সেই সব শহীদেরা/শতবর্ষের শ্রধাঞ্জলি: ডাঃ কোটনিস
শতবর্ষের শ্রধাঞ্জলিঃ ডাঃ কোটনিস
উত্তর চীনের পাহাড়ি গ্রামগুলিতে আছড়ে পড়ছে বোমা। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে জাপ সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে পাহাড় জঙ্গলের অভ্যন্তর মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে প্রণিত অষ্টম রুট বাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা। এমনই এক যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামের কুটীরে সে সময় মারা যাচ্ছেন চীনে ভারতীয় মেডিক্যাল মিশনের সর্বকনিষ্ঠ চিকিৎসক দ্বারকানাথ কোটনিস।
কে এই কোটনিস?
দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিসের জন্ম আজ হতে প্রায় শতবর্ষ আগে মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে। ১৯১০ সালের ১০ অক্টোবর। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের রোষের শিকার হন তিনি। পিতা ছিলেন সূতাকলের শ্রমিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রভাব পড়েছিল পুত্রের ওপর। যখন লালফৌজের জেনারেল চু-তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তদানিন্তন জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র মেডিক্যাল মিশন পাঠাতে মনস্থির করেন তার মধ্যে স্থান করে নেন ২৪ বছর বয়সী দ্বারকানাথ। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কোয়াংচৌতে পৌঁছে তারা বুঝতে পারেন কুয়োমিন্টাং কর্তৃপক্ষ তাদের সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী নয়। স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশও সেখানে ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা ঠিক করেন চীনের দুর্গম উত্তরাঞ্চলে মিশনকে নিয়ে যাওয়া। ইয়েনানে তখন লড়ছে অষ্টম রুট বাহিনী এবং জাপানি আগ্রাসনের ঝাঁজটাও সেখানে বেশি। যদিও মিশন নেতা ডাঃ অটল ছাড়া বাকিদের যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল না কিন্তু সাধারণ সরঞ্জাম এবং সেবা করার ঐকান্তিক আগ্রহকে সম্বল করেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন তারা। ইয়েনানে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ভারতবর্ষ থেকে এল চরম দুসংবাদ! কোটনিস পিতৃহারা হয়েছেন। সকলের আন্তরিক অনুরোধ সত্ত্বেও দেশে ফিরলেন না তরুন ডাক্তার। কারণ তার কাছে ফিরে যাওয়ার অর্থ মৃত পিতার স্বপ্নকেই অসফল করা যার নিকট থেকে দেশপ্রেম আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তরুন পুত্র। মিশন শেষে ফিরে গিয়েছেন সবাই। ফেরেননি একজন। ফেরা সম্ভব ছিল না, কারণ তিনি এতদিনে চীনা জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে নিজের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একাকার করে ফেলেছেন। এক পরাধীন দেশের নাগরিক কোটনিসের কাছে প্রেরনা হয়ে দাঁড়ালো আরেক পরাধীন জাতির অনমনীয় মুক্তিসংগ্রাম। শিখলেন চীনা ভাষা, বিবাহ করলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ অংশগ্রহণকারী তরুণী নার্সিং শিক্ষিকা কুয়োচিন-লানকে ছুটে চললেন এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে। কখনও Bethune International Peace Hospital-এর ডিরেক্টর, কখনও Bethune Hygiene School-এর লেকচারার। এর মাঝে আন্তর্জাতিকতাবাদ, নারীমুক্তির ওপর বক্তব্য রেখেছেন। উৎপাদন অভিযান, শুদ্ধিকরণ, সাংস্কৃতিক কাজে অংশ নিয়েছেন। প্রতিনিয়ত শেখবার চেষ্টা করেছেন জনগণের কাছ থেকে। এভাবেই আসতে আসতে হয়ে উঠলেন অষ্টম রুটবাহিনীর একজন বিশ্বস্ত সৈনিক। ডাঃ বেথুনের বিপ্লবী মানবতাবাদের সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে বাজি রাখলেন জীবন। স্থানীয় মানুষ ভালোবেসে তার নাম দেয় ডাঃ খো, তাদের সুখ দুঃখের সাথী।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আক্রমণ, খাদ্যভাব, ওষুধের অপ্রতুলতা। অপরদিকে জনগণের সর্বাত্মক প্রতিরোধ আর অফুরন্ত ভালোবাসা। মুগ্ধ হয়ে গেলেন ডাঃ কোটনিস। ডাঃ বেথুন নির্দেশিত পথেই ভ্রাম্যমান হাসপাতাল গড়ে ফ্রন্টের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন তিনি। অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে প্রায় ৮০০ আহত সৈন্যের চিকিৎসা করতে সক্ষম হন তিনি। অমানুষিক পরিশ্রম ও সঠিক ওষুধের অভাবে ভেঙে পড়তে থাকে শরীর। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। যদিও বিশ্রাম শব্দটি তার অভিধানে ছিল না। যখনই জাপানি আক্রমন তীব্র হয়েছে, প্রতিরোধ হয়েছে তীব্রতর, হাসপাতাল সরিয়ে নিয়ে যেতে হয় জঙ্গলের গভীরে, পাহাড়ের গুহায়। সঙ্গে চলে চলমান স্কুল। পথ চলতে চলতে শেখে ছাত্রেরা। এরই মধ্যে কোটনিস শেষ করেছেন General Introduction to Surgery, হাত দিয়েছেন Surgery in detail লেখার কাজে। সবই চীনা ভাষায়! মৃত্যুর কয়েকদিন আগে স্ত্রীকে জানাচ্ছেন ‘আমি যদি মরেও যাই তবু আমার দেশের মানুষ এই জেনে খুশি হবেন যে আমি ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্যই প্ৰাণ দিয়েছি' এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪২-এর ৯ ডিসেম্বর প্রায় সেবারত অবস্থাতেই সহযোদ্ধাদের ছেড়ে চলে গেলেন সর্বস্বত্যাগী এই ডাক্তার। বয়স তার তখন মাত্ৰ বত্রিশ।
চীন-ভারত দু-দেশই তাঁকে নিয়ে ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে। লেখা হয়েছে বই। হয়েছে চলচ্চিত্রও। তাঁর জীবনীকার শেন সিয়ান কুং সঠিক ভাবেই কোটনিসকে ‘চীনে এক ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী' বলে চিহ্নিত করেছেন। স্মৃতিচারণে মাদাম সান ইয়াৎ সেন বলেছেন ‘বর্তমানের চাইতে ভবিষ্যত ডাঃ কোটনিসের জন্য বেশি সম্মান অপেক্ষা করছে কারণ এই ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্যই ছিল তাঁর লড়াই। ‘আর কি বলেছিলেন অষ্টম রুট বাহিনীর প্রধান স্বয়ং যার সাথে Ji-chai-ji সীমান্তে Wutai পাহাড়ের কাছে যোগ দিয়েছিলেন ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস?
‘সৈন্যবাহিনী হারালো তাঁর এক আপনজনকে এবং জাতি হারালো তার এক সুহৃদকে। ডাঃ কোটনিসের আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রেরণাকে আমরা যেন কখনও না ভুলি। ‘বক্তার নাম ছিল মাও-সে-তুং।