সেই সব শহীদেরা/“…হিমালয়ের চাইতেও ভারী”
“........হিমালয়ের চাইতেও ভারী”
লালগড় তথা জঙ্গলমহলে ধূমায়িত অসন্তোষ যখন ধীরে ধীরে গণ আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে, সেই প্রথম পর্বে সবার অলক্ষ্যে পার হয়ে গেল নীল বিদ্রোহের অবিসংবাদিত নেতা বিশ্বনাথ সর্দারের মৃত্যুর দ্বিশতবার্ষিকী। অবহেলিত শ্রমিক কৃষকদের বিদ্রোহ বা তথাকথিত পিছড়েবর্গ মানুষের লড়াইকে চাটুকার ঐতিহাসিকরা বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও আন্দোলন কখনোই তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় না। তাই বর্তমান বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশ্বনাথ সর্দারের নাম অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকে যেভাবে বাংলার মানুষ ক্রমাগত বঞ্চনা আর জুলুমবাজির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তেমনভাবেই ঠিক ২০০ বছর আগে নীলবিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছিলেন নদীয়ার এক সাধারণ কৃষক বিশ্বনাথ। ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নীলবিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ আর পাঁচটা গণ অভ্যুত্থানের চেয়ে নীল বিদ্রোহ আলাদা। বিদ্রোহ হয়েই থেকে যায়নি, অনেকাংশে সফল হয়ে বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছিল।
এই আন্দোলন ছিল ইংরেজ সরকার, নীলকর ও দেশীয় জমিদারদের সম্মিলিত শোষণের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম, যার পথিকৃৎ ও প্রথম শহীদ বিশ্বনাথ সর্দার।
ব্রিটিশ সরকার ও তাদের তৎকালীন তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীরা সেদিন কলম ধরেছিলেন নীলকরদের পক্ষে, বিদ্রোহীদের হেয় করার পাশাপাশি সরকারের প্রশস্তি রচনায় রত হয়েছিলেন তাঁরা। শতাব্দী পার হয়ে গেছে। শাসকের চরিত্র যেমন বদলায়নি তেমনি আজো সরকারী বেতনভুক, উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবীমহল নির্লজ্জভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরোধিতা করে চলেছেন। আজকের শাসকবর্গও শঙ্কিত, বামপন্থার মুখোশের আড়ালে, উন্নয়নের নামে জল, জঙ্গল, জমি থেকে মানুষের অধিকারকে হরণ করতে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমনপীড়ন নামিয়ে আনছে প্রতিনিয়ত। আজকের মতোই সেদিন অবর্ণনীয় অত্যাচার, নিরবিচ্ছিন্ন শোষণের প্রতিবাদে বাংলার কৃষক মহাপরাক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পিছপা হয়নি। লড়েছে, মরেছে, পাল্টা মার দিয়েছে।
বাংলায় বেশ কয়েকটি পর্যায়ে নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৭৭৮-১৮০০, পরবর্তীতে ১৮৩০-৪৮ এবং ৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পরে বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশ্বনাথ ছিলেন একদম প্রথম পর্বের নেতা। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও সাহসের ফলে নদীয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন গণবিদ্রোহের আকার নেয়। প্রথমেই শান্তিপুরের তাঁত শ্রমিকদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেন বিশ্বনাথ। তাঁর একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমণে ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় অত্যাচারের প্রাণকেন্দ্র খালবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্দিপুর, বাঁশবেড়িয়ার নীলকুঠিগুলি। নায়েব, গোমস্তা মুৎসুদ্দিদের ঝাড়ে বংশে উৎখাত করে বিদ্রোহীরা সন্ত্রস্ত করে তোলেন শাসকবর্গকে। উপর্যুপরি রাজনৈতিক ডাকাতির ফলে নীলচাষ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। নদীয়া ইন্ডিগো কনসার্নের মাথা স্যামুয়েল ফেডা নামক এক নীলকরের জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষেরা বিশ্বনাথের নেতৃত্বে ১৮০৮ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাত্রে তাঁর কুঠী আক্রমণ করে। ফেডী ও এক ইউরোপিয়ান যাজক মিঃ লিডিয়ার্ডকে বন্দী করে সারা বাড়ি লুঠ হয়। ফেডীকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন গ্রামবাসীরা কিন্তু বিশ্বনাথের দয়ায় সে প্রাণভিক্ষা চেয়ে মুক্তি পায়। এর কয়েকমাস বাদেই ফেডী, ইংরেজ সেনাপতি ব্ল্যাক ওয়ারের সেনাবাহিনীর সাহায্যে ও নদীয়ার জেলাশাসক ইলিয়টকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বনাথকে ঘেরাও করে ফুলিয়ার জঙ্গলে। সাথীদের প্রাণ রক্ষার্থে দলনেতা বিশ্বনাথ সংঘর্ষ এড়িয়ে যান ও গ্রেপ্তার বরণ করেন। বিচারের প্রহসন শেষ করতে সরকার বেশি দেরী করেনি। তাঁকে ফাঁসী দেওয়ার পর ‘সুসভ্য’ ইংরেজ সরকার ঘৃণ্যতম মানসিকতার পরিচয় দেয়। এই মহাবিপ্লবীর মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় পুরে আসাননগরের একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় ও চিল, শকুন দিয়ে খাওয়ানো হয়। ভীত শাসকরা চেয়েছিল বিদ্রোহীর পরিণতি প্রত্যক্ষ করে বাকি কৃষকরাও শঙ্কিত হোক। বিশ্বনাথের মা, পুত্রের কঙ্কালটি জলে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। অধুনা আসাননগর গ্রামের সেই মাঠটি ফাঁসিতলার মাঠ বলে খ্যাত।
মার্কসবাদী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন “অসহায় জনগণের, কৃষকের সম্মুখে দন্ডায়মান হইয়া তাহাদিগকে অভয় ও বাঁচিবার জন্য সংগ্রামের প্রেরণাদানের উদ্দেশ্যে যাহারা একক শক্তিতে বিদেশী নীলকর দস্যুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করিয়ছিলেন, তাহাদের মধ্যে বিশ্বনাথ সর্দার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী।”
শহীদ বিশ্বনাথের জীবনীকার বিমলেন্দু কয়াল চমৎকার বলেছেন “শেরউড বনভূমির দস্যু রবিনহুড যে ইংরেজদের জাতীয় জীবনে মহিমায় মহিমান্বিত হইয়াছেন, সেই ইংরেজ ব্রাহ্মণীতলার বনভূমির বাঙ্গালী বীরকে দস্যু আখ্যায় আখ্যাত করিয়া হীনভাবে হত্যা করিয়াছে।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শিশুসাহিত্যিক ধীরেন্দ্রলাল ধর তাঁর “নীলকর এলো দেশে উপন্যাসে বিশ্বনাথকে পূজারী ব্রাহ্মণ হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন, বাস্তবে তিনি ছিলেন কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত।
চিরকালই সমস্ত জঙ্গী কৃষক আন্দোলন ও তার মহান নেতৃবর্গকে সন্ত্রাসবাদী ডাকাত, লুঠেরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। আজো ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে'। শাসকশ্রেণীর রচিত ইতিহাসে বীর বিশ্বনাথ হয়ে গেছেন বিশে ডাকাত। তাদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে তো দূরের কথা ছাপার অক্ষরেও ভালোভাবে লেখা নেই। যেমন লেখা নেই সন্ন্যাসী, চাকমা, চুয়াড়, গারো বিদ্রোহীদের দুরন্ত লড়াই-এর ইতিবৃত্ত।
না, বিদ্রোহী বিশ্বনাথকে আমরা সত্যিই ভুলেছি। তাঁর শাহাদতকে ইতিহাস মর্যাদা দেয়নি, তিনি বাস্তবিকই মুছে গেছেন ইতিহাস থেকে। তাই অতিনাটকীয় ভাবে একথা বলে এই লেখা শেষ করা যাচ্ছে না যে “শহীদ বিশ্বনাথের মৃত্যু নেই”। তবে বারবার ব্যবহারেও ক্লীশে না হয়ে যাওয়া একটি শব্দ আছে না?
“কোনো কোনো মৃত্যুর ওজন...”