চল্‌তি ছবি


রোদ্দুরেতে ঝাপসা দেখায় ঐ যে দূরের গ্রাম
যেমন ঝাপসা না-জানা ওর নাম।
পাশ দিয়ে যাই উড়িয়ে ধূলি, শুধু নিমেষতরে
চল্‌তি ছবি পড়ে চোখের ’পরে।


দেখে গেলেম, গ্রামের মেয়ে কলসি-মাথায়-ধরা,
রঙিন-শাড়ি-পরা,
দেখে গেলেম, পথের ধারে ব্যবসা চালায় মুদি;
দেখে গেলেম, নতুন বধূ আধেক দুয়ার রুধি’
ঘোমটা থেকে ফাঁক ক’রে তার কালো চোখের কোণা
দেখছে চেয়ে পথের আনাগোনা।
বাঁধান বটগাছের তলায় পড়তি রোদের বেলায়
গ্রামের ক’জন মাতব্বরে মগ্ন তাসের খেলায়।

এইটুকুতে চোখ বুলিয়ে আবার চলি ছুটে,
এক মুহূর্তে গ্রামের ছবি ঝাপসা হয়ে উঠে।


ঐ না-জানা গ্রামের প্রান্তে সকাল বেলায় পুবে
সূর্য ওঠে, সন্ধ্যে বেলায় পশ্চিমে যায় ডুবে।
দিনের সকল কাজে,
স্বপ্নদেখা রাতের নিদ্রামাঝে,
ঐ ঘরে, ঐ মাঠে,
ঐখানে জল-আনার পথে ভিজে পায়ের ঘাটে,
পাখিডাকা ঐ গ্রামেরি প্রাতে,
ঐ গ্রামেরি দিনের অন্তে স্তিমিত-দীপ রাতে
তরঙ্গিত দুঃখসুখের নিত্য ওঠা-নাবা,
কোনোটা বা গোপন মনে, বাইরে কোনোটা বা।
তা’রা যদি তুলত ধ্বনি, তাদের দীপ্ত শিখা
ঐ আকাশে লিখত যদি লিখা,
রাত্রিদিনকে কাঁদিয়ে-তোলা ব্যাকুল প্রাণের ব্যথা
পেত যদি ভাষার উদ্বেলতা,
তবে হোথায় দেখা দিত পাথর-ভাঙা স্রোতে
মানব-চিত্ত তুঙ্গ-শিখর হতে
সাগর-খোঁজা নির্ঝর সেই, গর্জিয়া নর্তিয়া
ছুটছে যাহা নিত্যকালের বক্ষে আবর্তিয়া
কান্নাহাসির পাকে,

তাহা হোলে তেমনি করেই দেখে নিতেম তাকে
চমক লেগে হঠাৎ পথিক দেখে যেমন ক’রে
নায়েগারার জলপ্রপাত অবাক্‌ দৃষ্টি ভ’রে।


যুদ্ধ লাগল স্পেনে;
চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতক্ষ্মীবাণ হেনে।
সংবাদ তার মুখর হোলো দেশমহাদেশ জুড়ে,
সংবাদ তার বেড়ায় উড়ে উড়ে
দিকে দিকে যন্ত্র-গরুড় রথে
উদয়-রবির পথ পেরিয়ে অস্তরবির পথে।
কিন্তু যাদের নাই কোনো সংবাদ,
কণ্ঠে যাদের নাইকো সিংহনাদ,
সেই যে লক্ষকোটি মানুষ কেউ কালে কেউ ধলো,
তাদের বাণী কে শুনছে আজ বলো।
তাদের চিত্ত-মহাসাগর উদ্দাম উত্তাল,
মগ্ন করে অন্তবিহীন কাল;
ঐ তো তাহা সম্মুখেতেই, চারদিকে বিস্তৃত
পৃথ্বীজোড়া মহাতুফান, তবু দোলায় নি তো
তাহারি মাঝখানে-বসা আমার চিত্তখানি।
এই প্রকাণ্ড জীবননাট্যে কে দিয়েছে টানি’

প্রকাণ্ড এক অটল যবনিকা।
ওদের আপন ক্ষুদ্র প্রাণের শিখা
যে আলো দেয় একা,
পূর্ণ ইতিহাসের মূর্তি যায় না তাহে দেখা


এই পৃথিবীর প্রান্ত হতে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি
জেনেছে আজ তারার বক্ষে উজ্জালিত সৃষ্টি
উন্মথিত বহ্নি-সিন্ধু-প্লাবন নির্ঝরে
কোটি যোজন দূরত্বেরে নিত্য লেহন করে।
কিন্তু এই যে এই মুহূর্তে বেদন হোমানল
আলোড়িছে বিপুল চিত্ততল
বিশ্বধারায় দেশে দেশান্তরে
লক্ষ লক্ষ ঘরে,
আলোক তাহার দাহন তাহার, তাহার প্রদক্ষিণ
যে অদৃশ্য কেন্দ্র ঘিরে চলছে রাত্রিদিন
তাহা মর্ত্যজনের কাছে
শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে।
যেমন শান্ত যেমন স্তব্ধ দেখায় মুগ্ধ চোখে
বিরামহীন জ্যোতির ঝঞ্ঝা নক্ষত্র আলোকে।

আলমােড়া