সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/বেরোনা নগরের দুই সম্ভ্রান্ত

R. D. SORNOKAR, ENGR
২৪৯

বেরোনা নগরের দুই সম্ভ্রান্ত।

বেরোনা নগরের দুই সম্ভ্রান্ত


 প্রসিদ্ধ বেরোনা নগরী মধ্যে বালেন্তাইন্ ও প্রোতিয়স নামে দুই জন সম্ভ্রান্ত যুবা বসতি করিতেন। তাঁহাদের বহু কালাবধি পরস্পর সাতিশয় সৌহৃদ্য ছিল। সর্ব্বদা একত্র অধিবেশন পুরঃসর বিশ্রম্ভালাপ ও অধ্যয়নাদি করিতেন। কিয়ৎ কাল পরে প্রোতিয়স জুলিয়া নামী পরম রূপবতী এক যুবতীর প্রতি আসক্ত হইলেন সুতরাং এক দিন বন্ধুকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক একাকী কামিনীর সহিত সাক্ষাৎ করণার্থ গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার নায়িকানুরাগ এবং তদনুরোধে বয়স্যের সহিত অদর্শন ক্রমে ব্যাপক হইতে লাগিল অতএব পরস্পরের অন্তঃকরণে পূর্ব্ব ভাবের পরিবর্ত্তন হইয়া ভাবান্তরের আবির্ভাব হইবার উপক্রম হইল। বালেন্তাইন্ মিত্রের প্রমুখাৎ তদীয় মনোভাবিনী ভাবিনীর গুণানুবাদ সর্ব্বদা শ্রবণ করিতেন কিন্তু তাহাতে হর্ষ বা ঔৎসুক্য প্রকাশ না করিয়া বরং বৈরক্তি ভাব ব্যক্ত করিতেন এবং কখনই সহাস্য আস্যে প্রেম পদার্থকে পরম বৈরী বলিয়া পরিহাস পূর্ব্বক কহিতেন মিত্র আমার মনে নিরর্থক প্রণয়ভাবনা যেন কদাপি লব্ধাবকাশ না হয়, বয়স্য প্রেমজন্য তোমার চিত্তোচ্চাটন এবং মানসিক মহেদ্বেগ বিবেচনা করাতে আমার নির্বিকার অন্তঃকরণ অতিশয় সুখদায়ক বোধ হইতেছে।

 বালেন্তাইন্ দেশ ভ্রমণে কৃতমানস হইয়া এক দিবস প্রত্যুষে প্রিয় সুহৃৎ প্রোতিয়সের সমীপে গমন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন সখা কিয়ৎ কালের নিমিত্ত বিদায় প্রার্থনা করি মিলান্ নগরে যাত্রা করিব সংকল্প করিয়াছি। প্রোতিয়স এ কথায় তটস্থ হইয়া বয়স্য বিয়োগ ভয়ে নানা প্রকারে বারণ করিতে লাগিলেন। তাহাতে বালেন্তাইন্ প্রতিবচন প্রদান করিলেন মিত্র আমার যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা করিতে যত্ন করিও না, অলস লোকের তুল্য গৃহপঞ্জরে বদ্ধ থাকিয়া জীবন ক্ষয় করিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। প্রিয়তম, পুরুষ কূপমণ্ডকের ন্যায় চিরকাল এক স্থানে অবস্থিতি করিলে কুবুদ্ধির উদয়ে অবসন্ন হয়, বিচিত্র জগতের বিবিধ আশ্চর্য্য বস্তু অবলোকন করিয়া জন্ম সফল করিতে পারে না। বন্ধো যদিস্যাৎ তুমি জুলিয়ার প্রেমে বিমোহিত না হইতে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতাম। তুমি ভাবিনীর ভাবে বিমুগ্ধ হইয়াছ এখন তাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবে না। সুতরাং সমভিব্যাহারি হইতে অনুরোধ করা বৃথা অতএব তুমি প্রেম লইয়া থাক, আমাকে বিদায় দাও, প্রার্থনা করি তোমার প্রেম সুখ দায়ক হউক।

 বালেন্তাইন্ এবম্প্রকার অনুযোগ করিয়া তদনন্তর মিষ্টালাপ করত বিদায় হইলেন। প্রোতিয়স্ প্রণয়িনীর নবীন প্রেমে আসক্ততা প্রযুক্ত সমভিব্যাহারী হইতে না পারিয়া স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক এতাবন্মাত্র কহিলেন বয়স্য বিদায় হইলে হও কিন্তু দেশ পর্য্যটন করিতে২ যখন কোন অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিবে তখন আমাকে স্মরণ করিয়া আপন সুখের অংশী করিও।

 বালেন্তাইন্ বয়স্যের সকাশাৎ বিদায় গ্রহণ পুরঃসর মিলান্ নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রোতিয়সও বন্ধু হইতে পৃথক্ হইয়া চিত্তবিলাসিনী ভাবিনীর ভাবনায় নিমগ্ন হইলেন। অনন্তর কামিনীর প্রণয় জিজ্ঞাসার্থ ব্যস্ত হইয়া তাঁহার নিকট এক খানি লিপি প্রেরণের মানস করত লিখিতে আরম্ভ করিলেন এবং লিপি সমাপ্ত হইলে অবিলম্বে জুলিয়ার দাসী লুসেতার দ্বারা পাঠাইয়া দিলেন।

 জুলিয়া প্রোতিয়সের প্রতি মনে সাতিশয় অনুরাগবতী ছিলেন কিন্তু সুবুদ্ধি ও বিজ্ঞতা প্রযুক্ত আপনার প্রণয় প্রকাশ করেন নাই। বিবেচনা করিয়াছিলেন কুমারী হইয়া ত্বরায় অনুরাগ ব্যক্ত করা উপযুক্ত নয়। অতএব নায়ক তাঁহার সহিত সংপ্রীতির বাসনা করেন তাহা যেন অবগত নহেন এবম্বিধ ভাব প্রকটন পুরঃসর কপট ব্যবহার করিতেন। সুতরাং প্রোতিয়স্ অন্তঃকরণ মধ্যে সাতিশয় ব্যাকুল হইতেছিলেন।

 লুসেতা লিপি গ্রহণ পূর্ব্বক জুলিয়ার নিকট আসিল এবং কামিনীর করে সমর্পণ করিয়া কহিল প্রোতিয়স্ এই পত্র পাঠাইয়া দিলেন। যুবতী প্রোতিয়সের নাম শ্রবণে সাতিশয় কোপ প্রকাশ করিলেন এবং দাসীর হস্তে লিপি প্রত্যর্পণ পুর্ব্বক তাহাকে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন তুই কি নিমিত্ত প্রোতিয়সের পত্র লইয়া আসিলি? যা, তোর মুখাবলোকন করিব না, এখনই বাহিরে গমন কর্। কিন্তু কিঙ্করী ভবন হইতে নির্গত হইলে লিপ্যর্থ অবগত হইবার নিমিত্ত মনে২ মহা ব্যস্ত হইলেন অতএব, অবিলম্বে তাহাকে নিকটে আহ্বান করিলেন। সে সমক্ষে আসিয়া উপস্থিতা হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন এখন বেলা কত? লুসেতা মনে২ বিবেচনা করিল এতৎ প্রশ্ন ছল মাত্র, লিপি পাঠ করিতে ঠাকুরাণীর অভিলাষ আছে, অতএব ঐ কথায় কোন উত্তর না দিয়া পুনুর্বার সেই পত্র খানি তাঁহার হস্তে অর্পণ করিল। কিন্তু জুলিয়া আপনার অভিপ্রায় দাসী বুঝিতে পারিল বলিয়া ক্রোধে প্রজ্বলিত হইলেন এবং রোষাবেগে তাহার সমক্ষে সেই লিপি খণ্ড ২ করিয়া তৎক্ষণাৎ ভূমিতে ফেলিয়া দিলেন। পরে কিঙ্করীকে তিরস্কার করত কহিলেন অরে পাপীয়সি ত্বরায় এস্থান পরিত্যাগ কর্। লুসেতা কর্ত্রীর ক্রোধ দর্শনে শঙ্কিত হইল এবং শীঘ্র সে স্থান হইতে প্রস্থান করিবার মানসে ছিন্ন লিপি কুড়াইতে লাগিল। জুলিয়া লিপি খণ্ড পাঠ করিয়া নায়কের অভিপ্রায় বিদিত হইতে ইচ্ছাম্বিতা ছিলেন অতএব কোপভরে দাসীকে পুনর্ব্বার কহিলেন অবিলম্বে আমার দৃষ্টি পথের বহির্ভূত হ, ছিন্ন লিপি পড়িয়া থাকুক, পুনর্ব্বার উহা স্পর্শ করিতে দেখিয়া আমার ক্রোধ বাড়িতেছে।

 এবম্প্রকার তর্জ্জনে কর্ম্মকরী সত্বর প্রস্থান করিলে জুলিয়া লিপি খণ্ড সকল উত্তোলন পূর্ব্বক একত্র সংকলন করিতে লাগিলেন তাহাতে প্রথমতঃ এই কএকটী শব্দ যোগ করিয়া পাঠ করিলেন যথা “প্রণয় নিহত প্রোতিয়স্” পরে অন্যান্য ক্ষুদ্র খণ্ড একত্র সংযোগ করাতে তাহাতেও প্রেম সূচক পদ পাঠ করিয়া বিলাপ করত কহিলেন হায় এই সকল প্রেমপদ আমা হইতে এরূপে আঘাত প্রাপ্ত হইল যাবৎ ইহাদের ক্ষত প্রতীকার না হয় তাবৎ আপনার হৃদয় শয়নে শয়ান করিয়া রাখি এবং প্রত্যেক খণ্ডকে চুম্বন করিয়া আপন ত্রুটির প্রায়শ্চিত্ত করি।

 কামিনী এবম্প্রকারে অবোধ বালিকার তুল্য আপনা আপনি বিলাপ করিতে লাগিলেন। গ্রিয়তমের পত্রীস্থ স্নেহ সূচক পদ সকল স্বয়ং বিনষ্ট করাতে আপনাতে কৃতঘ্ন জ্ঞান হইতে লাগিল। লিপির ক্ষুদ্র২ খণ্ডে নেত্রপাত পুরঃসর যত মর্ম্মাববোধে অসমর্থ হইলেন ততই আপনার প্রতি অনর্গল ধিক্কার বাক্য মুখ হইতে বিনির্গত হইল। অনন্তর কাল বিলম্বে অসহিষ্ণু হইয়া সাতিশস্ত্র প্রণয় প্রকাশক এক লিপি স্বহস্তে লিখিলেন এবং ত্বরায় নায়কের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

 প্রোতিয়স্ প্রেয়সীর সকাশাৎ প্রত্যুত্তর পত্রী প্রাপ্ত হইয়া সাতিশয় উল্লাসিত হইলেন। মুকুলিত করণানন্তর পাঠ করিতে২ তাঁহার ঈদৃশ আনন্দোদয় হইল যে হর্ষাবেগ সম্বরণে অসমর্থ হইয়া উচ্চ স্বরে পরস্পর অসম্বদ্ধ এই কএকটী পদ উচ্চারণ করিলেন হায় সুধাভিষিক্ত প্রেম, অহা কি মধুর রচন, মনোহর জীবন। যুবক এইরূপে আহ্লাদ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহার পিতা কহিলেন প্রোতিয়স্ ও কি? কাহার লিপি পাঠ করিলে? জনকের এতদ্বচনে তাঁহার আনন্দানুভবে হঠাৎ যেন ব্যাঘাত হইল।

 প্রোতিয়স্ প্রকৃত বিষয় গোপন পূর্ব্বক পিতার কথায় উত্তর করিলেন তাত এতল্লিপি মিলান্ নগর হইতে আসিয়াছে, মদীয় হৃদয়ঙ্গম বয়স্য বালেন্তাইন্ পাঠাইয়া দিয়াছেন।

 তাঁহার পিতা কহিলেন তবে পত্রখান একবার আমার হস্তে প্রদান কর, কি সংবাদ আছে পাঠ করিয়া দেখি।

 প্রোতিয়স্ অন্তঃকরণ মধ্যে সাতিশয় ভীত হইয়া কহিতে লাগিলেন পিতঃ ইহাতে এমন কোন সমাচার নাই, বন্ধু এতাবন্মাত্র লিখিয়াছেন মিলান্ নগরাধিপতির প্রিয় পাত্র হইয়া তন্নিকটে প্রতিদিন অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইতেছি। অপর আমিও তাঁহার সঙ্গী হইয়া তদীয় সৌভাগ্যের ভাগী হই ঈদৃশী বাসন প্রকাশ করিয়াছেন।

 পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার মানস কি? তাঁহার অভিলাষ পূর্ণ করিতে চাহ!

 প্রোতিয়স্ বিনীতভাবে প্রতিবচন প্রদান করিলেন প্রভো আমি আপনকার আজ্ঞানুবর্ত্তী, বয়স্যের বাসনানুসারে কার্য্য করি না।

 তদনন্তর এক দিন প্রোতিয়সের পিতা আপনার এক জন বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ঐ বিষয়ের প্রসঙ্গ করত কথোপকথন করিতে লাগিলেন তাহাতে তদীয় বয়স্য বলিলেন কি আশ্চর্য্য আপনি উপযুক্ত সন্তানকে নিরন্তর কেবল বাটীতে রাখিয়া তাহার বয়স্ বৃথা ক্ষয় করাইতেছেন? প্রায় তাবৎ মহৎ লোকেরা স্ব২ তনয়ের বুদ্ধি বৃদ্ধি ও উচ্চ পদ প্রাপ্তি নিমিত্ত তাহাদিগকে বিদেশে পাঠাইয়া দিয়া থাকেন। কেহ২ আপনার নন্দনকে যুদ্ধে কেহ বা দূর স্থিত উপদ্বীপাদি দর্শনে কেহ বা ভিন্ন দেশীয় চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন নিমিত্ত প্রেরণ করেন। আপনার পুত্রের মিত্র বালেন্তাইন কিয়ৎ কাল হইল মিলান্ নগরীয় নরপতির সভায় গমন করিয়াছেন। আপনকার পুত্র উপযুক্ত হইয়াছে। এখন যদি তাহাকে নিরন্তর সদনে রাখিয়া অনর্থক যৌবনকাল যাপন করিতে দেন তাহা হইলে পরে চরম বয়সে তাহার পক্ষে পরম ক্ষতির সম্ভাবনা।

 প্রোতিয়সের পিতা বয়স্যের এই সমস্ত উক্তি অতি সদযুক্তি বোধ করিলেন এবং তাঁহার স্মরণ হইল তনয়ের মিত্র বালেন্তাইন স্বীয় সখাকে আত্ম সৌভাগ্যের ভাগী করিতে বাসনা করেন অতএব সন্তানকে মিলান্ নগরে প্রেরণ করিবার সংকল্প করিলেন। বৃদ্ধ আত্মজকে আপনার সহিত কোন বিষয়ে বাদানুবাদ করিতে কদাপি স্বাধীনতা দেন নাই সুতরাং সংকল্পের বিষয় তাহাকে না কহিয়া এক দিন একেবারে আজ্ঞা করিলেন প্রোতিয়স্ তোমার মিত্র বালেন্তাইনের যাদৃশী বাসনা আমারও তাদৃশ অভিলাষ। এতদ্বিষয়ে যুবা বিস্ময় প্রকাশ করিলে তাহাকে কহিলেন বৎস মিলান নগরের রাজসভায় আমি তোমাকে প্রেরণ করিতে মনস্থ করিয়াছি এতন্নিমিত্ত বিস্ময়াপন্ন হইও না, আমার যাহা মানস হয় নিঃসন্দেই সম্পূর্ণ করি অতএব এ বিষয়ে কোন আপত্তি করিও না, আমার প্রতিজ্ঞা অচল, কল্য যাত্রা করিতে হইবে, এখনি গিয়া প্রস্তুত হও।

 প্রোতিয়স বিবেচনা করিলেন জনকের অজ্ঞায় আপত্তি করিয়া কদাপি কোন ফল দেখি নাই তাঁহার যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই করেন কাহারও অনুরোধ রক্ষা করেন না। অতএব আপনারই দোষ দিয়া খেদ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, হায় পিতার নিকট জুলিয়ার লিপি সংগোপন করিয়া কেন মিথ্যা কহিয়াছিলাম, আমি আত্ম দোষে প্রেয়সীর সহিত বিচ্ছেদ ঘটাইলাম।

 অনন্তর প্রেয়সী জুলিয়ার আলয়ে গমন পূর্ব্বক তাঁহার সন্নিধানে বিষণ্ণ বদনে জনকের আদেশ ব্যক্ত করিলেন। তাহাতে নবানুরাগিণী রমণী প্রিয়তমের সহিত ব্যাপক কাল বিচ্ছেদ হইল বিবেচনা করিয়া সাতিশয় খিন্না হইলেন। প্রথম২ কপটতা পূর্ব্বক নায়কের প্রতিকূলতা করিতেন এক্ষণে মুক্তকণ্ঠে প্রণয়নুরাগ ব্যক্ত করিতে লাগিলেন সুতরাং উভয়ে বিস্তর বিশ্রম্ভালাপ হইল। পরে অপ্রসন্ন মনে পরস্পর বিদায় গ্রহণ পুরঃসর অন্যোন্যের স্মরণ নিমিত্ত অঙ্গুরী বিনিময় করিয়া স্ব২ অঙ্গুলি পর্ব্বে পরম যত্নে ধারণ করিলেন। প্রোতিয়স্ এই রূপে প্রণয়িনীর নিকট বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক পিতার আজ্ঞাক্রমে মিলান্ নগরে যাত্রা করিয়া প্রিয় সুহৃদ্ বালেন্তাইনের নিকট গমন করিলেন।

 প্রোতিয়স্ পিতার সমীপে কল্পনা করিয়া কহিয়াছিলেন মিত্র মিলানাধিপতির অতিশয় প্রিয়পাত্র হইয়াছেন তথায় উপস্থিত হইয়া বস্তুতঃ তাঁহার তদ্রূপ খ্যাতি প্রতিপত্তি দেখিতে পাইলেন, এতদ্ব্যতীত অন্য এক অদ্ভুত অচিন্ত্য ঘটনা অবলোকিত হইল, ইহাতে সাতিশয় বিস্ময়াকুল হইলেন। বালেন্তাইন্ সর্ব্বদা গর্ব্ব করিয়া কহিতেন কদাপি প্রেমের বশতাপন্ন হইবেন না, সে স্থলে দৃষ্ট হইল নায়িকার প্রণয়ে একেবারে উন্মত্ত হইয়াছেন।

 মিলনাধিপতির দুহিতা সিল্‌বিয়া বালেন্তাইনের প্রতি আসক্তা হইয়া আত্ম প্রেমনিগড়ে তাঁহাকে বন্ধন পূর্ব্বক তদীয় মতের পরিবর্ত্ত করেন কিন্তু তাঁহাদের প্রণয়নুরাগ নরপতির সুগোচর ছিল না। যদিও ভূপাল বালেন্তাইনের প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ পুরঃসর সর্ব্বদা তাঁহাকে নিমস্ত্রণ করিয়া রাজসদনে গমনাগমন করিতে দিতেন তথাপি তনয়ার বরপাত্র করিতে মানস করেন নাই, থুরিও নামক এক যুবককে কন্যা সম্প্রদান করিবেন ধার্য্য করিয়াছিলেন। কিন্তু রাজনন্দিনী বালেন্তাইনের প্রতি অনুরাগিণী হইয়া থুরিওকে ঘৃণা করিতে লাগিলেন কারণ ঐ ব্যক্তিতে নায়কের তুল্য রূপ লাবণ্য ও সুবুদ্ধি সগুণ কিঞ্চিন্মাত্র দেখিতে পান নাই।

 এক দিবস থুরিও এবং বালেন্তাইন্ উভয়ে মিলিত হইয়া নৃপবালা সিলবিয়ার সহিত সাক্ষাৎ করণাশয়ে তদীয় আলয়ে গমন করিলেন। সেখানে উপস্থিত হইয়া থুরিও রাজনন্দিনীর সমক্ষে যে২ কথা কহিলেন বালেন্তাইন্ তাহতে পরিহাস করত কুমারীকে প্রমুদিত করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে মিলানেশ্বর ঐ স্থানে উপনীত হইয়া বালেন্তাইনকে তদীয় মিত্র প্রোতিয়সের আগমন সংবাদ কহিলেন। বালেন্তাইন্ এতদ্বার্ত্তায় মহা আহ্লাদিত হইয়া মনে২ কহিতে লাগিলেন আমার অতিশয় বাসনা ছিল এস্থানে হৃদয়ঙ্গম সুহৃদের দর্শন প্রাপ্ত হই। পরে নৃপতি সমীপে তদীয় বিস্তর প্রশংসা করিয়া বলিলেন মহারাজ আমি বরং অনেক সময় অনর্থক ক্ষেপণ করিয়াছি মদীয় সখা সর্ব্ব ক্ষণ কেবল গুণোপার্জ্জনে নিযুক্ত ছিলেন অতএব সম্ভ্রান্ত সদ্বংশীয় লোকদের যে সমস্ত সদ্‌গুণ প্রয়োজনীয়, আমার বন্ধুতে তাহার কিঞ্চিন্মামাত্র অভাব নাই।


 মিলানাধিপতি এতাবৎ শ্রবণে স্বীয় নন্দিনী ও থুরিওকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন সেই যুবা যাদৃশ গুণ ভূষিত তাঁহার তদনুরূপ সমাদর করিও। পরে বালেন্তাইনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ পুরঃসর বলিলেন তোমাকে কিছু কহিতে হইবেক না আপন বন্ধুর অভ্যর্থনা অবশ্যই করিবে। ভূপাল এই কথা বলিয়া প্রস্থান করিলে প্রোতিয়স্ পুরীমধ্যে প্রবেশিত হইয়া তাঁহাদের সমীপে আনীত হইলেন সুতরাং পূর্ব্বে যে সকল কথোপকথন হইতেছিল তাহাতে ব্যাঘাত পড়িল। বালেন্তাইন্ রাজকুমারীর নিকট বয়স্যের পরিচয় দিয়া কহিলেন সুন্দরী এই যুবককে আমার তুল্য কিঙ্কর করিতে আজ্ঞা হয়।

 এইরূপে অন্যান্য সকলের সহিত প্রোতিয়সের সাক্ষাৎ হইলে পর দুই মিত্রে নির্জ্জনে অধিবেশন পূর্ব্বক কথোপকথন করিতে লাগিলেন। বালেন্তাইন্ হর্ষোৎফুল্ল হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য সমাচার কি? তোমার চিত্তবিলাসিনী জুলিয়া কেমন্ আছেন? তাঁহার সহিত তোমার প্রীতির কি রূপ উন্নতি হইতেছে? প্রোতিয়স্ প্রতিবচন প্রদান করিলেন, মিত্র প্রেমের কথায় তোমার আমোদ হয় না নায়িকার অনুরাগের বিষয় ব্যক্ত করিয়া বৃথা কেন তোমাকে উত্ত্যক্ত করিব?

 বালেন্তাইন্ বিনয় প্রকাশ পুরঃসর বলিলেন মিত্র আমার আর সে ভাব নাই, আমি প্রেমের প্রতি দোষারোপ করিয়া সমুচিত শাস্তি প্রাপ্ত হইয়াছি। পূর্ব্বে যে প্রণয়কে ঘৃণা করিতাম অধুনা সেই প্রণয় আমাকে সর্ব্বতোভাবে পরাভব করত বিলক্ষণ প্রতিহিংসা করিতেছে। মিত্র প্রেমের প্রাদুর্ভাবে আমার আহার নিদ্রার অভাব হইবার উপক্রম হইয়াছে। হে বয়স্য, প্রেম পরাক্রান্ত রাজা আমাকে শাসন করিয়া এবম্প্রকার অধীন করিয়াছে যে আমি অকপট মনে স্বীকার করিতে পারি তাহার দণ্ডের তুল্য কঠিন দণ্ড ভূমণ্ডলে নাই। কিন্তু সখা এই অসার সংসার মধ্যে প্রেমের সদৃশ সুখপদার্থও দেখিতে পাই না তাহাতে আমার এতাদৃশী আসক্তি হইয়াছে যে তৎ প্রসঙ্গের কথা বার্ত্তাতেও সন্তুষ্ট থাকি এবং তাহার নামোল্লেখেও জীবন শীতল হয়।

 প্রোতিয়স্ নায়িকানুরাগে বয়স্যের এবম্প্রকার ভাব পরিবর্ত্তন অবলোকন করিয়া আহ্লাদে পুলকিত হইলেন কিন্তু অনতিবিলম্বে তাঁহারদের বন্ধুত্ব বিগমের উপক্রম হইল। বালেন্তাইন্ যাঁহার উপর আপনার প্রণয়াসক্তির কথা কহিলেন প্রোতিয়সের অন্তঃকরণে, তদীয় প্রেমাকাঙ্ক্ষা হঠাৎ প্রবল হইয়া উঠিল। অতএব যে ব্যক্তি ইতি পূর্ব্বে বিশ্বস্ত সুহৃদ্ ছিল মিত্রের প্রণয়াস্পদ প্রমদার সন্দর্শনাবধি অবিশ্বাসী ও কাল্পনিক সৌহৃদ্য ব্যবহারী হইতে লাগিল। ফলতঃ সিল্‌বিয়ার রূপ লাবণ্য অবলোকনে তাঁহার সহিত স্বীয় প্রণয় নিবন্ধন নিমিত্ত প্রোতিয়সের এতাদৃশ ঔৎসুক্য হইল যে নিজ প্রণয়িনী জুলিয়ার প্রেম চিন্তা চিত্ত হইতে দূরীভূত হইয়াগেল এবং বয়স্যের অনুপম গুণে বিমোহিতা তদীয় নায়িকা কিরূপে তাঁহার প্রতি হতাদর হয় তদুপায় করণার্থ যৎপরোনাস্তি যত্ন হইল। সচ্চরিত্রান্বিত লোকেরা যৎকালে কোন অন্যায় কার্য্যে প্রবর্ত্তমান হয়, তখন তাহারদিগের অন্তঃকরণে নানা প্রকার সংশয়ের আবির্ভাব হইয়া থাকে অতএব চির প্রণয়িনী জুলিয়ার পরিত্যাগ এবং আবালবন্ধু বালেন্তাইনের সহিত বহিরঙ্গতা উৎপাদন প্রসঙ্গে যদিও প্রোতিয়স্ বিবিধ প্রকার চিন্তা করিল তথাপি প্রেম অতি দুর্জয় রিপু, তাহার আক্রমণে হিতাহিত দর্শন হয় না। সুতরাং ঐ রূপ চিন্তাকালে প্রোতিয়সের মনে কিঞ্চিন্মাত্র দোষ বোধ হইল না।

 বালেন্তাইন্ বয়স্যের আন্তরিক ভাব বুঝিতে পারিলেন না, পূর্ব্ববৎ বিশ্বস্ত জ্ঞানে আপনার প্রণয়ের আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া কহিলেন মিত্র আমাদের পরস্পর প্রেমাসক্তির কথা মিলানাধিপতি মহারাজের কর্ণগোচর হয় নাই। পরন্তু এতদ্বিষয় অবগত হইলে নৃপতি সম্মতি দিবেন এতাদৃশী সম্ভাবনা দেখি না। অতএব সিল্‌বিয়া সুন্দরীর মতানুসারে এই পরামর্শ স্থির করিয়াছি অদ্য রজনী যোগে রাজসদন হইতে পলায়ন পূর্ব্বক তাঁহার সহিত মেন্তুয়া নগরে প্রস্থান করিব। অনন্তর রজ্জুনির্মিত একটা সোপান প্রদর্শন পুরঃসর কহিলেন বয়স্য নিশাগমে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইলে রাজভবনের কোন গবাক্ষ দ্বার দিয়া এই সোপান যোগে প্রণয়িনী বহির্ভূত হইবেন।

 প্রোতিয়স্ বালেন্তাইনের এই সকল গোপনীয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মনোমধ্যে বিবেচনা করিল এ বিষয় প্রকাশ করিয়া দিতে পারিলেই ইহাকে নিরাশ করিতে পারা যায় অতএব বিশ্বাস ঘাতকতা পূর্ব্বক নৃপতি সন্নিধানে প্রকটন করিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিল।

 অনন্তর মিলানাধিপতির সমীপে গমন পূর্ব্বক ঐ সমস্ত বৃত্তান্ত ব্যক্ত করণাশয়ে চতুরতার সহিত বক্ত্তৃতা আরম্ভ করিল মহারাজ আমি যে বিষয় প্রকাশ করিতে উপস্থিত হইলাম মিত্রতাধর্ম্মে তাহা গোপন রাখাই উচিত কিন্তু আপনি আমার প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ করিয়াছেন যদিস্যাৎ জানিয়া শুনিয়া আপনার সাবধানার্থ অগ্রে অনিষ্ট সম্ভাবনার সংবাদ জ্ঞাপন না করি কৃতঘ্ন হইতে হইবেক অতএব কেবল কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন নিমিত্ত আমাকে কহিতে হইল। হে নরনাথ আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে বিষয় নিবেদন করিব তাহাতে আমার সাংসারিক কোন প্রকার লাভাকাঙ্ক্ষা নাই। এই রূপে ভূমিকা করিয়া বয়স্যের নিকট যে২ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছিল এবং বালেন্তাইন রজ্জু নির্মিত সোপান যে প্রকারে স্বীয় পরিচ্ছদের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল সমুদায় প্রকাশ করিয়া কহিল।

 মিলানাধিপতি প্রোতিয়স্‌কে স্বীয় বয়স্যের অন্যায় ও দুষ্ট প্রবৃত্তি এবম্প্রকারে প্রকাশ করিতে দেখিয়া বিবেচনা করিলেন এ ব্যক্তি অতি সজ্জন, অকর্ত্তব্য বিষয়ে মিত্রেরও অনুরোধ রক্ষা করে না। অতএব যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া তাহাকে বিশ্বস্ত জ্ঞান করিতে লাগিলেন। অধিকন্তু তাহার নিকট স্বীকার করিলেন এ সকল সমাচার কি প্রকারে প্রাপ্ত হইলাম দুরাত্মা বালেন্তাইনের নিকট ব্যক্ত করিব না, তাহার গুপ্তাভিপ্রায় যাহাতে স্বতঃ প্রকাশ পায় তদুপায় করিতেছি। অতএব সন্ধ্যা কালাবধি নৃপতি সতর্ক হইয়া বালেস্তাইনের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিয়দ্বিলম্বে দৃষ্টিগোচর হইল ঐ ব্যক্তি নৃপ নিকেতনে আসিয়াছে এবং তদীয় পরিচ্ছদে একটা দ্রব্য লুক্কায়িত রহিয়াছে। রাজা তাহাকে অবলোকন করিবামাত্র স্থির করিলেন বসনান্তর্ব্বর্ত্তি বস্তু রজ্জু নির্ম্মিত সোপান ব্যতীত অন্য কিছ নহে।

 মিলানাধিপতি বালেন্তাইন্‌কে নিরীক্ষণ করিয়া গতিরোধের মানসে উচ্চ স্বরে আহ্বান পুর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন বালেন্তাইন্ ব্যস্তসমস্ত হইয়া কোথায় যাইতেছ? বালেন্তাইন্ রাজাকে দেখিয়া সচকিত হইলেন এবং আপনার অভিপ্রায় গোপন পূর্ব্বক সম্মান করিয়া উত্তর করিলেন মহারাজ আমার বাটীতে একখান লিপি লইয়া যাইবার নিমিত্ত একজন বার্ত্তাবহ ঐ স্থানে দণ্ডায়মান রহিয়াছে তাহার হস্তে পত্র প্রদান নিমিত্ত সত্বর গমন করিতেছি। প্রোতিয়স্ জনকের নিকট অলীক কথা কহিয়া যে প্রকার বিপদে পড়িয়াছিল বালেন্তাইনের এই মিথ্যা কথনেও তাদৃশী দশা ঘটিল।

 নৃপতি জিজ্ঞাসা করিলেন পত্রে কি কোন বিশেষ সংবাদ আছে?

 বালেন্তাই উত্তর দিলেন, না মহারাজ, লিপিতে এতাবন্মাত্র লিখিয়াছি আমি আপনকার আশ্রয়ে পরম সুখে কাল যাপন করিতেছি।

 রাজা কহিলেন এত ব্যস্ত কেন? আমার নিকট কিঞ্চিৎ কাল অবস্থিতি কর একটা বিষয়ের পরামর্শ করি। অনন্তর তদীয় গুপ্তাভিপ্রায় প্রকাশ নিমিত্ত চতুরতা পূর্ব্বক একটা কথার প্রসঙ্গ করিয়া বলিলেন ওহে তোমার বিদিত আছে আমি তনয়ার পরিণয় দান নিমিত্ত থুরিওকে বরপাত্র অবধারিত করিয়াছি কিন্তু আমার কন্যাটা অতিশয় অবাধ্যা, আমাকে পিতা বলিয়া সম্মান বা ভয় করে না, তাহার এই অহঙ্কার নিমিত্ত তৎপ্রতি আমার যে স্নেহ তাহা আর নাই, মনে করিয়াছিলাম আমার প্রাচীনাবস্থায় পুত্রের ন্যায় ব্যবহার করিবে কিন্তু তাহার প্রকৃতি দেখিয়া এক্ষণে পুনর্বার সংসার ধর্ম্মে প্রবেশ পুরঃসর দার পরিগ্রহ করিবার মানস করিয়াছি। আমি আর তাহার নিমিত্ত বরপাত্রের অনুসন্ধান করিব না যে তাহাকে জিঘৃক্ষু হইবে তাহাকেই প্রদান করিব। তাহার রূপ লাবণ্যই তাহার বিবাহের যৌতুক হইবে, আমি কিছু দিব না, কেননা আমার সম্পত্তি তাহার লক্ষ্য হয় না।

 বালেন্তাইন্ বিবেচনা করিয়া নৃপতির এই সমস্ত উক্তির তাৎপর্য্য কিঞ্চিন্মাত্র বুঝিতে পারিলেন না, আশ্চর্য্য প্রকাশ পুরঃসর এতাবন্মাত্র নিবেদন করিলেন মহারাজ এতদ্বিষয়ে আমার প্রতি কি আদেশ হইবেক?

 ভূপাল বলিলেন আমি যে অঙ্গনার পাণিগ্রহণ করিতে বাসনা করিয়াছি সেই কামিনী পরমা সুন্দরী ও অতিশয় লজ্জা শীলা। আমি জরাগ্রস্ত এ প্রযুক্ত আমার কথোপকথন তাঁহার মনোনীত হয় না। ফলতঃ যৌবনাবস্থায় যুবতীদের সহিত যে প্রকারে কথা বার্ত্তা কহিতাম এক্ষণে তাহার অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে অতএব উপদেশ কর দেখি আমার প্রতি সেই তরুণীর প্রীতি কি রূপে জন্মিতে পারে।

 তদানীন্তন তরুণ পুরুষেরা তরুণীর মনোহরণ নিমিত্ত যে প্রকারে প্রেমালাপ করিত অনুপূর্ব্বিক তদ্বিষয়ের বর্ণনা করিয়া বালেন্তাইন্ বলিলেন মহারাজ, সর্ব্বদা সন্দর্শন ও উত্তমোত্তম দ্রব্যাদি প্রদান করিলে কামিনীগণ অসংশয় প্রণয় বাগুরায় পতিত হয়।

 ভূপাল বলিলেন ওহে বালেন্তাইন আমি কামিনীর সন্নিধানে অনেক বার অনেক প্রকার উপায়ন প্রেরণ করিয়াছিলাম কিন্তু তিনি গ্রহণ করেন নাই। অপর তাঁহার পিতা তাঁহাকে সর্ব্বদা কঠিনতার সহিত রক্ষা করেন ইহাতে তাঁহার সহিত দিবাভাগে সাক্ষাৎ হওয়া সুকঠিন।

 বালেন্তাইন কহিলেন রজনীযোগে সুন্দরীর আবাস সমীপে গমন পূর্ব্বক তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করুন না?

 রাজা কথা প্রসঙ্গেই স্বীয় অভীষ্ট সাধন মানসে বলিলেন নিশাভাগে সেই যোষার শয়নাগারস্থ দ্বার রুদ্ধ থাকে সে সময় কি রূপে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব?

 তদনন্তর দুর্ভাগ্য বশতঃ বালেন্তাইন্ অসাবধানতা পূর্ব্বক এই প্রস্তাব করিলেন মহারাজ রজ্জু নির্মিত সোপান অবলম্বন করিলে অনায়াসে শূন্যে২ আপন প্রেয়সীর শয়নাগারে প্রবেশ করিতে পারিবেন আমি এতদ্বিষয়ে সাহায্যার্থে একটা দড়ির সিঁড়ি আনাইয়া দিব। পরিশেষে নৃপতিকে পরামর্শ দিলেন যদি সেই সিঁড়ি গোপনে রাখিবার বাসনা হয় আমি যাদৃশ বসন পরিধান করিয়াছি এপ্রকার পরিচ্ছদ ধারণ করিলে তন্মধ্যে লুক্কায়িত করিয়া রাখিতে পারিবেন। বালেন্তাইনের পরিচ্ছদ মুক্ত করিয়া তন্মধ্যে কি আছে দেখিবেন এতন্মানসেই ভূপাল একটা প্রসঙ্গ কল্পনা করিয়া তাহার সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, পরিচ্ছদ মধ্যে সিঁড়ি গোপন করিয়া রাখিবার কথা শ্রবণ মাত্রে কহিলেন তবে তোমার অঙ্গাবরণ একবার আমাকে দাও দেখি, কিপ্রকারে লুকাইয়া রাখিব বুঝিয়া লই। এই কথা বলিয়া বালেন্তাইনের অঙ্গ বসন উন্মোচন করিবা মাত্রে তদভ্যন্তরে রজ্জু নির্ম্মিত সোপান এবং সিল্‌বিয়ার নামাঙ্কিত এক খান লিপি দেখিতে পাইলেন। রাজকন্যা বালেন্তাইন্ সমভিব্যাহারে যেপ্রকারে পলায়ন করিবেন তত্তাবদ্বৃত্তান্ত সেই পত্র মধ্যে লিখিয়াছিলেন। মিলানাধিপতি এক্ষণে কোপ কম্পিত কলেবর হইয়া সাতিশয় তর্জ্জন পূর্ব্বক ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন অরে দুরাচার কৃতঘ্ন তুই বিশ্বাস ঘাতকতা পূর্ব্বক আমার তনয়াকে লইয়া গোপনে পলায়নের মানস করিয়াছিস্। এবম্প্রকার ভূরি২ তিরস্কার করিয়া যৎপরোনাস্তি অপমান পূর্ব্বক স্বীয় রাজধনী মিলান্ নগরী হইতে দূর করিয়া দিতে আদেশ করিলেন। অতএব বালেন্তাইন্ আপনার পরম প্রণয়িনী রাজনন্দিনী সিল্‌বিয়ার লোভে নিরাশ হইয়া সেই দিবস নিশা ভাগে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 প্রোতিয়স্ যৎকালে প্রণয় পরাধীনতা প্রযুক্ত মিত্রদ্রোহী হইয়া বয়স্য বালেন্তাইনের এই রূপ অনিষ্ট করিতেছিল সে সময় তাহার পূর্ব্ব প্রণয়িনী জুলিয়া বেরোন নগরে বিরহ ব্যাকুলা হন। কামিনী নিরন্তর নায়কের অনুধ্যানে নিমগ্না হওয়াতে উন্মত্ত প্রায়া হইলেন। শেষে অধীরতা প্রযুক্ত হিতাহিত বিবেচনা বিসর্জ্জন করিয়া স্বদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক মিলান নগরে প্রিয়তমের অন্বেষণ নিমিত্ত প্রস্থান করিতে সংকল্প করিলেন। সুন্দরী আপনার এই মানস সিদ্ধি নিমিত্ত অবিলম্বে স্বীয় কিঙ্করী লুসেতার সহিত যাত্রা করিলেন এবং বর্ত্মোপরি উত্তীর্ণ হইয়া উভয়ে পুরুষের পরিচ্ছদ ধারণ পূর্ব্বক ছদ্মবেশে মিলান নগরে গিয় উপনীত হইলেন। তাঁহার সে স্থানে উপস্থিত হইবার কিয়ৎকাল পূর্বে বালেন্তাইন্ বন্ধুর অবিশ্বস্ত ব্যবহার নিমিত্ত তথা হইতে পলাইয়া আসেন।

 জুলিয়া মিলানে উত্তীর্ণ হইয়া এক গৃহস্থের সদনে বাস স্থল গ্রহণ করিলেন এবং কিয়ৎকাল বিশ্রামানন্তর অন্তঃকরণের ব্যাকুলতা প্রযুক্ত বাটীর কর্ত্তার সহিত কথোপকথন করিতে লাগিলেন।

 গৃহাধিকারী জুলিয়াকে যুবা পুরুষ বোধ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার রূপ লাবণ্য ও অবয়ব সৌষ্ঠব অবলোকনে মনে করিতেছিলেন এ ব্যক্তি কোন সম্ভ্রান্ত সন্তান, সন্দেহ নাই। অতএব সাতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে মিত্র ভাবে তাঁহার সহিত কথা বার্ত্তা কহিতে লাগিলেন। অধিকন্তু গৃহস্থ অতিশয় সুশীল ও সচ্চরিত্র ছিলেন, অভ্যাগত তরুণকে বিষন্ন বদন দেখিয়া তদীয় চিত্তের বিনোদন মানসে কথাবসরে প্রস্তাব করিলেন অদ্য আমাদের এতন্নগরী মধ্যে এক স্থানে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রেমাস্পদ প্রমদার মনোরঞ্জন নিমিত্ত তৌর্য্যত্রিক হইবে, কেমন, শ্রবণে বাসনা হয়? আমার সমভিব্যাহারে চল শুনিয়া আসি।

 জুলিয়ার আস্য কমল ম্লান থাকিবার কারণ এই, তিনি বিরহ যন্ত্রণায় অধীর হইয়া আপন ভবন বিসর্জ্জন পুরঃসর ছদ্ম বেশে বিদেশে আসিয়া অনুক্ষণ এই চিন্তা করিতেছিলেন প্রিয়তম প্রোতিয়স্ আমার পলায়ন ব্যাপার অবগত হইয়া কি মনে করিবেন? নিষ্কলঙ্ক কৌমার ও গৌরবান্বিত প্রকৃতি নিমিত্তই আমার প্রতি তাঁহার অতিশয় আস্থা হয়, এখন পাছে কামুকী বোধে হেয় জ্ঞান করেন। যুবতী এই উদ্বেগে মনোমধ্যে সতত ব্যাকুলা ছিলেন সুতরাং তাঁহার আকৃতিও বিষাদের চিহ্ণে আচ্ছন্ন হইয়াছিল।

 অতএব বাটীর অধ্যক্ষ তৌর্য্যত্রিক দর্শনাদি নিমিত্ত সমভিব্যাহারে লইয়া যাইবার প্রসঙ্গ করিলে কামিনী অন্তঃকরণের বিনোদন মানসে তৎক্ষণাৎ তাহাতে সম্মতা হইলেন। অপর মনোমধ্যে তাঁহার আশা হইল যাইতে২ পথের মধ্যে প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ হইলেও হইতে পারিবেক।

 অনন্তর গৃহাধিকারির সঙ্গে গমন করিয়া রাজসদনে উপনীত হইলেন এবং সংগীত সভা মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক ইতস্ততো নয়ন নিক্ষেপ করাতে দেখিতে পাইলেন আপনার প্রেমাস্পদ প্রোতিয়স্ রাজকন্যা সিল্‌বিয়ার প্রমোদ নিমিত্ত গীত বাদ্য এবং মধ্যে২ প্রেমালাপ করিতেছেন। জুলিয়া এতদবলোকনে অন্তঃকরণ মধ্যে আরো অধীরা হইলেন সুতরাং গৃহাধ্যক্ষ যে অভিপ্রায়ে তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া গিয়াছিলেন তাহার বিপরীত ঘটিল। পরন্তু যুবতী গোপনে শ্রবণ করিলেন রাজকুমারী আপনার আগারের গবাক্ষদ্বারে বসিয়া প্রোতিয়স্‌কে এই বলিয়া ভর্ৎসনা করিতেছেন অরে নির্দয় বিশ্বাসঘাতক তোকে ধিক ধিক, তুই একজন অবলাকে প্রেমশৃঙ্খলে বদ্ধ করিয়া পরে পরিত্যাগ করিয়াছিস্ এবং তোর পরম বিশ্বস্ত মিত্র বালেন্তাইনের সঙ্গে তাদৃশ বিশ্বাসঘাতকতা ব্যবহার করিলি, তুই আমার সহিত সংপ্রীতি করিতে যত্ন করিস কি? রাজকন্যা বারম্বার এই সকল তিরস্কার বাক্য কহিতেছিলেন তাহার গীত বাদ্যে মনোযোগ দেন নাই এবং কিয়ৎ ক্ষণ পরেই সে স্থান হইতে অন্তরে গেলেন। বস্তুতঃ নৃপ নন্দিনী বালেন্তাইনের গুণে তৎপ্রতি অত্যন্ত আসক্তা হইয়াছিলেন সুতরাং তদীয় কৃত্রিম মিত্র প্রোতিয়সের কৃতঘ্নতায় তাঁহার সহিত বিচ্ছেদ হওয়াতে ঐ ব্যক্তিকে বিজাতীয় ঘৃণা করিতেন ইহাতে প্রেমের সম্ভাবনা কি?

 জুলিয়া যদিও প্রিয়তমের ব্যবহার প্রত্যক্ষ নিরীক্ষণ করিয়া আপনার আশায় নিরাশ্বাস হইলেন তথাপি চিত্ত তদীয় অনুরাগে বিমুগ্ধ থাকাতে তাহার সহিত প্রণয় বাসনা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। ঐ সময়ে প্রোতিয়স্ আপনার একজন কর্ম্মচারিকে বিদায় দিয়াছিল যুবতী অবগত হইয়া গৃহপতির সাহায্যে তাহার নিকট সেই কার্য্যে নিবিষ্ট হইবার প্রার্থনা করিলেন। প্রোতিয়স্ পুরুষ বেশধারিণী রমণীকে চিনিতে পারিল না সুতরাং গৃহপতির অনুরোধে তাঁহাকে ভৃত্যের কার্য্যে নিযুক্ত করিল। তরুণী কিঙ্কর হইলে প্রোতিয়স্ তদ্বারা স্বীয় নব প্রণয়ভাজন সিল্‌বিয়ার সন্নিধানে সর্ব্বদা উপায়নাদি প্রেরণ করিতে আরম্ভ করিল। অধিকন্তু কামিনী তাহার সহিত প্রণয় বন্ধন করিয়া বেরোনা নগর হইতে বিচ্ছেদ সময়ে যে অঙ্গুরীয়ক তাহাকে সমর্পণ করিয়াছিলেন এক দিন তাহা ঐ যুবতীর হস্তে নৃপনন্দিনীর নিকট পাঠাইয়া দিল।

 জুলিয়া যে দিবস অঙ্গুরী গ্রহণ পূর্ব্বক রাজবালা সিলবিয়ার সন্নিধানে গমন করিলেন সে দিন নৃপনন্দিনী প্রোতিয়সের প্রার্থনা সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করাতে ছদ্মবেশ ধারী কিঙ্কর বিমর্ষ না হইয়া বরং সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। জুলিয়া পুরুষের বেশে সিবাস্তিন্ নাম ধারণ পূর্ব্বক দাসত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন প্রোতিয়সের প্রতি নৃপকুমারীর কোপ দেখিয়া আপনিও স্বীয় প্রভুর উপরে বৈরক্তি ভাব ব্যক্ত করত তৎ প্রসঙ্গে কথোপকথন করিতে বসিলেন। অন্যান্য আলাপের পর আপনার পক্ষে একটা কথার উত্থাপন পূর্ব্বক বলিলেন জুলিয়ার সহিত আমার বিলক্ষণ পরিচয় আছে আমি তাহাকে বিলক্ষণ রূপে জানি। তদনন্তর জুলিয়া প্রোতিয়সের প্রতি কিরূপ প্রেম করিতেন এবং ঐ যুবা তাঁহাকে অবজ্ঞা করাতে সেই কামিনী কি প্রকার ব্যাকুল হইয়া বেড়ায় আনুপূর্ব্বিক সমুদায় বিবরণ ব্যক্ত করিলেন। পরে সন্দিগ্ধ বচনে রাজতনয়াকে জুলিয়ার অবয়ব সৌষ্ঠবের পরিচয় দিয়া বলিতে লাগিলেন সেই তরুণী দেখিতে প্রায় আমারই তুল্য, আমার ও তাঁহার শরীরের বর্ণ প্রায় এক প্রকার। জুলিয়া পুরুষের পরিচ্ছদ পরিধান করিলেও তাঁহার রূপ লাবণ্যের বৈলক্ষণ্য হয় নাই অতএব ভূপালবালা সিল্‌বিয়া কিঙ্করের সৌন্দর্য্য সন্দর্শন করিয়া জুলিয়ার শরীরের ভাব অনুভব করিলেন এবং তাদৃশী সুরূপা অঙ্গনার প্রতি নায়কের অসদ্ব্যবহারের কথা শুনিয়া অতিশয় দয়ার্দ্র হইলেন। অতএব ভৃত্য যখন তাঁহার করে অঙ্গুরী প্রদান করিল তখন গ্রহণে অস্বীকার করিয়া কহিলেন এ আরো লজ্জার বিষয়, জুলিয়া যে অঙ্গুরী আপনার প্রিয়তমকে প্রদান করিয়াছিলেন প্রোতিয়স্ সেই অঙ্গুরী আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছে আমি কদাপি গ্রহণ করিব না। আমি তাহারই প্রমুখাৎ কত দিন শুনিয়াছি তাহার অঙ্গুলি পর্ব্বে জুলিয়ার প্রদত্ত একটী অঙ্গুরীয়ক আছে, এ জুলিয়ারই অঙ্গুলি ভূষণ। হে সুশীল ভৃত্য তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট স্নেহ হইল কেননা তুমি সেই অভাগিনী রমণীকে ভালবাস। আহা সেই বিরহিণী অবলা অতি দুঃখিনী, আমি তোমার হস্তে তাহার নিমিত্ত এক তোড়া টাকা দিতেছি লইয়া যাও। নৃপসুতা সিলবিয়ার এতাদৃশ শান্তনা বচনে ছদ্মবেশি কিঙ্কর অতিশয় আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন এবং চির বিরহ দুঃখে মুদিত তদীয় হৃদয় কমল আনন্দে বিকসিত হইল।

 এক্ষণে বালেন্তাইনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করি। তিনি যৎপরোনাস্তি অপমান সহকারে তাড়িত হওয়াতে স্বালয়ে আসিতে অনিচ্ছু হইলেন। কোথায় যাইবেন ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিতে পারিলেন না। মনোহারিণী সিলবিয়ার রূপ লাবণ্য ও প্রণয়ের বিষয় ভাবিতে২ এক দিকে গমন করিয়া মিলান নগরের নিকটস্থ একটা অরণ্য মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেখানে বিমনস্কভাবে ইতস্ততো ভ্রমণ করিতেছেন ইত্যবসরে কতিপয় দস্যু আসিয়া উপস্থিত হইল এবং তাঁহাকে ধারণ পূর্ব্বক ধন প্রার্থনা করিল।

 বালেন্তাইন্ তাহাদিগকে আত্ম অবস্থা বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক কহিলেন আমি দেশ হইতে নিষ্কাসিত হইয়াছি আমার নিকট টাকা কড়ি কিছুই নাই, সম্বলের মধ্যে কেবল পরিহিত বসন মাত্র আছে, তোমরা কি লইবে?

 দস্যুরা তাঁহার দুর্দশার কথা শুনিয়া দয়ান্বিত হইল এবং মহৎ মনুষ্যের আকৃতি ও ভদ্র সন্তানের তুল্য প্রকৃতি দেখিয়া প্রস্তাব করিল তুমি আমাদের সহিত একত্র অবস্থান পূর্ব্বক অস্মদাদির সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষ স্বীকার কর আমাদের সম্পূর্ণ অভিলাষ। তাহা হইলে তোমার মঙ্গল হইবে আমরা আজ্ঞাবহ হইয়া থাকিব কিন্তু যদি এ বিষয়ে অঙ্গীকার না কর অবিলম্বে শমন ভবনে প্রেরণ করিব।

 বালেন্তাইন্ দস্যুদের প্রদর্শিত ভয়ে ভীত না হইয়া এতাবন্মাত্র উত্তর করিলেন যদিস্যাৎ তোমরা অবলা এবং দীন দরিদ্র পান্থ জনের প্রতি কখন কোন প্রকার অত্যাচার না কর তাহা হইলে তোমাদের সম্প্রদায়ে প্রবেশ পূর্ব্বক অধ্যক্ষতা স্বীকারে সম্মত হইতে পারি।

 এইরূপে সম্ভ্রান্ত বংশীয় মহান বালেন্তাইন বিখ্যাত দস্যু রবিন্‌হুদের ন্যায় সাহসিক তস্কর দলের অধিপতি হইলেন। কিয়ৎ কালানন্তর ঐ অবস্থায় সিলবিয়ার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তাহার বিবরণ নিম্নে লিখিতেছি।

 মিলানাধিপতি থুরিওর সহিত স্বীয় তনয়া সিলবিয়ার পরিণয় সম্পাদন নিমিত্ত অতিশয় যত্ন করিতেছিলেন। কামিনী নিরন্তর তাহাতে বাধা দিতে অসমর্থা হইয়া উপায় বিরহে প্রতিজ্ঞা করিলেন মেন্তুয়া নগরে প্রণয়ি বালেন্তাইন লুকাইয়া আছেন গোপনে পলায়ন পুরঃসর তাঁহার নিকট গমন করি। কিন্তু প্রিয়তমের বাসস্থলের বিষয়ে ভূপালবালা সটীক সংবাদ প্রাপ্ত হন নাই কেননা সে সময় বালেন্তাইন দস্যুদের দলপতি হইয়া বিপিন মধ্যে সাহসিক তস্কর সমভিব্যাহারে অবস্থিতি করিতেছিলেন। তিনি অধ্যক্ষতা করিয়া দস্যুদিগের অপহার ব্যাপারের কোন সংশ্রবে থাকিতেন না কেবল যে সময় তাহারা অনাথ পথিকদের উপর আক্রমণ পূর্ব্বক অত্যাচার করিবার উপক্রম করিত তৎকালে ক্ষমতা বিস্তার পুর্ব্বক করুণা বিতরণ করিয়া বিপন্ন জনের ক্লেশ নিবারণ করিতেন।

 সিল্‌বিয়া পিত্রালয় হইতে পলায়ন পূর্ব্বক বর্ত্ম মধ্যে যদি কোন বিপদ ঘটে এই ভয়ে এগ্লামোর নামক এক জন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ পুরুষ সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর যে বিপিন মধ্যে বালেন্তাইন দস্যু সম্পদায়ের প্রধান হইয়া রাজত্ব করিতেছিলেন সেই বনে প্রবেশ করিলেন। তাহাতে উক্ত দলের এক জন দস্যু ভয়ানক বেশ ধারণ পূর্ব্বক তাঁহাকে ধৃত করিল। সঙ্গি এগ্লামোরও তাহাদের হস্তে পতিত হইতেন চতুরতা পূর্ব্বক পলায়ন করাতে রক্ষা পাইলেন।

 দস্যু সিল্‌বিয়ার কলেবর ভয়ে কম্পিত দেখিয়া আশ্বাস প্রদান পুরঃসর বলিল সুন্দরি ভীত হইও না, চল, তোমাকে আমাদের অলিয়ে লইয়া যাই। সেখানে অস্মদাদির প্রধানাধ্যক্ষ আছেন, তিনি অতিসজ্জন, বিশেষতঃ কামিনীগণের প্রতি নিরন্তর করুণা বিতরণ করিয়া থাকেন। তোমার কোন চিন্তা নাই। রাজকুমারী তস্করের এতাদৃশী শান্ত্বনা বাক্যেও অধিক শান্তা হইতে পারিলেন না বন্দীভূতা হইয়া দস্যুদলপতির সমীপে নীতা হইতেছি এই ভাবিয়া সাতিশয় বিষাদ প্রকাশ পূর্ব্বক উচ্চস্বরে কহিতে লাগিলেন হা বালেন্তাইন্ কোথায় গেলে তোমার নিমিত্ত ঈদৃক্ দুঃখ সহ্য করিতেছি।

 অনন্তর দস্যু সিল্‌বিয়া সমভিব্যাহারে স্বীয় প্রভুর সন্নিধানে গমন করিতে উদ্যত হইলে প্রোতিয়স আসিয়া তাহাতে বাধা দিল। এই ব্যক্তি নৃপবালার পলায়ন বার্ত্তা শ্রবণাবধি ছদ্মবেশি জুলিয়া ভৃত্যের সহিত তাহার অনুসন্ধান করিতে ছিল। রাজকুমারীর পদ চিহ্ণ লক্ষ্য করত যাইতে২ ঐ অরণ্য মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইল এবং রাজতনয়াকে দস্যু হস্তে পতিতা দেখিয়া শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ পূর্ব্বক উদ্ধার করিল। যদিও নৃপনন্দিনী তাহার বিদ্বেষিণী ছিলেন তথাপি বিপদ্ সময়ে ঈদৃক্ আনুকূল্য করাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারিতেন কিন্তু তিনি তাহার ধন্যবাদ না করিতে২ সে আপনার প্রণয়ের কথার উত্থাপন করিল সুতরাং যুবতী মহতী যন্ত্রণায় পড়িলেন। প্রোতিয়স কামিনীকে একাকিনী পাইয়া আপনার গলে বরমাল্য প্রদানে অঙ্গীকার করাইবার নিমিত্ত সাতিশয় উত্তেজনা করিতে লাগিল এই সময়ে তাহার ছদ্ম বেশী কিঙ্কর অর্থাৎ জুলিয়া সোদ্বেগান্তঃকরণে নিকট দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন এবং আপনার মনে এই আশঙ্কায় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন রাজকুমারী উপকারে বাধ্য হইয়া যদি তাহার প্রতি দয়ার্দ্রা হন তাহা হইলে বিপদ ঘটিবে। কিন্তু নৃপনন্দিনী প্রোতিয়সের উত্তেজনায় কেবল উত্ত্যক্ত হইতেছিলেন তাঁহার অন্তঃকরণে তৎপ্রতি স্নেহ বা দয়ার সঞ্চার মাত্র হয় নাই। ইতিমধ্যে বালেন্তাইন্ সহসা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন তাহাতে সকলেই সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল। যে তস্কর নৃপতনয়াকে ধৃত করিয়াছিল সে প্রোতিয়স কর্ত্তৃক নিরাকৃত হইয়া আপনার প্রভু সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক সংবাদ প্রদান করিয়াছিল সুতরাং বালেন্তাইন অবলার উদ্ধার নিমিত্ত স্বয়ং আগমন করিলেন।

 প্রোতিয়স আপন বয়স্যের প্রেয়সী রাজকুমারীর নিকট প্রণয় যাচ্‌ঞা করিতেছিল মিত্র হঠাৎ আসিয়া ঐ কথা শ্রবণ করাতে সাতিশয় লজ্জিত হইল। পরে স্বীয় অসদাচরণ নিমিত্ত অনুতাপ করিয়া বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল। বালেন্তাইন্ অতিশয় সদাশয় ছিলেন এ প্রযুক্ত তাহার কিয়ৎক্ষণের বিনয়ে মহা২ বিদ্রোহ বিস্মরণ করিলেন এবং পুনর্ব্বার সৌহৃদ্য করিয়া মহানুভবতা প্রকাশ পুরঃসর বলিলেন প্রোতিয়স্ আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম অকপটে কহিতেছি সিলবিয়ার উপর আমার যে অধিকার আছে তুমি গ্রহণ কর, তোমাতে অপর্ণ করিলাম। জুলিয়া দাস বেশে স্বীয় প্রণয়াস্পদ প্রোতিয়সের পার্শ্বে দণ্ডায়মান ছিলেন নায়কের বয়স্য বালেন্তাইনের এতাদৃশী অদ্ভুত বদান্যতার কথা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন এবং আপনার মনোনীত পতি এই অভিনব সৌহৃদের অনুরোধে রাজকুমারীর করগ্রহণে বুঝি স্বীকার করিবেন এতদাশঙ্কায় ক্ষণ কাল মধ্যে সেই স্থলে মূর্ছান্বিত হইয়া পড়িলেন। তাহাতে সকলে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া তাঁহাকে সুস্থ করিতে লাগিল। যদিস্যাৎ এই ঘটনা না হইত তাহা হইলে রাজকুমারী বালেন্তাইনের বন্ধুর প্রতি তাদৃশ সদ্ব্যবহার দর্শনে তদীয় প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাস করিতেন এবং প্রোতিয়সের হস্তে পতিত হইলাম ভাবিয়া একেবারে ভগ্নচিত্তা হইতেন। জুলিয়া মূর্চ্ছাভঙ্গ হইলে একটী অঙ্গুরী অঙ্গুলী হইতে উন্মোচন পুরঃসর সিলবিয়া সুন্দরীকে দেখাইয়া কহিতে লাগিলেন প্রভু এই অঙ্গুলি মুদ্রা আপনকার হস্তে সমর্পণ নিমিত্ত আমাকে দিয়াছিলেন আমি আপনাকে দিতে বিস্মৃত হইয়াছি। প্রোতিয়স ঐ অঙ্গুলি ভূষণ অবলোকন মাত্রে চিনিতে পারিয়া মনেই বিবেচনা করিতে লাগিল আমি জুলিয়াকে যে অঙ্গুরী প্রদান করিয়াছিলাম এ যে সেই অঙ্গুরী দেখিতে পাই। রাজকুমারীর নিকট এ অঙ্গুরী প্রেরণ করি নাই, সে অন্য অঙ্গুলি ভূষণ, অনন্তর ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিল ওহে তুমি এ অঙ্গুরী কোথায় কি প্রকারে পাইলে? আমি পূর্ব্ব প্রণয়িনী জুলিয়াকে ইহা প্রদান করিয়াছিলাম। এ অঙ্গুরী যে তাহার অঙ্গুলি পর্ব্বে শোভমানা ছিল। ভৃত্য অব্যক্ত বচনে প্রতিবচন প্রদান করিল জুলিয়া স্বয়ং ইহা এ স্থলে আনয়ন করিয়া আমাকে দিলেন।

 প্রোতিয়স্ ভৃত্যের তদ্রূপ উত্তরে সংশয়াকুল হইয়া মনোযোগ পূর্ব্বক তাহার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রহিলেন। অনেক ক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্চয় করিলেন সেবক সিবাস্তিনই জুলিয়া। অতএব প্রিয়তমার অকৃত্রিম প্রণয়ের প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়াতে তাহার মনে কামিনীর প্রতি পূর্ব্বে যে প্রেম উৎপন্ন হয় তাহা পুনর্বার আবির্ভূত হইল। তৎক্ষণাৎ কামিনীর কর গ্রহণ পুরঃসর প্রণয়ির ব্যবহার করত বন্ধু বালেন্তাইনকে বলিল মিত্র নব নায়িকা সিলবিয়া রাজনন্দিনী, তুমিই তাঁহার উপযুক্ত বরপাত্র, আমিও তোমার হস্তে তাঁহাকে প্রত্যর্পণ করিলাম।

 অতএব প্রোতিয়স্ ও বালেন্তাইন্ স্ব২ চির প্রণয়িনী প্রমদালাভে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া পরস্পর সুখানুভব করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে মিলানাধিপতি ও থুরিও সিলবিয়ার অন্বেষণ করিতে২ হঠাৎ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন তাহাতে সকলে বিস্মিত ও অতিশয় সন্ত্রস্ত হইল।

 থুরিও সিলবিয়াকে বালেন্তাইনের পার্শ্বে অবলোকন করিয়া ক্রোধে প্রজ্বলিত হইলেন এবং তাঁহার নিকট গমন পুর্ব্বক বলে কর ধারণের উপক্রম করিয়া কহিলেন রাজকুমারী মদীয় বনিতা। ইহাতে বালেন্তাইন বিভীষিকা প্রদর্শন পূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন থুরিও মানে২ নিবৃত্ত হও, পুনর্ব্বার যদি কহ সিলবিয়া তোমার মহিলা, অবিলম্বে শমন সদনে প্রেরণ করিব। এখানে নৃপনন্দিনী দণ্ডায়মানা রহিলেন ইহার অঙ্গ স্পর্শ কর্ দেখি, আমার প্রেয়সীর গাত্রে হস্তাপর্ণ করিলে কি হয় এখনি দৃষ্টি গোচর হইবে। থুরিও স্বভাবতঃ ভীত এ প্রযুক্ত বালেন্তাইনের এই সমস্ত শৌর্য্য বচনে মনে২ মহা শঙ্কিত হইলেন কিন্তু মুখে কহিতে লাগিলেন আমি এ রমণীকে গ্রহণ করিতে চাহি না। আমি এতাদৃশ উন্মত্ত হই নাই যে নিঃস্নেহা প্রমদা নিমিত্ত সংগ্রাম করিব।

 মিলানাধিপতি মহাবল পরাক্রান্ত ও অতিশয় সাহসী ছিলেন থুরিওকে নিবৃত্ত হইতে দেখিয়া ক্রোধ প্রকাশ পূর্ব্বক তিরস্কার করিতে লাগিলেন তুই এমন কাপুরুষ, আপন প্রেয়সীর উদ্ধার নিমিত্ত কিঞ্চিন্মাত্র সাহস প্রকাশ করিতে পারিলি না, ছি তুই অতি অপদার্থ, কোন কর্ম্মের নহিস্। অনন্তর বালেন্তাইনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ পূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধিয়া কহিলেন তোমার সাহস অতিশয় প্রশংসনীয়, তুমিই মদীয় নন্দিনীর আনন্দ বর্দ্ধন নায়কের উপযুক্ত পাত্র। ওহে বালেন্তাইন্ আমি তোমাকেই স্বীয় কন্যা সম্প্রদান করিব। বালেন্তাইন্ মিলানাধিপতির কোপাবসানে ঈদৃক্ কোমলান্তঃকরণ দর্শনে হর্ষে পুলকিত হইয়া বিনয় প্রকাশ পুরঃসর তাঁহার কর চুম্বন করিলেন। পরে রাজনন্দিনীর কর গ্রহণ করিয়া নৃপসন্নিধানে যথোচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অবশেষে এই আনন্দের সময় অরণ্য নিবাসি দস্যুগণের প্রতি মহারাজের অনুগ্রহ প্রার্থনা করিয়া তাহাদিগকে ক্ষমা করিতে অনুরোধ করিয়া কহিলেন মহারাজ ইহাদের প্রতি করুণা বিতরণ পুরঃসর লোকালয়ে বসতি করিবার আদেশ হয় আমি নিঃসন্দেহ বলিতে পারি তাহা হইলে ইহাদের রীতি প্রকৃতির সংশোধন হইবে। অধিকন্তু ইহাদের বৃত্তান্তানুসন্ধান পুরঃসর বিবেচনা করিলে মহারাজের বিদিত হইতে পারিবে যে অনেকে আমার ন্যায় রাজবিদ্রোহপরাধে দূরীকৃত হইআছে। মিলানেশ্বর বালেন্তাইনের শৌর্য্য বীর্য্য ও গুণের পরিচয় পাওয়াতে যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন অতএব তাঁহার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। তদনন্তর মহারাজ প্রোতিয়সের মিত্র দ্রোহ নিমিত্ত এতাবন্মাত্র দও বিধান করিলেন সে নব নায়িকার সহিত স্বীয় প্রণয় বাসনায় যে সমস্ত প্রতারণা ব্যবহার করে তাহার সমক্ষে উল্লেখ করিলেন। তাহাতে প্রোতিয়স্ জন সমাজে বিজাতীয় লজ্জা প্রাপ্ত হইল। পরিশেষে প্রণয়ি চতুষ্টয় স্ব২ চির প্রেমাসক্ত নায়ক নায়িকা সহ মিলিত হইয়া পরমাহ্লাদে মিলান নগরে প্রত্যাগমন করিলেন এবং নৃপতি সমক্ষে অতিশয় সমারোহ পূর্ব্বক তাঁহাদের পরিণয় ব্যাপার সম্পন্ন হইল ইতি।