(পৃ. ১২৫-১৩৬)
◄  ১২
১৪  ►

১৩

 পুপুদিদির মনে হোলো আমি ওর মর্য্যাদাহানি করেছি। তখন সন্ধে হয়ে আসছে। কেদারায় হেলান দিয়ে ও বসল আমার কাছে। অন্যদিকে মুখ ক'রে বললে, তুমি আমাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কেবল ছেলেমানুষি করছ, এতে তোমার কী সুখ।

 আজকাল ওর কথা শুনে হাসতে সাহস হয় না। ভালোমানুষের মতো মুখ করেই বললুম,—তোমার বয়সে পাকা বুদ্ধির প্রমাণ দিতেই তোমাদের আগ্রহ, আমার বয়সে ভাবতে ভালো লাগে যে মজ্জাটা এখনো আছে কাঁচা। সুযোগ পেলে মশগুল্ হয়ে ছেলেমানুষি করি বানিয়ে, হয়তো মানানসই হয় না।

 তাই ব'লে আগাগোড়াই যদি ছেলেমানুষি করো তাহোলে সত্যিকার ছেলেমানুষিই হয় না। ছেলে বয়সের ভিতরে ভিতরে বড়ো বয়সের মিশল থাকে।

 দিদি, এটা একটা কথার মতো কথা বলেছ। শিশুর কোমল দেহেও শক্ত হাড়ের গোড়াপত্তন থাকে। এ কথাটা আমি ভুলেছিলুম না কি।

 তোমার বকুনি শুনে মনে হয় যখন আমি ছোটো ছিলুম তখনকার দিনে এমন কিছুই ছিল না যা ব্যঙ্গ করবার নয় অথচ মজা করবার।

 একটা উদাহরণ দেখাও।

 মনে করে আমাদের মাষ্টারমশায়। তিনি অদ্ভুত ছিলেন, কিন্তু খাঁটি অদ্ভুত। তাই তাঁকে এত ভালো লাগত।

 আচ্ছা তাঁর কথাটা একটু ধরিয়ে দাও না।

 আজো তাঁর মুখখানা স্পষ্ট মনে পড়ে। ক্লাসে বসতেন যেন আলগোছে, বইগুলো ছিল কণ্ঠস্থ। উপরের দিকে তাকিয়ে পাঠ ব'লে যেতেন, কথাগুলো যেন সদ্য ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। আমরা ক্লাসে উপস্থিত থাকব, মন দিয়ে পড়া শুনব, সে গরজটা সম্পূর্ণ আমাদেরই ব'লে তিনি মনে করতেন।

 তিনি তোমাদের মুখ চেনবার সুযোগ পাননি বোধ হয়।

 চেষ্টাও করেননি। একদিন ছুটির দরবার নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে চৌকি ছেড়ে উঠে পড়লেন, মনে করলেন আমি বুঝি যাকে বলে একজন রীতিমতো মহিলা।

 অমনতরো অভাবনীয় ভুল করা তাঁর অভ্যস্ত ছিল।

 ছিল বই কি। তোমার দাড়ি দেখে কোনোদিন তোমাকে নবাব খাঞ্জেখাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি ব'লে ভুল করেন নি তো। না ঠাট্টা নয়, তিনি তো তোমার বন্ধু ছিলেন, বলো না তাঁর কথা।

 তাঁর শত্রু কেউ ছিল না, কিন্তু সমজদার বন্ধু ছিলুম একলা আমি। লোকে যখন তাঁর ক্ষ্যাপামির কথা রটাত তিনি আশ্চর্য্য হয়ে যেতেন। একদিন আমাকে এসে বললেন, সবাই বলছে আমি ক্লাস পড়াই কিন্তু ক্লাসের দিকে তাকাইনে।

 আমি বললুম, তোমার সাঙাৎরা তোমার বিদ্যের দোষ ধরতে পারে না তোমার বুদ্ধির দোষ ধরে। তারা বলে, তোমার পড়ানোর ভুল হয় না কিন্তু পড়াচ্চ যে সেইটেই ভুলে যাও।

 পড়াচ্চি যদি না ভুলি তবে পড়াতে পারতুম না, নিছক মাষ্টারিই করে যেতুম। পড়ানোটা নিঃশেষে হজম হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে মনটা আইঢাই করে না।

 জলচর জলে সাঁতার দিলে টের পাওয়া যায় না, স্থলচর দিলে সেটা খুবই মালুম হয়। তুমি অধ্যাপন সরোবরের গভীর জলের মাছ।

 আমি যদি ছাত্রদের দিকেই তাকাই তবে ক্লাসের দিকে মন দেব কী ক'রে।

 তোমার সেই ক্লাসটা আছে কোথায়।

 কোথাও না, সেইজন্যেই তো বাধা পাইনে। ছাত্ররাই যদি আমার চোখ জুড়ে বসে তাহোলে ক্লাসের আত্মাপুরুষটা আড়ালে পড়ে যে।

 “পড়ো বাবা আত্মারাম”—এই বুঝি তোমার বুলি।

 পড়াচ্চি কই। তমার আত্মািরামকেই টহল দেওয়াচ্চি।

 তোমার প্রণালীটা কী রকম।

 গঙ্গাধারার বহে যাবার প্রণালী যে রকম। ডাইনে বাঁয়ে কোথাও মরু, কোথাও ফসল, কোথাও শ্মশান, কোথাও সহর। এই নিয়ে গঙ্গামায়ীকে পদে পদে বিচার করতে যদি হোত তাহোলে আজ পর্য্যন্ত সগরসন্তানদের উদ্ধার হোত না। যাদের যতটা হবার তাই হয়, বিধাতার সঙ্গে টক্কর দিয়ে তার চেয়ে বেশি হওয়াতে গেলেই চলা বন্ধ। আমার পড়ানো চলে মেঘের মতো শূন্য দিয়ে, বর্ষণ হয় নানা ক্ষেতে, ফসল ফলে ক্ষেত অনুসারে। অসম্ভবকে নিয়ে ঠেলাঠেলি ক'রে সময় নষ্ট করিনে বলে হেডমাষ্টার হন ক্ষাপা। ঐ হেডমাষ্টারটিকেও অত্যন্ত সত্য ব'লে গণ্য করলে অত্যন্ত ভুল করা হয়।

 পুপু বললে, ছাত্রীদের অনেকে মনে মনে খুঁৎখুঁৎ করত। তাদের লক্ষ্য করে একদিন বলেছিলেন, এখানে যে মাষ্টারটা আছে তাকে নেই ক"রে দিয়েছি, তোমাদের নিজের মনকেই বেড়ে ওঠবার জায়গা করে দেবার জন্যেই। আর একদিন তিনি বলেছিলেন, মাষ্টারিতে আমি হচ্চি ক্লাসিক, আর সিধুবাবু রোমাণ্টিক। বলা বাহুল্য মাষ্টারমশায়ের কথাটা আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি।

 মানে হচ্ছে, মাষ্টার সমগ্র ক্লাসকেই দিতেন উপরে তুলে, আর সিধু ছাত্রদের একে একে নিজের কাঁধে চড়িয়ে গর্ত্তগাড়ি পার করত। বুঝেছ।

 না, বোঝবার দরকার নেই। তুমি তাঁর কথা বলে যাও, মজা লাগে শুনতে।

 আমারো লাগে, কেননা লোকটাকে বুঝতে লাগে দেরি। একদিন চীন দার্শনিকের দোহাই দিয়ে মাষ্টার আমাকে বললে, যে-রাজ্যে রাজত্বটা নেই সেই রাজ্যই সকল রাজ্যের সেরা।

 পুপে সগর্ব্বে বললে, আমাদের ক্লাস সেরা ক্লাস ছিল সন্দেহ নেই।

 আমি বললুম, তার কারণ, প্রমাণ সত্ত্বেও তোমার কমবুদ্ধির লক্ষণ মাষ্টার লক্ষ্য করতেন না।

 পুপে মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, এটাকে কি গাল বলব, না ঠাট্টা।

 আমি বললুম, পাশ দিয়ে যেতে যেতে তোমার চুলটা টেনে দিই, এ ঠাট্টা সেই স্নিগ্ধ জাতের। এতে ক্যাসাস্ ব্যালাই, অর্থাৎ অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়ার ঘোষণা নেই।

 পুপে বললে, মাষ্টার মশায়ের ব্যবস্থা ছিল মজার রকমের। তিনি বলতেন, তোমাদের নিজের খবর নিজেই রাখবে; তোমাদের খবরদারি করবার কাজ আমার নয়। প্রতিদিনের পড়ার ফল নিজেরাই রাখতুম—মার্কা দেবার নিয়ম জানা ছিল।

 তার ফল কী হোলো।

 মার্কা বরঞ্চ কম করেই দিতুম।

 কখনো কি ঠকাতে না।

 বাইরের কেউ মার্কা দেবার থাকলে তাকে ঠকাবার লোভ হোতে পারত। নিজেকে ঠকানো বোকামি। বিশেষত তিনি তো দেখতেন না।

 তারপরে।

 তারপরে প্রত্যেক তিনমাস অন্তর নিজেরাই হিসেব ক'রে জানতুম উঠছি কি নাবছি।

 তোমাদের কি সত্যযুগের হাইস্কুল, অত্যন্ত হাই। ফাঁকি দেবার লোকই বুঝি ছিল না।

 মাষ্টার মশায় ছিলেন অবিচলিত। তিনি বলতেন, সংসারে একদল লোক ফাঁকি দেবেই। কিন্তু নিজের দায় যাদের নিজের হাতে, ওরি মধ্যে তারাই কম ফাঁকি দেয়। আমাদের শাস্তিও ছিল ঐ জাতের। বাইরে থেকে না। একদিন হাজিরি নামডাক উপলক্ষ্যে প্রিয়সখীর পর্সেণ্টেজ্ বাঁচাবার জন্যে মিথ্যে কথা বলে ফেলেছিলুম। তিনি বললেন, অশুচি হয়েছ, প্রায়শ্চিত্ত কোরো। তিনি জানতেও চাইতেন না করেছি কি না।

 প্রায়শ্চিত্ত কি করেছিলে।

 নিশ্চয়ই করেছিলুম।

 অর্থাৎ তোমার পাউডরের কৌটোটা ঐ প্রিয়সখীকে দান করেছিলে।

 আমি কখ্‌খনো পাউডর মাখিনে।

 বলতে চাও, তোমার ঐ মুখের রঙ্ তোমার খাষ নিজেরই।

 আর যাই হোক্ তোমার কাছ থেকে ধার নিইনি, মিলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে।

 ছি, আমাকে নিয়ে তোমার দৃষ্টিতে যদি ভেদবুদ্ধি দেখা দেয় তাহোলে জাতে দোষারোপ ঘটে। আমরা যে সবর্ণ-বর্ণভেদের জো কী। হাতের কাছে কবি থাকলে বলতেন, তোমার গায়ের রং ফুটে বেরিয়েছে ব্রহ্মার হাসি থেকে।

 আর তোমার রং তাঁর ঠাট্টার হাসি থেকে।

 এ'কেই বলে অন্যোন্য স্তুতি, ম্যুচূয়ল অ্যাড্‌মিরেশন। পিতামহের দুই জাতের হাসি আছে, একটা দন্ত্য একটা মূর্দ্ধণ্য। আমাতে লেগেছে মূর্দ্ধণ্য হাসি, ইংরেজিতে তাকে বলে উইট্।

 দাদামশায়, নিজের গুণগান তোমার মুখে কখনো বাধে না।

 সেইটেই আমার প্রধান গুণ। আপনাকে যারা জানে আমি সেই অসামান্যের দলে।

 মুখ খুলে গেছে, কিন্তু অর নয়, এবার থামো। মাষ্টারমশায়ের কথা হচ্ছিল এখন উঠে পড়ল তোমার নিজের কথা।

 তাতে দোষ হয়েছে কী। বিষয়টা তো উপাদেয়, যাকে বলে ইণ্টারেষ্টিঙ্।

 বিষয়টা সর্ব্বদাই রয়েছে সামনে। তাকে তো স্মরণ করবার দরকার হয় না। তাকে যে ভোলাই শক্ত।

 আচ্ছা, তাহোলে মাষ্টারের একটা বিশেষ পরিচয় দিই তোমাকে। এটা টুঁকে রাখবার যোগ্য। একদিন সন্ধ্যেবেলায় মাষ্টার জনকয়েক লোককে নেমন্তন্ন করেছিল। খবরটা তার মনে আছে কি না জানবার জন্যে সকাল সকাল গেলুম তার বাড়িতে। সেবক কানাইএর সঙ্গে তার যে আলোচনাটা চলছিল, বলি সে কথাটা। কানাই বললে, জগদ্ধাত্রী পূজোর বাজারে গলদা চিংড়ির দাম চড়ে গেছে তাই এনেছি ডিমওয়ালা কাঁকড়া। মাষ্টার ঈষৎ চিন্তিত হয়ে বললে, কাঁকড়া কী হবে। ও বললে, লাউ দিয়ে ঝোল, সে তোফা হবে। আমি বললুম, মাষ্টার, গল্দা চিংড়ির উপর তোমার লোভ ছিল।

 মাষ্টার বললে, ছিল বই কী!

 তাহোলে তো লোভ সম্বরণ করতে হবে।

 তা কেন। লোভটা প্রস্তুত হয়েই আছে তাকে শাণ্ট্ ক’রে চালিয়ে দেব কাঁকড়ার লাইনে।

 দেখছি, তোমাকে বিস্তর শাণ্ট্ করতে হয়।

 মাষ্টার বললে, কঁকড়ার ঝোল তো খেয়েছি অনেকবার। সম্পূর্ণ মন দিইনি। এবার যখন দেখলুম কানাইয়ের জিভে জল এসেছে তখন তার সিক্ত রসনার নির্দ্দেশে খাবার সময় মনটা ঝুঁকে পড়বে কাঁকড়ার দিকে, রসটা পাব বেশি ক’রে। কাঁকড়ার ঝোলটাকে ও যেন লাল পেনসিলে আণ্ডরলাইন্ ক’রে দিলে, ওটাকে ভালো ক’রে মুখস্থ করবার পক্ষে সুবিধে হোলো আমার।

 মাষ্টার জিগেস করলে, আঁঠি-বাঁধা ওটা কী এনেছিস। কানাই বললে, সজনের ডাটা। মাষ্টার সগর্বে আমার দিকে চেয়ে বললে, এই দেখো মজা। ও বাজারে যাবার সময় আমার মনে ছিল লাউডগা। ও বাজার থেকে ফিরে এল, আমি পেয়ে গেলুম সজনের ডাটা। হুকুম না করবার এই সুবিধে।

 আমি বললুম, সজনের ডাটা না এনে ও যদি আন্‌ত চিচিঙ্গে।

 মাষ্টার জবাব দিলেন, তাহোলে ক্ষণকালের জন্যে ভাবনা করতে হোত। নাম জিনিষটার প্রভাব আছে। চিচিঙ্গে শব্দটা লোভজনক নয়। কিন্তু কানাই যদি ওটা বিশেষ ক’রে বাছাই ক’রে আনত, তাহোলে সংস্কার কাটাবার একটা উপলক্ষ্য হোত। জীবনে সব প্রথমে ভেবে দেখবার সুযোগ হোত। দেখাই যাক্ না; হয়তো আবিষ্কার করতুম, ওটা মন্দ চলে না। চিচিঙে পদার্থটার বিরুদ্ধে অন্ধবিরাগ দূর হয়ে উপভোগ্যের সীমানা বেড়ে যেত। এমনি ক’রেই কাব্যে কবিরা তো নিজের রুচিতে আমাদের রুচির প্রসার বাড়িয়ে দিচ্ছে। সৃষ্টিকে আণ্ডরলাইন করাই তাদের কাজ।

 তোমার রুচির প্রসার বাড়াবার কাজে কানাইয়ের আরো এমন হাত আছে।

 আছে বই কি। ও না থাকলে পিড়িং শাকে আমি কোনোদিন মনোেযোগই দিতুম না। শব্দটা আমাকে মারত ধাক্কা। সংসারে সংস্কারমুক্তিই তো অধিকারব্যাপ্তি।

 সেই মহৎ কাজে আছে তোমার কানাই।

 তা মানতে হবে ভাই। ওর ইচ্ছার যোগে আমার ইচ্ছার সঙ্কীর্ণতা ঘুচে যায় প্রতিদিন। আমি একলা থাকলে এমনটা ঘটত না।

 বুঝলুম, কিন্তু কানাইয়ের ইচ্ছার সীমানাটা—

 বাড়িয়েছি বই কি। পূর্ব্ববঙ্গের লোক, কলাইয়ের ডালের নাম শুনতে পারত না। আজকাল হিং দিয়ে কলাইয়ের ডাল ও খাচ্চে বেশ।

 এমন সময়ে কানাইয়ের পুনঃ প্রবেশ। বললে, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আজ দইটা আনিনি। কবরেজমশায় বলেন, রাত্রে দইটা বারণ।— দইয়ের দাম চড়ে গেছে বললে দ্বিরুক্তি হয় এইজন্যে কবরেজমশায়কে পাড়তে হোলো। সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললে, অল্প একটু আদার রস মিশিয়ে পাৎলা চা বানিয়ে দেব, শীতের রাত্রে উপকার দেবে।

 আমি জিগেস করলেম, কী বলো হে মাষ্টার, আদা দিয়ে চা সবাইকে খাওয়াবে না কী।

 সবাইকার কথা বলব কী ক’রে। যারা খাবে তারা খাবে। হোতে পারে উপকার। যারা খাবে না তাদের অপকার হবে না।

 আমি বললুম, মাষ্টার, চীন দার্শনিকের উপদেশমতে তোমার গেরস্থালিতে মনিব নেই বুঝি।

 না।

 তাহোলে চাকরই বা আছে কেন।

 মনিব না থাকলেই চাকর স্বতই থাকে না।

 তোমার এখানে চাকরে মনিবে বেমালুম মিশিয়ে গিয়ে একটা যৌগিক পদার্থ খাড়া হয়েছে বুঝি।

 মাষ্টার হেসে বললে, অক্সিজেন হাইড্রোজেনের দাহ্য মেজাজ ঘুচে গিয়ে দোঁহে মিলে একেবারে জল।

 আমি বললুম, যদি বিয়ে করতে ভায়া, পাড়া ছেড়ে চীনের দর্শন দৌড় দিত। থেকেও থাকবে না গিন্নি এমন নির্ব্বিশেষ পদার্থ নয়। মুখের উপর ঘোমটা টেনেও তোমার সংসারে সে হোত অতিশয় স্পষ্ট। তার রাজ্যে রাজত্বটা তার কটাক্ষে খেত দোলা —সর্বদা ধাক্কা লাগতি কখনো পিঠে কখনো বুকে।

 মাষ্টার বললে, তাহোলে কর্তা রিটর্ণ টিকিট না কিনেই দৌড় মারত ডেরা-গাজিখাঁয়ে, গিন্নিত্ব অন্তর্ধান করত ইষ্টার্‌ন্‌ বেঙ্গল রেলের রাস্তা বেয়ে বাপের বাড়িতে।

 মাষ্টার মাঝে মাঝে হাসির কথা বলে কিন্তু হাসে না।

 পুপুদিদি বললে, আমাদের মাষ্টারমশায়কে নিয়ে যদি গল্পের পালা বাঁধতে হয় কী রকম ক’রে বাঁধো।

 তাহোলে দশলক্ষ বছর বাদ দিই।

 তার মানে আজগুবি গল্প বানাতে। অথচ আজকের দিনের বিরুদ্ধপক্ষের সাক্ষীর শঙ্কা থাকত না।

 কোনো সাহিত্যওয়ালা কখনো সাক্ষীর ভয় করে না। আসল কথা আমার গল্পটা ফুটে উঠতে যুগান্তরের দরকার করবে। কেন, সেইটে বুঝিয়ে বলি।

 পৃথিবী-সৃষ্টির গোড়াকার মালমসলা ছিল পাথর লোহা প্রভৃতি মোটা মোটা ভারি ভারি জিনিষ। তারই ঢালাই পেটাই চলেছিল অনেককাল। কঠোরের বেআব্রুতা ছিল বহুযুগ ধ’রে। অবশেষে নরমমাটি পৃথিবীকে শ্যামল আস্তরণে ঢাকা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার যেন লজ্জা রক্ষা করলে। তখন জীবজন্তু আসরে নামল স্তুপাকার হাড় মাংসের বোঝাই নিয়ে; মোটা মোটা বর্ম্ম প’রে তারা দুশো পাঁচশো মোণ অসভ্য ল্যাজ টেনে টেনে বেড়াতে লাগল। তারা ছিল দর্শনধারী জীব। কিন্তু সেই মাংসবাহীর দল সৃষ্টিকর্ত্তার পছন্দসই হোলো না। আবার চলল বহু যুগ ধরে নিষ্ঠুর পরীক্ষা। শেষকালে এল মনোবাহী মানুষ। ল্যাজের বাহুল্য গেল ঘুচে, হাড়মাংস হোলো পরিমিত, কড়া চামড়াটা নরম হয়ে এল ত্বকে। না রইল শিং, না রইল ক্ষুর, না রইল নখের জোর, চার পা এসে ঠেকল দুটিমাত্র পায়ে। বোঝা গেল বিধাতা তাঁর হাতিয়ার চালাচ্চেন সৃষ্টির যুগটাকে ক্রমশঃ সূক্ষ্ম ক’রে আনবার জন্যে। স্থূলে সূক্ষে জড়িয়ে আছে মানুষ। মনের সঙ্গে মাংসের চলেছে ঠেলাঠেলি মারামারি। বিধাতা পুনশ্চ মাথা নাড়ছেন, উহু হোলো না। লক্ষণ দেখা যাচ্চে এটাও টিকবে না, এ আপনিই আপনাকে নিকেশ করে দেবে আশ্চর্য্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে। যাবে কয়েক লক্ষ বছর কেটে। মাংস পড়বে ঝরে, মন উঠবে একেশ্বর হয়ে। সেই বিশুদ্ধ মনের যুগে তোমার মাষ্টারমশায় বসেছেন শরীররিক্ত ক্লাসে। মনে করে দেখে তার শিক্ষা দেবার প্রণালী হচ্চে ছাত্রদের মধ্যে নিজেকে মেলাতে থাকা, মনের উপর মন বিছিয়ে; বাইরের বাধা নেই বললেই হয়।

 স্থলবুদ্ধির বাধাও নেই।

 সেটা না থাকলে বুদ্ধি মাত্রই হয়ে পড়ে বেকার। ভালোমন্দ বোকা বুদ্ধিমানের ভেদ আছেই। চরিত্র আছে নানারকমের। ভাবের বৈচিত্র্য আছে, ইচ্ছার স্বাতন্ত্র আছে। এখন তিনিই ভালো মাষ্টার যিনি সেই অনেকের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন, শিক্ষা এখন অন্তরে অন্তরে।

 দাদামশায়, ইস্কুলটা কোথায় আছে সেটা ঠিক মনে আনতে পারছিনে।

 পৃথিবীতে তিনটে বাস আছে—এক সমুদ্রতলে, আর এক ভূতলে, আর আছে আকাশে, যেখানে সূক্ষ্ম হাওয়া আর সূক্ষ্মতর আলো। এইখানটা আজ আছে খালি আগামী যুগের জন্যে।

 তাহোলে তোমার ক্লাস চলেছে সেই হাওয়ায় সেই আলোয়। কিন্তু ছাত্রদের চেহারাটা কী রকম।

 বুঝিয়ে বলা শক্ত, তাদের আকার নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আকারের আধার নেই।

 তাহোলে বোধ হচ্ছে নানা রঙের আলোয় তা’রা গড়া।

 সেইটেই সম্ভব। তোমাদের বিজ্ঞান মাষ্টার তো সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন—বিশ্বজগতে সূক্ষ্ম আলোর কণাই বহুরূপী হয়ে স্থলরূপের ভান করছে। সেদিন আলো আপন আদিম সূক্ষ্মরূপেই প্রকাশ পাবে। ক্লাসে তোমরা সবাই আলো করে বসবে। সেদিন ওটিন-স্নো-ওয়ালারা একেবারে দেউলে হয়ে গেছে।

 দেউলে কেন, আলো হয়ে গেছে।

 দেউলে হয়ে যাওয়ার মানেই তো আলো হয়ে যাওয়া।

 আমি কোন্ রঙের আলো হব দাদামশায়।

 সোনার রঙের।

 আর তুমি।

 আমি একেবারে বিশুদ্ধ রেড়িয়ম।

 সেদিন আলোয় আলোয় লড়াই হবে না তো, ইলেক্ট্রন নিয়ে হবে না। কি কাড়াকাড়ি।

 ভাবনা ধরিয়ে দিলে। লীগ্ অফ্ লাইট্‌সের দরকার হবে বোধ হচ্চে। ইলেক্ট্রন নিয়ে টানাটানির গুজব এখনি শুনতে পাচ্ছি।

 ভালোই তো দাদামশায়। বীররসের কবিত। তোমার ভাষায় উজ্জ্বল বর্ণে বর্ণিত হবে। ঐ যাঃ, ভাষা থাকবে তো।

 শব্দের ভাষা নিছক ভাবের ভাষায় গিয়ে পৌঁছবে—ব্যাকরণ মুখস্থ করতে হবে না।

 আচ্ছা গান।

 গান হবে রঙের সঙ্গত। বডো সহজ হবে না। তান যখন ঠিকরে পড়তে থাকবে, ঝলক মারবে আকাশের দিকে দিকে। তখনকার তানসেনরা দিগন্তে অরোরা বোরিয়ালিস বানিয়ে দেবে।

 আর তোমার গদ্যকাব্য কী হবে বলো তো।

 তাতে লোহার ইলেক্ট্রনও মিশবে আবার সোনারও।

 সেদিনকার দিদিমা পছন্দ করবে না।

 আমার ভরসা আছে সেদিনকার আধুনিক নাৎনীরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।

 তাহোলে সেই আলোর যুগে তোমার নাৎনী হয়েই জন্মাব। এবারকার মতো দেহধারিণীর ’পরে ধৈর্য্য রক্ষা কোরো। এখন চললুম সিনেমায়।

 কিসের পালা।

 বৈদেহীর বনবাস।