স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/প্রথম অধ্যায়



স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা।

 প্রাচীনকালে সভ্যতা, সৌন্দর্য্য ও শিক্ষার বিচিত্র লীলাভূমি ও কীর্ত্তিমন্দির বলিয়া যে সমস্ত মহানগরী খ্যাতিলাভ করিয়াছিল, তন্মধ্যে গৌরবোন্নত, সৌন্দর্য্য-সমলঙ্কত, সমৃদ্ধিসম্পন্ন স্পেনের কর্ডোভা মহানগরী অন্যতম। বোগদাদ ব্যতীত কর্ডোভা মহানগরীর সহিত অপর কোনও নগরীর নামও উল্লিখিত হইবার যোগ্য নহে। স্পেনকে পরী বলিয়া কল্পনা করিলে কর্ডোভাকে তাহার চক্ষু বলিয়া স্থান দিতে হয়। প্রাচীন আরব ঐতিহাসিকগণ কর্ডোভাকে স্পেনের পাত্রী বা ক’নে (Bride) বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। গৌরবের দিনে কর্ডোভার ঐশ্বর্য্য ও সৌন্দর্য্য, শিক্ষা ও সভ্যতা, শিল্প ও বাণিজ্য, স্থখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, আমোদ প্রমোদ ও বিলাস-উল্লাস, একত্র পুঞ্জীভূত হইয়া ইহাকে কবি-চিত্ত-সম্মোহন কল্পনাতীত সুন্দরী ও সুখময়ী করিয়া তুলিয়াছিল। পৃথিবীর নানা দিগ্দেশের ভ্রমণকারিগণ কৌতূহলাক্রান্তচিত্তে কর্ডোভার বিশ্ব-বিশ্রুত সৌন্দর্য্য-গরিমায় মুগ্ধ হইয়া তদ্দর্শনার্থ আগমন করিতেন এবং বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে ইহার গঠন-সৌন্দর্য্য, পরিচ্ছন্নতা, সুখশান্তি এবং বিপুল ঐশ্বর্য্যচ্ছটায় স্তম্ভিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে ইহার প্রশংসা কীর্ত্তনে আপনাদিগকে চরিতার্থ মনে করিতেন।

 অন্ধতমসাচ্ছন্ন অসভ্য এবং বর্ব্বরপ্রকৃতি খ্রীষ্টানগণ উত্তর কালে শিক্ষা ও সভ্যতার যে আলোকে ইউরোপকে আলোকিত করিয়া তুলিয়াছে; শিক্ষা ও সভ্যতার সেই প্রদীপ্ত আলোকভাণ্ড কর্ডোভাতেই বিশেষরূপে প্রজ্বলিত হইয়াছিল।

 পাঠক! মনে রাখিবেন, মুসলমান-স্পেনের কর্ডোভা নগরী হইতে যখন সভ্যতার স্বর্গীয় প্লাবন, জ্ঞান-বিদ্যাশিক্ষার উত্তাল তরঙ্গমালা বক্ষে ধারণ করিয়া কুসংস্কার জঞ্জাল-পরিপূর্ণ ইউরোপকে বিপ্লাবিত এবং বিধৌত করিবার জন্য চতুর্দ্দিকে তীব্রবেগে ছুটিয়া পড়িতেছিল; তখন বর্ত্তমান জ্ঞানগর্ব্বিত সভ্যতা-প্রদীপ্ত ইংরাজ, ফরাসী, এবং জর্ম্মাণ জাতির পূর্ব্বপুরুষগণ পর্ব্বতগহ্বরে এবং গভীর কাননাবাসে বন্য ফল মূল এবং আম-মাংসে উদরপূর্ত্তি করিয়া আপনাদের বন্যজীবন অতিবাহিত করিত। নগরবাসিগণ সামান্য পর্ণকুটীরে মৃগচর্ম্ম-জাত-পরিচ্ছদাদি নির্ম্মাণে এবং যুদ্ধ কলহে আপনাদের বর্ব্বরজীবনের অভিনয় করিত। স্পেনে যখন দর্শন-বিজ্ঞানের জ্ঞানগর্ভ সূক্ষ্ম সমালোচনায় মুসলমান মনীষিবৃন্দ ব্যাপৃত ও আবিষ্কার উদ্ভাবনার সূত্র নির্ণয় এবং গুপ্ততত্ত্ব উদঘাটনে মস্তিষ্ক বিলোড়ন করিতেছিলেন,খ্রীষ্টিয়ান জাতির ধর্ম্মাচার্য্যগণ তখন কোনরূপে লাটিন ভাষায় নাম স্বাক্ষর করিয়া আপনাদের বিদ্যাবত্তার পরিচয় প্রদান করিতেন। গ্রীসে তখন অজ্ঞানতার অমাবস্যা বিরাজমান। সান্দ্র-তমোময় খ্রীষ্টিয়ান ইউরোপের মধ্যে একমাত্র কনষ্টাণ্টিনোপলে রোমীয় সভ্যতার বিকট বিকৃতি, নিতান্ত ক্ষীণরশ্মি কালিমাময় প্রদীপের ন্যায় স্তিমিতভাবে প্রজ্বলিত হইয়া, সেই ভীষণ অন্ধকারে কেবলমাত্র বিভীষিকাই উৎপন্ন করিতেছিল!

 নগরী-কুল-সাম্রাজ্ঞী কর্ডোভা সুন্দরীর সৌন্দর্য্যচ্ছটা ও ঐশ্বর্য্যঘটা,—খলিফাদিগের অজস্র অর্থব্যয় ও প্রাণগত চেষ্টা, ভাস্কর কারু ও স্থপতিগণের আশ্চর্য্য কারুকৌশল ও গঠননৈপুণ্য এবং নাগরিকগণের বিলাস-বিভ্রম-প্রিয়তায় বাসন্তী পূর্ণিমার কৌমুদীজাল-বিস্নাত-নিসর্গের উন্মুক্ত-সৌন্দর্য্যের স্বৰ্গীয় লীলাভঙ্গীর বিচিত্র পটের ন্যায় প্রতীয়মান হইত। মহানগরী কর্ডোভার তুষার-ধবল-স্নেহমসৃণ মর্ম্মর প্রস্তর-বিনির্ম্মিত, কারুকার্য্য-শোভিত অসংখ্য প্রাসাদ ও সৌধ, নানাজাতীয় সুস্বাদু সুদৃশ্য ও সুগন্ধ ফলফুলের তরুলতা-শোভিত মাধবী-সুষমাসম্পন্ন চিত্তবিনোদন উদ্যানাবলী, সুপ্রশস্ত পরিচ্ছন্ন প্রস্তরাস্তরণাবৃত-ঋজু-রথ্যাবলী, কমলদল-শোভিত সুপেয় স্বচ্ছ পয়োপূরিত প্রশস্ত সরোবর সকল, শ্যামলতৃণশষ্প-মণ্ডিত বিস্তৃত ময়দান, নাগরিকগণের উৎকৃষ্ট ক্ষৌম পরিচ্ছদ, সদাচার ও সদালাপ, তাহাদিগের শাস্ত্রজ্ঞান এবং শস্ত্রপটুতা, দিগ্বিজয়ী বীরেন্দ্রবৃন্দের অধ্যবসায় এবং রণনৈপুণ্য, অধ্যাপক ও পণ্ডিতবর্গের জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা, কলেজ ও পাঠশালার অসংখ্য ছাত্রের সহর্ষ কোলাহল, খরস্রোতা ওয়াদীঅল-কবীরের (গোয়াডেল কুইভার) মর্ম্মর-মণ্ডিত তীরে অধিবাসীদিগের সান্ধ্যভ্রমণ, ময়দানে অশ্ব-ধাবন ও চৌগন-ক্রীড়া, (পলো) অপরাহ্ণে এবং জ্যোৎস্না-স্নাত-প্রফুল্ল-যামিনীতে নদীবক্ষে নানা বর্ণের নানা আকারের তরণীমালার অভিযান, পথিক ও ভ্রমণকারীদিগের আশ্রম-গৃহ, নানা দেশীয় বিলাস-সামগ্রী-সম্ভারপূর্ণ বাজার ও বিপণি সমূহ, বিবিধ উৎকৃষ্ট গ্রন্থপূর্ণ লাইব্রেরী, অসংখ্য স্নানাগার, নদীতীরের হাওয়াখানা এবং বুরুজ, স্বর্ণচূড় রমণীয় মস্‌জিদ সমূহ, অভ্রভেদী সুদৃঢ় দুর্গ, বিস্তৃত পরিখা এবং মনোহর রাজপ্রাসাদনিচয় ইত্যাদির মনোরম দৃশ্যে ইহা ভুবনমোহিনী নগরীকুল-রাণী বলিয়া বিশ্ববিশ্রুত খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। ফলতঃ তৎকালের সুসভ্য ও সমুন্নত জাতির নাগরিক জীবনের যাবতীয় আবশ্যকীয় উপকরণ এবং দ্রব্য একত্র সম্মিলিত ও সুশৃঙ্খলিত হইয়া কর্ডোভাকে ভূস্বর্গে পরিণত করিয়াছিল! কার্ডোভার নাগরিকগণ সুশিক্ষিত এবং সুমার্জ্জিত রুচি-সম্পন্ন ছিলেন। কাব্য ও সঙ্গীতালোচনা, লালিতকলা ও সুকুমার বিদ্যাচর্চ্চা সম্ভ্রান্তবর্গের আদরণীয় ছিল।

 ডোজী (Dozey) লেন্‌পুল (Lane Pool) আল্‌মেকারী বলেন, “গৌরবের দিনে কর্ডোভার বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞান-গরিমার পরিসীমা করা দুষ্কর ছিল!” ইউরোপের মধ্যে কর্ডোভাতেই সর্ব্ববিদ্যা-বিশারদ ধী-সমৃদ্ধ পণ্ডিতমণ্ডলী পরিদৃষ্ট হইত। কর্ডোভার বিদ্যোৎসাহী সোলতান এবং খলিফাগণের রাজসভা এবং রাজপ্রাসাদ উভয়ই সর্ব্বপ্রকার বিদ্যালোচনার আশ্রয়স্থান এবং জ্ঞান, বিদ্যা ও বীরত্বের সম্মানভূমি ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী এখানে উচ্চশ্রেণীর কতিভাশালী রাজনীতিবিশারদ মন্ত্রিগণ, শাসনপটু গভর্ণরগণ, বিচারক্ষম বিচারক এবং আইনজ্ঞ ব্যবহারাজীবগণ, তত্ত্বগ্রাহী বৈজ্ঞানিকবর্গ, শক্রন্তপবীরেন্দ্রবৃন্দ, বংশপরম্পরায় জন্মগ্রহণ করিয়া কর্ডোভাকে পবিত্র এবং গৌরবান্বিত করিয়াছিলেন।

 উদ্ভিদ্‌তত্ত্ব এবং চিকিৎসাবিদ্যা এখানে আশাতীত উন্নতি লাভ করে। বাণিজ্য ও শিল্পকলার অপূর্ব্ব শ্রী এখান হইতে ইউরোপের সর্ব্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জ্যোতিষ, কবিত্ব ও সঙ্গীতবিদ্যা কর্ডোভাতেই পুষ্টি লাভ করে। পাঠক! শুনিলে আবাক্ হইবেন যে, কর্ডোভার গোলাম এবং নাবিকগণের মধ্যেও অন্যান্য নগরের নাগরিকগণ অপেক্ষা সঙ্গীত ও কবিত্বে অধিকতর অনুরাগ ও কৃতিত্ব ছিল। দশম শতাব্দীতে মোস্লেম-স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতে প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরীর জ্ঞানচর্চ্চা ও শিক্ষানুরাগ এবং প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের মহারাজধানী রোম নগরের বিলাস-উল্লাস ও বীরত্বাভিনয়ের বিচিত্র দৃশ্যের একত্র সমাবেশ পরিদৃষ্ট হইত! মুরিস আরবদিগের দেহ এবং বাহ্যপ্রকৃতি রোমীয় এবং মন ও অন্তর্‌-প্রকৃতি গ্রীসীয় ছিল। বোধ হইত যেন রোমীয়দিগের দেহ এবং গ্রীকদের আত্মা লইয়া মুরিস আরবগণ ভূমণ্ডলে নবজন্ম পরিগ্রহ করিয়াছেন। বস্তুতঃই তাঁহাদের দেবতুল্য অমায়িকতা ও সৌজন্য এবং অগ্নিময় বীরত্ব ও অসামান্য পাণ্ডিত্য তাহাদিগকে এক অসাধারণ জাতিতে পরিণত করিয়াছিল। কর্ডোভা এই অসাধারণ জাতির জীবনের বিকাশ-ভূমি ও কর্ম্মক্ষেত্র ছিল। বর্তমান সময়ে কর্ডোভার সেই অতীত-শ্রী, ঐশ্বর্য্য ও সভ্যতা গরিমা বিলুপ্ত হইয়াছে। স্পেন এখন মুসলমানশূন্য, কর্ডোভা প্রাণশূন্য! তথাপি ইহার ধ্বংসাবশেষ দর্শনে বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইতে হয়। ভগ্ন অট্টালিকার মর্ম্মর-প্রস্তরের স্তূপমাল, ইদানীং কাননে পরিণত-উদ্যানাবলী, বন্যজন্তু-নিবাস—দুর্গ ও গড়, মহাপ্রাসাদ আল্‌কসারের বিরাট ধ্বংসাবশেষ এবং ভূপতিত ও গির্জ্জায় পরিণত মস্‌জিদনিচয় দর্শন করিলে, এখনও ভাবুক ও পর্য্যটক, প্রাচীন কর্ডোভার শ্রী ও ঐশ্বর্য্য কল্পনাপথে দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত ও বিমুগ্ধ হইয়া পড়েন! পাঠক! খ্রীষ্টীয় পর্য্যটকগণ পর্য্যন্ত কর্ডোভার ধ্বংসাবশেষ দর্শনে অশ্রু সম্বরণ করিতে অক্ষম হইয়াছেন। ওয়াসিংটন আইরভিং এবং ডন পাস্‌কল প্রভৃতি মুসলমানবিদ্বেষী খ্রীষ্টান ঐতিহাসিকগণও কর্ডোভার ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া ভাবাবেশে বিমোহিত হইয়া পড়িয়াছিলেন! যাবতীয় খ্রীষ্টীয়ান ঐতিহাসিকগণ মুক্ত কণ্ঠে কর্ডোভার অপূর্ব গৌরবকাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন এবং সজলনয়নে দুঃখিত অন্তঃকরণে ইহার পতন ও ধ্বংসে অসভ্য স্পানিয়ার্ডদিগকে তিরস্কারপূর্ব্বক সমধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া দুঃখ ও লজ্জায় একান্ত ম্রিয়মাণ হইয়াছেন! এখনও গোয়াডেলকুইভারের[] বক্ষে সেই বিরাট্‌ মুরিস সেতু বিদ্যমান থাকিয়া কর্ডোভার আশ্চর্য্য স্থাপত্য-কৌশলের পরিচয় প্রদান করিতেছে। উম্মিয়া বংশীয় সোলতানের প্রথম মস্‌জিদ এখনও বর্ত্তমান রহিয়া ভাস্কর-নৈপুণ্যের কারুকৌশলের মহিমা ব্যক্ত করিতেছে!

 প্রাতঃস্মরণীয় খলিফা তৃতীয় আব্দর রহমানের সময় হইতে কর্ডোভা উত্তরোত্তর দ্রুতবেগে উন্নত ও সমৃদ্ধ হইতে থাকে। গোয়াডেলকুইভারের উভয় তীরে রম্য হর্ম্ম্যাবলী, উপবন এবং তুঙ্গশীর্ষ মস্‌জিদের শ্রেণী, দশ মাইল পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গোয়াডেল কুইভারের উভয় তীরে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ দ্বাদশ সহস্ৰ নগরের পত্তন হইয়াছিল। পৃথিবীর কোনও নদীতীরে এত অধিক সংখ্যক নগরের আর কখনও পত্তন হয় নাই! মুরিস আরবগণ কৃষিবিদ্যায় বিশেষ দক্ষতা ও কৌশল প্রকাশ করিতেন। তাহদের যত্ন ও কৌশলে নানাদেশীয় নানাবিধ দুর্ল্লভ বৃক্ষলতাদি রোপিত হইয়া স্বাভাবিক ভাবে বৰ্দ্ধিত এবং ফলিত হইত। উম্মিয়া বংশের প্রথম সোলতান আব্দর রহমান তাহার পিতামহ হিশাম কর্ত্তৃক বিরচিত বাল্যকালের ক্রীড়াভূমি দামেস্কের শাহী-উদ্যানের অনুরূপ একটী বিরাট্‌ রমণীয় উদ্যান কর্ডোভা নগরীতে প্রস্তুত করেন। সোলতান পৃথিবীর নানাদেশের বিভিন্ন উদ্যানে লোক পাঠাইয়া এই উদ্যানের জন্য নানাজাতীয় বৃক্ষলতা, তৃণগুল্ম ও বীজ সংগ্রহ করিয়া অপরিসীম যত্নে তৎসমুদয়কে পুষ্পিত ও ফলিত করেন। দামেস্কের খর্জ্জুর সর্ব্ব প্রথমে এই উদ্যানেই রোপিত হইয়াছিল। এখান হইতেই পরে সমগ্র স্পেন ও ইউরোপের বিভিন্নদেশে খর্জ্জুর বৃক্ষ সমুৎপন্ন হয়। উদ্যানপালগণ উদ্ভিদ্‌বিদ্যা এবং রাসায়নিক বিদ্যায় এমনি পারদর্শী ছিলেন যে, তাঁহারা অতি সত্বর নানাদেশীয় ভিন্ন ভিন্ন জল বায়ুতে উদ্ভূত বৃক্ষলতাদি অতীব আশ্চর্য্য রূপে স্বাভাবিক ভাবে বৰ্দ্ধিত ও ফলিত করিয়া তুলিতেন। এই উদ্যান হইতেই সর্ব্বপ্রথমে স্পেনের সর্ব্বত্র এসিয়ার নানাজাতীয় বৃক্ষলতাদি বংশ বিস্তার করিয়াছিল। এইরূপে সিরিয়া প্রদেশের উৎকৃষ্ট দাড়িম্ব, আখ্‌রোট, জলপাই, কুঙ্কুম, ইক্ষু, তিল, পেস্তা এবং বিবিধ প্রকারের ফুল প্রভৃতি প্রথমে স্পেনে এবং তথা হইতে ভূমধ্য-সাগরের দ্বীপব্যূহে ও ইটালী ফান্স প্রভৃতি দেশে বিস্তৃতি লাভ করে। স্পেনের অসংখ্য উদ্যানে জল সিঞ্চনের উত্তম বন্দোবস্ত ছিল। অসংখ্য সীস-নির্ম্মিত নল সংযোগে পাহাড়ের ঝরণার নির্ম্মল জল সরবরাহ করা হইত। এই সমস্ত জলরাশি, অসংখ্য কৃত্রিম উৎস, পুষ্করিণী, দীঘিকা, সরোবর, চৌবাচ্চা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নহরে উৎসারিত, সঞ্চিত ও প্রবাহিত হইত। আরব জাতির জল-সরবরাহের প্রণালী সর্ব্বত্রই প্রশংসনীয় এবং উত্তম ছিল। আরবগণ মরুবাসী ছিলেন বলিয়া শ্যামলতরু-কুঞ্জময়-রমণীয়-উদ্যান, কুলুকুল-নাদিনী নির্ঝরিণী ও জলের উৎস তাহাদের নিকট নিতান্ত প্রীতিপ্রদ এবং চিত্তবিনোদন বলিয়া প্রতীয়মান হইত।

 সোলতানদিগের প্রাসাদ সমূহ সৌন্দর্য্যে এবং প্রিয় দৰ্শন-দুর্ল্লভ-দ্রব্য-সম্ভারে নিতান্তই চিত্তাকর্ষক ও মনোজ্ঞ ছিল। ঐতিহাসিকগণ মুক্তকণ্ঠে প্রাসাদগুলির অতুলনীয় জাঁকজমক এবং সৌন্দর্য্যবাহুল্যের বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। প্রাসাদগুলির সিংহদ্বারের সম্মুখে কোথাও বা গোয়াডেলকুইভারের খরস্রোত প্রবাহিত হইত, আবার কোথায়ও বা সুবিশাল সবুজ ময়দান রম্যদৃশ্য প্রকটন করিত। প্রত্যেক প্রাসাদ হইতে একটা প্রস্তরনির্ম্মিত বর্ত্ম জামে-মস্‌জিদের সহিত সংলগ্ন করা হইয়াছিল। প্রতি শুক্রবারে স্বর্ণ ও মণি-মুক্তা-খচিত উজ্জ্বল পরিচ্ছদ-পরিহিত দেহরক্ষী সৈন্য এবং পার্শ্বচরগণে পরিবেষ্টিত হইয়া সোলতান ও শাহ্‌জাদাগণ অপূর্ব্ব জাঁকজমক ও বাদ্যোদ্যমসহ এই পথ দিয়া জামে-মস্‌জিদে গমন করিতেন। গ্রীষ্মকালে সবুজবর্ণের এবং শীতকালে রক্তবর্ণের বহুমূল্য গালিচা এবং মখ্‌মল এই পথে বিস্তৃত করিয়া তদুপরি কুসুমজাল বিকীর্ণ করা হইত! প্রাসাদগুলির মধ্যে, কোনটীর নাম পুষ্প-প্রাসাদ, কোনটীর নাম প্রেম-প্রাসাদ, কোনটীর নাম মুকুট-প্রাসাদ ইত্যাদি ছিল। উম্মিয়া বংশের প্রাচীন কীর্ত্তিভূমি এবং রাজধানী দামেস্ক নগরীর নামানুযায়ী একট প্রাসাদ দামেস্ক-প্রাসাদ বলিয়া কথিত হইত। এই প্রাসাদ দামেস্কের প্রাসাদের অনুকরণেই নির্ম্মিত ও সজ্জিত করা হইয়াছিল। মার্ব্বেল প্রস্তরের স্তম্ভাবলীর উপরে ইহার স্বর্ণরাগ-রঞ্জিত বিরাট ছাদ ছিল। ইহার মেজেতে মণিমুক্তা রজত কাঞ্চনের দ্বারা নীল, শ্বেত ও রক্তপ্রস্তরের জমিনে বিবিধ কারুকার্য্য খচিত করা হইয়াছিল! এই প্রাসাদটী কর্ডোভা নগরীর মধ্যে, সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর ছিল। একজন আরব-ভ্রমণকারী লিখিয়াছেন “এই প্রাসাদের ন্যায় রমণীয় প্রাসাদ আর দেখিতে পাওয়া যায় না!” কেবল পুষ্প-পুঞ্জ-মণ্ডিত মঞ্জুলতা-কুঞ্জে এবং শীতল জল-শীকর-সম্পৃক্ত-সুমন্দ-সমীরণ-সঞ্চারে ইহার উদ্যান শুধু প্রীতিপ্রদ ও স্বাস্থ্যজনক ছিল না; পরন্তু গোলাপ-জলের বৃহৎ বৃহৎ কৃত্রিম সরোবর, পৃথিবীর নানা দেশ হইতে সংগৃহীত নানা জাতীয় জলচরপক্ষী-সমন্বিত এবং কমলদল-শোভিত আশ্চর্য্য ঝিল, এবং নানাবর্ণের মৎস্যসমাকুলিত কুলুকুলুনাদিনী নির্ঝরিণী প্রবাহিত ছিল। এই প্রাসাদে দিবারজনী সমভাবে বহুমূল্য আম্বর-চন্দন বিবিধ সুগন্ধি প্রজ্বলিত হইয়া প্রাসাদের বায়ুপ্রবাহকে সুরভিত করিয়া রাখিত, গোলাপ-সরোবর হইতে সুগন্ধ বাষ্প উত্থিত হইয়া উদ্যানের প্রবাহকে সুশীতল ও সুগন্ধিযুক্ত করিত। প্রাসাদের আকাশভেদী সুদৃশ্য ও সুরঞ্জিত গম্বুজ সমূহে সুবৃহৎ পতাকা উড্ডীন হইয়া বিজয়-গৌরব ঘোষণা করিত। কর্ডোভা মহা নগরীর বহুসংখ্যক উদ্যানের মধ্যে কতিপয় উদ্যান অতীব বিশাল এবং আশ্চর্য্য শোভাময় ছিল। ‘জল-চক্র-উদ্যানে’ একটী সুবৃহৎ জলযন্ত্র দ্বারা জলরাশি ঊর্দ্ধে উত্তোলিত এবং বৃক্ষ-বাটিকায় সিঞ্চিত হইত। উদ্যানের ক্ষেত্রগুলি এই শব্দায়মান জলযন্ত্রের জলোচ্ছাসে প্লাবিত হইত।

 উদ্যানের প্রত্যেক তরুশ্রেণীর পার্শ্ব দিয়া নির্ম্মল জলধারা প্রবাহিত হইত। নানা প্রকারের সুদৃশ্য ফোয়ারায় দিবারাত্র সলিল উৎক্ষেপ হইত। গ্রীষ্মকালে “ঝরণা ময়দানে” নাগরিকগণের বায়ু সেবন নিত্য প্রয়োজনীয় ছিল। এই মখ্‌মল-কোমল-শ্যামল-তৃণদল সমাবৃত ময়দানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শত শত নির্ঝরিণী প্রবাহিত হইত। নির্ঝরিণীগুলি কোথায়ও ত্রিকোণাকার, কোথায়ও বৃত্তাকার, কোথায়ও বহু ভুজাকার, কোথায়ও অৰ্দ্ধচন্দ্রাকার সুদৃশ্য পুষ্পকুঞ্জ ও লতাগৃহ বেষ্টন করিয়া পরস্পর মিলিত হইয়া বহিয়া যাইত। উদ্যানে বিশ্রামের জন্য মার্ব্বেলপ্রস্তরের শত শত আসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। অসংখ্য প্রকারের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মৎস্য সমূহ সলিল ক্রীড়া করিয়া নাগরিকগণের নয়নরঞ্জন করিত। রবিতাপতপ্ত নিদাঘ-অপরাহ্ণে এখানে ভ্রমণ করা বড়ই আরামজনক ও স্বাস্থ্যপ্রদ ছিল। খরস্রোতা গোয়াডেলকুইভারের স্ফীতপ্রবাহ নাগরিকগণের পক্ষে বিশেষ আমোদজনক ছিল। সংখ্যাতীত চিত্র বিচিত্র তরণীমালায় নদীবক্ষ সমাচ্ছন্ন-প্রায় থাকিত। সপ্তদশটী সুবৃহৎ ও সুদৃঢ় প্রস্তরনির্ম্মিত খিলানের উপরে এক বিরাট্‌ সেতু নির্ম্মাণ করিয়া নদীর উভয়তীর সংযুক্ত করা হইয়াছিল। এই বিরাট সেতু অদ্যপি অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান থাকিয়া মুরিসদিগের স্থাপত্যকৌশল-মহিমা পরিব্যক্ত করিতেছে। নগরীতে সম্ভ্রান্তবর্গ ও আমীর ওমরাহ ইত্যাদির পঞ্চাশ সহস্রেরও অধিক বাটী ছিল। এই সমস্ত বাটীই মর্ম্মরমণ্ডিত, হুগঠিত ও সুদৃশ্য প্রাসাদনিচয়ে সুশোভিত ছিল। সাধারণ লোকের বাটীর সংখ্যা এক লক্ষ ছিল। উপাসনার জন্য সপ্তশত মস্‌জিদ এবং স্নানের জন্য নয় শত স্নানাগার প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুরিস আরবগণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য চিরপ্রসিদ্ধ ছিল। পরিচ্ছন্নতা এবং নির্ম্মলতা মুসলমান ধর্ম্মের অপরিহার্য্য অঙ্গ। অপবিত্র ও মলিন অবস্থায় কোনও মুসলমান ঈশ্বরের উপাসনা করিতে অধিকারী নহে। পাঠক! মনে রাখিবেন, মুসলমানগণ যখন স্পেনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল, ইউরোপের খ্রীষ্টানগণ তখন মলিনতা ও অপরিচ্ছন্নতার আদর্শস্থলছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন “শরীরে জল স্পর্শ না করা খ্রীষ্টানগণ বিশেষ গৌরবাত্মক বলিয়া মনে করিত।” পাদ্রিগণ চিরজীবন অস্নাত অবস্থায় যাপন করিবার জন্য চেষ্টা করিত। বিশেষ অনিবার্য্য কারণে কদাপি কখনও স্নান করিতে হইলে, তাহাদের অনুতাপের পরিসীমা থাকিত না! ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “জনৈক মঠাধ্যক্ষা সন্ন্যাসিনী তাঁহার ষষ্টি বৎসর বয়সে রাজকীয় ক্যাথলিক গির্জ্জায় খ্রীষ্টের ভোজে হস্তের অঙ্গুলীর অগ্রভাগ একবার মাত্র ধৌত করিয়াছিলেন; ইহা ব্যতীত তিনি সমস্ত জীবনে কদাপি শরীরের অপর কোনও অঙ্গ ধৌত করিয়াছিলেন না। এই বৃত্তান্ত তিনি অত্যন্ত গর্ব্বের সহিত লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছিলেন!” ফলতঃ শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের অনুশাসনও নহে। এই বিংশ শতাব্দীতে সমুন্নত খ্রীষ্টানগণও মলমূত্র ত্যাগ করিয়া জল ব্যবহারের আবশ্যকতা এখনও উপলব্ধি করিতে পারেন নাই। মুসলমান-অধিকৃত স্পেন, অসভ্য খ্রীষ্টান-হস্তে পতিত হইবার পরে ইংলণ্ডের রাজ্ঞী মেরীর স্বামী দ্বিতীয় ফিলিপের আদেশে স্পেনের যাবতীয় স্নানাগারগুলি ঐস্লামিক স্মৃতিচিহ্ন বলিয়া ধ্বংস করা হইয়াছিল!


  1. আরবী ওয়াদী আলকবির (বৃহৎ নদী) হইতে গোয়াডেল কুইভার শব্দের নিষ্পত্তি হইয়াছে।