সেই সব শহীদেরা/আফগান নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্নিশিখা মীনা কেশওয়ার কামাল

আফগান নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্নিশিখা
মীনা কেশওয়ার কামাল

 I am the women who has awoken
 I have arisen and become a temptest through
 the ashes of my brunt children
 I have arisen from the rivulets of my brother's
blood....
 I have found my path and will never return

 কবিতাটির লেখিকা নিশ্চিতভাবেই তাঁর পথ খুজে নিয়েছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের মাঝে, গণবিপ্লবের সরণীতে এবং শেষ পংক্তির মতো সত্যিই আর ফিরে আসেননি কারণ তাঁকে জীবন দিতে হয় ঘাতকের বুলেটে। মধ্যযুগীয় শাসন ও ধর্মের নামে ভয়াবহ হিংস্রতার বিচারে প্রথম সারিতে যে দেশগুলির নাম উঠে আসে, আফগানিস্তান তাঁদের অন্যতম। জন্মলগ্ন থেকে ধর্মীয় কু-শাসনের নিগড়ে বাঁধা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির ভাগ-বাঁটোয়ারা, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদিতে অর্থনৈতিকভাবে চুড়ান্ত বিপর্যস্ত, ক্ষতবিক্ষত এই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিশুহত্যা, নারীহত্যা অতি সাধারণ ঘটনা। তালিবাণী অপশাসনে নারীদের অবস্থা কি মর্মান্তিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘নারী স্বাধীনতা' শব্দটিই সেখানে অলীক কল্পনা মাত্ৰ!

 সাউর রেভোলিউশন (৭৮ সালের ক্যু-দেতাকে এই নামে ডাকা হয়ে থাকে) ক্ষমতার হাতবদল ঘটায় বটে কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন কিছুই হয়নি। উপরন্তু নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি পরিচালিত পুতুল সরকার উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে পরিশেষে যা রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ফলতঃ নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটা বরাবরের মতো অবহেলিতই থেকে গেছে যুদ্ধবিগ্রহ, অভ্যন্তরীণ বিবাদে শতদীর্ণ আফগানিস্তানে। সে দেশ রূপ নিয়েছে বধ্যভূমির। বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। তবে বধ্যভূমিতেও গোলাপ ফোটে। শাসন নিপীড়নের প্রাবল্য উপেক্ষা করে প্রতিবাদের জন্ম হয় নিজস্ব নিয়মে জীবন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। করবেই। আর জীবন দিয়ে এই কথাটির প্রতিষ্ঠা দিয়ে যান আফগান নারীমুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী মীনা কেশওয়ার কামাল।

 মীনার জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী কাবুলে। স্কুলজীবন থেকে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। শুধু নারী অধিকারের দাবীতেই নয় অন্যান্য সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিল তাঁর স্বচ্ছল পদচারণা। তিনি ছিলেন একধারে কবি, সমাজকর্মী ও মানবাধিকার আন্দোলনের একজন আপোষহীন সেনানী। মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন গড়ে তুলেছিলেন Revolutionary Association of the Women of Afghanistan (RAWA), অল্প কিছুকালের মধ্যে যা হয়ে উঠল দেশের সর্বাগ্রগণ্য প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন। ১৯৮১ সাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকে একটি দ্বিভাষিক পত্রিকা পায়াম-ই-জান যেখানে দেশীয় মৌলবাদ ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালান মীনা ও তাঁর সহযোগীরা। পরবর্তীতে তিনি বিবাহ করেছেন আফগানিস্তান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট কর্মী ফয়েজ আহমেদকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ডঃ ফয়েজ আহমেদকেও ১৯৮৬ সালে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নৃশংসভাবে খুন করে। শুধুমাত্র রাজনীতিতেই মীনার কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি, উদবাস্তু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হসপিটাল, মহিলাদের জন্য কুটির শিল্পকেন্দ্র স্থাপনা ইত্যাকার সামাজিক কাজ তাঁকে দিল অভাবনীয় জনসমর্থন যা শঙ্কিত করে তুলল তালিবানী গোষ্ঠীগুলিকে।

 আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বদেশের নারীদের কথা তুলে ধরে তিনি তৎকালীন পুতুল সরকার তথা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদেরও মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠলেন যার জন্য তাঁকে CIA এর দালাল, অতিবাম-নৈরাজ্যবাদী প্রভৃতি নানাবিধ হাস্যকর কুৎসারও সম্মুখীন হতে হয়েছে।

 অবশেষে, ১৯৭৮-এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী KGB মদতপুষ্ট সিক্রেট পুলিশ KHAD-এর গুন্ডাবাহিনী ও ভাড়াটে মৌলবাদী জঙ্গীরা মীনাকে হত্যা করল নিজ বাসভবনে, পাকিস্তানের কোয়েত্তা-তে। গনতন্ত্র, নারীমুক্তি ও স্বাধীনতার দাবিতে এক যুগ ধরে বিরামহীনভাবে কাজ করে চলা মীনা কেশওয়ার কামাল এভাবেই প্রাণ দিলেন মানবতার শত্রুদের হাতে। মাত্র ত্ৰিশ বছর বয়সে! আফগান মহিলাদের ঘুমন্ত সিংহর সাথে তুলনা করেছিলেন এই বিপ্লবী রমণী, যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া দেশে প্রকৃত বিপ্লব সম্ভব নয় একথা সঠিকভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি।

 ঔপনিবেশিক শক্তি দেশীয় মৌলবাদী বর্বরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে এবং করছে আরো অগণিত বিপ্লবীকে। কমিউনিজমের আড়ালে পররাজ্যলোভী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে এখন সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ স্ব-মহিমায় অধিষ্ঠিত। ঘটে চলেছে একের পর এক যুদ্ধাপরাধ, ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার। কিন্তু স্বপ্ন মরে না, মীনার সাথীরা ও অসংখ্য বিপ্লবী যোদ্ধা দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ। আজও যখন 'কাবুলিওয়ালার দেশে কোনো প্রতিবাদ- প্রতিরোধ হয়, মুষ্টিমেয় গেরিলার ভয়ে থমকে দাঁড়ায় ‘বিশ্বজয়ী' মার্কিন কনভয় কিংবা বোরখা ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় নামেন বিদ্রোহী নারীরা, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই বহন করেন তাঁদের পূর্বসূরি শহীদ মীনা কেশওয়ার কামালের সংগ্রামী চেতনা।

মানবী এখন, মার্চ, ২০১২