স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/দ্বিতীয় অধ্যায়
জামে মসজেদ।
সৌধ কিরীটিনী নগরী-কুলরাণী কর্ডোভা-সুন্দরীর সৌন্দর্য্য ও গৌরবের সর্ব্বপ্রধান অলঙ্কার এবং নিদর্শন ছিল—ইহার অতুলনীয় জামে মস্জেদ। পাঠকদের মধ্যে যাঁহারা দিল্লীর জামে এবং পাণ্ডুয়ার আদিনা মস্জেদের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছেন, তাঁহারা জানিয়া রাখুন যে, কর্ডোভার জামে মস্জেদের বিশালতা, সৌন্দর্য্য, জাঁকজমক, কারুকার্য্যসমৃদ্ধি ও দৃঢ়তার তুলনায় দিল্লী, আদিনা, দামেস্ক বা বোগ্দাদের কোনও মস্জেদই তুলিত হইতে পারে না। ৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে সোলতান প্রথম আব্দর রহমান অশীতি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ব্যয়ে এই মস্জেদের পত্তন করেন। তৎপরে তাহার ধর্ম্মপ্রাণ পুত্র সোলতান হিশাম ‘নারবণ’ নগর ধ্বংস ও লুণ্ঠন করিয়া তাহার সমগ্র ঐশ্বর্য্যব্যয়ে ৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই মস্জেদের নির্ম্মাণকার্য্য সমাধা করেন। তাঁহার পরবর্তী প্রত্যেক সোলতানই এই বিরাট্ মন্দিরের আয়তন, সৌন্দর্য্য ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করেন। কেহ ইহার উদ্যান সুসজ্জিত এবং ফোয়ারার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন; কেহ ইহার প্রাচীরগুলি স্বর্ণমণ্ডিত এবং গম্বুজগুলি স্বর্ণ-কলস ও ছত্রে সুশোভিত করেন; কেহবা স্বর্ণাক্ষরে আল্কোরাণের প্রবচনাবলী অঙ্কিত করিয়া দেন; এবং কেহ কেহ ইহার আয়তন বৃদ্ধি করিয়া দেন। এই প্রকারে শতাব্দীর পর শতাব্দী এই বিরাট্ ব্রহ্ম-মন্দিরের গৌরব ও শ্রীবৃদ্ধি হইয়া ইহাকে অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় করিয়া তুলিয়াছিল। ৫০টী খিলান ও ১২৯৩টী মার্ব্বেল স্তম্ভের উপরে ইহার অভ্রভেদী গম্বুজমালা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইহার মেজেতে রৌপ্য গলাইয়া আস্তরণ করা হইয়াছিল। শুভ্র-রজত জমিনের উপরে লতাপর্ণ এবং মৌক্তিক পুষ্পদাম অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য বিকাশ করিত। মার্ব্বেল স্তম্ভগুলির গাত্রে রজত-কাঞ্চন-বিনির্ম্মিত মণি-মুক্তা-খচিত পুষ্প-পত্রময় স্বভাব রঞ্জন বল্লরী-দাম স্বগীয় সুষমা বিষ্ফুরিত করিত। স্তম্ভাবলীর শীর্ষদেশে গ্রীস এবং বাইজাণ্টাইনের ভাস্কর ও কারুগণ কর্ত্তৃক অপূর্ব্ব ভাবে লতাকুঞ্জ খোদাই করা হইয়াছিল। ছত্রিশ সহস্ৰ দ্বিরদ-দন্তে এবং উৎকৃষ্ট কাষ্ঠখণ্ডে অসংখ্য মণিমুক্তা এবং সুবর্ণ-নির্ম্মিত কীলকে মস্জেদের প্রকাণ্ড বেদী (মিম্বর) রচিত হইয়াছিল। চারিটী বৃহৎ ঝরণা দ্বারা দিবানিশি পর্ব্বত হইতে নির্ম্মল জলধারা এই মস্জেদের অসংখ্য জলপাত্র, চৌবাচ্চা এবং নালায় প্রবাহিত করা হইত। মস্দের পশ্চিম পার্শ্ব, অন্ধ আতুরদিগের অনাথাশ্রম এবং পান্থদিগের জন্য পান্থশালা নির্ম্মিত হইয়াছিল। পথিক এবং অনাথ আতুরগণ এখানে উপযুক্ত ভরণ পোষণ পাইত। উজ্জ্বল কাংস্য-নির্ম্মিত কারুকার্য্যময় নানা আকারের শত শত প্রদীপ ও ফানুস রাত্রিকালে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় মস্জেদের আশ্চর্য্য সুষমা ষোলকলায় প্রদীপ্ত করিয়া তুলিত। পবিত্র রমজান মাসে ৫০ পাউণ্ড ওজনের একটী মোমবাতি দিবারাত্র ধর্ম্মেপদেষ্টার পার্শ্বদেশে প্রজ্বলিত হইত। এতদ্ব্যতীত কাচনির্ম্মিত, স্বর্ণখচিত সুগন্ধি-তৈলের দশ সহস্র ঝাড়, দেওয়ালগিরি, ফানুস ও লণ্ঠন প্রজ্বলিত হইয়া ইহাকে আলোক-প্রাসাদে পরিণত করিত! তিন শত ভৃত্য, আম্বর-চন্দন জ্বালাইতে, উপাসকদিগকে আতর ও গোলাপ বিতরণ করিতে, প্রদীপ প্রজ্বালন এবং তৈল সুগন্ধ করিবার জন্য নিযুক্ত থাকিত। মস্জেদের রক্ত নীল সবুজ প্রস্তর-নির্ম্মিত প্রাচীরের বহির্ভাগের বিচিত্র কারুকার্য্য, লতা-পাতার অঙ্কন, জানালাগুলির সূক্ষ্ম ও মসৃণ জাফরীর কার্য্য এবং সুবিরাট্ একবিংশতিটী দ্বারের কাংস্যকপাট ইত্যাদি সমস্তই অতুলনীয় সুন্দর এবং মসৃণ ও সুদৃঢ় ছিল। ইহার বিশাল প্রাঙ্গণে কমলা, দ্রাক্ষা, মার্ব্বেল, সাইপ্রাস এবং নয়নমোহন কুসুমশোভিত তরুপুঞ্জে পূর্ণ ছিল। পূর্ণিমার বিমল জ্যোৎস্নায় ও তরুণ অরুণের রক্তিমরাগে এই মস্জেদ অতীব রমণীয় সৌন্দর্য্য ধারণ করিত। পর্য্যটকগণ এখনও এই সৌন্দর্য্য-নিলয় মহামন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া বিস্ময়-সমুদ্রে নিমগ্ন এবং কর্ডোভা সুন্দরীর গৌরবাত্মিকা স্মৃতি দ্বারা আকৰ্ষিত হইয়া স্পেনের সেই সৌন্দর্য্য-সূর্য্যের প্রদীপ্ত কিরণজালবিকীর্ণ দিব্য সম্পদময় মুরিসসভ্যতার বিচিত্রতা, অতুলনীয়তা এবং সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্ঘ্যের অতীত দৃশ্যে বিমুগ্ধ হইয়া আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়ে। হায়! স্পেন! তোমার সেই অতীত গৌরব ও সৌভাগ্য আর কখনও কি ফিরিবে?