সেই সব শহীদেরা/ভালোবাসার মানুষ— মুরারি

ভালোবাসার মানুষ- মুরারি

 ‘ভালোবেসে চাঁদ হোয়ো না কো
 পারো যদি সূর্য হয়ে এসো
 আমি সে উত্তাপ নিয়ে নিয়ে
 আঁধার অরণ্য জ্বেলে দেবো।'

 পংক্তিটি প্রায় প্রবাদের পর্যায়ে উন্নীত, যদিও কবির নাম খুব সুপরিচিত নয়। কারণ কবি স্নিগ্ধ চাঁদ, গোলাপের সৌরভ কিংবা পাখির কাকলী ভরা কবিতা বাজারি পত্রিকায় বিকোননি, সমাজবদলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে কবিতার মলোটভ ককটেল হতে গিয়েছিলেন। তাঁকে মাসুল দিতে হয়েছিল স্বপ্ন দেখার। যেমন দিতে হয়েছিল দ্রোণ, আশু, তিমির, অমিয়, সমীর ও আরো অনেককে। এঁরা সকলেই কবিতা লিখতেন, হয়তো বিপ্লবের সঙ্গে কবিতাকে কোথাও মেলাতে চেয়েছিলেন। আরো অনেকের মতোই কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়ও ফিরে আসেননি হাজারিবাগ থেকে। তাঁর হত্যার ৪০ বছর পূর্ণ হল এ বছরে ২৫ জুলাই।

 কবি মুরারি মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ২৫শে মার্চ কলকাতার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। নকশালবাড়ির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠার সময় তাঁর বয়েস মাত্র ২২। আপাতশান্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের দর্শন বিভাগের মেধাবী ছাত্র মুরারি উদাসীন থাকলেন না কৃষক বিদ্রোহের সেই দুরন্ত দ্রোহকালে। তাঁর বাগ্মিতা ও বলিষ্ঠ লেখনী ছিল তারিফ করার মতো।

 আগুনের তাপে উত্তাপ নেবো মোরা
 স্থালিত যুগের চিতায় আগুন জ্বালা;
 শীতের ভাবনা কেঁপে হবে দিশাহারা
 উঠবে শপথ পালাবদলের পালা

 কবিতাঃ পালাবদলের পালা

 বন্ধুমহলে, সহপাঠীদের অত্যন্ত প্রিয় মুরারি গল্প, প্রবন্ধ, কবিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন শোষিত মানুষের কথা। তাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের কথা, শ্রেণীসংগ্রামের কাহিনী। আড়িয়দহ-দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলে ছাত্রযুবকদের মধ্যে অসামান্য দক্ষতায় সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন তিনি। লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা থেকে শুরু করে ফ্রি-কোচিং, ছাত্র-শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি সামাজিক-রাজনৈতিক ভেতর দিয়ে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিলেন নকশালবাড়ির রাজনীতিকে। চারু মজুমদারের ‘গ্রামে চলো” ও ‘শ্রমিক কৃষকদের সাথে একাত্ম হও' আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রামে গোপন কাজ করতে থাকেন তিনি। এই অকুতোভয় তরুণ ততদিন হয়ে উঠেছেন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী, একজন নির্ভরযোগ্য সংগঠক। অনুধাবন করেছেন নকশালবাড়ির আলোকে সশস্ত্র সংগ্রামই এক ও একমাত্র মুক্তির পথ। বাংলা বিহার উড়িষ্যার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির অধীনে ‘আনন্দ' ছদ্মনামে রাজনৈতিক কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন এবং বহরগোড়া-চাকুলিয়া কৃষক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে প্রেরণ করে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই জেল পালানোর মিথ্যা গল্প সাজিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কর্তৃপক্ষ। হত্যা করে তাঁর সঙ্গী আরো ষোলোজন বন্দীকেও ৷

 স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অরবিন্দ পোদ্দার মহাশয় তাঁর ‘রক্তে ভাসে স্বদেশ সময়' লেখাটিতে শহীদ মুরারির কবি প্রতিভাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন। তাঁর ভাষায় ‘ভালোবাসা কবিতাটি পাঠ করতে করতে কাব্যের সৌন্দর্যের মধ্যে সংকল্পের সংহত শক্তির প্রকাশ দেখে বিস্মিত হলাম। ওই কবিতার শেষ অংশটি এই রকম-

 চাঁদ, নদী, ফুল, তারা, পাখি
 দেখা যাবে কিছুকাল পরে
 কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি
 এখন আগুন চাই আমাদের এই কুঁড়েঘরে।

আগুনের খোঁজে মুরারি ও তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী অসংখ্য সহযোদ্ধার লড়াই আজো থামেনি। আজো এই বিপ্লবীর কবিতা নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীদের প্রেরণা জোগায়, প্রাণশক্তি সঞ্চার করে। এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তিনি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড হতে চেয়েছিলেন। সেই ভালোবাসাকে ভয় করেছিল শাসকশ্রেণী যা বজ্র হয়ে দিকে দিকে লড়াইয়ের বার্তা ছুঁড়ে দিয়েছিল। বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে কিন্তু স্বপ্ন মরে না, জনগণের জন্য শোষণহীন ভারতবর্ষ গড়ার আপাত অসম্ভব স্বপ্ন দেখা এই তরুণের মৃত্যু প্রকাণ্ড হিমালয়ের ওজনের চাইতেও বহু বহু গুন ভারি। প্রতিক্রিয়াশীল শাসক জেলের অভ্যন্তরে কাপুরুষের মতো তাঁকে হত্যা করেছে, তাতে কী? বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে গেছেন তিনি, তাঁর বিনাশ নেই।

 ‘কবিতার জ্বলন্ত মশাল
 কবিতার মলোটভ ককটেল
 কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা
 এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক। '
 [এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না- নবারুণ ভট্টাচার্য]

গণসংস্কৃতি, জুলাই, 2011