ-অব-ওয়ার চলছে দিবারাতে,
জানি কেহ পারবে না ভাই মোদের দাবীর সাথে।
বন্ধু রবি, শিশু কবি, বিদ্যা তোমার খুবই,,
শুনতে তো পাই কাদের নাকি করলে নৌকাডুবি।
কাদের চোখে বালি’ দিয়ে ঝরিয়ে দিলে ধারা,
‘শিশু ভোলানাথের দলে করলে যে ‘খাপছাড়া।
দুষ্টুমিতে দেখছি তুমি মোদের মতই পাকা,
তবে কেন ‘বুড়ো’ বলেন বাবা জ্যাঠা কাকা?
বন্ধু রবি, তোমার বয়স আশি বছর নাকি?
আমরা জানি—আটের পিঠে শূন্যটি যে ফঁাকি।
আশির থেকে অনায়াসে শূন্যটি বাদ দিয়ে
আট বছরের সঙ্গী মোরা করব তোমায় নিয়ে।
শুনতে তত পাই জগৎ-জোড়া তোমার খ্যাতি আছে,
তুমি কিন্তু শিশু হয়েই রইবে মোদের কাছে।
‘নোবেল পুরস্কারে’ তোমায় পূজলো বিদেশভূমি,
মোদের প্রেমের পুরস্কারে রইলে বাঁধা তুমি।