সেই সব শহীদেরা/প্রমিথিউসের পথে ডাঃ দাভলকর
প্রমিথিউসের পথে ডাঃ দাভলকর
মানুষের মুক্তির জন্য যারা অস্ত্র ধরেন তাঁরা বিপ্লবী, তাঁরা যোদ্ধা। চিন্তার মুক্তির জন্য যারা পথে নামেন, তুলে নেন শানিত কলম তাঁরাও যোদ্ধা। যুক্তি, জ্ঞান ও মুক্তিচিন্তার প্রসার ঘটাতে তাদেরও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, জাতপাত, বর্ণবিদ্বেষ, অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে অহরহ লড়াই চালাতে হয়। বাজী রাখতে হয় জীবন। এমনই এক যোদ্ধা ছিলেন ডাঃ নরেন্দ্র দাভলকর। যাকে ২০১৩ সালের ২০শে অগাস্ট গুলি করে হত্যা করল ভাড়াটে বন্দুকবাজেরা।
নরেন্দ্র দাভলকরের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১লা নভেম্বর। দাদা দেবদত্ত দাভলকর ছিলেন সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ, তাঁর প্রভাব পড়েছিলেন নরেন্দ্রর ওপর। সাতারার নিউ ইংলিশ স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন মিরাজ মেডিক্যাল কলেজে। কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারি পাশ করেন। ছাত্রবস্থায় পড়াশোনা ছাড়াও ভালো অ্যাথলিট হিসেবে সুনাম ছিল। জাতীয় কবাডি দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। এজন্য মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে শিবছত্রপতি যুব পুরষ্কারে সম্মানিত করে।
ডাঃ দাভলকর পেশাগতভাবে টানা একযুগ ডাক্তারির সাথে যুক্ত থাকলেও তাঁর মূল জেহাদ ছিল সমাজের কুসংস্কার, ভণ্ডবাবা ও অলৌকিকতার বিরুদ্ধে! যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিলেন আশির দশকের প্রথম দিকে। ১৯৮৯ সালে ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূল কমিটির মহারাষ্ট্র শাখা গড়ে তোলার প্রধান কুশীবল তিনি। যে সংগঠন বুজরুক তান্ত্রিক ও স্বার্থান্বেষী ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে ও আজো চালাচ্ছে। মহারাষ্ট্রের বুকে তার ১৮০ টি শাখা বিদ্যমান।
দাভলকরের স্বপ্ন ছিল তার প্রস্তাবিত কুসংস্কার বিরোধী বিলকে আইনে বাস্তবায়িত করা যা তাঁর জীবদ্দশায় হতে দেয়নি বিজেপি ও শিবসেনা গোষ্ঠী, ‘হিন্দু বিরোধীতা’র ধুয়ো তুলে।
একদিন চার্বাক দর্শনের জনপ্রিয়তা ও সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার জোরালো কণ্ঠে শঙ্কিত হয়েছিল শাসক ও রাজন্যপুষ্ট পুরোহিতবর্গ। যুক্তিবাদী পুঁথিপত্রের বহুৎসব ঘটেছিল সেদিন। শ্রেণীনিপীড়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ধর্মকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা এইসব ঠকবাজ পরজীবীরা চিরকালই মদত দেয় কর্মফল-জন্মান্তবার-আত্মা প্রেতাত্মার অলৌকিক কাণ্ডকারখানাকে। এর বিরুদ্ধে যে বা যারাই রুখে দাঁড়ায় তাঁদের ‘গণশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যুগে যুগে। ইবসেনের নায়ক ডাঃ স্টকম্যানের মতোই প্রতিবাদ করেছিলেন দাভলকর। এককথায় ভূত-ভগবানের নামে শয়তানের কারবারকে ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি ও তাঁর সাথীরা। তাঁর খসড়া করা তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক ও অলৌকিক পদ্ধতিতে রোগ সারাবার বিরুদ্ধে যে বিলটি (Anti Black Magic Bill) বারংবার মন্ত্রীসভায় আলোচিত হয়েছে তা পুরোপুরি পাস হলে একশ্রেণীর অসাধু ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আঘাত করবে বলাই বাহুল্য। তাঁরা বহুবার হুমকি দিয়েছে দাভলকরকে। ১৯৮৩ সাল থেকেই তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নানা আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। দমেননি অকুতোভয় এই বিজ্ঞানকর্মী। এমনকি নিজের দেহরক্ষীর সুবিধাও তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন এই বলে যে “If I have to take police protection in my own country from my own people, then there is something wrong with me, I am fighting within the framework of The Indian Constitution and it is not against anyone but for everyone."
বিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক এবং অন্যান্য প্রগতিশীল কর্মযজ্ঞের প্রথম সারির সৈনিক তিনি। মহারাষ্ট্রের বুকে প্রায় কয়েক হাজার কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান, জনসভা, সেমিনার করে তথাকথিত গডম্যানদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী ও ভবিষ্যত বক্তারা বারবার তাঁর চ্যালেঞ্জের কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে দাভলকরের সাথী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী জয়ন্তুবিষ্ণু নারলিকার। দলিতদের অধিকারের দাবী ও অস্পৃশ্যতা-জাতপাত বিরোধী সংগ্রামের শরিক হিসেবে মারাঠাওয়াড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাবাসাহেব আম্বেদকরের নামে পরিবর্তিত করার উদ্যোগে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রচুর বই লিখেছেন, সাতারা জেলার প্রান্তিক পিছড়েবর্গের মানুষদের অধিকার সচেতনতায় লড়াকু সংগঠন ‘পরিবর্তন’ তারই হাতে তৈরী। ভারতীয় যুক্তিবাদী সংগঠনের সহ- সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত গান্ধিবাদী সানে গুরুজীর প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সাধনা'।
ডাঃ দাভলকরের সাহসী কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল ক্ষমতাশালী ধর্মগুরু আশারাম বাপুর (বর্তমান যৌন কেলেঙ্কারী ও ধর্ষিতার সম্পর্কে ন্যক্কারজনক মন্তব্যে কুখ্যাত!) অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। ২০১৩-এর মার্চে নাগপুরে হোলি খেলার নামে এই ভণ্ড সাধু পৌরসভার পানীয় জলের ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে স্ফূর্তি শুরু করে। প্রায় ৫০ হাজার লিটার পানীয় জল নষ্ট হয়! দাভলকর এবং তাঁর সাথীরা প্রথম প্রতিবাদ জানান এই ঘটনায়, পৌরসভা বাধ্য হয় ব্যবস্থা নিতে। এ থেকে বোঝাই যায় যে তাঁর শত্রুসংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে যেসব ধর্মীয় মাফিয়াদের সন্তুষ্ট করে, তাদেরই সাহায্যে জনবিরোধী কাজকর্ম চালায় তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি ডাঃ দাভলকরকে। তাই তাঁকে প্রাণ দিতে হল।
হত্যার দিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন দাভলকর। সকাল ৭:২০ নাগাদ দুই বন্দুকধারী খুব কাছ থেকে পরপর চার রাউন্ড গুলি চালিয়ে খুন করে তাঁকে। পুনে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের সামনে পড়ে থাকে মহান বিজ্ঞানকর্মীর লাশ! এরপর গোটা রাজ্যজুড়ে বিজ্ঞানকর্মীরা, অসংখ্য সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেন, স্বতঃস্ফূর্ত বনধ পালিত হয়। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রগতিশীল ও বিজ্ঞান সংগঠনগুলি তীব্র ধিক্কার জানায়। মৃত্যুর পরেই তড়িঘড়ি করে সব রাজনৈতিক দলগুলি শোকবার্তা পাঠিয়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান ১০ লক্ষ টাকা পুরষ্কারই ঘোষণা করে ফেলেন খুনির সন্ধানে! যদিও সনাতন সংস্থা নামে একটি হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনের সদস্যকে পুলিশ সন্দেহবশতঃ গ্রেপ্তার করলে শিবসেনাপ্রধান উদ্ধব ঠাকরে নির্লজ্জভাবে ধমকি দিতেও থামেনি! দাভলকর স্মরণে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট পরিচালিত অনুষ্ঠান বানচাল করে দেয় A.B.V.P-এর গুন্ডাবাহিনী। আরো মজার ব্যাপার যে বিলটি দাভলকর নিজের জীবদ্দশায় অক্লান্ত প্রচেষ্টাতেও পাশ করাতে পারেনি সেটিও অর্ডিন্যান্স আকারে পাশ করানো হল পরের দিন! এ সবই ছিল ড্যামেজ কন্ট্রোলের চিরাচরিত ব্যাবস্থা।
দাভলকরের মতো ধর্মদ্রোহী মানুষের শেষজীবন অনেকক্ষেত্রেই খুব মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে তাঁর ভুরি ভুরি উদাহরন মিলবে।
অ্যানাক্সাগোরাস (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫০০-৪২৮)-কে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এথেন্সবাসীরা ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে, তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। যতদূর জানা গেছে ধর্মবিরুদ্ধ বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচারের জন্য এটিই প্রথম লিপিবদ্ধ নির্যাতন।
কোপার্নিকাসের De Revolutionibus নিষিদ্ধ হলো।
গ্যালিলিও নিক্ষিপ্ত হলেন জেলে, অন্ধ হয়ে গেলেন এই মহান জ্ঞানতপস্বী।
আলেকজান্দ্রিয়ার অসামান্য গণিতজ্ঞা বিদুষী নারী হাইপেশিয়াকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করে একদল পাদরী। রোমকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যারিস্টাকার্সের সূর্যকেন্দ্রীক পরিকল্পনা মানেনি যাজক সম্প্রদায়, তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
দীর্ঘ সাতবছর অত্যাচার ও বিচারের প্রহসনাস্তে জিওরদানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারল ইনকুইজিশন। দুঃসাহসী ব্রুনো নিজের পথ থেকে সরে আসেননি। মাথা নোয়াননি। বিজ্ঞান মাথা নোয়ায় না অপবিজ্ঞানের সামনে। শাসকের মদতপুষ্ট ধর্মধ্বজাধারীরা যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন পৃথিবী তবুও ঘোরে। ঘুরবেও।
প্রমিথিউস ছিলেন বিদ্রোহী। ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আগুন নিয়ে এসেছিলেন মানুষের কাছে, মানুষের জন্য। ধর্মান্ধতার উর্ণজাল ছিন্ন করে যারা যুগে যুগে আলোর মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে হেঁটেছেন তাঁদের হাতে ছিল প্রমিথিউস প্রদত্ত সেই অগ্নিশিখা, বিজ্ঞানের বিজয় বৈজয়ন্তী। কোনো ইনকিউজিশন, বন্দীশালা, লঞ্ছনা অপমান তাঁকে নেভাতে সক্ষম হয় না। এখানেই যুক্তিবাদের জয় আর এখানেই জিতে গেছেন চেতনার দাসত্বের বিরুদ্ধে আমৃত্যু যুদ্ধ করে চলা ডাক্তার নরেন্দ্র অচ্যুত দাভলকর। তাঁর প্রাণ কেড়ে নিল ঘাতকের বুলেট তবু মরেও বেঁচে রইলেন তিনি। সেই অনিৰ্বাণ অগ্নিশিখার মতো।