সেক্সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/যাদৃশী বাসনা তাদৃশী ঘটনা
যাদৃশী বাসনা তাদৃশী ঘটনা।
যাদৃশী বাসনা তাদৃশী ঘটনা।
মেসালিন্ নগরে সিবাস্তিন নামা এক যুবা এবং বাইওলা নাম্নী এক যুবতী বসতি করিতেন। তাঁহারা যমজ ভ্রাতৃ ভগিনী, এক সময়ে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন। জন্মাবধি তাঁহাদের পরস্পরের অবয়বে এতাদৃশ সৌসাদৃশ্য ছিল যে কেবল পরিচ্ছদের ভিন্নতায় উভয়ের মধ্যে প্রভেদ করা যাইতে পারিত। একদা দুই জনে অণর্ব যানারোহণ পুরঃসর জলপথে ভ্রমণ করিতে গিয়াছিলেন দৈবাৎ অর্ণবতরি ইলাইরা দেশের সম্মুখে জলমগ্ন হওয়াতে উভয়ের প্রাণ বিনাশের সম্ভাবনা হয়। সমুদ্রপোত প্রবল ঝটিকা দ্বারা সাগরের মধ্যবর্ত্তি প্রকাণ্ড পর্ব্বতোপরি নিক্ষিপ্ত হইয়া আদৌ চূর্ণীকৃত হইয়াছিল তাহাতে পোতস্থ ভূরি২ ব্যক্তি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া বিনষ্ট হয়। পরে তরণী জলসাৎ হইবার কালে অবশিষ্ট মানবের নিমগ্ন হইল কেবল কর্ণধার ও কতিপয় নাবিক বাইওলাকে লইয়া একখানি ক্ষুদ্র তরিযোগে পয়োধি তীরে আসিয়া উত্তীর্ণ হইলেন। তরুণী যদিও কূলপ্রাপ্তা হওয়াতে আপনাকে নিরাপদ বোধ করিলেন তথাপি সহোদর জলমগ্ন হইয়াছেন ভাবিয়া সাতিশয় শোকাকুলা হইলেন এবং চীৎকার স্বরে অত্যর্থ বিলাপ করিতে লাগিলেন। কর্ণধার তাঁহাকে বিবিধ প্রবোধ বচনে শান্ত্বনা করিয়া কহিলেন হে ভ্রাতৃবৎসলে তোমার সহোদর জলসাৎ হন্ নাই, যৎকালে অর্ণবযান ভগ্ন হয় তখন বহু দূরে একটা মাস্তুল অবলম্বন পূর্ব্বক সাগর তরঙ্গোপরি তাঁহাকে ভাসিতে দেখিয়াছিলাম অতএব অবশ্য ইলাইরা দেশের নিকট কূল প্রাপ্ত হইয়া থাকিবেন। এতচ্ছ্রবণে বাইওলার শোকাবেগ যৎকিঞ্চিৎ শান্ত হইল কিন্তু কি প্রকারে একাকিনী কাল যাপন করিবেন এতভাবনায় মহা ব্যাকুলা হইলেন। কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করিলেন ইলাইরা দেশ কোন্ দিকে? তদ্বিষয় কি তোমার জ্ঞাত আছে? নাবিক উত্তর করিলেন হাঁ ঐ দেশের বিষয় বিলক্ষণ রূপে অবগত আছি, ইলাইরা নগর আমার জন্মভূমি, এ স্থান হইতে তিন ঘটিকার পথ দূর হইবেক। বাইওলা জিজ্ঞাসিলেন তবে ঐ নগরের অধিপতি কে বল দেখি? কর্ণধার কহিল ইলাইরা নগরের অধিপতির নাম অর্সিনো, তিনি অতি মহাশয় লোক। বাইওলা বলিলেন হাঁ আমিও জনকের প্রমুখাৎ অর্সিনোর মাহাত্ম্যের কথা শুনিয়াছি তৎকালে তিনি অকৃতদার যুবরাজ ছিলেন। কর্ণধার কহিলেন অয়ি বিনীতে ইলাইরাধিরাজ এক্ষণেও অবিবাহিতাবস্থায় আছেন। এক মাস গত হইল আমি উক্ত নগর হইতে আসিয়াছি, আগমন কালে শুনিয়াছিলাম ইলাইরাধিপতি ওলিভিয়া নাম্নী একটী সুশীলা মহিলার প্রেমে সংপ্রতি আসক্ত হইয়াছেন। সেই কামিনী এক জন সম্ভ্রান্ত লোকের দুহিতা। এক বৎসর গত হইল সেই ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে। তিনি মরণ কালে তনয়াটীকে স্বীয় তনয়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া যান্ কিন্তু বিধাতার কি বিড়ম্বনা, কিয়দ্দিন গত হইল কামিনীর সহোদরও পরলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন। সেই অবলা ভ্রাতার প্রতি অতিশয় স্নেহবতী ছিলেন। সর্ব্বদা সহোদরের সহিত একত্র অবস্থিতি করিয়া পরম সুখে কাল যাপন করিতেন। সোদরের শোকে খিন্না হইয়া শপথ করিয়াছেন অন্য পুরুষের মুখাবলোকন অথবা সহবাস করিবেন না। অয়ি সুশীলে মহদ্ব্যক্তিদের কথা সর্ব্বদা সকল লোকে আন্দোলন করিয়া থাকে অতএব পরম্পরায় তদ্বিষয় আমার শ্রুতিগোচর হইয়াছে। বাইওলাও সহোদরের শোকে দগ্ধ হৃদয় হইতে ছিলেন অতএব ভ্রাতৃশোকার্ত্তা ওলিভিয়ার কথা শুনিয়া তাঁহার সমীপে গমন পূর্ব্বক একত্র বাস করিতে বাসনা করিলেন। কামিনী সাতিশয় বিনয় পুরঃসর কর্ণধারকে কহিলেন যদি তুমি অনুগ্রহ প্রকাশ পূর্ব্বক আমাকে ওলিভিয়ার নিকট লইয়া গিয়া তাঁহার সহিত পরিচয় করিয়া দেও তাহা হইলে আমি তাঁহার সেবা করিয়াই চিত্ত বিনোদন পূর্ব্বক কালযাপন করি। কর্ণধার কহিলেন অয়ি সরলে সংপ্রতি ওলিভিয়ার সহিত সাক্ষাৎ হওয়া অতি দুর্ঘট, কামিনী ভ্রাতৃ বিয়োগাবিধি খেদে অন্য পুরুষের কথা দুরে থাকুক প্রণয়ভাজন ইলাইরাধিপতিকেও আপন ভবনে প্রবেশ করিতে দেন না। বাইওলা এতচ্ছ্রবণে উপায়ান্তরাবলম্বন অর্থাৎ পুরুষের পরিচ্ছদ ধারণ পুরঃসর ইলাইরাধিরাজের ভৃত্য বর্গ মধ্যে নিযুক্ত হইতে মানস করিলেন। সুশীলা যুবতীর পুরুষ বেশে নরপতির নিকট পরিচিত হওয়া দুষণাবহ ব্যাপার বটে কিন্তু তিনি যে প্রকার নিরাশ্রয়ে পড়িয়াছিলেন তাহাতে সে সময় ছদ্মবেশাবলম্বনে তাঁহার প্রতি দোষারোপ করিতে পারা যায় না।
বাইওলা কর্ণধারকে সদন্তঃকরণ ও করুণান্বিত দেখিয়া তাঁহার সমীপে আপনার মানস প্রকাশ করিলেন। কর্ণধারও অবলার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তৎক্ষণাৎ সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইলেন। পরে যুবতী স্ব সমভিব্যাহারে যে কিঞ্চিৎ অর্থ ছিল তাহা নাবিকের হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন আমার ভ্রাতা যে প্রকার পরিধেয় ধারণ করিতেন এই অর্থ দ্বারা তদ্রূপ এক প্রস্থ পরিচ্ছদ আমার নিমিত্ত ক্রয় করিয়া আনিয়া দাও। কর্ণধার তাঁহার আদেশ ক্রমে তাদৃশ সজ্জা আনিয়া দিলে তরুণী যখন পুরুষের বেশ ধারণ করিলেন তখন অবিকল ভাতার ন্যায় তাঁহার আকৃতি দৃষ্ট হইতে লাগিল। অতএব তিনি তাদৃশ বেশে ইলাইরা নগরে গমন করিলে তত্রত্য কোন২ ব্যক্তির অদ্ভুত ভ্রম জন্মিবার উপক্রম হইল কেননা সে স্থানে তাঁহার তুল্যাকৃতি সোদরও সমুদ্র হইতে রক্ষা পাইয়া অবস্থিতি করিতেছিলেন, তদ্বিবরণ পশ্চাৎ প্রকাশিত হইবে।
অনন্তর সকরুণ কর্ণধার পুরুষ বেশ ধারিণী নব যৌবনান্বিতা সেই কামিনীর সিজারিও নাম করণ পুরঃসর তাঁহাকে অনায়াসে মহারাজ অর্সিনোর সন্নিধানে লইয়া গেলেন কেননা আপনি রাজসভায় মান্য ছিলেন। ইলাইরাধিরাজ কর্ণধারের সমভিব্যাহারি যুবকের রূপ লাবণ্য অবলোকনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং সিজারিও রাজ সেবকের পদে নিযুক্ত হইবার প্রার্থনা করাতে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ভৃত্য মধ্যে নিযুক্ত করিলেন। বাইওলা যে কর্ম্মের ভার প্রাপ্ত হইলেন তাহা উত্তমরূপে সম্পাদন করত নিরন্তর নৃপতির পরিতোষ জন্মাইতে লাগিলেন এবং ত্বরায় ইলাইরাধিপের স্নেহ ও প্রিয়পাত্র হইলেন। যুবরাজ অর্সিনো সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া সর্ব্বদা তাঁহার সহিত কথোপকথন করিতে আরম্ভ করিলেন। এক দিন ওলিভিয়ার প্রতি আপনার প্রেমের কথা ব্যক্ত করিয়া বলিলেন দেখ সিজারিও আমি সেই তরুণীর প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত বহু দিনাবধি উপাসনা করিয়াছি কিন্তু অনুমান করি তিনি আমার শারীরিক সৌন্দর্য্য ও সম্পত্তিতে ঘৃণা করেন কেননা সংপ্রতি আমাকে সম্মুখে যাইতেও নিষেধ করিয়াছেন, তথাচ সেই নির্দয় দয়িতার প্রতি আমার অন্তঃকরণ এতাদৃক প্রণয় প্রবণ হইয়া আছে যে আমি তাঁহার বিরহে পুরুষ সাধ্য তাবৎ ব্যাপারে নিরুৎসাহ হইয়াছি। পূর্ব্বে পৌরুষ প্রকাশের কথা শুনিলে অন্তঃকরণ সমুৎসুক হইত এক্ষণে ঔৎসুক্য মাত্র জন্মে না কেবল নিরন্তর প্রেমালাপ ও সংপ্রীতির গীত শ্রবণে আমোদ হয় এবং তাহাতেই কাল ক্ষেপ করিতেছি। ইলাইরাধিরাজ রাজকার্য্য পরিহার পূর্ব্বক অহোরাত্র কেবল সিজারিওর সহিত কথোপকথনে অনুরাগী হওয়াতে সভাসদগণ অতিশয় বিরক্ত হইতে লাগিলেন এবং সিজারিওকে রাজার অযোগ্য সঙ্গি বোধ করিলেন।
তরুণীদের পক্ষে সুরূপ যুবরাজদিগের বিশ্বাস পাত্রতায় প্রায় বিপদ ঘটিয়া থাকে। ইলাইরাধিরাজ ওলিভিয়ার প্রতি স্বীয় আসক্তির বিষয়ে পুরুষবেশি বাইওলার সহিত যে সকল কথোপকথন করিলেন তাহাতে তাঁহার হৃদয়ে প্রণয়ানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। বাইওলা ভূপালের প্রেমাভিলাষিণী হইয়া মদনবাণে জর্জরিত হইতে লাগিলেন। কিন্তু ওলিভিয়ার ব্যবহার স্মরণ পুরঃসর সাশ্চর্য্য চিত্তে এক২বার এই বিতণ্ডা করিলেন সেই যুবতী অতুল্য রূপবান্ অনুপম গুণ নিধান এই পুরুষকে কি নিমিত্ত উপেক্ষা করিলেন। মহারাজ রূপে রতিপতি, যাহার নয়নগোচর হন সেই ব্যক্তিই দৃষ্টির সার্থকতা বোধে কৃতার্থম্মন্য হইয়া ইহাঁর প্রশংসা করেন। অনন্তর যুবরাজ অর্সিনোর প্রতি নিবেদন করিলেন মহারাজ এ অতি খেদের বিষয়। সেই রমণী দৃষ্টিহীনা, আপনার এতাদৃশ অসংখ্য গুণ কিছুই দেখিতে পায় না তথাপি আপনি অনুরাগ প্রকাশ করত তাহাকে প্রেমাসক্তা করিতে যত্ন করিতেছেন। প্রভো আপনি ওলিভিয়াতে যদ্রূপ প্রীতি প্রদর্শন করিলেন অন্য কোন কামিনী যদিস্যাৎ আপনার প্রতি তদ্রূপ প্রেম প্রকাশ করে তবে কি তাহাতে অনুরাগী হইবেন না? হে কৃপানিধান আমি নিশ্চয় বলিতে পারি কোন সুরূপা সুন্দরী আপনার প্রতি ততোধিক প্রণয় নিবন্ধন করিয়াছে কিন্তু আপনি যদিস্যাৎ সেই অবলাতে অনুরাগ প্রদর্শন না করেন প্রত্যুত তাহাকে কহেন আমি তোমার সহিত প্রণয় করিব না তাহা হইলে আপনার এতদ্রূপ নিষ্ঠর উত্তর প্রাপ্ত হইয়া সে মহিলা কি নিরস্ত থাকিবে না? অবশ্য থাকিবে। যুবরাজ অর্সিনো বাইওলা সুন্দরীর এতদ্বচনের তাৎপর্য পর্যালোচনে মনোযোগ না করিয়া তাহা সমূলে অস্বীকার করত কহিলেন সিজারিও আমি ওলিভিয়াতে যে প্রকার প্রণয় নিবন্ধন করিয়াছি স্ত্রীলোকের তাদৃক্ প্রেম কদাপি সম্ভবে না। ফলতঃ অবলা জনের অন্তঃকরণ স্বভাবতঃ সঙ্কীর্ণ সুতরাং তন্মধ্যে অধিক প্রেম থাকিতে পারে না অতএব আমি ওলিভিয়াকে যদ্রূপ ভালবাসি কোন অঙ্গনার তাদৃশী আসক্তি আমার প্রতি হওয়া সর্ব্বতোভাবে অসম্ভব। যদিও বাইওলা ভৃত্যত্ব স্বীকারাবধি যুবরাজের কথা অত্যন্ত মান্য করিতেন তথাপি এতদ্বাক্য মনে২ অপ্রকৃত জ্ঞান করিতে লাগিলেন কেননা অর্সিনোর হৃদয়ের ন্যায় তাঁহার অন্তঃকরণ প্রণয় রসে আর্দ্রীভূত হইয়াছিল। অতএব তিনি যুবরাজের ঐ কথায় এতাবন্মাত্র প্রত্যুক্তি করিলেন প্রভো এতদ্বিষয় আমার বিদিত আছে। অর্সিনো ব্যস্ত সমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন কি জান বল দেখি? বাইওলা নিবেদন করিলেন মহারাজ কামিনীগণ নায়কের প্রতি কি পর্য্যন্ত অনুরাগ প্রকাশ করেন শ্রবণ করিবেন হে নরনাথ আমারদের অন্তঃকরণ যদ্রূপ, অবলাজনের মনও তদ্রূপ। হে নৃপবর আমার পিতার এক কন্যা ছিল। সে কোন যুবা পুরুষের প্রেমে বিমুগ্ধা হইয়াছিল অর্থাৎ আমি অবলা হইলে আপনাতে যাদৃক্ প্রণয় নিবন্ধন করিতাম সেও নায়কের প্রতি তাদৃক্ প্রেম করিত। যুবরাজ বলিলেন তাহার প্রেমের বৃত্তান্ত বল দেখি। বাইওলা বিনীতি প্রদর্শন পুরঃসর নিবেদন করিলেন প্রভো বৃত্তান্ত জ্ঞাত নাই, আমার ভগিনী প্রেমের কথা কাহার নিকট ব্যক্ত করিত না, সতত গোপন করিয়া রাখিত। তাহার প্রণয় বাসনা কুসুম কলিকা মধ্যস্থ কীটের ন্যায় ক্রমশ মধুরাকৃতির শোভা হরণ করিয়াছিল অর্থাৎ নিরন্তর চিন্তাদ্বারা শরীর শীর্ণ ও মনঃপীড়ায় বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল তথাচ ধৈর্য্যাবলম্বন পরঃসর উপবেশন করিয়া হাস্য করিত। যুবরাজ জিজ্ঞাসিলেন সে কামিনী কি প্রেমের জন্য প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে? বাইওলা এতৎ প্রশ্নে ঈদৃশী ভঙ্গি করিয়া উত্তর দিলেন তাহাতে স্পষ্ট বোধ হইল যেন স্বয়ং অর্সিনোর প্রতি স্বীয় গুঢ়ানুরাগ ব্যক্ত করিবার নিমিত্ত উক্ত উপন্যাস কল্পনা করিলেন।
সে যাহা হউক। বাইওলা যুবরাজের সহিত যৎকালে এবম্প্রকারে কথোপকথন করিতেছিলেন সে সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাদের সম্মুখবর্ত্তী হইল। যুবরাজ তাহাকে ওলিভিয়ার ভবনে প্রেরণ করিয়াছিলেন। সে তথাকার সমাচার আনয়ন পূর্ব্বক নিবেদন করিল মহারাজ আমি কামিনীর দর্শন প্রাপ্ত হইলাম না, যুবতী স্বকীয় কর্ম্মকরীর দ্বারা আপনার কথার এই উত্তর পাঠাইয়া দিলেন অদ্যাবধি সপ্ত বৎসর কাহাকেও আপনার আস্য দর্শন করাইবেন না, সন্ন্যাসিনীর ন্যায় বদনাবরণ ধারণ পুরঃসর সোদরের নিমিত্ত নিজ কুটীরে বসিয়া অজস অস্রপাতে কাল যাপন করিবেন। যুবরাজ এতদ্বার্ত্তা শ্রবণে উচ্চ স্বরে বলিলেন হায় যাহার চিত্ত মৃত সোদরের নিমিত্ত এতাদৃশ শোকাকুল, তাহার হৃদয় মদনবাণে আহত হইলে, না জানি কতই প্রেম প্রকাশ হইবে। পরে পুরুষ বেশধারিণী বাইওলাকে সম্বোধন করত কহিলেন সিজারিও আমার মনোগত সকল বিষয় তোমার নিকট প্রকাশ করিয়া কহিয়াছি, হে সুশীল তুমি একবার ওলিভিয়ার নিকেতনে গমন কর, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া আসিও না, তাঁহার গৃহদ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া সম্ভাষা করিও যাবৎ তোমার সহিত সাক্ষাৎ না করেন তাবৎ সে স্থান হইতে বিচলিত হইও না। বাইওলা বলিলেন প্রভো যদিস্যাৎ সেই মহিলা কথোপকথন করিতে অনুমতি করেন কি করিব? অর্সিনো বলিলেন কথা উপস্থিত হইলে আমার প্রণয়ের প্রসঙ্গ করিও আমি তাঁহার নিমিত্ত যে প্রকার ব্যাকুল হইয়াছি দেখিতেছ উত্তম রূপে কহিয়া শুনাইও, তুমি অতি উপযুক্ত পাত্র, আমার পক্ষ হইয়া তাঁহার সহিত বিলক্ষণ রূপে কথোপকথন করিতে পারিবে এবং দৃঢ় বিশ্বাস হয় প্রবীণ ব্যক্তি অপেক্ষাও তোমার কথায় তাঁহার অধিক মনোযোগ হইবে।
বাইওলা স্বয়ং যাহার অঙ্কলক্ষ্মী হইবার নিমিত্ত মনোমধ্যে সাতিশয় অভিলাষ করিতেন তাঁহার প্রতি অন্য কামিনীর প্রণয়োৎপদনার্থ প্রেরিত হওয়াতে যদিও প্রশস্ত মনে যাত্রা হইল না, তথাপি ভৃত্যত্ব স্বীকার করাতে প্রভুর নিদেশ রক্ষা নিমিত্ত সত্বর ওলিভিয়ার সদনে গিয়া উপস্থিত হইলেন এবং যে কার্য্যের ভার হইল অতি বিশ্বস্ত রূপে তাহা সম্পন্ন করিলেন। কিঙ্করবেশ ধারিণী তরুণী ওলিভিয়ার আলয়ে উপনীত হইয়া একজন ভৃত্যদ্বারা সংবাদ করিলেন এক যুবক সাক্ষাৎ করিবার আশয়ে দ্বারে আসিয়াছে। ভৃত্য কর্ত্রীর সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক নিবেদন করিল একটী তরুণ কিঙ্কর আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান রহিয়াছে আমি তাহাকে কহিয়াছি এক্ষণে কর্ত্রী অসুস্থ আছেন সাক্ষাৎ হইবে না, কিন্তু সে কহিল তাহা আমার জ্ঞাত আছে তজ্জন্যই কথোপকথন করিতে আসিলাম। তদনন্তর তাহাকে নিরস্ত করণাশয়ে মিথ্যা করিয়া কহিলাম কর্ত্রী শয়নাগারে নিদ্রিতা আছেন সাক্ষাৎ হইবে না। তাহাতে সে বলিল তাহাও আমার অবিদিত নাই তন্নিমিত্ত আলাপ করিবার মানসে আসিয়াছি, এ বিষয়ে আপনকার কি আদেশ হয় বলুন সে দ্বারে দণ্ডায়মান আছে গিয়া কি বলিব। নানা প্রকার আপত্তি করিয়াছি কোনমতে আপনার সঙ্কল্প হইতে বিচলিত হয় নাই। তাহার সহিত আলাপ করিতে আপনকার ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক সে সাক্ষাৎ করণ পুরঃসর কথোপকথন করিতে বোধ হয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। ওলিভিয়া দূতের দৃঢ়প্রতিজ্ঞতার বার্ত্তা শ্রবণে তাহাকে দেখিতে মানস করিয়া নিকটে আহ্বান করিলেন কিন্তু ভৃত্যকে কহিয়া দিলেন বসনদ্বারা বদনাবরণ পুরঃসর একবার মাত্র তাহার বাক্য শ্রবণ করিব বার্ত্তাবহের দৃঢ় প্রতিজ্ঞতার দ্বারা নিঃসন্দেহ বোধ হয় সে ব্যক্তি মহারাজের দূত হইবে, নৃপ নিকেতন হইতে আসিয়াছে। অনন্তর ভৃত্য আসিয়া কর্ত্রীর সন্নিধানে যাইবার কথা কহিলে কিঙ্কর রূপিণী বাইওলা পুরুষের প্রকৃতি ধারণ পূর্ব্বক সম্ভ্রান্ত মনুষ্যের ভৃত্যের ন্যায় ওলিভিয়ার সমীপে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন এবং বসনাবৃত মুখী কামিনীর প্রতি অতি মধুর বচনে কহিতে লাগিলেন অয়ি রূপ লাবণ্যময়ি আপনিই কি এই বাটীর কর্ত্রী? গৃহাধ্যক্ষার সমীপেই আমার বক্তব্য আছে তদ্ভিন্ন অন্য ব্যক্তির নিকট আমার বাঙ্নিষ্পত্তি নিষ্ফল। ফলতঃ আমি বহু পরিশ্রমে বাক্য রচনা অভ্যাস করিয়াছি কর্ত্রীর সন্নিধানে কহিতে পারিলে কৃতার্থম্মন্যা হইব। ওলিভিয়া পুরুষবেশি কিঙ্করের এতাবদুক্তি শ্রবণানন্তর জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কোথা হইতে আসিলে? বাইওলা ইহাতে এতাবন্মাত্র প্রতিবচন প্রদান করিলেন এরূপ প্রশ্নের উত্তর অভ্যাস করি নাই আমি কেবল অভ্যস্ত বিষয় কহিতে পারি। ওলিভিয়া বলিলেন তুমি কৌতুকী পুরুষ না কি? বাইওলা বলিলেন, না, আমার আকৃতি যদ্রূপ প্রকাশ পাইতেছে তদ্রূপ নহে অর্থাৎ ভঙ্গিক্রমে বলিলেন আমি অবলা, পুরুষের বেশ ধারণ করিয়াছি। পরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন আপনিই কি বাটীর কর্ত্রী? ওলিভিয়া বলিলেন হাঁ আমি এ গৃহের অধ্যক্ষা। বাইওলা স্বীয় প্রভুর নিদেশ তাঁহার সুগোচর করণ অপেক্ষা তদীয় মুখমণ্ডল অবলোকন করিতে সমুৎসুকা হইয়া বলিলেন ঠাকুরাণি আপনকার বদনারবিন্দ সন্দর্শনার্থ অতিশয় বাসনা হইতেছে। ওলিভিয়া কিঙ্করের এই সাহসিক প্রস্তাব গ্রহণ করিতে পরাঙ্মুখী হইলেন না। যদিও ঐ প্রগল্ভা অবলা যুবরাজের প্রেমে এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত দয়ার্দ্রা হন্ নাই তথাপি রাজভৃত্য সিজারিওর রূপ গুণ দর্শনে যৎপরোনাস্তি বিমুগ্ধা হইলেন। বাইওলা মুখমণ্ডল অবলোকনাথ প্রার্থনা করিলে ওলিভিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কহিতে লাগিলেন তোমার প্রভু কি আমার মুখের সহিত কার্য্য করিতে আদেশ করিয়াছেন? কিন্তু বার্ত্তাবহের ভাব ভক্তির দ্বারা আশু তাঁহার প্রতি সন্তোষ জন্মিবাতে সপ্ত বৎসর পর্য্যন্ত বদনাবরণ ধারণ করিবেন যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন তাহা বিস্মৃত হইয়া গেলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে আবরণ উন্মোচন পুর্ব্বক বলিলেন আমি এই অবগুণ্ঠন উত্তোলন করিলাম বিচিত্র চিত্র অবলোকন কর, কেমন এ কি উত্তম নহে? বাইওলা পরম পরিতোষ প্রকাশ পুরঃসর কহিতে লাগিলেন আপনকার বদনারবিন্দ অনুপম সৌকুমারান্বিত এতাদৃশ না হইবেক কেন? প্রকৃতি সুনিপুণ কর করণক চমৎকার ভাবে আপনকার কপোল দ্বয় নির্ম্মাণ করিয়াছেন। কিন্তু যদিস্যাৎ আপনার এই আকৃতি জগতের মধ্যে প্রতিকৃতি না রাখিয়া কাল বশতঃ ভূমিসাৎ হয় তাহা হইলে আপনা অপেক্ষা এ ভূমণ্ডলে নির্দয় মহিলা অরি নাই। ওলিভিয়া বলিলেন, না, আমি এতদ্বিষয়ে নিষ্কৃপ হইব না, জগতীতলে আপন আকৃতির প্রতিকৃতি অবশ্য স্থাপন করি। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তুমি কি মদীয় শোণবর্ণ ওষ্ঠ, ধূষরবর্ণ লোচন, বিচিত্র গ্রীবাদেশ এবং চমৎকার চিবুকাদি অবয়বের প্রতিষ্ঠা নিমিত্ত এ স্থানে প্রেরিত হইয়াছ? বাইওলা বলিলেন ঠাকুরাণি আমি আপনকার অঙ্গ সৌষ্ঠব অবলোকন করিলাম আপনি পরমা সুন্দরী বটেন কিন্তু অতিশয় অভিমানবতী, কেননা আমার প্রভু আপনার প্রতি অনির্ব্বচনীয় রূপে প্রেম করেন আপনি তাঁহার সহিত সমুচিত সম্ভাষণ করিয়াও প্রণয়ের পুরস্কার করেন না? আপনি কামিনী মণ্ডলের কিরীট স্বরূপা বটেন কিন্তু গুণজ্ঞা নহেন। আহা, অর্সিনোর চিত্ত চকোর চন্দ্রবৎ আপনাতে প্রণয়ী হইয়া বিরহে নিরন্তর বিষণ্ণ হইতেছে আপনি তাহার প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়াও অনুকম্পা করেন না। ওলিভিয়া বলি-
লেন তোমার প্রভু জানিতে পারিয়াছেন আমি তাহার প্রতি অনুরাগিণী হইব নয়, তবে কেন আমার প্রণয়াভিলাষ করেন? তিনি অতিশয় সদাণাধিত, ধর্মিষ্ঠ, ধনবান, এবং নিষ্কলঙ্ক নবীন পুরুষ বটেন, সকলেই স্থির প্রতিজ্ঞ সুশীল ও পরাক্রমী বলিয়া তাহার প্রতিষ্ঠা করে ইহাও সত্য, কিন্তু আমার চিত্ত তাহার প্রতি প্রণয় নিবন্ধনে কোন ক্রমে উৎসুক নহে তোমার প্রভু কি এতদ্বিষয় অবগত নহেন? এত দিন কহিয়া পাঠান্ নাই কেন? কোন্ কালে উত্তর প্রাপ্ত হইতেন। বাইওলা বলিলেন আমি যদিস্যাৎ প্রভুর ন্যায় আপনার প্রেমে আসক্ত হইতাম তাহা হইলে নিরন্তর আপনকার দ্বারে তরুবৎ দণ্ডায়মান হইয়া থাকিতাম এবং সংগীত রচনা করিয়া নিশাযোগে গান ও উচ্চস্বরে নামোচ্চারণ করিতাম। আপনার নামের প্রতিধ্বনি গিরি গহ্বর ব্যাপিনী হইয়া বায়ুবেগে বহুদূর চালিতা হইলে আপনি স্নেহ প্রকাশ না করিয়া অবনিমণ্ডলে অবস্থিতি করিতে পারিতেন না, অবশ্য করুণী বিতরণ করিতেন। ওলিভিয়া বলিলেন এবম্প্রকার ব্যবহার করিলে কিছু হইলেও হইতে পারিত। সে যাহা হউক, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি কোন বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছ? বাইওলা উত্তর প্রদান করিলেন ঠাকুরাণি আমার অদৃষ্টই মন্দ কিন্তু সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মিয়াছি এবং অবস্থাও অপ্রশস্ত নহে। ওলিভিয়া এতদ্বচন শ্রবণে বিদায় দিতে ইচ্ছা না হইলেও এই বলিয়া নিবৃত্ত করিলেন তুমি স্বীয় প্রভুর সমীপে গিয়া বল আমি তাহার সহিত প্রেম করিব না, আর যেন আমার নিকট দূত প্রেরণ না করেন। তোমার প্রমূখাৎ এই সমস্ত কথা শুনিয়া কি প্রকার ব্যবহার করেন তদ্বিষয় অস্মদাদির সুগোচর করণার্থ যদিস্যাৎ তোমার বাসনা হয় আসিও বারণ করি না। বাইওলা এতদ্বচনে ওলিভিয়াকে নির্দয় মহিলা বলিয়া সম্বোধন করত নমস্কার করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। দ্রুত এবম্প্রকারে নিরাকৃত হইয়া গমন করিলে ওলিভিয়া আপনাআপনি তাহার কথা উচ্চারণ করিতে লাগিলেন যথা অদৃষ্টই মন্দ কিন্তু সম্ভান্ত বংশে জন্ম এবং অবস্থাও অপ্রশস্ত নয়। কিয়ৎ ক্ষণ পরে চীৎকার করিয়া উঠিলেন আমিও শপথ পূর্ব্বক কহিতে পারি তিনি বাস্তব মহদ্ব্যক্তি, তাঁহার আকৃতি প্রকৃতি দ্বারা স্পষ্ট রূপে সপ্রমাণ হইয়াছে ভদ্র লােক বটেন। অনন্তর ইচ্ছাপুর্ব্বক কহিতে লাগিলেন আহা সিজারিও কেন যুবরাজ হন নাই, আবার আপনাতে ধিক্কার দিয়া বলিলেন ছিঃ আমি কি অপদার্থ, এত অরায় তদীয় প্রণয় রজুতে বদ্ধ হইলাম। কিন্তু আত্মকর্মের উপর যে দোষ প্রদান করে তাহা অন্তঃকরণ মধ্যে প্রায় প্রগঢ়ি হইয়া থাকে না। সুতরাং সুশীলা ওলিভিয়া অপনার ও রাজ কিঙ্করের অবস্থার অসমানতা ও কুমারীদিগের প্রধান অলঙ্কার যে গাম্ভীর্য্য তাহা বিস্মরণ পুরঃসর পুনর্ব্বার যুবা সিজারিওর প্রেমাভিলাষিণী হইলেন। অতএব একটী হীরকারী স্বীয় দাসের হস্তে দিয়া ছল পূর্ব্বক এই বলিয়া তন্নিকটে প্রেরণ করিলেন যুবরাজ অর্সিনাের সকাশাৎ এই অঙ্গুরীয়ক উপহার আনিয়াছিলে প্রত্যাগমন কালে বিস্মৃতি ক্রনে রাখিয়া যাও অতএব পাঠাইয়া দিলেন। ওলিভিয়ার এবম্পকার ছল করিবার তাৎপর্য এই যে সিজারিও তদীয় মানস বুঝিতে পারিবেন। ভৃত্য অঙ্গরী আনিয়া উপস্থিত হইলে বাইওলা মনােমধ্যে পরিতাপ করিতে লাগিলেন এবং স্মরণ করিয়া দেখিলেন নিজ প্রভু তাহার দ্বারা কোন অলঙ্কার প্রেয়সীর নিকট উপহার পাঠা নাই। অধিকন্তু তাঁহার স্মৃতি পথে আবিভূত হইল তরুণী ওলিভিয়া অন্তঃস্নিগ্ধ বচনে তাহার সহিত কথােপকথন করিয়াছেন অতএব অঙ্গরী দর্শনে স্পষ্ট রূপে বুঝিতে পারিলেন প্রভুর প্রেয়সী আমার প্রণয়াকাক্ষিণী হইয়াছেন। অবশেষে খেদ করিতে কহিতে লাগিলেন হায় আমার সহিত প্রেম করা ও স্বপ্নের প্রতি প্রণয় বন্ধন তুল্য পদার্থ। যাহা হউক, ছদ্ম বেশ অতি ভয়ঙ্কর, আমি যেমন অর্মিনোর নিমিত্ত অনর্থক দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছি ওলিভিয়াও কি আমার জন্য তাদৃক্ বিলাপ করিতে লাগিলেন। অনন্তর বাইওলা ভূপালালয়ে প্রবেশ পুর্ব্বক যুবরাজ অর্সিনোর সন্নিধানে নিবেদন করিলেন মহারাজ ভবদীয় প্রার্থনা সিদ্ধির সম্ভাবনা মাত্র দেখিলাম না, হে নৃপবর আপনকার প্রণয়াস্পদ ওলিভিয়া কহিলেন কি, যুবরাজ আমাকে এ প্রকারে নিরন্তর কেন বিরক্ত করেন? কিন্তু অসিনোর অন্তঃকরণ কামিনীর প্রণয় বাসনায় বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল সুতরাং এতদ্রুপ নিরাকরণ বচনেও নিবৃত্ত হইল না। তিনি ক্ষণ কাল নিরাশ হইয়া পুনর্ব্বার আপন প্রণয়েদ্রেকে আশা করিতে লাগিলেন সুচতুর সিজারিও যত্ন করিলে প্রিয়তমার প্রবৃত্তি লওয়াইতে পারিবে। অতএব তাহাকে আদেশ করিলেন আগামি কল্য পুনর্ব্বার প্রেয়সীর সদনে গমন করিতে হইবে। পরে প্রিয়তমার নিমিত্ত অস্থির হওয়াতে কোন প্রকারে কাল হরণের মানসে যে গীত ভাল বাসিতেন তাহা গান করিতে অনুমতি করিয়া প্রিয় কিঙ্করকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন সিজারিও গত নিশাভাগে যে গীত গাহিয়াছিলে তাহা পুরাতন বটে কিন্তু ভাব অতি চমৎকার, শ্রবণ করিয়া আমার বিরহাতুর হৃদয়ের যথেষ্ট শান্ত্বনা হইয়াছিল। কুমারীর। আতপে উপবেশন করিয়া সূত্রকর্ত্তন করিবার কালে ঐ গীত গান করিয়া থাকে। যদিও তাহার রচনা বিচিত্র নহে তথচ আমি অতিশয় ভাল বাসি কেননা তাহাতে প্রাচীন কালীন প্রেমের বিবরণ জানিতে পারাযায়।
সেই সংগীতে সুললিত ভাষায় বিরহ যন্ত্রণার বর্ণনা থাকাতে যুবরাজের আদেশ হইবা মাত্র বাইওলা গান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং গীতের ভাবার্থ স্বয়ং যে বিলক্ষণ রূপে বুঝিয়াছেন মুখভঙ্গি দ্বারা প্রকাশ করিলেন। অর্সিনে সংগীত সময়ে তাঁহার শোকাবহ আকার অবলোসেক্সপিয়র। কন করিয়া কহিলেন সিজারিও তোমার বয়ঃক্রম অল্প বটে কিন্তু অনুমান হয় কোন প্রিয়তমার বদন সুধাকর নিরীক্ষণে তোমার চিত্ত তাহাতে আসক্ত হইয়াছে তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত সর্ব্বদা বাসনা কর। বল দেখি সত্য কি না? বাইওলা বিনয় পুরঃসর নিবেদন করিলেন প্রভো কিঞ্চিৎ সত্য বটে। অর্সিনে জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার মনেহারিণীর আকার কি রূপ, কত বয়স? বাইওলা বলিলেন মহারাজ আমার চিত্ত বিলাসিনী অবিকল আপনাকার তুল্য। যুবরাজ এ কথায় হাস্য করিয়া মনে করিলেন এই যুবক স্বাপেক্ষা অধিক বয়স্কা কোন কামিনীর প্রণয়াসক্ত হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু বাইওলা তাহাকেই লক্ষ্য করিয়া ঐ রূপ উক্তি করিলেন যুবরাজের ন্যায় তাহার চিত্তে কোন অঙ্গন স্থান লাভ করে নাই।
সে যাহা হউক, বাইওলা প্রভুর আদেশ ক্রমে পর দিবস ওলিভিয়ার আলয়ে গমন করিলেন এবং অতি সহজে সমীপে গিয়া সাক্ষাৎ করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হইলেন। কামিনীগণ সুরূপ যুরা দূতদের সঙ্গে সানন্দ চিত্তে কথোপকথন করিলে ভৃত্যের। তাহাদের অভিপ্রায় প্রায় বুঝিতে পারে ওলিভিয়ার কিঙ্কর বর্গ পুরুষ রূপি বাইওলার সহিত কত্রীর কথাবার্তা শ্রবণ করিয়া মনোগত ভাব লক্ষ্য করিয়াছিল সুতরাং পুনর্ব্বার তিনি আসিয়া দ্বার দেশে দণ্ডায়মান হইলে সমাদর পুরঃসর কত্রীর সন্নিধানে লইয়া গেল। বাইওলা সাক্ষাৎ করণানন্তর প্রভুর প্রণয়ের প্রসঙ্গ করত কথোপকথন আরম্ভ করিলে ওলিভিয়া কহিলেন তোমাকে পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি আমার নিকট তাহার প্রসঙ্গ করিও না। আমি তাহার কোন কথা শুনিতে চাহি না, যদি অন্য কোন বিষয়ের কথা কহ তাহা হইলে সুমধুর বাদ্যধ্বনি অপেক্ষা অধিক মিষ্ট বোধে মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিব। ওলিভিয়ার এতদ্বচনে বাইওলার সহিত প্রণয়বাসনা স্পষ্ট রূপে প্রকাশমান হওয়াতে বাইওলা কিঞ্চিৎ বৈরক্তি লক্ষণ ব্যক্ত করিতে লাগিলেন তাহাতে ওলিভিয়া বলিলেন আহা তোমার অবজ্ঞা কি মনোজ্ঞ এবং কোপ কি শোভাকর। ওহে সিজারিও যৌবন গৌরব যদিও বসন্ত সময়ের সুরভি সুদৃশ্য কুসুম তুল্য অচিরস্থায়ি তথাপি তাহার প্রাবল্যে অতিশয় অধীর হইয়াছি। আমি শপথ পূর্ব্বক কহিতেছি তোমার প্রতি আমার যৎপরোনাস্তি আসক্তি জন্মিয়াছে তোমার সাহঙ্কার প্রকৃতি অবলোকন করিয়াও স্বীয় প্রণয় বাসনা গোপন করিতে পারিলাম না। কিন্তু কামিনীর এতাবদুক্তি বিফল হইল, কেননা বাইওলা আর প্রভুর প্রণয়ের কথা কহিতে আসিব না এতাবন্মাত্র কহিয়া তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। গমন কালে অব্যক্ত স্বরে এই কথাটী কহিয়া গেলেন অবলা হইয়া কখন তবলাতে প্রেম করিও না।
বাইওলা বিরক্ত ভাবে প্রত্যাগমন করেন ইত্যবসরে ওলিভিয়ার প্রেমে বঞ্চিত এক ব্যক্তি তাহার পরাক্রম পরীক্ষা নিমিত্ত সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে মহারাজের এক জন যৎ সামান্য দূতের প্রতি প্রেয়সীর আসক্তির কথা শ্রবণ করিয়াছিল অতএব সম্মুখীন হইয়া মল্লযুদ্ধ যাচ্ঞা করিল। বাইওলা অবলা, কেবল ভ্রাতৃশোকে পুরুষ বেশে কাল যাপন করিতেছিলেন, যুদ্ধের কথায় চক্ষুঃস্থির করিয়া রহিলেন। ফলতঃ স্ত্রী স্বভাব প্রযুক্ত আপনার অসির প্রতিই দৃষ্টি করিতে তাহার শঙ্কা হইত পুরুষের সঙ্গে সমরের কথায় সুতরাং যৎপরোনাস্তি ত্রাস জন্মিল।
পরন্তু বাইওল যখন দেখিলেন শত্রু অসি নিষ্কাসন পুরঃসর আক্রমণার্থ অগ্রসর হইতে লাগিল তখন মনেই বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন এক্ষণে আপনার অবল। রূপ প্রকাশ করি কেননা তদ্ব্যতীত পরিত্রাণের উপায়ন্তর দেখি না। কিন্তু তৎকালে হঠাৎ এক ব্যক্তি আগমন পূর্ব্বক তাহার প্রতি আনুকুল্য করাতে যুবতী পথিমধ্যে ছদ্মবেশ প্রকাশের লজ্জা হইতে পরিত্রাণ পাইলেন। ঐ ব্যক্তির সহিত যদিও তরুণীর পরিচয় ছিল না তথাপি তিনি বহু কালের পরিচিত ও পরম বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করত সেই আক্রমণকারির প্রতি আক্রোশ পূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন যদিসৎ এই যুবা তোমার কোন অপকার করিয়া থাকেন সে অপরাধ আমার বলিয়া গণ্য কর, সাবধান, ইহার অপমান করিবার উপক্রম করিলে আমি তোমার সহিত সংগ্রাম করিব। বাইওলা এই অপরিচিত মিত্রের অকৃত্রিম সৌহার্দ্য নিমিত্ত ধন্যবাদ এবং তাহার অকস্মাৎ ঈদৃশ করুণা প্রকাশের কারণ জিজ্ঞাসা না করিতে ঐ ব্যক্তি হঠাৎ অপর এক প্রবল শক্ত দ্বারা আক্রান্ত হইলেন তাহাতে তাহার শৌর্য বীর্যের কোন কার্য্য হইল না। ঐ অপরিচিত পুরুষ পূর্ব্বে রাজার কোন প্রকার অনিষ্ট করিয়াছিলেন এ কারণ রাজপুরুষগণ সেই সময় দেখিতে পাওয়াতে মহারাজের নাম গ্রহণ পূর্বক তাহাকে ধৃত করিল। সুতরাং তিনি বাইওলাকে কহিতে লাগিলেন তোমার অন্বেষণ করিতে আসিয়া আমার এই দুর্দশা ঘটিল। অনন্তর বাইওলার নিকট কতকগুলি মুদ্রা যাচ্ঞা করত কহিলেন বিশেষ প্রয়োজন বশতঃ তোমার নিকট সেই টাকা চাহিতেছি, স্বয়ং দুরবস্থায় পতিত হইলাম এতন্নিমিত্ত দুঃখিত নহি, তোমার বিপদের প্রতীকার করিতে অক্ষম হওয়াতে সাতিশয় খেদিত হইতেছি। তুমি নিস্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলে কেন? ধৈর্য্যাবলম্বন কর। বাইওলা সেই ব্যক্তির এই সমস্ত কথাতে আশ্চর্যান্বিত হইলেন অনেক ক্ষণ হতজ্ঞান হইয়া থাকিয়া শেষে কহিলেন তুমি কে? আমি চিনি, তোমার নিকট কখন মুদ্রা লইলাম? তুমি আমার প্রতি দয়া প্রকাশ করিয়াছ এ নিমিত্ত আমার সমীপে যৎকিঞ্চিৎ যাহা আছে প্রদান করি গ্রহণ কর। তিনি এতৎ এবণে কোপাবিষ্ট হইয়া নিষ্ঠুর কৃতঘ্ন বলিয়া ভৎসনা করিতে লাগিলেন এবং কহিলেন আমি তোকে মৃত্যুর করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করিয়াছি এবং তোর নিমিত্ত এ নগরে আসিয়া এই বিপদে পড়িলাম সমুদায় উপকার বিস্মৃত হইলি আমার এতদবস্থাতেও তোর দয়া হইল না? কিন্তু রাজপুরুষগণ তাঁহার বাক্যে মনোযোগ করিল না, তাহারা বলিল আমাদের এ সকল কথায় কর্ণপাত করিবার প্রয়োজন কি? এই বলিয়া বলে ধারণ পূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে লইয়া গেল। সে ব্যক্তি গমন কালে বাইওলাকে সিবাস্কিন বলিয়া সম্বোধন করত সাক্রোশ বচনে বলিতে লাগিলেন ভাল তোর ব্যবহার মনে রহিল। বাইওলা আপনার প্রতি সিবাস্তিন সম্বোধন শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং তাহার বিশেষ যত্ন হইল তথ্য জিজ্ঞাসা করেন কিন্তু রাজপুরুষেরা সেই ব্যক্তিকে লইয়া সত্বর গমন করাতে অনুসন্ধান করিতে পারিতেন না। আপনি আপনার মনে বিতর্ক করিতে লাগিলেন বোধ হয় ঐ অপরিচিত ব্যক্তি অবয়ব সাদৃশ্যে আমার সহোদর ভাবিয়া আমাকে ঐ প্রকার সম্বোধন করিয়া গেলেন অনুমান করি তাহা কর্তৃক ভাতার জীবন রক্ষা হইয়া থাকিবেক। বস্তুতঃ সেই ব্যক্তি তাঁহার সহোদরের জীবন দাতা। তাহার নাম আন্তোনিও, তিনি এক অর্ণবযানের কর্ণধার ছিলেন। সিবাস্তিন যৎকালে সমুদ্রোপরি মাস্তুল সঙ্গে ভাসিয়া ক্লান্ততা প্রযুক্তি নিমগ্ন প্রায় হন তখন তিনি তাহার প্রতি দয়া প্রকাশ করিয়া স্বীয় পোতমধ্যে তুলিয়া লয়েন এবং তাহাকে আশ্রয় প্রদান পুরঃসর স্বনিকটে রাখিয়া প্রতিপালন করেন যেখানে গমন করিতেন সেই স্থানেই সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতেন। সিবাস্তিন অর্সিনো নৃপতির রাজসভা দর্শনের মানস প্রকাশ করতে তাঁহাকে সঙ্গে নাইয়া ইলাইরা নগরে আসিয়াছিলেন। পরন্তু তিনি নাবিক যুদ্ধে মহারাজ অসিনোর ভ্রাতৃ পুলকে আঘাতি করিয়াছিলেন ইহাতে নিশ্চয়। জানিতেন রাজপুরুষদের কর্তৃক ধৃত হইলে ঐ দোষের কারণ দারুণ সঙ্কটে পড়িবেন স্নেহ বশতঃ সিবাস্তিনের অনুরোধে ইলাইরা নগরে আসাতে তাহাই ঘটিল রাজপুরুষেরা তাহাকে ধরিয়া কারাবৃত করিল।
আন্তোনিও সিবাস্তিন সমভিব্যাহারে ইলাইরা নগরে পদাপর্ণ করিয়া তাহার হস্তে কতকগুলি মুদ্রা প্রদান পূর্বক কহিয়াছিলেন এই নগরে বহুবিধ উত্তমোত্তম দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয় হয় যদিস্যাৎ কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে অভিলাষ জন্মে এই মুদ্রা ব্যয় করিও আমি তোমার সঙ্গে যাইব না পান্থশালায় অবস্থিতি করি তুমি নগর ভ্রমণ করিয়া ত্বরায় আসিও। কিন্তু সিবাস্তিন অধিক কাল বিলম্বে প্রত্যাগমন না করতে তাহার অন্বেষণ নিমিত্ত স্বয়ং বহির্গত হয়ে এবং পথিমধ্যে তাহার তুল্যাকার বাইওলাকে দেখিয়া বোধ করেন এই সিবাস্তিন। বাইওলা সে সময় পরাক্রান্ত বৈরি কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিলেন আন্তোনিও অবলোকন করিয়া সিবাস্তিনকেই বিপদগ্রস্ত ভাবিলেন এবং তাহার রক্ষার্থ অসি ধারণ পুরঃসর সমর করিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু রাজপুরুষ কর্তৃক স্বয়ং ধৃত হইয়া যখন সিবাস্তিন বোধে বাইওলার নিকট মুদ্রা চাহিলেন। তখন বাইওলা বাস্তবিক সিবাস্তিন নহেন সুতরাং টাকার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করাতে তাঁহাকে কৃতঘ্ন বলিয়া ভৎসনা করিবেন বিচিত্র কি?
যাহা হউক রাজপুরুষেরা আন্তোনিওকে ধারণ পূর্ব্বক কারালয়ে লইয়া গেলে বাইওলা পুনর্বার বৈরি কর্তৃক আক্রান্ত হইবার ভয়ে দ্রুতগতি আপন ভবনে প্রস্থান করিলেন। তাহার পলায়নের কিয়ৎ ক্ষণ পরে তাহার শত্রু সিবাস্তিনকে হঠাৎ সেই স্থলে আসিতে দেখিয়া অবয়ব সাদৃশ্যে বাইওলা বোধে তাহার প্রতি পুনর্বার আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল এবং কহিতে লাগিল পুনবার সাক্ষাৎ পাইয়াছি এবার প্রতিফল না দিয়া ত্যাগ করিব না। এইরূপ তর্জন করিয়া এক মুষ্ট্যাঘাত করিল। সিবাস্তিন সাহসী পুরুষ ছিলেন যদিও অকস্মাৎ আক্রোশে বিস্ময়ান্বিত হইলেন তথাপি সে মুষ্ট্যাঘাত করিলে বিলক্ষণমতে প্রতিফল দিয়া শিরচ্ছেদার্থ অসি নিষ্কাসন করিলেন। সে সময় হঠাৎ এক যুবতী তথায় উপস্থিত হওয়াতে তাহা হইতে দুই ব্যক্তির সমর নিবৃত্ত হইল। সেই তরুণী। ওলিভিয়া, স্বীয় ভবন হইতে কোন কারণে বহির্গত হইয়াছিলেন, সিবাস্তিনকে দেখিয়া সিজারিও জ্ঞানে তাহার হস্ত ধারণ করিলেন এবং তাহার প্রতি অকারণ আক্রমণ নিমিত্ত। বিস্তর বিষাদ করিয়া স্বালয়ে লইয়া যাইতে যত্ন করিতে লাগিলেন। সিবাস্তিন অপরিচিত যুবতীর সদ্ব্যবহারে এবং বৈরির মূঢ়তায় চমৎকৃত হইয়াছিলেন সুতরাং ইচ্ছা পূর্ব্বক কামিনীর সমভিব্যাহারে গমন পূর্ব্বক তদীয় আবাসে প্রবেশ করিলেন। ওলিভিয়া তাহাকে সিজারিও বলিয়া বারস্বার সম্বোধন করত তাহার সহিত আমোদ করিতে লাগিলেন এবং মনে আশা করিলেন সিজারিও এত দিনে আমার প্রণয় রজ্জতে বদ্ধ হইলেন কেননা যদিও বাইওলা সিবাস্তিনের তুল্যাকার ছিলেন তথাপি বাইওল। যেমন প্রেমের কথায় মুখ ভঙ্গিদ্বারা বৈরক্তি চিন্ন প্রকাশ করিতেন সিবাস্তিন তদ্রুপ করিলেন না, সুতরাং ওলিভিয়া আহাদে পুলকিত হইলেন।
সিবাস্তিন ওলিভিয়ার প্রীতির কথায় কোন প্রকার বাধা দিলেন না বরং সন্তোষ প্রকাশ করিলেন কিন্তু মনেই বিতর্ক করিতে লাগিলেন এ অবলা কি বিহ্বলা হইয়াছেন। আবার আপনিই সিদ্ধান্ত করিলেন ইহার বুদ্ধিভ্রংশ কিপ্রকারে অনুমান করিব প্রত্যক্ষ দেখিতেছি বাটীর কী। হইয়া পরিজন দিগকে যথা নিয়মে শাসন ও সমস্ত কার্য্য সম্পাদন করিতেছেন কেবল অকস্মাৎ আমার প্রতি এবারে প্রণয় প্রকাশই উন্মাদের চিহ্ন। পরন্তু ওলিভিয়া তাঁহার মানস তর্ক করিলেন না আপনার সঙ্গে প্রেমের কথায় আমোদ করিতেছেন দেখিয়া আনন্দে গদ হইলেন এবং কি জানি যদি নায়কের মনঃ পুনবার অন্য প্রকার হয় এই ভয়ে প্রস্তাব করিলেন প্রিয়তম আমার পুরীমধ্যে পুরোহিত উপস্থিত আছেন অতএব আমাদের পরিণয় এক্ষণেই সম্পন্ন হইলে ভাল হয় না? সিবাস্তিন কামিনীর রূপ লাবণ্য এবং গুণ দশনে সাতিশয় গ্রীত হইয়াছিলেন বিবাহের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন সুতরাং অবিলম্বে তাহাদের পরিণয় সম্পন্ন হইল। সিবাস্তিন হঠাৎ সুরূপা রমণী লাভে আহলাদিত হইয়া আপনার পরম মিত্র আন্তোনিওকে তদ্বিষয়ের সংবাদ কহিতে মানস করিলেন অতএব পত্নীর নিকট ক্ষণ কালের নিমিত্ত বিদায় গ্রহণ করিয়া তদীয় ভবন হইতে বহির্গত হইয়াছেন ইতিমধ্যে দেখিতে পাইলেন যে ইলাইরাধিরাজ অর্সিনো ওলিভিয়ার ভবনাভিমুখে আসিতেছেন এবং অনতিদূরে রাজপুরুষেরা আন্তোনিওকে ধারণ পূর্ব্বক রাজার নিকট আনিতেছে। বাইওল। সে সময় নৃপতির সমভিব্যাহারে থাকাতে আন্তোনিও তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া সিবাস্তিন বোধে চীৎকার পূর্ব্বক কহিতেছিলেন আমি এই যুবকে মহা সাগরের তরঙ্গ হইতে রক্ষা করিয়াছি এবং নানা প্রকারে ইহার প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ করিয়াছি এ প্রায় তিন মাস আমার সহিত 'অহোরাত্র একত্র অবস্থিতি করিয়াছে এক্ষণে আমাকে চিনিতে পারিল না কি কৃতঘ্ন। ওলিভিয়া পুরদ্বারের অদূরে কলরব আকন করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। ইলাইরাধিরাজ তাহাকে দেখিতে পাওয়াতে আন্তোনিওর কথায় মনোযোেগ না করিয়া কহিলেন ঐ দেখ রাজ্ঞী আসিতেছেন আহা স্বর্গীয় বিদ্যাধরী যেন অবনী মণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছেন। পরে বন্দিকে বলিলেন অরে তুই মিথ্যা কি চীৎকার করিতেছিস এ যুঁব। গত তিন মাসাবধি আমার নিকট আছে এই বলিয়া বন্দিকে স্থানান্তর করিতে আজ্ঞা দিলেন। কিন্তু ওলিভিয়ার ব্যবহার অবলোকন করিয়া আন্তোনিওর ন্যায় মহারাজকেও প্রিয় ভৃত্য সিজারিওর প্রতি অবিলম্বে কৃতঘ্ন পদ প্রয়োগ করিতে হইল। যুবতী যুবরাজকে উপেক্ষা করিয়া তদীয় কিঙ্করের প্রতি সপ্রণয় বচনে স্নেহ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলে নৃপতি স্বীয় ভৃত্যকে আপন প্রেয়সীর চিত্ত হারক জ্ঞান করত কোপে প্রজ্বলিত হইলেন এবং তর্জন পুরঃসর প্রতিহিংসার ভয় প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে সে স্থান হইতে প্রত্যাগমন করত তাহাকে কহিলেন অরে কৃতঘ্ন বালক আমার পশ্চাৎ আগমন কর। সমুচিত শাস্তি না দিয়া তোকে ত্যাগ করিব না। ভূপাল যে প্রকার কোপ প্রকাশ করিতে লাগিলেন তাহাতে সকলেই অনুমান করিল অবিলম্বে শিরচ্ছেদের আজ্ঞা হইবেক কিন্তু বাইওল। প্রেমানলে বিপ্লষ্ট হৃদয় হইয়া থাকাতে তাহাতে ভীত। হইলেন না। মুক্ত কণ্ঠে নিবেদন করিলেন মহারাজ আমার প্রতি বধ দণ্ডাদেশ করিয়া যদি আপনার স্বাস্থ্য বোধ হয় আমি আদ পূর্ব্বক তাহা স্বীকারে প্রস্তুত আছি। এত শ্রবণে ওলিভিয়া পতিবিরহাসহিষ্ণ, হইয়া কহিতে লাগিলেন প্রিয়তম কোথায় যাও? বাইওলা বলিলেন আপন জীবন অপেক্ষা যাহার প্রতি আমার চিত্ত প্রণয়াসক্ত তাহার পশ্চাৎ গমন করিতেছি। তখন ওলিভিয়া তাহাকে স্পষ্ট রূপে পতি বলিয়া সম্বোধন পূর্ব্বক পরিণয় দাতা পুরোহিতকে উচ্চস্বরে ডাকিতে লাগিলেন তাহাতে রাজার পরিজন সহিত প্রত্যাগমনে বাধা জন্মিল কেননা যাজক যুবতীর আর্তস্বরে সত্বর আগমন পূর্ব্বক কহিলেন দুই ঘটিকা মাত্র অতীত হইয়া থাকিবেক আমি ওলিভিয়ার সহিত এই যুবার বিবাহ দিয়াছি। বাইওলা বিবাহের কথায় বিস্মিত হইলেন এবং দৃঢ়তর বচনে বলিতে লাগিলেন সে কি আমি কখ ইহার পাণি গ্রহণ করিলাম? কিন্তু তাহার কথায় কোন ফল দর্শিল না, ওলিভিয়া এবং পুরোহিতের বচনে অসিনোর বিশ্বাস হইল বিশ্বাসঘাতক কিঙ্কর তাহার জীবিতাধিক রত্ন। হরণ করিয়াছে কিন্তু অতীতের অনুতাপ বিফল বিবেচনা করিয়া শেষে ধৈর্য্যাবলম্বন করিলেন। অপর প্রণয় ভাজন প্রিয়তমার নিকট বিদায় গ্রহণ পুরসর প্রস্থান কালে তদীয় পাণিগ্রাহ যুবা কিঙ্করকে কহিতে লাগিলেন আর কখন তোর মুখাবলোকন করিব না। কিন্তু যুবরাজ পরিজন সমভিব্যাহারে প্রত্যাবৃত্ত হন্ ইত্যবসরে একটী বিস্ময়াবহ বিচিত্র ব্যাপার ঘটিল অর্থাৎ অন্য এক জন সিজারিও তথায় আসিয়া ওলিভিয়াকে পত্নী বলিয়া সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন, এই ব্যক্তি সিবাস্তিন, ইনিই যুবতীর পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার আগমনে উপস্থিত লোকেরা তুল্যাকৃতি ও তুল্য পরিচ্ছদ ধারি দুই সিজারিও সমক্ষে অবলোকন করিয়া সাতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিল। অনন্তর সহোদর সহোদরায় কথোপকথন আরম্ভ হইল | তাহারা পরস্পর মনে করিয়াছিলেন ভ্রাতা ভগিনী সাগর সলিলে নিমগ্ন হইয়া লৌকিক লীলা সম্বরণ করিয়াছেন এক্ষণে পুরুষ বেশে উভয়ে এক স্থানে উপস্থিত হওয়াতে অন্যোন্যের সহিত সাক্ষাৎ হইলেও সহসা কিছু, স্থির করিতে পারিলেন না। কিন্তু বাই ওলা কিঞ্চিৎ বিলম্বে সহোদরকে চিনিতে পারিয়া। কহিলেন আমি তোমার ভগিনী, ছদ্ম বেশ ধারণ করিয়া কাল যাপন করিতেছি।
পরে তাহাদের উভয়ের অনুরূপ আকৃর্তি নিমিত্ত যে সমস্ত ভ্রম জন্মিয়াছিল তাহা উলিত হইল এবং ওলিভিয়া ছদ্ম বেশে অবলার প্রতি প্রণয়িনী হওয়াতে উপস্থিত ব্যক্তিরা তাহার সহিত অনেক ক্ষণ পরিহাস করিলেন। কিন্তু ওলিভিয়া তাহাতে ক্ষুন্না হইলেন না কেননা ভগিনীর পরিবর্তে তাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।
ওলিভিয়ার এবকারে পরিণয় হওয়াতে যুবরাজ অর্সিনো একেবারে নৈরাশ্যে পতিত হইলেন। তাঁহার বহু কালের প্রণয় বিফল হইয়া গেল। পরন্তু প্রিয় কিঙ্কর সিজারিওর বেশ পরিবর্তনে তাহাকে পরম রূপবতী যুবতী অবলোকন করিয়া সাতিশয় বিস্ময়াকুল হইলেন এবং সাশ্চর্য্য চিত্তে অনেক ক্ষণ চিন্তা করিলেন। কিয়দ্বিলম্বে আপনা আপনি কহিলেন কতবার মনে করিয়াছিলাম সিজারিও যদিস্যাৎ রমণীর বেশ ধারণ করে তাহা হইলে চমৎকার দেখায় এখন ফলতঃ তাহাই দেখিলাম। অধিকন্তু স্মরণ। হইতেছে সিজারিও কতবার বলিয়াছিল আমাতে প্রেম করে তৎকালে তাহা আজ্ঞাবহ বিশ্বস্ত ভৃত্যের বাক্য বলিয়া জ্ঞান করিয়াছিলাম এখন স্পষ্ট বোধ হইল তাহার অর্থান্তর ছিল। এই রূপে যুবরাজ সিজারিও ভৃত্যের পূর্ব্বকার ভূরি২ উক্তির ভাব ভঙ্গি এক্ষণে হৃদয়ঙ্গম করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে তাহারই পাণি গ্রহণ স্থির করিলেন কিন্তু অভ্যাস বশতঃ তখনও তাহাকে বালক বলিয়া সম্বোধন করত কহিতে লাগিলেন কেমন তোমার স্মরণ হয় কতবার বলিয়াছিলে আমার। ন্যায় কোন কামিনীর সহিত প্রণয় করিবে না? যাহা হউক তুমি অবলা হইয়া যে প্রকার বিশ্বস্ত কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছ অপর অঙ্গন হইতে তপ কার্য্য কদাপি হইতে পারে না। তুমি এ পর্যন্ত আমাকে কী বলিয়া সম্বোধন করিয়াছ এক্ষণে স্বয়ং কত্রী অর্থাৎ ইলাইনার রাজমহিষী হও। অনন্তর ওলিভিয়া আপনার প্রতি মহারাজের প্রণয় বাইওলাতে সংক্রান্ত হইতে দেখিয়া পরম পরিতোষ প্রকাশ পূর্ব্বক যৎপরোনাস্তি যত্ন সহকারে তাহাদিগকে আপনার আলয়ে লইয়া গেলেন এবং যে পুরোহিত প্রাতঃকালে সিবাস্তিনের সহিত তাঁহার পরিণয় সম্পাদন করিয়া দিয়াছিলেন তাঁহাকে সেই দিনেই বাইওলার সহিত মহারাজের বিবাহ দেওয়াইয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। অতএব যমজ সহোদর সহোদরার বিবাহ এক দিনেই। সম্পন্ন হইল। তাহারা সমুদ্রে অর্ণবযান যোগে ভ্রমণ করিতে গিয়া দুরদৃষ্ট বশতঃ জল মগ্ন হইয়া পরস্পর বিযুক্ত হইয়াছিলেন এক্ষণে অদৃষ্ট প্রসন্ন হওয়াতে অকস্মাৎ উভয়ের মিলন ও অতুল ঐশ্বর্য্য হইল। বাইওল। ইলাইরাধিপের রাজমহিষী এবং সিবাস্তিন মহা ধনসম্পন্ন। রূপ লাবণ্যবতী সম্ভান্তা ওলিভিয়ার স্বামী হইলেন ইতি।
Bb