সেই সব শহীদেরা/সন্ত্রাস, নৈরাজ্যবাদ ও মার্কসবাদী উত্তরণ—প্রসঙ্গ ভগৎ সিং
সন্ত্রাস, নৈরাজ্যবাদ ও মার্কসবাদী উত্তরণ
–প্রসঙ্গ ভগৎ সিং
অগাস্ট বৈলেয়ন্ট (Vaillant)। ফরাসী নৈরাজ্যবাড়ি বিপ্লবী। প্রথম দিকে নিযুক্ত ছিলেন শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতেন, কিন্তু তৎকালীন ফ্রান্সে যে স্বৈরাচারী শাসকেরা গায়ের জোরে অন্যায় শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখতে ছয় তাদের ওপর এসব আন্দোলনের কোনো প্রভাব পড়েনি। বৈলেয়ন্ট ৭ই ডিসেম্বর ১৮৯৩ ফ্রান্সের বিধানসভায় একটি বোমা নিক্ষেপ করেন। কয়েকজন সামান্য আহত হলেও কেউ মারা যাননি, কারণ তিনি কাউকে হত্যা করতে চাননি। বলেছিলেন “বোধিরকে শোনাতে উচ্চ কণ্ঠের প্রয়োজন, একথা ভেবেই আমি বিধানসভায় বোমা ছুঁড়েছি, আমার উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। ঘুমন্ত শাসক-শোষকবর্গের আসন্ন রক্তক্ষয়ী বিপ্লব সম্পর্কে হুঁশিয়ারী।” ৩রা ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৪ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর শেষ শ্লোগান ছিল ‘Death to the bourgeoisie, long live anarchism.’
১৯২৯-এর ৪ই এপ্রিল বটুকেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে ভগৎ সিং যখন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটচ্ছেন এবং কিছুকাল পরেই তাঁকে অক্ষয় দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী, নৈরাজ্যবাদী নামে, তরুণ বিপ্লবী কী অসামান্য যুক্তিতে সে সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করেছেন সেই আলোচনার প্রবেশের আগে সংক্ষেপে দেখে নিতে হবে তৎকালীন ভারতবর্ষের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে। শুরুটা ১৮৭৯ সালে। সর্বপ্রথম বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের সশস্ত্র দল গড়ে বিদ্রোহ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল ঠিকই কিন্তু বপন করে দিল বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের বীজ। বাংলায় মাথা চাড়া দিয়েছে সশস্ত্র আন্দোলন। ১৯০৮ সালে উল্লাসকর, বারীন্দ্রকুমারের তৈরী বোমায় কিংসফোর্ডকে মারতে ব্যর্থ ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাকে লক্ষ্য করে তিলক কেশরী পত্রিকায় লিখেছেন-
The military strength of no govt. is destroyed by bombs, the bombs has not the power of crippling the power of an army, nor does the bomb possess the strength to change the current of military but owing to the bomb the attention of govt. is attracted towards the disorder which prevail owing to the pride of military strength. [Keshri-22 June, 1908]
এই দৃষ্টি আকর্ষণের কথা ভগৎ সিং-এর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হবে ভবিষ্যতে, অ্যাসেম্বলিতে বোমা ফেলার পর। সন ১৯১২, ডিসেম্বর মাসে রাসবিহারীর শিষ্য নদীয়ার এক অখ্যাত গ্রামের কিশোর বসন্ত মোক্ষম বমটি মারলেন দিল্লির রাজপথে, টার্গেট বড়লাট হার্ডিংস। কোনো মতে লাটসাহেব প্রাণে বঞ্চলেও মহাপরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আঁতকে উঠেছিল সেদিন। সর্বমোট চারজনের মৃত্যুদণ্ড হয়। অন্যতম অবোধবিহারী ফাঁসির মঞ্চে তাঁর শেষ ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে- ‘আমি চাই এই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে যাক, এ আগুনে আমি তুমি আমরা সবাই ছয় হবো, তার সাথে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে আমাদের দাসত্ব।’২ এ একেবারে নৈরাজ্যবাদের গোড়ার কথা। ফাদকের গ্রেপ্তারের পর তার বক্তব্যও অনেকটা এইরকম- ‘My life alone will not given but thousands of others will be killed.’
এই যে ধ্বংসের সর্বগ্রাসী ভাবনা যার মধ্যে নিহিত ছিল নৈরাজ্যবাদী ধারণা, তা ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জপথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ স্থান অধিকার করে। উল্লেখ্য গদর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা লাল হরদয়াল ছিলেন নৈরাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক। অকল্যান্ডে গিয়ে তিনি ‘বাকুনিন ইনস্টিটিউট অফ ক্যালিফোর্নিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন। হার্ডিঞ্জ কাণ্ডের সময় কমরেড ভগৎ সিং-এর বয়স মাত্র ছয়। তখন তিনি মাঠে কাঠি পুঁতে বন্দুকের চাষ করছেন। বোঝা যায় শিশুমনে এ ঘটনের ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। ১৯১৫ তে ব্যর্থ হয়েছে রাসবিহারী বসুর সেন বিদ্রোহের প্রচেষ্টা, ফাঁসি হয়েছে কর্তার সিং সারাভা (ভগৎ সিং-এর আদর্শ) ও আরো অনেকের। চার বছর পর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। এই দুই ঘটনা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল তাঁকে। জেনেছেন বিশ্ববিপ্লবের ইতিহাস বাকুনিনের ‘রাষ্ট্র এবং ঈশ্বর’ গ্রন্থটি গভীর মনোযোগের সাথে পথ্য করেছেন। নৈরাজ্যবাদ শুধু নয়, মার্কস, এঙ্গেলস, প্লেখানভ, লেনিন, ট্রটস্কি যতটুকু পেয়েছিলেন অদম্য উৎসাহে শেষ করেছেন। পড়েছেন গোর্কি, ডস্তয়ভস্কি, ভিক্টর হুগো, আপটন সিনক্লেয়ার, ডিকেন্স, শ এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর লেখা বিস্ময়কর প্রবন্ধ ‘পাঞ্জাবের ভাষা ও লিপির সমস্যা’তে কবি নজরুলকে বর্ণনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে।৩
আবার ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে কীর্তি পত্রিকায় ‘নয়ে নেতাও কো আলগ আলগ বিচার’ নিবন্ধে সুভাষচন্দ্র ও নেহেরুর তুলনা প্রমাণ করছে কি অসম্ভব দুরদর্শী ছিলেন তিনি। একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী থেকে পরিপূর্ণ মার্কসবাদীতে উত্তরণ কোনো Magical Way-তে হয়নি। স্বল্প জীবনে অসম্ভ অধ্যয়ন আর লড়াকু মানসিকতা তাঁকে উন্নীত করে প্রকৃত কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে। সাথী শিব বর্মা লেখছেন ভগৎ সিং ও শুকদেব দুজনেই বাকুনিনের দর্শনে বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, সেই অবস্থান থেকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব মূলত দুজনের; কমরেড সোহন সিং জোশ এবং লাল ছবিল দাশ। কমরেড জোশ ছিলেন ‘কীর্তি’ পত্রিকার সম্পাদক যেখানে ১৯২৮ সালের মে মাস থেকে ভগৎ সিং ধারাবাহিকভাবে প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করেন। বিষয় ছিল নৈরাজ্যবাদ।৪ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো ওই বছরের ২১-২৪ শে ডিসেম্বর কলকাতায় শ্রমিক-কৃষক দলের (Workers and Peasant Party) সারা ভারত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।৫ সভাপতিত্বে ছিলেন সোহন সিং জোশ। উপস্থিত ছিলেন তাবড় কমিউনিস্ট নেতার, ঘটে, পি. সি. জোশী, মুজফফর আহমেদ, আব্দুর রেজ্জাক খাঁ প্রমুখ। দর্শকদের মধ্যে গোপনে এসেছিলেন ভগৎ সিং স্বয়ং।৬ হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA) ও তার সদস্যদের যারা শুধুই একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে দেখতে চান, ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীদের বৈপ্লবিক উত্তরণটাকে এড়িয়ে যেতে চান তাঁর। একজন সশস্ত্র সংগ্রামের বিশ্বাসী বিপ্লবীর নৈরাজ্যবাদের প্রতি আকর্ষণ থাকতেই পারে, কমরেড সিংয়েরও ছিল, তবে তা থেকে ওই বয়সে পরিপূর্ণ মানসিক গুণে ঋদ্ধ মার্কসবাদী হয়ে ওঠা তাঁর মতো অনন্যসাধারণ ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। সাম্যবাদের অন্তিম আদর্শও রাষ্ট্রের বিলোপ ছয়, কিন্তু নৈরাজ্যবাদীরা মনে করেন রাষ্ট্রের বিলপের মাধ্যমেই জনগণের মুক্তি সম্ভব। এই ধারণার প্রতি সর্দার ভগৎ সিং সহনুভূতিশীল ছিলেন ঠিকই তবে পরবর্তীতে বিশ্বমানবসমাজকে পুঁজিবাদের শৃঙ্খল এবং যুদ্ধের সর্বনাশ সঙ্কট থেকে রোখার জন্য সর্বহারার একনয়কতন্ত্রের ধারণাকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন।
অ্যাসেম্বলিতে বোমা বিস্ফোরণের প্রেরণা যার কাছ থেকে পেয়েছিলেন সেই বৈলেয়ন্ট ছিলেন প্রকৃত অর্থেই নৈরাজ্যবাদী। বোঝাই যাচ্ছে চিন্তাচেতন ও মতাদর্শ ভগৎ সিং তাঁর পূর্বসূরীকে ছাপিয়ে গেছিলেন। ‘অ্যানার্কিজম’-এর বদলে শ্লোগান তোলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। বিপ্লবের প্রশ্নে এবং সন্ত্রাসবাদী হিসেবে তাঁকে, তাঁর সহযোগীদের যে সমালোচনা করা হয় তার প্রত্যেকটির জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন। এ প্রশ্নে বলা দরকার নৈরাজ্যবাদ ও সন্ত্রাসবাদ এক জিনিস তো নয়ই বরং তাদের মধ্যে মুলগত অনেক তফাৎ আছে। প্রায়শই দুটিকে এক অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখনও পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একে নির্দিষ্ট মতবাদের ওপর দাঁড় করানো যাবে না, অন্যদিকে নৈরাজ্যবাদ একটি তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত যার অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে। আধুনিক নৈরাজ্যবাদের প্রবক্তা পিটার ক্রপটক্রিন একে চারভাগে ভাগ করেছেন।৭ প্রথম ধারাটি অরাজনৈতিক, প্রবক্তা মাক্স স্টান্দর নামে এক জার্মান, এখানে রোমান্টিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রভাব লক্ষ্যও করা যায়। পরবর্তী ধারা রাজনটিক হলেও সমাজবাদী নয়। প্রবক্তা প্রুঁধো। তাঁর আদর্শ ক্ষুদে উৎপাদকদের দিয়ে গড়া সমাজ। তৃতীয়টি শান্তিবাদী অ্যানার্কিস্ট, যেমন ছিলেন টলস্টয়। গান্ধীকে ও অনেকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে নৈরাজ্যবাদী বলে থাকেন। চতুর্থ ধারাটি নিয়েই আমরা আলোচনা করছি যেটাকে ইতিহাসে অ্যানার্কিস্ট কমিউনিজম বলে। রাষ্ট্র এবং অর্থনীতি সম্পর্কে এনদর গুরুত্বপূর্ণ মতামত রয়েছে। ভগৎ সিং অ্যানার্কিস্ট ছিলেন না, সন্ত্রাসবাদী তো ননই। জেল থেকে পাঠান ইস্তেহার, চিঠি এবং রচনাগুলি (দুর্ভাগ্যবশতঃ যার অনেককিছুই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে আসেনি, জেলজীবনে তিনি চারখানে বই লেখেন)৮ যতটুকে পাওয়া জগেছে এর পিছনে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনীত ধারা রয়েছে, প্রথমটি সশস্ত্র বলপ্রযোগের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ; অহিংস এবং আপোষ আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর; তৃতীয়টি মার্কসবাদী গণ আন্দোলনের ধারা। কমরেড সিংয়ের সবচেয়ে বড় অবদান তিনি প্রথম ও তৃতীয় এই লাইনের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। একদিকে লাল লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার গুরুত্ব প্রথম অনুধাবন করেন তিনি, কারণ অত্যাচারী শাসক কেবল বোঝে বন্দুকের ভাষা, পাশাপাশি তিনি এও লিখেছেন, “মানুষের জীবন আমরা পবিত্র বলে মনে করি। মানুষের রক্ত ঝরাতে বাধ্য হয় বলে আমরা দুঃখিত। তবে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সকলকে সমান স্বাধীনতা দিতে, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণকে শেষ করতে বিপ্লবে কিছু না কিছু রক্তপাত অনিবার্য।” অর্থাৎ বিপ্লবীরা যে খুনি বা রক্তপিপাসু নয় তা লেখার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। লালাজীর মৃত্যুর পর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহধর্মিণী বাসন্তীদেবী একটি শোকসভায় বলেছিলেন, “আমি একজন বিভারতীয় নারী হিসাবে দেশের যুবশক্তির প্রতিক্রিয়া জানতে চাই যে, লালাজীর মতো দেশবরেণ্য নেতা যদি পুলিশের লাঠির ঘায়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে সেই জাতির অপমান অবহেলার বিরুদ্ধে লালাজীর চিতা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই তারা কি ব্যবস্থা নিতে চায়?”৯
HSRA-এর সৈনিকেরা তুরন্ত জবাব দিয়েছিলেন, দেখিয়েছিলেন সব ভারতবাসীর রক্ত শীতল হয়ে যায়নি। মার খেয়ে পাল্টা মার দিতে জানে। এখন এটাকে যদি কেউ শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী (বড়ো হরফ আমার) কার্য বলে অভিহিত করেন, তাহলে তার পেছনে আলাদা কারণ আছে। L. J. Carr প্রমুখ বুর্জোয়া তাত্ত্বিকেরা এভাবেই বিপ্লব ও হিংসাকে সমার্থক দেখিয়ে মার্কসবাদের বিরোধীতা করে থাকেন। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের ঐতিহাসিকেরা সচেতন ও অচেতনভাবে একই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ভগৎ সিংয়ের ভুল মূল্যায়ণ তার অন্যতম প্রমাণ।
বি. টি. রণদিভে বলেছেন “সর্বহারা শ্রেণীর স্বপ্নকে ও সমাজতন্ত্রের সমর্থনে তাদের দেওয়া শ্লোগান থেকেই সমাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণভাবে তাদের সমর্থনের কথা জানা যায়, যদিও তাকে ঠিক মার্ক্সবাদে বরণ করে নেওয়া চলে না।”১০[ভগৎ সিং-এর চিন্তাভাবনা-বিটি রণদিভে]
অথচ ওই একই প্রবন্ধে লেখক কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রতি ভগৎ সিং-এর বার্তার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে সর্বহারা শ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয় ও পুঁজিবাদের বিনাশের পক্ষে তাঁর কণ্ঠে সোচ্চার হচ্ছে। আসলে সেই সময় মার্কসবাদী বই, পত্রপত্রিকা ছিল অপ্রতুল, তাই অধ্যায়নের যথেষ্ট সুযোগ এবং স্বল্প জীবনকালে পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্ব বিচারের সময় (বড়ো হরফ আমার) তিনি পাননি একথা জানায় পরেও তাঁকে মার্ক্সবাদী বলতে কারো যদি আপত্তি থাকে তাহলে বলা উচিত, মার্ক্সবাদ বইতে আবদ্ধ কয়েকটি বাক্যাংশ নয়, এটি একটি বস্তুবাদী দর্শন, সুনির্দিষ্ট প্রয়োগেই যার বিকাশ ঘটে। তত্ত্বের অধ্যায়ণ ভুল হয় না, ভুল বা ত্রুটি যা কিছু ঘটে প্রয়োগ কালে। সর্বোপরি একথাই বলা যে ভগৎ সিং জীবনযাপন করেছিলেন, লড়েছিলেন এবং মানুষকে ভালবেসেছিলেন একজন আদর্শ মার্ক্সবাদীর মতো, তার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের আলোকে ভারতীয় সমাজকে সবরকম শোষণের জোয়াল থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। হাস্যকর মনে হচ্ছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির তথাকথিত সভ্যপদ না থাকায় তাঁকে এই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে ভগৎ সিং হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি।
শৈলেশ দে’র লেখনী থেকে তুলে ধরছি- ‘ভগৎ সিং কোনো মার্ক্সবাদী দলের সদস্য ছিলেন না একথা সত্য, সে সুযোগও ছিল না কারণ তখন মার্ক্সবাদ এতটা প্রসার লাভ করেনি আমাদের দেশে। দলীয় সদস্য না হয়েও মার্ক্সবাদকে আদর্শ হিসাবে গ্রহন করেছিলেন এটাই কি তাঁর একমাত্র আপরাধ?’১১
আসলে বিপ্লবী যোগেশ চ্যাটার্জীর লেখা থেকে জানা যায় দেউলি বন্দীনিবাসে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা ভগৎ সিং ও আজাদ দিবস পালন করতে চাননি, কারণ এটা নাকি তাদের নীতিবিরুদ্ধ কাজ এই যুক্তিতে! এ প্রসঙ্গেই লেখক উপরোক্ত কথাগুলি লিখেছেন, সেই সঙ্গে একখানি অসাধারণ প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছেন গ্রন্থাকার “পরবর্তীকালে ক’জন মার্ক্সবাদী মার্ক্সবাদকে এতখানি ভালবাসতে পেরেছিলেন ভগৎ সিং-এর মতো??” [ওরা আকাশে জাগতো ঝড়, পৃষ্ঠা ১৭২]
ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, “তিনি কেবল ভারতের অন্যতম মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রথম যুগের অন্যতম মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিক। দুঃখের বিষয় ভগৎ সিং সম্পর্কে শেষের এই গুণাবলী কথা তুলনামূলক ভাবে অজানাই রয়ে গেছে।”১২
রণদিভে যাই বলুন না কেন বিপান চন্দ্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন ১৯২৭-১৯২৮ সাল থেকে তিনি বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ ত্যাগ করে মার্ক্সবাদী চিন্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন এবং ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ অবধি তিনি পড়াশোনা করেছেন অবিশ্বাস্য পুস্তক ক্ষুধায়।
গান্ধীজী এই মহান বিপ্লবী ও তাঁর সাথীদের কার্যকলাপকে নিছক গুন্ডামি ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। শত্রুর দুঃখেও যারা প্রাণ কাঁদতো তিনি এঁদের প্রাণ কাঁদতো তিনি এঁদের প্রাণ রক্ষার্থে বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেননি। কারণ তাঁর ভাষায়- “The Bhagat Singh worship has done and is doing incalculable harm to the country....The deed itself (the Act of Bhagat Singh) is being worshipped as if it is worthy of emulation. The result is goondaism and degradation wherever this mad worship is performed.”১৩ [হত্যার রাজনীতি নিয়ে Young India পত্রিকায় প্রকাশিত মতামত, The Cult of the Bomb, 2nd January, 1931]
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন! যতীন দাসের মহত্তম আত্মদানকে যিনি Diabolical suicide বলতে পারেন, তার পক্ষে এ জাতীয় ভাবনা অসম্ভব নয়।
এবার সন্ত্রাসবাদ এবং HSRA-কে নিয়ে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ মধ্য যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, তার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জেলার অভ্যন্তরে ‘হিংসা অহিংসার প্রশ্নে’ একটি লেখা লেখেন ভগত সিং। যেখানে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলা আছে।
“সন্ত্রাসবাদ শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চার করার মধ্যে দিয়ে নিপীড়িত মানুষের ভিতরে প্রতিরোধের আকাঙ্খা জায়গায়, তাঁকে শক্তি দেয়, দোদুল্যমান চিত্র ব্যক্তিরা এরই ভিত্তিতে সাহসে বুক বাঁধে, তার মধ্যে সৃষ্টি হয় আত্মবিশ্বাসের।”১৪
এখান থেকে আপাত প্রতীয়মান যে, লেখক সন্ত্রাসবাদকে গৌরবান্বিত করেছেন, তার পক্ষে ওকালতি করেছেন কিন্তু নিছক খুন-জখম, দু-চারটে ইংরেজ মেরে আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না তাও পরবর্তী একটি লেখায় প্রকাশ করে দিয়েছেন তিনি। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো তার আগে মুজফফর আহমেদ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ১৬-০৩-১৯৬১ তারিখে দেওয়া বয়ানে বলেছিলেন একটু দেখা যাক।
“প্রত্যেক বিপ্লবী সন্ত্রসবাদীদের ত্যাগ স্বীকারকে নিশ্চয় সাধুবাদ জানাবেন কিন্তু সন্ত্রাসবাদীরা কি বিপ্লবী? আমি নিশ্চয়ই বলব, না। তারা বিপ্লবী জন। তারা বিপ্লবের যা প্রকৃত সামাজিক উপাদান সেই মজুর শ্রেণীর ও কৃষকসমাজের ওপর কখনোই আস্থা পোষণ করেননি।”১৫
এই অভিযোগ ভগৎ সিং-এর ক্ষেত্রে খাটে না যিনি দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন যে, প্রকৃত বিপ্লবী সেনাবাহিনী অবস্থান করছে গ্রামে এবং কলকারখানায় কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে কিন্তু আমাদের বুর্জোয়া নেতারা তাদের মোকাবিলা করার সাহস নেই। ঘুমন্ত সিংহের একবার তন্দ্রা টুটলে সে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।১৬ [তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি-২ রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৩১]
তর্কের অবকাশ আছে যে শ্রমিক-কৃষকদের তুলনায় তিনি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রফেশন্যাল রেভুল্যুশনারী বা শিক্ষিত সাহসী যুবক সম্প্রদায়ের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছিলেন কিনা। কিন্তু যে ব্যক্তি ‘মানুষের প্রতি আমরা ভালবাসা কারো থেকে কম নয়’ এই রচনায় শ্রমিকশ্রেণীকে সমাজের সত্যিকারের স্রষ্টা বলে চিহ্নিত করেছেন অথচ তাদেরই প্রধান বৈপ্লবিক শক্তি বলে মনে করতেন না এই অভিযোগ ধোপে টেঁকে না। আরো একবার বলা ভালো মাত্র সাড়ে তেইশ বছরের জীবনে মার্ক্সবাদ চর্চার যথেষ্ট সময় তিনি পাননি কিন্তু বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী থেকে একজন বস্তুনিষ্ঠ মার্ক্সবাদীতে উত্তরণটি যে ঘটেছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।১৭
শ্রীযুত আহমেদের ভাষায়-
“হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি এই নামে অথবা লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার কয়েদীদের শ্রমিকশ্রেণী সুলভ বিপ্লবী স্লোগানে আমার মোহ ভঙ্গ হতে দিইনি, HSRA-র সদস্যদের পরবর্তী ক্রিয়াকলাপ থেকে একথা নির্ভয়ে সাব্যস্ত করা যায় যে, এই বন্ধুরা কখনোই এইসব শ্রমিকশ্রেণী সুলভ বিপ্লবী স্লোগানে আস্থা পোষণ করেননি।”১৮
এই উপলব্ধি যুক্তিহীনই শুধু নয় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকও। তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে জেল থেকে পাঠানো দলিলটির বয়ান কি মুজাফফর আহমেদ সাহেবের অজ্ঞাত ছিল যেটা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার এই বয়ানের অন্তত দেড় মাস আগে ভগৎ সিং লেখেন সমস্ত অভিযোগের সুনির্দিষ্ট জবাব সহ?
“সর্বশক্তি সংহত করে বলতে চাই আমি সন্ত্রাসবাদী নই। বিপ্লবের পথে যেদিন পা বাড়িয়েছিলাম, সেই ঊষালগ্নটুকু ছাড়া কোনো দিনই আমি সন্ত্রাসবাদী ছিলাম না। সন্ত্রাসবাদের পথে আমরা কিছুই করতে পারবো না এ আমার দৃঢ় প্রত্যয়। আমাদের HSRA-এর ইতিহাস থেকেই একথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।”১৯
এ ঘোষণা একজন আত্মপ্রত্যয়ী মার্ক্সবাদী যে মার্ক্সবাদ গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদিকে একেবারে অনুমোদন করছে না।২০
“বোমা পিস্তলের কোনো কার্যকরীতাই নেই একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় বরং বক্তব্য তার বিপরীত। কিন্তু আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই নিছক বোমা ছোঁড়া শুধু অকার্যকারীই নয়, কখনও তা যথেষ্ট ক্ষতিকারকও বটে।”
ওই একই লেখায় নিয়মিত আলোচনা সভা, স্টাডি ক্লাস, প্রচার, গণসংগঠন ইত্যাদি ধৈর্যশীল কর্মসূচীর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে বলা আছে, কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই যাকে সন্ত্রাসবাদীর দর্শন বলা যাচ্ছে না। বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহারাজও এ কথার সমর্থন করেছেন।
“ভগৎ সিং ইহা জানিত এই বোমা নিক্ষেপ দ্বারা কতিপয় সাহেব খুন দ্বারা দেশের স্বাধীনতা আসিবে না, ভগৎ সিং বিশ্বাস করিত ইহা দ্বারা দেশ আগাইয়া যাইবে। দেশের যুবকদিগের মধ্যে আসিবে নবজাগরণ।“২১ [জেলে ত্রিশবছর ও ভারতপাক স্বাধীনতা সংগ্রাম]
বাস্তবিক সেই বোমা ফেটে ধামাকারই শুধু সৃষ্টি করেনি। নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢেউ তোলার মতো দেশের জনসাধারণ নিজের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সর্বস্তরে ধ্বনিত হয় প্রতিবাদ। এই মহান বিপ্লবীর জীবনীকার জিতেন্দ্রনাথ সান্যাল (বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথের ভাই) সঠিকভাবেই লিখেছেন- “Sardar Bhagat Singh, I know was neither a terrorist nor an anarchist, therefore to discharge my duty towards my late friend; I thought of presenting his true and historical picture. In this I wanted to show that he was a communist and a internationalist and that people had misunderstood him.”
গবেষক ও রাজ্যপুলিশের মহানির্দেশক অমিয়কুমার সামন্ত হিংসার প্রশ্নে গান্ধিজীর সমালোচনা ভগৎ সিংয়ের যুক্তিগুলিকে ভারহীন ও চটকদারী কথা বলে উল্লেখ করছেন।২২ ‘ভগৎ সিং ও স্বাধীনতাপূর্ব সন্ত্রাসবাদের বিবর্তন' শীর্ষক প্রবন্ধে কমরেড সিং-এর বিপ্লবের ধারণার সমালোচনা করে লিখেছেন “The Philosophy of Bomb” প্রবন্ধে বিপ্লবের কথা অনেকবার আসেছে কিন্তু বিপ্লবের স্বরূপ বা পদ্ধতি সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য খুব কম আছে।” তিনি এও অভিযোগ করেছেন যে, বিপ্লবের তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক কোনো রূপই ভগৎ সিং বা সহকর্মীদের রচনায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেনি।২৩
প্রায় একশো বছরে পরে স্বাধীন রাষ্ট্রের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে সামন্তমশাই এ কথা বলতেই পারেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগ সত্য কি? নিম্ন আদালতে ভগৎ সিংকে প্রশ্ন করা হয় তিনি ‘বিপ্লব' বলতে কি বোঝেন? উত্তরে তিনি যা বলেন তা এই রূপ-
“বিপ্লব মানে রক্তক্ষয়ী হানাহানি নয়, বিপ্লবের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ মেটানোরও সম্পর্ক নেই। বিপ্লবের অর্থে বোমা বা পিস্তলের চর্চাও বোঝায় না। বিপ্লব, বর্তমান সমাজব্যবস্থা যা কিনা জ্বলন্তরূপে অন্যায়ের কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।“ এর চাইতে সহজ সরল সংজ্ঞা বোধহয় আর দেওয়া সম্ভব নয়।লোভ সামলানো যাচ্ছে না আরেকটি জায়গা থেকে উদ্ধৃতি টানবার-
“তোমাকে তো বলেছি ভারতী, বিপ্লব মানেই শুধু রক্তক্ষয়ী কাণ্ড নয়, বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন।” [পথের দাবী, সপ্তবিংশ পরিচ্ছদ]
ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে বিপ্লবের আবির্ভাব ঘটে, মার্কস যাকে বলেছেন ‘Locomotives of history' |২৪ গবেষকরা যেরকম হাতে গরম সংজ্ঞা চান সেটা তো থিওরিটিক্যালি দেওয়া সম্ভব নয় তবে ইহুদি কবি জোসেফ বলশোভার তাঁর বিপ্লব নামক কবিতায় একটি সুন্দর চিত্র এঁকেছেন-
আমি আসি। কারণ দেশের জনগণের বদলে
স্বৈরাচারীরাই সিংহাসন দখল করেছে
আমি আসি। কারণ শাসকেরা তাদের যুদ্ধের
প্রস্তুতির পাশাপাশি শান্তির রোমন্থন করে
আমি আসি। কারণ যে বন্ধন মানুষকে একত্রে
গ্রাথিত করে তা এখন শিথিল
আমি আসি। কারণ মূর্খেরা মনে করে যে
তাদের তৈরী বেড়ার মধ্যেই প্রগতি আবদ্ধ থাকবে।২৫
আর বিপ্লবের তাত্ত্বিক বা সাংগঠনিক দিককে ফুটিয়ে তুলতে গেলে শুধু রচনার দিকে তাকালে হবে না, লক্ষ্য করতে হবে সিং ও তাঁর সাথীদের কার্যকলাপের উপর। এই জাত-বিপ্লবীদের স্বল্প অথচ কর্মময় জীবন তাত্ত্বিক বিচার কতটা গুরুত্ব পাবে তা বলার কাজ ঐতিহাসিক কিম্বা গবেষকদের। কিন্তু বাস্তবে তা যে পরবর্তী সমস্ত গণ আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল তা অনস্বীকার্য। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি তো এই ঐতিহ্যকেই বয়ে এনেছিল। জনসমর্থনের অভাব, সন্ত্রাসবাদী ঝোঁক ইত্যাদি কারনে বিপ্লববাদী কার্যকলাপ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছিল, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল বলে যারা মনে করেন তারা ব্যর্থতার নিরিখে, সফলতার মাপকাঠিতে ব্যক্তির আত্মবলিদান, কর্তব্যনিষ্ঠাকে বিচার করার ভুল করেন। যা ইতিহাসের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর।
বিপ্লব যেমন কোনো রক্তক্ষয়ী, মানবতা বিরোধী ব্যাপার নয়, তেমনি ভোজসভা বা সূক্ষ্ম সুললিত সুচীকর্মও নয়, কখন কোন পথ ধরে আসবেতা বই পড়ে ঠিক করা যায় না। সাফল্য-ব্যর্থতা অনেক সময়ই নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। সেদিক থেকে কমরেড সিংয়ের ধারণা কি উচ্চস্তরের ছিল তা তাঁরই সহকর্মী বিপ্লবী শিববর্মা স্মৃতিচারণ থেকে অনুমান করা যাবে-
“খানিক্ষণ চুপ করে থেকে ভগৎ সিং আবার বলল আমরা সবাই সৈনিক। সৈনিকের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ রণক্ষেত্রের প্রতি। তাই অ্যাকশনে যাবার কথা উঠতেই সবাই উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তবু আন্দোলনের কথা মনে রেখে কাউকে না কাউকে তো অ্যাকশনের মোহ ছাড়তে হবে। সাধারণত অ্যাকশনে যারা লড়ে বা ফাঁসিতে ঝোলে শহীদত্ত্বের বরন মালা তাদেরই গলায় পড়ে একথা ঠিক, ইমারতের সিংহদরজায় হীরার যে অলঙ্করণ এঁদের মূল্যও তাই অথচ ইমারতের দিক থেকে দেখতে গেলে ভিতের নিচে চাপা পড়া একটা পাথরের তুলনায় এদের মূল্য কিছুই নয়......
তাছাড়া ত্যাগ আর আত্মবলিদানেরও দুটো রূপ। এক হলো গুলি খেয়ে বা ফাঁসিতে লটকে মরা- এর চমকটাই বেশি, কষ্টটা কম। দ্বিতীয়টা হল পিছন থেকে সারাজীবন ইমারতের বোঝা বয়ে বেড়ানো। আন্দোলনের চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে প্রতিকূল অবস্থায় কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন এক এক করে সব সাথীদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যায়, মানুষ তখন দুটো সহানুভুতির কথার জন্যও লালায়িত হয়। তেমনি সময়ে যারা অবিচলিত থেকে নিজেদের পথ ত্যাগ করে না, ইমারতের বোঝায় যাদের পা টলে না, কাঁধ বাঁকে না, তিলতিল করে যারা নিজেদের গলিয়ে যায়, জ্বালিয়ে যায় যাতে প্রদীপের জ্যোতি মলিন না হয়, নিস্তব্দ পথে যাতে আঁধার না ছেয়ে আসে, সেইসব লোকের ত্যাগ আত্মবলিদান কি প্রথমোক্তদের তুলনায় বেশি নয়?”২৬[শহীদ স্মৃতি-শিব বৰ্মা]
এত অল্পবয়সে যে মানুষটি যে মানুষটি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে আলিঙ্গন করেছিলেন দেশবাসী জানে না তিনি বাস্তবিক কি ছিলেন। কতটা অসামান্য চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী এবং সদ-হৃদয়সম্পন্ন মানুষ ছিলেন একথা অনেকেরই জানা নেই। পরবর্তী সময়ে দেশের কর্ণধারেরা সেটা জানাবার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন কি? মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ল্যাটিন আমেরিকার এক বিপ্লবী ঘাতকের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, “তোমরা হত্যা করতে পারবে শুধু মানুষটিকে”। একই ভাবে ভগৎ সিং বলে গিয়েছিলেন, “একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা সহজ কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না।”
প্রথম জনকে সার্ত্রে আখ্যা দেন ‘তার সময়কার সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে’ দ্বিতীয়জনকে একমাত্র সুভাষচন্দ্র ছাড়া সেরকম সন্মান (He symbolises the spirit of revolt that has taken possession of the country) কেউ দেননি।
প্রথমোক্ত ব্যক্তির ছবি ইদানিং জামা, টুপি, আর্মব্যান্ড মায় অন্তর্বাসেও শোভা পায়। এদেশে তিনি রূপকথার রাজপুত্র, বিশ্ববিপ্লবের আইকন। অথচ যে ব্যক্তি নিরামিষ একখানি বোমা ফেলে পৃথিবী শাসন করা ব্রিটিশ সিংহের থরহরি কম্পমান করে দিয়েছিলেন, সেই জায়গায় তাঁর একটি ছবি বা মূর্তিও নেই। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে রক্তঋণ শোধ হয় না। পাড়ার মোড়ে মোড়ে মূর্তি বানিয়ে, তা আবার সমাজবিরোধীদের দিয়ে উন্মোচন করে কিম্বা বুকে উল্কি এঁকে তারই পূজার ছলে তাঁকে ভুলে থাকার ভণ্ডামিটাও তুলনায় কম। ১৯৩১ সনের ২৩শে মার্চ যে ক্লান্তিহীন বিপ্লবীকে ইংরেজরা কারাবিধি লঙ্ঘন করে ফাঁসিতে লটকে দেয় তখন তার বয়েস মাত্র ২৩ বছর ৫ মাস ২৭ দিন। শহীদের জীবনকালের হিসাব সামান্য পাটিগণিতে বা বলিউডি সিনেমায় পাওয়া যায় না। যতদিন পৃথিবীতে থাকবে অন্যায়, থাকবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। তিনি জ্বলবেন পৃথিবীর রঙে।
অনেকে তাঁকে নৈরাজ্যবাদী শিরোপা দেবেন। কারণ ফরাসী অ্যানার্কিস্টের হুবহু অনুকরণে আইনসভায় বোমা ফেলেছিলেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হওয়াতে ‘গোঁড়া’ বিপ্লবীরা হয়তো কখনোই ভগৎ সিংকে কমিউনিস্ট বলবেন না, তবু তাঁর চিন্তাচেতনা জীবনদর্শন এবং লড়াই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কমিউনিস্ট বীরদের সাথে তাঁকে একাসনে বসাবে। সুতরাং তিনি বেঁচে থাকবেন একজন কমিউনিস্ট হিসাবে। প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে যখন বাকি সব নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা মাথা কুটে মরবে, পৃথিবীর নিপীড়িত জনজাতি যেখানে, যে প্রান্তে শেষ সম্বল হিসেবে তুলে নেবে রাইফেল, কান্না জ্বালাবে সর্বগ্রাসী দাবানল সেখানেই তিনি দেখা দেবেন সন্ত্রাসবাদী রূপে। আবার এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিচয়ের উর্ধ্বে দেশবাসীর কাছে, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তিনি থাকবেন আলাদা এক পরিচয়, তাকে আমরা ভালোবেসে ডাকব একটি বিশেষ নামে। শহীদ-ই-আজম। শহীদ কুলে সম্রাট।
টীকাঃ-
১। সন্তোষকুমার অধিকারী, সন্ত্রাসবাদ ও শহীদ ভগৎ সিং, পৃষ্ঠা ১১
২। সন্তোষকুমার অধিকারী, ঐ পৃষ্ঠা ১৩
৩। বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লবী ভগৎ সিং পৃষ্ঠা ৪৯
৪। বিনদ মিশ্র, ভগৎ সিং বিপ্লবী যুবসমাজের আলোকবর্তিকা, আজকের দেশব্রতী, ৩১শে
মার্চ,’০৫
৫। সারা ভারতের মধ্যে বাংলাতেই এই পার্টি প্রথম গঠিত হয়। নাম ছিল Workers and Peasant Party of Bengal। প্রতিষ্ঠাদের মধ্যে কুতুবদ্দিন আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার অগ্রগণ্য। ২১-২৪ ডিসেম্বর পরিবর্তিত ও সর্বভারতীয় নামে সম্মেলন হয় কলকাতার অ্যালবার্ট হলে। অমিতাভ চন্দ্র, অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন (সূচনা পর্ব), পৃষ্ঠা ৪, ৫
৬। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সমাজতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন, পৃষ্ঠা ২৩
৭। সুচরিতা সেন, নৈরাজ্যবাদ ও মার্কসবাদ, অনীক, কার্ল মার্কস বিশেষ সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল, ১৯৮৪
৮। জেল জীবনে ভগৎ সিং আরো চারটি বই লেখেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শ, আত্মজীবন, মৃত্যু ফটকের সামনে এবং ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস। এই বইগুলির পাণ্ডুলিপি বইয়ের পাচার করার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু যেসব সাথী ও সমর্থকদের হাতে তা সুরক্ষিত থাকার ব্যবস্থা ছিল সেই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। ভগৎ সিং জেল ডায়েরী, অনুঃ তপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ১৭
৯। বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, ঐ, পৃষ্ঠা ১১১
১০। অমেলেন্দু ভট্টাচার্য (সম্পা), প্রসঙ্গ ভগৎ সিং, পৃষ্ঠা ২৩
১১। বিপ্লবী যোগেশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেউলি বন্দীনিবাসে থাকাকালীন এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। যা তিনি In search of freedom গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। অথচ আজাদ হিন্দ ফৌজে নির্দিষ্ট দিনে শহীদ ভগৎ সিং দিবস পালিত হতো! ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়, পৃষ্ঠা ১৬৭
১২। বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, ঐ, পৃষ্ঠা ১৮৫
১৩। বক্তব্যের এই অংশটি ১৩৩৮ (১৯৩১) সালের ভাদ্র মাসে প্রবাসী পত্রিকায় হুবহু ছেপে দেওয়া হয়েছিল। রঞ্জিত সেন, একটি অপরাভূত বিপ্লবের প্রতি শতবার্ষিকী শ্রধাঞ্জলী, 'পশ্চিমবঙ্গ' ভগৎ সিং স্মরণ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৫৯
১৪। মানিক মুখোপাধ্যায় (সম্পা), ভগৎ সিং রচনাসংগ্রহ, পৃষ্ঠা ২৯
১৫। ‘কমিউনিস্ট পার্টিই সংগ্রামের পথ দেখাবে', গণশক্তি, মুজফফর আহমেদ, জন্মশতবর্ষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১৯৬
১৬। মানিক মুখোপাধ্যায় (সম্পা), ঐ, পৃষ্ঠা ৫১
১৭। K.N. Panikkar, Celebrating Bhagat Singh, Frontline, 2nd November, 2007, P. 6, 8.
১৮। কমিউনিস্ট পার্টিই সংগ্রামের পথ দেখাবে, ঐ, পৃষ্ঠা ১৯৭
১৯। মানিক মুখোপাধ্যায় (সম্পা), ঐ, পৃষ্ঠা ৫৯
২০। মার্কসবাদ গুপ্তহত্যা বা বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ অনুমোদন না করলেও শাসকের বর্ণনাতীত অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধকে অস্বীকার করে না। মার্কস যাকে বলেছেন, 'ঐতিহাসিক প্রতিশোধ'। জাতীয় মহাবিদ্রোহ, ভারতবাসীর সমষ্টিগত হিংসা বা সন্ত্রাস মার্কস যথেষ্ট সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেছেন। উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গ, ভারতীয় বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা ১৫৬ ভারতে জুলুমের তদত্ত, পৃষ্ঠা ১৬১
২১। বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, ঐ, পৃষ্ঠা ১২০
২২। অমিয়কুমার সামত্ত, হে মহাজীবন (সুশীল ধাড়ার জীবনী), মাহিষ্য সমাজ, শতবর্ষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৪৩
২৩। অমিয়কুমার সামন্ত, ভগৎ সিং ও স্বাধীনতাপূর্ব সন্ত্রাসবাদের বিবর্তন, পশ্চিমবঙ্গ, ঐ পৃষ্ঠা ৭৮
এ প্রসঙ্গে বলা যায় Modern review পত্রিকার তরফে সে সময় সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বিপ্লব ও ইনকিলাব জিন্দাবাদ শব্দগুলি নিয়ে প্রায় একই রকম সমালোচনা করেন। কমরেড সিং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এর যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেন। তিনি জানান, “দেশের শাসক শোষক শ্রেণীর নির্ভরযোগ্য দালাল, প্রতিনিধিত্বকারী এজেন্সিগুলির কাছে বিপ্লব মানেই হল রক্তাক্ত, ভয়ঙ্কর, ভীতিপ্রদ একটা কর্মকাণ্ড। অপরদিকে বিপ্লবীদের কাছে এটি একটি পবিত্র শব্দগুচ্ছ।“
২৪। The Class Struggle in France, 1848 to 1850, Marx, Part iii, Consequences of June, 13, 1849
২৫। সত্যসাধন চক্রবর্তী, বিপ্লবের মার্কসীয় তত্ত্ব
২৬। N. B. A.,শহীদস্মৃতি-শিব বর্মা, পৃষ্ঠা ২৬, ২৭।