মুখবন্ধ...

শহীদের কথা

সব্যসাচী দেব

ইতিহাস এক নিষ্ঠুর নির্বাচক; অসংখ্য ছড়ানো উপাদান থেকে সে শুধু বেছে নেয় পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত মুখগুলিই, বাইরে পড়ে থাকে নাম-না-জানা কত না চরিত্র, ব্যক্তির স্মৃতিতে কিছুদিনের জন্য তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। তারপর স্মৃতি ধূসর থেকে ধূসরতর হতে থাকে, মলিন থেকে মলিনতর হতে থাকে তাদের ঔজ্জ্বল্য, তবু ইতিহাসের এই বর্জনকে এড়ানো যায় না। ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাস-চর্চায় জনগণ একেবারেই গৌণ, মার্ক্সবাদী ও সাব-অল্টার্ণ ইতিহাসবিদ্রাই মনে করিয়ে দিয়েছেন তাদের ভূমিকা। কিন্তু ইতিহাস যত বড়ো ক্যানভাসই ব্যবহার করুক না কেন, প্যানারোমার বিস্তৃতিতে সমষ্টির চেহারা ধরা যেতে পারে, ব্যক্তির অবদানকে আলাদা করে চিহ্নিত করা কিছুতেই সম্ভব হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে ব্যক্তিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন আছে কী আদৌ!

 সে এক কূটতর্ক। কিন্তু এও তো মানতে হয় যে ইতিহাস যাঁকে স্মরণীয় করে তোলে সেই মুহূর্ত থেকে তিনি পরিণত হন এক আইডলে, এবং আইডল মাত্রেই শ্রদ্ধাভাজন ও অভিনন্দনীয়, কিন্তু কিছুটা মাপে বড়ো, ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘লার্জার দ্যান লাইফ'। এই মাপ আদর্শবাদের প্রতিমূর্তি হতে পারেন, কিন্তু কিছুটা দূরবর্তীও তো। লেনিন বা মাও-সে-তুং বরণীয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে চেনাজানা তাদের কর্মে, তাদের লেখায়। তাদের আদর্শ অনুসারে জীবনকে গড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু কী করে সেই আদর্শকে অনুসরণ করতে হবে তা বুঝতে গেলে দরকার হয় এমন মানুষদের জানা যারা অনেকটা কাছাকাছি, যাদের জীবন থেকে বুঝে নেওয়া যায় কীভাবে বরণীয়দের পথে চলতে হয়। এ ধরনের মানুষ অজস্র, নিজেদের জীবনে তারা দেখিয়ে গেছেন কীভাবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, স্রোতের উল্টোদিকে কীভাবে সাঁতার দিতে হয় ৷

 শহীদ কে! ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাহ্য করে যারা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সবরকম স্বাধীনতার জন্য, এক শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, বিনিময়ে কোনো নিজস্ব লাভ বা খেতাব বা স্বীকৃতি কিছুই চাননি শহিদ তারাই। এখন নির্বিচার ব্যবহারে শব্দটির মর্যাদা ক্ষুন্ন করে ফেলা হচ্ছে। সংকীর্ণ আঞ্চলিক বা পাড়াগত স্বার্থে বহু ওয়াগন-ব্রেকার, গুণ্ডা-মাস্তানরা গাষ্ঠেীসংঘর্ষে কিংবা পুলিশের বা প্রতিপক্ষ গেলেও তাকে শহীদ বানিয়ে, পাড়ার লোকের কাছে চাঁদা আদায় করে গলিত, বেদি খাড়া করে কিছুদিন ফায়দা লোটার প্রথা বেশ কিছুদিন ধরেই চালু। কিন্তু অধুনা ক্ষেত্রে শহীদ তৈরির একটা রেওয়াজ হয়েছে। সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা কোনো সংঘর্ষে মারা গেলেও তাকে দেওয়া হচ্ছে শহীদের সম্মান। তাদের মৃত্যু তাদের পরিবারের কাছে দুঃখজনক হলেও তারা বেতনভোগী কর্মী হিসেবেই মৃত্যু বরণ করেন, এই পরিণতি তাদের চাকরিরই অঙ্গ। জনগণের জন্য নিঃস্বার্থ মৃত্যুবরণ নয় তাদের, বরং অনেক সময় জনগণের সংগ্রামের বিরোধিতা করতে গিয়েই মরতে হয়েছে তাদের। কেন তাদের শহীদ বলব আমরা। কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দমিয়ে দিতে গিয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের হাতে মৃত্যু ঘটেছে যে পেশাদার সৈনিকের বা মণিপুরে যে পেশা, নিয়ত বিশেষ আইনের সুবিধা অত্যাচার-পীড়ন চালিয়ে গেছেন কোন যুক্তিতে তাকে মেনে নিতে হবে শহীদ বলে। এই সংকলন সেই ধারণার বিপরীতে গিয়েই প্রকৃত শহীদদের কথা বলতে চেয়েছে।

 এই সংকলনকে পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না, কোনো সংকলনই পূর্ণাঙ্গ হয় না; এই জাতীয় সংকলন তো নয়ই। খুব বিরাট কিছু করে ফেলার অহংকার থেকেও তৈরি করা হয়নি সংকলনটি। কিন্তু এর পিছনে ছিল এক দায়িত্ববোধে আর উত্তরপ্রজন্মের কৃতজ্ঞতা। পূর্বপ্রজন্মের প্রবল আত্মত্যাগ ছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের চেতনা প্রস্ফুটিত হতে পারে না, এগিয়ে যাওয়ার দিশা পাওয়া যায় না। নিজেদের জীবন দিয়ে যে মানুষগুলি শিখিয়ে গেছেন বাঁচতে হলে সবার জন্য বাঁচতে হয় তারা এও তো শিখিয়ে গেছেন মরতে হলেও সবার জন্য মরাই শ্রেয়। সেই মানুষগুলির কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। এ নয় যে এই সংকলন দিয়ে ঋণ শোধের করার কথা ভাবা হয়েছে। এই ঋণ অপরিশোধ্য, তাকে বহন করেই উত্তরপ্রজন্মকে পথ চলতে হবে। এখানে শুধু এটাই জানাতে চাওয়া হয়েছে তাদের আমরা ভুলিনি, ভুলতে চাই না।

 কোনো আন্দোলন কোনো বিদ্রোহ কোনো বিপ্লবই ভোজসভা নয়, তা এক কঠোর রুক্ষ রূঢ় সংগ্রাম। সে-সংগ্রামে পরিচালকের ভূমিকায় থাকেন কয়েকজন, বাকি বিপুলসংখ্যক থাকেন সেনানীর ভূমিকায়। সেই সেনানীরাই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান, সফলতা আসে তাদের হাত ধরেই, ব্যর্থতা এলেও তাদের শ্রম, কষ্ট এঁকে দিয়ে যায় পথরেখা, তারা যদি ভুল করেও থাকেন সে ভুল অন্যদের কাছে হয়ে ওঠে সতর্কবার্তা। এই যে মানুষগুলি, নিজেদের চারপাশে বা নিজের সঙ্গেও প্রবল লড়াই করে তারা এগিয়ে যান, কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধির জন্য নয়, এক উপলব্ধ বিশ্বাস, এক আদর্শের জন্য, শুধুই জনগণের জন্য। চারপাশে বেঁচে থাকার চেয়েও তাদের মৃত্যু অনেক বেশি ভরে থাকে জীবনের উত্তাপে। চারপাশে প্রতিদিন নিজেরটুকু গুছিয়ে নেওয়ার কিছুটা বাধ্য কিছুটা স্বার্থপর ইদুরদৌড়ের শেষে যে মৃত্যু, পালকের চেয়েও হালকা সেই মৃত্যুকে কেউ মনেও রাখে না। আর এই শহীদরা জীবন দিয়ে গেছেন অন্যদের জীবনকে সুখী করে তোলার ব্রত পালন করতে গিয়ে, আত্মহত্যার আবেগে নয়, আত্মত্যাগের দৃঢ় প্রত্যয়ে, তাদের মৃত্যু হিমালয়ের চেয়েও ভারি। তবু ইতিহাস তাঁদের সবাইকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে না, বলতে পারে না তাঁদের সবার কথা। তাহলে কি তাঁরা থেকে যাবেন সমষ্টির অংশ হয়েই, হারিয়ে যাবেন ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ধরা ভিড়ের ছবিতে। সেই বিস্মরণকে এড়ানোর জন্য তৈরি হয় অনেক স্মৃতিকথা, অনেক টুকরো টুকরো বাক্তিপরিচয়। একথা অস্বীকার করা যাবে না ব্যক্তি নয়, সমষ্টির লড়াই-ই তৈরি করে বিপ্লবের রূপরেখা, তবু এও তো সত্য যে ব্যক্তিকে গেঁথে গেঁথেই গড়ে ওঠে সমষ্টি; তাই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা চলে না। বিপ্লব জনগণের উৎসব, সেই উৎসবে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি উপেক্ষা করা সম্ভব নয় কিছুতেই।

 এই সংকলন সে-রকমই কয়েকজন ব্যক্তির কথা। এমন ব্যক্তি যারা নিজের ব্যক্তিসত্তাকে বিলীন করে দিয়েছিলেন সমষ্টির মধ্যে, সমষ্টির মুক্তির জন্যই লড়াই করেছিলেন তারই অংশ হয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা করে না রেখে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন তাঁরা, তবু এক অপরিমেয় স্বাতন্ত্র্যে তাঁরা উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বলতা অন্যকেও দীপ্তি দেয়। তাঁদের লড়াই এক ধরনের নয়। এই সংকলনে যাদের কথা বলা হয়েছে তাঁরা কেউ লড়াই করেছিলেন বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, কেউ দেশীয় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে, কেউ দেশী-বিদেশী পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে, আর কেউ বা যে-কোনো ধরনের শোষণের মোক্ষম হাতিয়ার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এঁরা কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন রণাঙ্গনে, কেউ জেলখানায়, কেউ বা জনগণের সংগ্রামের সাথী হয়ে দুস্তর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নিজের কথা ভাবতে সময় পাননি বলে দুরারাগ্যে ব্যাধির কবলে পড়ে। তবু এক জায়গায় তাঁরা এক, তারা জনগণের পক্ষে, আর এই পক্ষাবলম্বন তাঁদের থাকতে দেয়নি কোনো নিশ্চিন্ত সুখী গৃহকোণে, টেনে এনেছে ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে। শেষ পর্যন্ত আরামের শয্যায় নয়, তাদের মৃত্যু হয়েছে ফাঁসির দড়িতে পুলিশ-মিলিটারি বা আততায়ীর বুলেটে অত্যাচারে চিকিৎসার অপ্রতুলতায়। কেউ মারা গেছেন ময়দানে, কেউ ধানক্ষেতে, কেউ শহরের ফুটপাথে, কেউ গোপন আস্তানায়, কেউ কারাগারে। তবু তারা সকলে মিলে রচনা করেছেন এক মহাকাব্য। এই সংকলন সেই মহাকাব্যটিকে ফিরে পড়ার এক সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

 এই সংকলনের সব লেখা এক ধরনের না। কোনো লেখা শুধু শহীদের পরিচয় ও কাজের বিবরণই আছে, আবার কোনো লেখায় আলোচ্য শহিদের কাজের সঙ্গে তাঁর মতাদর্শের বিশেষণও আছে। মনাযোগেী পাঠক অনুযোগ করতে পারেন অনেকর কথা আসেনি বলে, সে-অপূর্ণতার কথা মেনে নিতেই হচ্ছে। যদিও তার অনেক কারণই আছে। তবু কিছু কথা বলতে পারা গেল, আপাতত সেইটুকুও কম নয়, হয়ত আরও বিস্তৃত পরিসরে যোগ্য প্রয়াসে যোগ্যতর কোনো সংকলন কোনোদিন নির্মিত হবে, সেই আশা নিয়েই পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো এই সংকলনটি। স্মৃতিচারণার বেদনাবিলাস নয়, নিজেদের যাচাই করে নেওয়ার জন্য।