সেই সব শহীদেরা/আগুনের কবি অতো রেনে কাস্তাইয়ো
আগুনের কবি অতো রেনে কাস্তাইয়ো
‘তোমার আছে বন্দুক
আর আমার আছে ক্ষুধা'
ক্ষুধার কারণেই বোধহয় সব থেকে বেশি বন্দুকের প্রয়োজন হয়। শাসক ভয় পায় ক্ষুধাকে। সাদাত হোসেন মান্টোর কথায় ‘ক্ষুধা মানুষকে চরমপন্থী করে তোলে' আর কে না জানে শাসক চরমপন্থীদের ভীষণ ভয় করে। সর্বগ্রাসী খিদের আগুন যখন দাউদাউ জ্বলে তখন বন্দুক কেন, হাজার কামান, বিমান, মাইন, বন্দীশালা, ফাঁসিকাঠ কিছুই তাকে দমাতে পারে না। এ কথাই কবিতায় বলে গিয়েছিলেন অতো রেনে কাস্তাইয়ো।
গুয়াতেমালার বিপ্লবী কবি অতো জন্মগ্রহণ করেন ‘কোয়েতজালতেনাঙ্গো' নামক একটি স্থানে, ১৯৩৪ সালের ২৫ এপ্রিল, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিপ্লবী রাজনীতিতে আকৃষ্ট অতো লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। আঠারো বছর বয়সে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পরিচালনার পাশাপাশি চলতে থাকে কবিতা লেখা, যেগুলি দেশের তরুন সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর তিনি গুয়াতেমালা ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠনের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছেন, ততদিনে তাঁর কবিতা সমীহ আদায় করে নিয়েছে সে দেশের নামকরা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের। ১৯৫৪ সালে চক্রান্ত করে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে আরবেনজ সরকারের পতন ঘটায় CIA, গণতন্ত্রের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট আক্রমন। অনেকের সঙ্গে স্বদেশচ্যুত অতো আশ্রয় নেন এলসালভাদোরে। এসময় তাঁকে অসম্ভব পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। শ্রমিক, সেলসম্যান, ক্লার্ক ইত্যাদি সব রকম পেশাতেই যুক্ত থেকেছেন। এতো কষ্টের মধ্যেও ছাড়েননি কবিতা লেখা আর অধ্যয়ন। লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমাটোগ্রাফ নিয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাঁর আসল প্রেম ছিল কবিতা। জীবন ছিল ভ্রাম্যমান, পুরষ্কারও জুটেছে প্রচুর তাই বলে বিষদাঁতহীন বুদ্ধিজীবী হয়ে আরামে জীবন কাটিয়ে দেননি অতো রেনে কাস্তাইয়ো উল্টে তাঁর কবিতা আঙুল তুলেছে সেইসব মেরুদণ্ডহীনদের প্রতি-
'What did you do, when the poor
suffered, when tenderness and life
burned out of them?
apolitical intellectuals
of my sweet country, you will not be
able to answer'
তাঁর কবিতা প্রভাবিত করেছিল পাবলো নেরুদাকেও। পরবর্তীতে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। তাঁর কবিতা প্রেরণা হয়েছে সেই সমস্ত দেশের লড়াকু মানুষদের। আকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন জানিয়েছেন সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামকে। রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত, সামরিক শাসন, বিক্ষোভ-বিদ্রোহে উত্তাল গুয়াতেমালার স্বাধীনতা যুদ্ধ আর অন্য পরাধীন দেশের মুক্তিসংগ্রাম তাঁর কাছে আলাদা মনে হয়নি। অবস্থা কিছুটা প্রশমিত হলে স্বদেশে ফিরে অতো যোগ দেন রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক আন্দোলনে। সান কার্লোস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াও সম্পন্ন করে ফেলেন একটা সময়। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্টাডি সার্কেল। প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বইগুলি। ১৯৫৯ এ স্কলারশিপ পেয়ে এল সালভাদোর যাত্রা। কারারুদ্ধ হয়েছেন ৬৪ সালে। মুক্তি পেয়ে আবার অজানার খোঁজে পাড়ি, কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না। যেখানেই যান একটি দিনের জন্যেও ভুলতে পারেননি তিনি প্রিয় মাতৃভূমি গুয়াতেমালাকে। ফ্যাসিস্ট শাসনে বিপর্যস্ত সেই দেশে তখন গোপনে গড়ে উঠছে বিপ্লবী সংগঠন। জনগণের একটি অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছে প্রতিরোধী যুক্তফ্রণ্ট তৈরির কাজে। এমনই এক সন্ধিক্ষণে ১৯৬৬ সালে গোপনে স্বদেশে ফেরত আসেন অতো রেনে কাস্তাইয়ো। না, সে সময় তিনি আর শুধু সাধারণ কবি নন, শাসকের রক্তে কাঁপন-ধরানো পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা! নাম লিখিয়েছেন গেরিলা বাহিনী ‘রিবেল আর্মড ফোর্সে'। জানা যায় জাকাপা পর্বত্য অঞ্চলে তাঁর পরিচালনায় কয়েকটি সফল অভিযান করে এই বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ১৯ মার্চ তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ধরা পড়লেন সেনাবাহিনীর হাতে। কয়েকদিন বন্দী অবস্থায় অমানুষিক অত্যাচারের পর অতো ও তাঁর কমরেডদের জাকাপা বন্দীশালাতেই জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
কী আশ্চর্য! সেই দিনটিও ছিল ২৩ মার্চ! ৩৬ বছর আগের এমনই একদিনে ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামের অবিসংবাদিত নায়ক সর্দার ভগৎ সিং-কে কারাবিধি লঙ্ঘন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং গোপনে তাঁর ও তাঁর সাথীদের দেহগুলিকে পুড়িয়ে লোপাট করার ব্যবস্থা করে সাম্রাজ্যবাদী সরকার। ইতিহাস বোধহয় শহীদের জীবনীতেই সব থেকে বেশি পুনরাবৃত্ত হয়।
কবি এবং যোদ্ধা, দুই ভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। সমাজে তাঁদের অবস্থানও দুই বিপরীত মেরুতে। এঁদের মধ্যে মিলের চাইতে অমিলই বেশি। কিন্তু একবার যদি এই দুই বিপরীতমুখী সত্তা একদেহে লীন হয়ে যায় তবে তা শাসক ও শোষকশ্রেণীর কাছে মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই শাসক সরোজ দত্তের বিচারের প্রহসনটাও করার সাহস পায়নি। কাপুরুষের মতো হত্যা করেছে সুব্বারাও পানিগ্রাহীকে, খুন করা হয় কবি লোরকাকে। বিচারের প্রহসনান্তে একইভাবে মারা হয় বুলগেরিয়ার শ্রমিক কবি নিকোলাস ভ্যাপসারভকে। অতো রেনে কাস্তাইয়ো ছিলেন এঁদেরই মতো আরেক নির্ভীক সৈনিক।
এত হত্যা করে কি কবির কণ্ঠরোধ করা গেছে? ক্ষুধাকে দমন করা গেছে রক্তপাতের ভয় দেখিয়ে? উত্তরটি কবি অতো দিয়ে গেছেন-
তবু শেষটায়
আমার কিন্তু চিরকাল থাকবে
তোমার চেয়ে বেশি হাতিয়ার
যদি তোমার থাকে বন্দুক
আর আমার কেবল ক্ষুধা।