ঝুলন।


আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে
মরণ খেলা
নিশীথ বেলা!
সঘন বরষা গগন আঁধার
হের বারিধারে কাঁদে চারিধার,
ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে
ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন শয়ন
করিয়া হেলা,
রাত্রি বেলা!

ওগো পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কি কল্লোল!
দে দোল্‌ দোল্‌!
পশ্চাৎ হতে হাহা করে’ হাসি’
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি’
যেন এ লক্ষ বক শিশুর
অট্ট রোল!
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্ট গোল!
দে দোল্‌ দোল্‌!

আজি জাগিয়া উঠিয়া পরাণ আমার
বসিয়া আছে
বুকের কাছে।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
ধরিছে আমার বক্ষঃ চাপিয়া,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে
হৃদয় নাচে,
ত্রাসে উল্লাসে পরাণ আমার
ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে!



হায়, এতকাল আমি রেখেছিনু তারে
যতন ভরে
শয়ন পরে।
ব্যথা পাছে লাগে, দুখ পাছে জাগে
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসর-শয়ন করেছি রচন
কুসুম থরে,
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে
গোপন ঘরে,
যতন ভরে।

কত সোহাগ করেছি চুম্বন করি
নয়ন পাতে
স্নেহের সাথে।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয় নাম মৃদু মধুভাষে,
গুঞ্জর তান করিয়াছি গান
জ্যোৎস্না রাতে,
যা কিছু মধুর দিয়েছিনু তার
দুখানি হাতে
মেহের সাথে!



শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরাণ
আলস রসে,
আবেশ বশে।
পরশ করিলে জাগে না সে আর
কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার
নিশি দিবসে;
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ
মরমে, পশে
আবেশ বশে।

ঢালি’ মধুরে মধুর বধূরে আমার
হারাই বুঝি,
পাইনে খুঁজি!
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে,
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম
হয়েছে পুঁজি!
অতল স্বপ্ন-সাগরে ডুবিয়া
মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি!



তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে
নূতন খেলা
রাত্রি বেলা!
মরণ দোলায় ধরি রসিগাছি
বসিব দুজনে বড় কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া
মারিবে ঠেলা,
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে
ঝুলন খেলা,
নিশীথ বেলা!

দে দোল্‌ দোল্‌!
দে দোল্‌ দোল্‌!
এ মহাসাগরে তুফান তোল্!
বধূরে আমার পেয়েছি আবার
ভরেছে কোল!
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয় রোল!
বক্ষ শোণিতে উঠেছে আবার
কি হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার
কি কল্লোল!
উড়ে কুন্তল উড়ে অঞ্চল,
উড়ে বনমালা বায়ু চঞ্চল,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী
মত্ত বোল!
দে দোল্ দোল্‌!
আয় রে ঝঞ্ঝা, পরাণ বধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন
বসন খোল্‌!
দে দোল্‌ দোল্!

প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয় লাজ,

বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে
ভাবে বিভোল!
দে দোল্‌ দোল্‌!
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ
দুটো পাগোল!
দে দোল্‌ দোল্‌!


১৫ চৈত্র, ১২৯৯।