সে/১১
১১
মাষ্টরমশায়কে দেখলুম গলির মোড়ে, ট্রামের প্রত্যাশায় দাড়িয়ে আছেন। আমি যখন গেলুম সুকুমারদেব বাড়ির ছাদে, তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। সামনের তেতালা বাড়িটাকে পড়্তি বেলাকার রোদ্দুর আড়াল করেছে। গিয়ে দেখি চিলে কোঠার সামনে সুকুমাব চুপ ক’রে বসে। ছাদের কোণটাতে বিশ্রাম করছে তার ছত্রপতি। পিছনদিকের সিঁড়ি দিয়ে যখন উপরে উঠে এলুম, তখন আমার পায়ের শব্দ ওর কানে পৌঁছল না। খানিকবাদে ডাক দিলুম, রাজপুত্তুর। ওর যেন স্বপ্ন গেল ভেঙে, চমকে উঠল।
জিগেস করলুম, বসে কী ভাবছ ভাই।
ও বললে, শুকসারীর কথা শুনছি।
শুকসারীর দেখা পেলে কোথায়।
ঐ যে দেখা যাচ্চে পাহাড়ের গায়ে বন। ডালে ডালে ফুল ছড়াছড়ি হল্দে, লাল, নীল, যেন সন্ধ্যাবেলাকার মেঘের মতো। তারি ভিতর থেকে শুকসারীর গলা শোনা যাচ্চে।
তাদের দেখতে পাচ্চ তো।
হাঁ পাচ্চি। খানিকটা দেখা যায়, খানিকটা ঢাকা।
তা কী বলছে ওরা।
এইবার মুস্কিলে পড়ল আমাদের রাজপুত্তর। খানিকটা আম্তা আম্তা ক’রে বললে, তুমিই বলল না, দাদু, ওরা কী বলছে।
ঐ তো পষ্ট শোনা যাচ্চে ওরা তর্ক করছে। কীসের তর্ক।
শুক বল্ছে, আমি এবার উড়ব, সারী বলছে কোথায় উড়বে।শুক বলছে যেখানে কোথাও ব’লে কিছুই নেই, কেবল ওড়াই আছে। তুমিও চলো আমার সঙ্গে।—সারী বললে আমি ভালোবাসি এই বনকে, এখানে ডালে জড়িয়ে উঠেছে ঝুম্কো লতা; এখানে ফল আছে বটের, এখানে শিমুলের ফুল যখন ফোটে তখন কাকের সঙ্গে ঝগড়া ক’রে ভালো লাগে তার মধু খেতে। এখানে রাত্তিরে জোনাকিতে ছেয়ে যায় ঐ কামরাঙার ঝোপ, আর বাদলায় বৃষ্টি যখন ঝরতে থাকে তখন দুলতে থাকে নারকেলের ডাল ঝরঝর শব্দ ক’রে। আর তোমার আকাশে কীই বা আছে।শুক বললে, আমার আকাশে আছে সকাল, আছে সন্ধ্যে, আছে মাঝরাত্রের তারা, আছে দক্ষিণে হাওয়ার যাওয়া আসা, আর আছে কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না।
সুকুমার জিগেস করলে, কিছুই না থাকে কী ক’রে দাদু।
সেই কথাই তো এইমাত্র সারী জিগেস করলে শুককে।
শুক কী বলছে।
শুক বলছে, আকাশের সব চেয়ে অমূল্যধন ঐ কিছুই-না। ঐ কিছুই-না আমাকে ডাক দেয় ভোরের বেলায়। ওরি জন্যে আমার মন কেমন করে যখন বনের মধ্যে বাসা বাঁধি। ঐ কিছুই-না কেবল খেলা করে রঙের খেলা নীল আঙিনায়—মাঘের শেষে আমের বোলের নিমন্ত্রণ চিঠিগুলি ঐ কিছুই-না-র ওড়না বেয়ে হুহু ক’রে উড়ে আসে, মৌমাছিরা খবর পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
উৎসাহে সুকুমার লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, বললে, আমার পক্ষীরাজকে ঐ কিছুই না-র রাস্তা দিয়েই তো চালাতে হবে।
নিশ্চয়ই। পুপুদিদির হরণব্যাপারটা আগাগোড়াই ঐ কিছুই-না-র তেপান্তরে। সুকুমার হাত মুঠো করে বললে, সেইখান দিয়েই আমি তাকে ফিরিয়ে আনব, নিশ্চয় আনব।
বুঝতে পারছ তত পুপুদিদি, রাজপুত্তর তৈরিই আছে—তোমাকে উদ্ধার করতে দেরি হবে না। এতক্ষণে ছাদের উপরে তার ঘোড়াটা একবার পাখা খুলছে আবার বন্ধ করছে।
তুমি খুব ঝাঁজিয়ে উঠে বললে,—দরকার নেই।
বলো কী, এত বড় বিপদ থেকে তোমার উদ্ধার হোলা না, আর আমরা নিশ্চিন্ত থাকব।
হয়ে গেছে উদ্ধার।
কখন হোলো।
শুনলে না, একটু আগেই ঘণ্টাকর্ণ এসে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
কখন ঘটল এটা।
ঐ যে ঢং ঢং করে দিলে নটা বাজিয়ে।
কোন্ জাতের ঘণ্টাকর্ণ।
হিংস্রজাতের। এখন ইস্কুলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে। বিচ্ছিরি লেগেছে আওয়াজটা।
গল্পটা অকালে গেল ভেঙে। দুস্রা রাজপুত্তর খুঁজে বের করা উচিত ছিল। এ তো অঙ্কের হরণ পূরণ নয়—ও রকম ক্লাস-পেরনো ছেলে তেপান্তর পেরোবার স্পর্দ্ধা করবে এ তুমি কিছুতেই সইতে পারলে না। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলুম লাখখানেক ঝিঁ ঝিঁ পোকা আমদানি করব, আমাদের পানাপুকুরের ধারের স্যাওড়া বন থেকে। তা’রা চাঁদামামার নিদমহলের পশ্চিমদিকের খিড়কির দরজা দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে সবাই মিলে তোমার বিছানার চাদরটাতে দিত টান, সুর সুর ক’রে। তার উপরে তোমাকে নামিয়ে আনত। তাদের ঝিঁঝিঁ ঝিঁঝিঁ শব্দে চাঁদনি-চকে ঝিমিয়ে পড়ত চাঁদের পাহারাওয়ালা। সমস্ত রাস্তায় বায়না দিয়ে রেখেছিলুম জোনাকির আলোধারীর দলকে। বাঁশতলার বাঁকা গলি দিয়ে তোমাকে নিয়ে চলত, খস্খস্ শব্দ করত ঝরে-পড়া শুকনো পাতাগুলো। ঝর ঝর করতে থাকত নারকেলের ডাল। গন্ধে-ভুরভুর শর্ষে ক্ষেতের আল বেয়ে যখন এসে পড়তে তিরপুর্ণির ঘাটে, তখন ধামাভরা বিন্নিধানের খই নিয়ে ডাক দিতুম গঙ্গামায়ের শুঁড়তোলা মকরকে, তোমাকে চড়িয়ে দিতেম তার পিঠে। ডাইনে বাঁয়ে তার ল্যাজের ঠেলায় জল উঠত কল-কলিয়ে। তিন পহর রাতে শেয়ালগুলো ডাঙায় দাঁড়িয়ে জিগেস করত, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া। আমি বলতুম, চুপ রও, কুছ নেই হুয়া। এই যাত্রাপথে প্যাঁচা আর বাদুড়ের সঙ্গেও কিছু আপোসে বন্দোবস্তের কথা ছিল। তাদের কাজে লাগাতুম। ভোর সাড়ে চারটের সময় শুকতারা মেমে পড়ত পশ্চিম আকাশে, পূর্ব্ব আকাশে আলোর রেখায় দেখা দিত সকালবেলার তর্জ্জনীতে সোনার আঙুটি থেকে ঠিক্রে-পড়া সঙ্কেত। সদ্য জেগে-ওঠা কাক তেঁতুলের ডালে বসে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করত, কা-কা। আমি যেমনি বলতুম কিচ্ছু না, অমনি দেখতে দেখতে সব যেত মিলিয়ে।—তুমি জেগে উঠতে তোমার বিছানায়।
পুপুদিদি একটুখানি হেসে বললে, এই যে আমার ছেলেমানুষীর কাহিনীটি শোনা গেল—এটি এত ইনিয়ে বিনিয়ে ব’লে তোমার কী আনন্দ হোলো। আমার হিংসুকে স্বভাব ছিল এইটে জানাবার জন্যে তোমার এতই উৎসাহ। আর আমাদের বিলিতি আমড়াগাছের পাকা আমড়াগুলো পেড়ে নিয়ে সুকুমারদাকে লুকিয়ে দিয়ে আসতুম, আমড়া সে ভালোবাসত ব’লে; চুরির অপবাদটা হোত আমার আর ভোগ করত সে—সে কথাটা চেপে গেছ। সুকুমারদা না হয় অঙ্কই ভালো কষত কিন্তু আমার বেশ মনে আছে একদিন সে ‘অবধান’ কথাটার মানে ভেবে পাচ্ছিল না, আমি শ্লেটে লিখে আড় ক’রে ধ’রে তাকে দেখিয়ে দিয়েছিলুম, এ কথাগুলো বুঝি তোমার গল্পের মধ্যে পড়ে না।
আমি বললুম, আমার খুসির কারণ এ নয় যে মনের জ্বালায় তুমি সুকুমারদার যৌবরাজ্য মান্তে চাওনি। তার উপরে তোমার হিংসের কারণ ছিল আমার উপর তোমার অনুরাগবশত,আমার আনন্দের স্মৃতি রয়েছে ঐখানেই।
আচ্ছা তোমার অহঙ্কার নিয়ে তুমি থাকো।—একটা কথা তোমাকে জিগেস করি, সেই যে তোমার নামহারা বানানো মানুষটি—যাকে বলতে সে, তার হোলো কী।
আমি বললেম, তার বয়স বেড়ে গেছে।
ভালোই তো।
সে এখন চিন্তা কবে, মাথায় তার দুঃসমস্যার ভিমরুলে চাক বেঁধেছে, তর্কে তার সঙ্গে পারবার জো নেই।
দেখছি আমারি প্যার্যাল্যাল লাইনেই চলেছে।
তা হোতে পারে, কিন্তু গল্পের এলেকা ছাড়িয়ে গেছে। থেকে থেকে সে হাত মুঠো ক’রে ঝেঁকে ঝেঁকে বলে উঠছে, শক্ত হোতে হবে।
বলুক না। শক্ত ছাদেই গল্প জমুক না! চুক দিয়ে খাওয়া নেই হোলো, চিবিয়ে খাওয়া চলবে তো। হয়তো আমার পছন্দ হবে।
পাছে আক্কেল দাঁতের অভাবে তাকে কায়দা করতে না পারো এই ভয়ে অনেকদিন তাকে চুপ করিয়ে রেখেছি।
ইস্। তোমার ভাবনা দেখে হাসি পায়। তুমি ঠাউরে রেখেছ আমার যথেষ্ট বয়স হয় নি। সর্ব্বনাশ। এত বড়ো নিন্দে অতি বড়ো শত্রুও করতে পারবে না।
তাহোলে ডাকো না তাকে তোমার আসরে- তার বর্ত্তমান মেজাজটা বুঝে নিই।
তাই সই।