সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/শ্রীপঞ্চমীর ভোর

শ্রীপঞ্চমীর ভোর

চতুর্থী রাত শেষ হয়ে এলো, কাটে আঁধারের ঘোর,
বাংলার বুকে ধীরে ধীরে জাগে শ্রীপঞ্চমীর ভোর।
পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে যায় শিশুদের জাগরণ,
তার সাথে সাথে জেগে ওঠে আজ আমারো কিশোর মন।
ফেলে-আসা সেই অতীতের দিনে ছুটে যেতে চায় প্রাণ,
মনে জাগে সেই ভুলে-যাওয়া স্মৃতি, আনন্দে মহীয়ান;
মনে পড়ে সেই অতি মধুময় দিনগুলি অতীতের,
চঞ্চল মন, চল্ চল্ ফিরে ফেলে-আসা পথে ফের।
স্বপ্নের রচা স্বর্গীয় সেই উৎসবময় পুর,
সেই অঞ্চলে মোর মন চলে আনন্দভারাতুর।
শ্রীপঞ্চমীর প্রভাতে আজিকে ভুলেছি বর্তমান,
ছেলেবেলাকার মধু-এলাকার পাই যেন সন্ধান।

মনে প’ড়ে যায়, রাতে ঘুম নাই, উসখুস করে মন,
প্রথম কাকের ডাকের শব্দে তাড়াতাড়ি জাগরণ।
দলাদলি ভুলে গলাগলি করি’ ছুটেছি ছেলের দল,
খালি পায়ে চলি, গায়েতে জড়ানো চাদর ও কম্বল।
কার বাগানাতে অতসী ফুটেছে, দোপাটি, গন্ধরাজ,
চুপে চুপে ভোরে পাঁচিল ডিঙিয়ে চুরি ক’রে আনি আজ।
তখনো আকাশে আঁধার জড়ানো, ছড়ানো কুহেলীজাল।
মালী ও মালিক ঘুমে অচেতন, কে করিবে গালাগাল!

ভোরের আকাশে আলোর আমেজ করে ওঠে ঝলমল,
শাখায় শাখায় শুরু হয়ে যায় পাখীদের কোলাহল;
শতেক পাখীর চেনা-চেনা সুর কানে আসে অনিবার,
কোকিল পাখীর প্রথম কাকলি শুনিলাম মাঝে তার।
বহুদিন পরে শুনি কোকিলের আকুল-করা সে গীত,
সেই ডাকে যেন পেলাম প্রথম ফাগুনের ইঙ্গিত।
ফুটি-ফুটি করে পলাশের ফুল, উঠি ডালে ডালে তার,
জড় করি ফুল, রাঙা-তুল্ তুল্, শোভায় চমৎকার।
উঁচুনীচু ডাঙা, মাঝে মাঝে ভাঙা, তার পাশে শর-বন,
সেই শর তুলে নিয়ে আসি মোরা আনন্দে নিমগন।
পূজার আগেতে কুল খেতে মানা, কুলতলা দিয়ে যাই;
জিভে জল যেন জ’মে ওঠে যত কুলের গন্ধ পাই।
ঘাসে জ’মে আছে রাতের শিশির, পথটি পিছল রয়,
পা-টি টিপে টিপে হাঁটি সাবধানে, আছাড় খাবার ভয়।
মনে পড়ে সেই নদীর চড়ার শালিখ পাখীর দল,
শালুক ফুলের মধু খেতে এসে করে শুধু কোলাহল;
হাততালি দিয়ে শালিখ তাড়াই, পালায় পাখীর কুল,
তুলে নিয়ে আসি মায়ের পূজায় শালুক পদ্মফুল।

আলোছায়া-মাখা আঙিনায় আঁকা বিচিত্র আলিপন,
বিদ্যাদায়িনী বাণীর পূজার হ’ল সেথা আয়োজন।
বাসন্তী-রং শাড়ি-পরা যত কচি মেয়ে অবিরল,
তুল্‌তুলে তারা ফুল তুলে আনে চুল খুলে দলে দল।
আজ পড়া নাই, কোনো তাড়া নাই, পাড়া জুড়ে হৈ চৈ,
পড়ুয়ারা আজ বেপরোয়া হ’ল, ছুঁতে নাই আজ বই।
গুরুজন আজ দেবে নাকো বাধা, পড়াশোনা নাই আর,
বই যদি ছুঁই বকুনি লাগায়, বিপরীত ব্যবহার।

সারাটি বছর পড়ার জন্যে যারা শুধু ধরে খুঁৎ,
আজ বই ছুঁলে, তারা তাড়া দেয়,—এযে অতি অদ্ভুত!

শ্রীপঞ্চমীর প্রভাতে আজিকে মনে প’ড়ে যায় মোর,
রাঙা-রোদ-ভরা আঙিনার মাঝে আসর জমেছে জোর।
পূজার ক্ষণটা, কাঁসর-ঘণ্টা, বাজে ঘন ঘন শাঁখ,—
পুরুতের আজ ফুরসৎ নাই, ঘরে ঘরে তার ডাক।
ধূপের ধোঁয়ায় ধুনোর গন্ধে ভরপূর অঙ্গন,
মহা সমারোহে মায়ের পূজার হইয়াছে আয়োজন।
ফুল তুলে এনে স্নান সেরে মোরা জুটেছি ছেলের দল,
তাড়াতাড়ি করে অঞ্জলি দিতে প্রাণ বড় চঞ্চল।
এতখানি বেলা খালিপেটে আছি, কেউ কিছু নাহি খায়,
নাড়ু ও মোয়ার মিষ্টি গন্ধে ক্ষিধে যেন বেড়ে যায়।
তবু সে উপোসে কত আনন্দ জানে তাহা শিশুগণ,
অঞ্জলি দিতে চঞ্চলি ওঠে যত কিশোরের মন।
সরস্বতীর পূজা যেন শুধু শিশুদেরই উৎসব,
উৎসাহে তারা ভুলে যায় আজ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সব।

ঘরে ঘরে আজ বাণীর পূজার সাড়া জাগে বাংলায়,
বাংলার ছেলে, বাংলার মেয়ে, অঞ্জলি দিবি আয়।
মায়ের পায়েতে ফুল দিয়ে তোরা ধর্ সবে এই গান—
“বিদ্যাদায়িনী, জ্ঞান ও বিদ্যা কর মা মোদের দান।”
মায়ের প্রসাদে দূর হয়ে যাক অবিদ্যা-আঁধিয়ার,
জ্ঞানের আলোকে সোনার বাংলা হাসুক পুনর্বার।