(পৃ. ৯০-১০২)
◄  
১১  ►

১০

 সন্ধেবেলায় বসে আছি দক্ষিণদিকের চাতালে। সামনে কতকগুলো পুরোনো কালের প্রবীণ শিরীষ গাছ আকাশের তারা আড়াল ক’বে জোনাকির আলো দিয়ে যেন একশোটা চোখ টিপে ইসারা করছে।

 পুপেদিকে বললেম, বুদ্ধি তোমার অত্যন্ত পেকে উঠছে তাই মনে করছি আজ তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেব একদিন তুমি ছেলেমানুষ ছিলে।

 দিদি হেসে উঠে বললে, ঐখানে তোমার জিৎ। তুমিও এককালে ছেলেমানুষ ছিলে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবার উপায় আমার হাতে নেই।

 আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, বোধ হয় আজকের দিনে কারো হাতেই নেই। আমিও শিশু ছিলুম তার একমাত্র সাক্ষী আছে ঐ আকাশের তারা। আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি তোমার একদিনকার ছেলেমানুষির কথা বলব। তোমার ভালো লাগবে কি না জানিনে, আমার মিষ্টি লাগবে।

 আচ্ছা বলে যাও।

 বোধ হচ্চে ফাল্গুন মাস পড়েছে। তার আগেই ক’দিন ধরে রামায়ণের গল্প শুনেছিলে সেই চিক্‌চিকে টাকওয়ালা কিশোরী চট্টর কাছে। আমি সকাল বেলায় চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছি তুমি এতখানি চোখ ক’রে এসে উপস্থিত। আমি বললেম, হয়েছে কী।

 হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, আমাকে হরণ ক’রে নিয়েছে।

 কী সর্ব্বনাশ। কে এমন কাজ করলে।
-পৃঃ ৯২
 এ প্রশ্নর উত্তরটা তখনো তোমার মাথায় তৈরি হয়নি। বলতে পারতে রাবণ, কিন্তু কথাটা সত্য হোত না ব’লে তোমার সঙ্কোচ ছিল। কেননা আগের সন্ধেবেলাতেই রাবণ যুদ্ধে মারা গিয়েছে, তার একটা মুণ্ডুও বাকি ছিল। উপায় না দেখে একটু থম্‌কে গিয়ে তুমি বললে, সে আমাকে বলতে বারণ করেছে।

 তবেই তো বিপদ বাধালে। তোমাকে এখন উদ্ধার করা যায় কী

 কোন্‌ দিক দিয়ে নিয়ে গেল।

 সে একটা নতুন দেশ।

 খান্দেশ নয় তো।

 না।

 বুন্দেলখণ্ড নয়।

 না।

 কী রকমের দেশ।

 নদী আছে, পাহাড় আছে, বড়ো বড়ো গাছ আছে। খানিকটা আলো খানিকটা অন্ধকার।

 সে তো অনেক দেশেই আছে। রাক্ষস গোছের কিছু দেখ্‌তে পেয়েছিলে। জিব-বের-করা কাঁটাওয়ালা।

 হাঁ হাঁ, সে একবার জিব মেলেই কোথায় মিলিয়ে গেল।

 বড়ো তো ফাকি দিলে, নইলে ধরতুম তার ঝুঁটি। যাই হোক্‌ একটা কিছুতে করে তো তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল। রথে।

 না।

 ঘোড়ায়।

 না।  হাতীতে।

 ফস্ ক’রে ব’লে ফেললে—খরগোষে। ঐ জন্তুটার কথা খুব মনে জাগছে—জন্মদিনে পেয়েছিলে একজোড়া, বাবার কাছ থেকে।

সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 113 crop)
সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 113 crop)
 আমি বললেম, তবেই তো চোর কে তা জানা গেল।

 টিপিটিপি হেসে তুমি বললে, কে বলো তো।

 এ নিঃসন্দেহ চাঁদামামার কাজ।

 কী ক’রে জানলে।

 তারও যে অনেক কালের বাতিক খরগোষ পোষা।

 কোথায় পেয়েছিল খরগোষ।

 তোমার বাবা দেয়নি।

 তবে কে দিয়েছিল।

 ও চুরি করেছিল ব্রহ্মার চিড়িয়াখানায় ঢুকে।

 ছিঃ।

 ছিঃই তো। তাই ওর গায়ে কলঙ্ক লেগেছে, দাগা দিয়েছেন ব্রহ্মা।

 বেশ হয়েছে।

 কিন্তু শিক্ষা হোলো কই। আবার তো তোমাকে চুরি করলে। বোধ হয় তোমার হাত দিয়ে ওর খরগোষকে ফুলকপির পাতা খাওয়াবে।

 খুসি হোলে শুনে। আমার বুদ্ধির পরখ করবার জন্যে বললে, আচ্ছা বলল দেখি, খরগোষ কী করে আমাকে পিঠে করে নিলে।

 নিশ্চয় তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

 ঘুমলে কি মানুষ হাল্কা হয়ে যায়।

 হয় বৈকি। তুমি ঘুমিয়ে কখনো ওড়োনি।

 হাঁ উড়েছি তো।

 তবে আর শক্তটা কী। খরগোষ তত সহজ, ইচ্ছে করলে কোলা ব্যাঙের পিঠে চড়িয়ে তোমাকে মাঠময় ব্যাং-দৌড় করিয়ে বেড়াতে পারত।

 ব্যাং! ছী ছি ছি। শুনলেও গা কেমন করে।

 না, ভয় নেই—ব্যাঙের উৎপাত নেই চাঁদের দেশে।  একটা কথা জিগেস করি, পথের ব্যাঙ্গমা দাদার সঙ্গে তোমার দেখা। হয়নি কি।

 হাঁ, হয়েছিল বই কি।

 কী রকম।

 ঝাউগাছের উপর থেকে নিচে এসে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। বললে, পুপে দিদিকে কে চুরি করে নিয়ে যায়। শুনে খরগোষ এমন দৌড় দৌড়ল যে ব্যাঙ্গমা দাদা পারল না তাকে ধরতে।

 আচ্ছা তারপরে।

 কার পরে।

 খরগোষ তো নিয়ে গেল, তারপরে কী হোলো বলো না।

 আমি কী বলব। তোমাকেই তো বলতে হবে।

 বাঃ আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কেমন করে জানব।

 সেই তো মুস্কিল হয়েছে। ঠিকানাই পাচ্চিনে কোথায় তোমাকে নিয়ে গেল। উদ্ধার করতে যাই কোন্ রাস্তায়। একটা কথা জিগেস করি, যখন রাস্তা দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিল ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছিলে কি।

 হাঁ হাঁ, পাচ্ছিলুম, ঢং ঢং ঢং।

 তাহোলে রাস্তাটা সোজা গেছে ঘণ্টাকর্ণদের পাড়া দিয়ে।

 ঘণ্টাকর্ণ। তারা কী রকম।

 তাদের দুটো কান দুটো ঘণ্টা। আর দুটে। ল্যাজে দুটো হাতুড়ি। ল্যাজের ঝাপটা দিয়ে একবার এ কানে বাজায় ঢং, একবার ও কানে বাজায় ঢং। দুজাতের ঘণ্টাকর্ণ আছে, একটা আছে হিংস্র, কাঁসরের মতো খন্‌খন্‌ আওয়াজ দেয়, আর একটার গম্‌গম্‌ গম্ভীর শব্দ।

 তুমি কখনো তার শব্দ শুনতে পাও, দাদামশায়।

 পাই বই কি। এই কাল রাত্তিরেই বই পড়তে পড়তে হঠাৎ শুনলেম
-পৃঃ ৯৫
ঘণ্টাকর্ণ চলেছেন ঘোর অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। বারোটা বাজালেন যখন, তখন আর থাকতে পারলুম না। তাড়াতাড়ি বই ফেলে দিয়ে চমকে উঠে দৌড় দিলুম বিছানায়, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজে রইলুম পড়ে।

 খরগোষের সঙ্গে ঘণ্টাকর্ণের ভাব আছে।

 খুব ভাব। খরগোষটা তারই আওয়াজের দিকে কান পেতে চলতে থাকে সপ্তর্ষিপাড়ার ছায়াপথ দিয়ে।

 তার পরে।

 তার পরে যখন একটা বাজে, দুটো বাজে, তিনটে বাজে, চারটে বাজে, পাঁচটা বাজে তখন রাস্তা শেষ হয়ে যায়।

 তারপরে।

 তারপরে পেঁছিয় তন্দ্রা-তেপান্তরের ওপারে আলোর দেশে। আর দেখা যায় না।

 আমি কি পৌঁচেছি সেই দেশে।

 নিশ্চয় পৌঁচেছ।

 এখন তাহলে আমি খরগোষের পিঠে নেই।

 থাকলে যে তার পিঠ ভেঙে যেত।

 ওঃ, ভুলে গেছি, এখন যে আমি ভারি হয়েছি। তার পরে।

 তারপরে তোমাকে উদ্ধার করা চাই তো।

 নিশ্চয় চাই। কেমন ক’রে করবে।

 সেই কথাটাই তো ভাবছি। রাজপুত্তরের শরণ নিতে হোলো দেখছি।

 কোথায় পাবে।

 ঐ যে তোমাদের সুকুমার।

 শুনে এক মুহূর্ত্তে তোমার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। একটু কঠিন সুরেই
-পৃঃ ৯৭
বললে, তুমি তাকে খুব ভালোবাসো। তোমার কাছে সে পড়া ব’লে নিতে আসে। তাই তো সে আমাকে অঙ্কে এগিয়ে যায়।

 [এগিয়ে যাবার অন্য স্বাভাবিক কারণও আছে। সে কথাটার আলোচনা করলুম না।] বললুম, তা তাকে ভালোবাসি আব না বাসি সেই আছে এক রাজপুত্তুর।

 কেমন ক’রে জানলে।

 আমার সঙ্গে বোঝাপড়া ক’বে তবে সে ঐ পদটা পাকা ক’বে নিয়েছে।

 তুমি বেশ একটু ভুরু কুঁচকে বললে, তোমারি সঙ্গে ওর যত বোঝাপড়া।

 কী করি বলো, কোনোমতে ও মানতে চায় না ওর চেয়ে আমি বয়সে খুব বেশি বড়ো।

 ওকে তুমি বলো রাজপুত্তব। ওকে আমি জটায়ুপাখী ব’লেও মনে করিনে। ভারি তো।

 একটু শান্ত হও। এখন ঘোব বিপদে পড়া গেছে; তুমি কোথায় তার তো ঠিকানাই নেই। তা এবারকাব মতো কাজ উদ্ধার ক’রে দিক্‌,—আমরা নিশ্বেস ফেলে বাঁচি। এর পরে ওকে সেতুবন্ধনের কাঠবিড়ালি বানিয়ে দেব।

 উদ্ধার করতে ও রাজি হবে কেন। ওর এক্‌জামিনের পড়া আছে।

 রাজি হবার বারো আন। আশা আছে। এই পশু শনিবারে ওদের ওখানে গিয়েছিলুম। বেলা তিনটে। সেই রোদ্দুরে মাকে ফাঁকি দিয়ে ও দেখি ঘুরে বেড়াচ্চে বাড়ির ছাদে। আমি বললুম, ব্যাপার কী।

 ঝাঁকানি দিয়ে মাথাটা উপরে তুলে বললে, আমি রাজপুত্তর।

 তলোয়ার কোথায়।

 দেয়ালির রাত্রে ওদের ছাদে অধিপোড়া তুবড়িবাজির একটা কাঠি পড়েছিল। কোমরে সেইটেকে ফিতে দিয়ে বেঁধেছে-আমাকে দেখিয়ে দিলে।
সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 122 crop)
সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 122 crop)


 আমি বললুম, তলোয়ার বটে। কিন্তু ঘোড়া চাই তো।

 বললে, আস্তাবলে আছে।

 ব’লে ছাদের কোণ থেকে ওর জ্যাঠামশায়ের বহুকেলে বেহায়া একটা ছেড়া ছাতা টেনে নিয়ে এল। দুই পায়ের মধ্যে তাকে চেপে ধরে হাটহাট আওয়াজ করতে করতে ছাদময় একবার দৌড় করিয়ে আনলে। আমি বললুম, ঘোড় বটে।  এর পক্ষিরাজের চেহারা দেখতে চাও।

 চাই বই কী।

 ছাতাটা ফস ক’রে খুলে দিলে। ছাতার পেটের মধ্যে ঘোড়ার খাবার দানা ছিল সেগুলো ছড়িয়ে পড়ল ছাদে।

 আমি বললুম, আশ্চর্য্য। কী আশ্চর্য্য। এ জন্মে পক্ষীরাজ দেখব কোনোদিন এমন আশাই করিনি।

 এইবার আমি উড়ছি দাদা। চোখ বুজে থাকে তাহলে বুঝতে পারবে আমি ঐ মেঘের কাছে গিয়ে ঠেকেছি। একেবারে অন্ধকার।

 চোখ বোজবার দবকার করে না আমার। স্পষ্টই জানতে পারছি তুমি খুব উড়ছ, পক্ষীরাজেব ডানা মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে।

 আচ্ছা, দাদামশায়, আমার ঘোড়াটার একটা নাম দিয়ে দাও তো।

 আমি বললুম, ছত্রপতি।

 নামটা পছন্দ হোলা। রাজপুত্তুর ছাতার পিঠ চাপড়িয়ে বললে, ছত্রপতি। নিজেই ঘোড়ার হয়ে তার জবাব দিলে, আজ্ঞে।

 আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে, তুমি ভাবছ আমি বললুম; আজ্ঞে, তা নয়, ঘোড়া বললে।

 সে কথাও কি আমাকে বলতে হবে। আমি কি এত কালা।

 রাজপুত্তুর বললে, ছত্রপতি, আর ভালো লাগছে না, চুপচাপ পড়ে থাকতে।

 তারি মুখ থেকে উত্তর পাওয়া গেল, কী হুকুম বলো।

 তেপান্তরের মাঠ পেরোনো চাই।

 রাজি আছি।

 আমি তো আর থাকতে পারিনে, কাজ আছে—রসে ভঙ্গ দিয়ে বল্‌তে হোলো, রাজপুত্তুর, কিন্তু তোমার মাষ্টার যে বসে আছে। দেখে এলুম তার মেজাজটা চটা।

 শুনে রাজপুত্রের মনটা ছটফট ক’রে উঠল। ছাতাটাকে থাবড়া মেরে বল্‌লে, এখনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারো না কি।

 বেচারা ঘোড়ার হয়ে আমাকেই বলতে হোলো, রাত্তির না হোলে ওতো উড়তে পারে না। দিনের বেলায় ও ন্যাকামি ক’রে ছাতা সাজে-তুমি ঘুমলেই ও ডানা মেল্‌বে। এখনকার মতো পড়তে যাও নইলে বিপদ বাধবে।

 সুকুমার মাস্‌টারের কাছে পড়তে গেল। যাবার সময় আমাকে বললে, কিন্তু সব কথা এখনো শেষ হয়নি।

 আমি বললুম, কথা কি কখনোই শেষ হোতে পারে। শেষ হলে মজা কিসের।

 পাঁচটার সময় পড়া শেষ হয়ে যাবে, দাদু তখন তুমি এসো।

 আমি বললুম, থর্ড্‌নম্বর রীডরের পরে মুখ বদলাবার জন্যে পয়লা নম্বরের গল্প চাই। নিশ্চয় আসব।