স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/দশম পরিচ্ছেদ


দশম পরিচ্ছেদ।

আভ্যন্তরিক অবস্থা।

 ভারতবর্ষের আভ্যন্তরিক অবস্থা কিরূপ তাহা বলিবার নিমিত্ত কএকটী প্রসিদ্ধ পর্য্যটকের গ্রন্থ হইতে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করা যাইতেছে। ঐ পর্য্যটকেরা এই মহাদেশের নানা ভাগে পরিভ্রমণ করিয়া যাঁহার চক্ষে যাহা কিছু বিশেষ রূপে লাগিয়াছে, তাহাই সবিস্তার বর্ণন করিয়াছেন। গ্রন্থবাহুল্য ভয়ে তৎসমুদায় সংক্ষেপতঃ উল্লিখিত হইবে। একজন রুষীয় পর্য্যটক লিখিয়াছেন।—

 “ভারতবর্ষের প্রতি গ্রামই যেন একটী প্রজা তন্ত্র স্থান। গ্রামের যাবতীয় কার্য্য গ্রামের লোকেরাই স্বয়ং নির্ব্বাহ করে। রাজা অথবা রাজ প্রতিনিধি কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে হয় না। প্রতি গ্রামেই এক একটী দেবালয় আছে, সেই দেবালয়ের সন্নিহিত প্রাঙ্গণে গ্রামবাসী দিগের সভা হয়। গ্রামের প্রতিপল্লী হইতে ঐ সভায় এক একজন প্রতিনিধি উপস্থিত হন, পরে বিচার্য্য বিষয়ে বাদানুবাদ হইয়া যাহা অবধারিত হয়, সকলে তদনুযায়ীই কার্য্য করে। আমাদিগের রুষিয়াতেও ঐ প্রণালী প্রচলিত আছে। তবে আমাদের দেশে প্রতি গ্রামে কতকগুলি করিয়া লোক দাস্যে নিযুক্ত থাকে। ভারতবর্ষে সেরূপ নাই। আর একটী প্রভেদ এই— রুষিয়ার গ্রাম সকলের ভূমিতে প্রজাগণের সাধারণ স্বত্ব আছে, এখানে সেরূপ সাধারণ স্বত্ব নাই। এখানে গ্রামের প্রতি ভূমিখণ্ডে গ্রামিক বিশেষের অসাধারণ স্বত্ব আছে। কিন্তু রাজস্ব দান প্রতি ভূমিখণ্ডের জন্য পৃথক না হইয়া সাধারণতঃ গ্রামের জন্যই একবারে হইয়া থাকে। এক কালে গ্রীক দিগের মধ্যে যেমন এথিনীয়েরা প্রথমতঃ ব্যক্তিনিষ্ঠ অসাধারণ স্বত্বাধিকার বুঝিয়াছিল ভারতবর্ষীয় দিগের মধ্যেও এক্ষণে সেইরূপ স্বত্বাধিকার প্রচলিত আছে, কিন্তু যেমন রোমীয়দিগের কর্ত্তৃক বিজিত হইবার পূর্ব্বে স্পার্টার লোকেরা সেরূপ স্বত্বের অধিকারী হইতে পারে নাই, এক্ষণে রুষীয়েরাও সেইরূপ আছেন। রুসিয়ার গ্রামিক দিগের অধিকার স্পার্টার ন্যায়, ভারতবর্ষে এথিনীয় দিগের ন্যায়, কিন্তু কয়েকটী বিষয়ে সাধারণ স্বত্বের চিহ্ণ এখানেও বিদ্যমান আছে। গ্রাম রক্ষক, নাপিত, গ্রাম্য যাজক এবং গুরু মহাশয় এই কয়েক ব্যক্তি গ্রামিক ভূমির সাধারণ স্বত্বের এক এক অংশের অধিকারী। এদেশে ঐ সকল ভূমির নাম চাকরাণ, দেবোত্তর এবং মহোত্তর ইত্যাদি।

 “প্রতি গ্রামে যেমন এক একটী দেবালয় আছে, তেমনি এক একটী ব্যায়াম শিক্ষার স্থান এবং বিদ্যালয়ও আছে। ছেলে পাঁচ বৎসরের হইলেই বিদ্যালয়ে যায়, এবং ৮ বৎসরের হইলেই ব্যয়াম-শিক্ষা আরম্ভ করে। ওরূপ করতে হইবে বলিয়া যে কোন রাজনিয়ম আছে এমত নহে, কিন্তু ব্যবহারই এইরূপ। ধান্য ভূমি? সেখানকার লোক সকল স্বতঃই সৎকার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, আইনের বলের অপেক্ষা করে না।”

 একজন জর্ম্মণ পর্য্যটক লিখিয়াছেন, “আমি এদেশে (ভারতবর্ষে) আসিয়া একটী প্রধান তথ্য শিখিলাম। ইউরোপ খণ্ডের সর্ব্বত্র দেখিয়া এবং ইউরোপীয় ইতিবৃত্তের পর্য্যালোচনা করিয়া আমার সংস্কার হইয়া গিয়াছিল যে, মনুষ্যদিগের অন্তঃকরণে অপর সকল বৃত্তি অপেক্ষা স্বার্থপরতা বৃত্তিই অধিকতর প্রবল। কিন্তু দেশের জন্ম বাতাসের গুণেই হউক, আর মিতাহার গুণেই হউক, আর পুরুষানুক্রমিক শিক্ষার প্রভাবেই হউক, ভারতবর্ষীয় দিগের অন্তঃকরণে স্বার্থপরতা তেমন প্রবল বলিয়া বোধ হয় না। আমরা নিজস্ব রক্ষা করিবার জন্য সর্ব্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকি, নিরন্তর স্বত্বাধিকার লইয়াই বিবাদ করি, যাহা আপনার বলিয়া বোধ করিয়াছি, তাহ কোন মতেই ছাড়িয়া দিতে পারি না— কিন্তু এদেশীয় দিগের প্রকৃতি অন্যরূপ। ইহাদিগের মধ্যে আত্মপর বোধ অল্প—ঔদার্য্য গুণ অধিক।

 “তাহার দৃষ্টান্ত দেখ, এখানকার ভূম্যধিকারিগণ কদাপি স্ব স্ব অধীন গ্রামিকগণের স্বত্ব লোপ করিয়া আপনাদিগের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন না— পক্ষান্তরে গ্রামিকেরা ও ভূম্যধিকারীদিগের প্রতি চিরসন্দিগ্ধ চিত্তের ন্যায় ব্যবহার করে না। ইউরোপ খণ্ডে ঐ ব্যাপার লইয়া কত তুমুল বিবাদ হইয়া গিয়াছে। জর্ম্মণির মধ্যে সেই বিবাদ অদ্যাপি চলিতেছে। ভারতবর্ষে তাহার নাম গন্ধও নাই। এখানকার ভূম্যধিকারিগণের প্রধান কার্য্য (১ম) গ্রামিকদিগের স্থানে রাজস্ব আদায় করা (২য়) গ্রামিকেরা শান্তিভঙ্গাদি দোষের কিরূপ বিচার করে, তাহার তত্ত্বাবধান করা, (৩য়) আপনাপন অধিকারের মধ্যে রাস্তা, ঘাট, জলাশয়, বিপণি এবং দেবালয়াদির রক্ষণ এবং নূতন নির্ম্মাণ করা, (৪র্থ) আপনাপন আবাস স্থানে অথবা তাদৃশ সমৃদ্ধ নগরে একটী চতুষ্পাঠী সংস্থাপন, তাহার বৃত্তি নিৰ্দ্ধারণ এবং উৎকর্ষ সাধন করা।

 “সম্প্রতি ভূম্যধিকারিগণ আর একটী কার্য্যের সূত্রপাত করিতেছেন। তাঁহারা অনেকে মিলিয়া ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্ম্মে আবেদন করিয়াছিলেন যে, ২০ বর্ষ হইতে ৪০শ বর্ষ বয়স্ক যাবতীয় গ্রামবাসী প্রজাকে মাসের চারি দিন সম্মিলিত হইয়া যুদ্ধ বিদ্যা অভ্যাস করিতে হইবে, এইরূপ ব্যবস্থা প্রণীত হয়। যদিও ব্যবস্থা প্রণীত হয় নাই, কিন্তু ইচ্ছাতঃ সকলেই তাহার অনুষ্ঠান করিতে পারেন, সম্রাট্‌ এই অভিপ্রায় করিয়াছেন। তাহাতে অনেকেই তাহার পূর্ব্বানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছে। গত ৫০।৬০ বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষীয়দিগের আভ্যন্তরিক পরিবর্ত্ত যে কিরূপ হইয়াছে তাহার একটী দৃষ্টান্ত এই। পূর্ব্বে ভারতবর্ষে জাতিভেদের বড়ই আঁটা আঁটি ছিল। এক্ষণে তাহা অনেক কম হইয়াছে।

 “সেদিন একজন ক্ষত্রিয় ভূম্যধিকারীর গৃহে অতিথি হইলে তিনি স্বচ্ছন্দে আমার সহিত একত্রে বসিয়া আহার করিলেন। তাঁহাদিগের পূর্ব্ব ব্যবহার এরূপ ছিল না, এক্ষণে এরূপ হইয়াছে দেখিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিলে তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, ভারতবর্ষের জাতিভেদ প্রথার একটী প্রাকৃতিক মূল আছে; উহা নিতান্ত কৃত্রিম বস্তু নহে, এইজন্য উহা অদ্যপি চলিতেছে, আরও কিছুকাল চলিবে। তদ্ভিন্ন তখন অমাদিগের যে দশা, তাহাতে জাতিভেদের বিশেষ আঁটা আঁটি রক্ষা করিবার প্রয়োজন ছিল। তখন আমাদিগের দেশ স্বাধীন ছিল না, ধর্ম্ম বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছিল। সাহিত্য শাস্ত্রেরও উন্নতি হয় নাই। আমাদিগের জাতিত্বই বিনাশ দশায় পতিত হইয়া যাইতেছিল। সে সময়ে যদি বিশেষ যত্ন করিয়া আপনাদিগের প্রাচীন সামাজিক প্রণালী সমুদায় রক্ষা না করিতাম, তবে এতদিন আমরা বিলুপ্ত হইয়া যাইতাম, এখন আমাদিগের দেশ স্বাধীন—ধর্ম্ম সজীব—সাহিত্য পুনরুজ্জীবিত হইয়া জাতিত্ব রক্ষা করিতেছে। এখন আর কেহ আমাদিগকে আত্মসাৎ করিতে পারে না, প্রত্যুত আমরাই অন্যকে অন্তর্নিবিষ্ট করিতে পারি। আমরা পূর্ব্বে যে ভয়ে জড়ীভূত হইয়াছিলাম, এখন আমাদিগের আর সে ভয় নাই। ঐ ব্যক্তি কিছুকাল পারীস নগরে গিয়া বাস করিয়া আসিয়াছেন। ইঁহার শিক্ষা বারাণসীর চতুষ্পাঠীতে হইয়াছিল। “ভারতবর্ষের অধিংশ ভূম্যধিকারীই এই প্রকৃতির লোক।” একজন ইংলণ্ডীয় পর্য্যটক লিখিয়াছেন—

 “এখন সকলেই এদেশে ভ্রমণ করিতে আইসে, কিন্তু এখানে যে এমন কি অপূর্ব্ব পদার্থই দেখিতে পায় বলিতে পারি না। সত্য বটে, এখানকার নগরগুলি যেমন সমৃদ্ধিশালী তেমন আর কুত্রাপি নাই। পারীস, রোম, মেড্রিড, বর্লিন, প্রভৃতি ইউরোপের প্রথম শ্রেণীর নগরগুলি এখানকার লক্ষ্ণৌ, প্রয়াগ, অযোধ্যা, লাহোর প্রভৃতির তুল্য নয় বটে, আলহাম্ব্রা‌, কোলিসিয়ম, পার্থিনন্‌, থীব্‌স এবং পালমাইরার প্রধ্বস্তাবশেষ এখানকার ফতেপুর সিক্রি, ইলাবরা, হস্তীদ্বীপ এবং মহাবলিপুরের নিকট লজ্জা পায় বটে, পারীস লিডেন, গটিঞ্জেন, প্রভৃতির বিশ্ববিদ্যালয় এখানকার কনোজ, কাশী, কাঞ্চী, মথুরা প্রভৃতির চতুষ্পাঠীর সহিত তুলনায় প্রাথমিক পাঠশালার ন্যায় বোধ হয় বটে, কিন্তু এসকল হইলে কি হয়? এখানকার লোকেরা স্বাধীন নহে। ইহাঁদিগের রাজা যথেচ্ছাচারী। ইহাঁদিগের মধ্যে আমাদিগের মত পার্লিয়ামেণ্ট সভা নাই। বিশেষতঃ এখানকার খাদ্য সামগ্রী কিছুই ভাল নয়। ভারতবর্ষীয় খাদ্য ফলের মধ্যে একমাত্র নিচুই আমাদিগের স্বদেশীয় ফলের আস্বাদ ধারণ করে। তদ্ভিন্ন ভারতবর্ষীয় স্ত্রী লোকেরা নিতান্তই সৌন্দর্য্য বিহীনা। উহাদিগের বর্ণ ধবল নহে, চুল রাঙ্গা কিম্বা কটা নহে, চক্ষুও কটা নহে, ললাট ফলক উচ্চ নহে। আর যদিও ইহারা একান্ত পতিপরায়ণা তথাপি সততই লজ্জাশীলা এবং বিনয়াবনতমুখী। ইহাদিগের এখনও প্রকৃত স্বাধীন ভাব জন্মে নাই। এখানকার বিধবারা প্রায়ই বিবাহ করে না। কোথাও কোথাও দুই একজন স্বামীর অনুমৃতাও হয়।

 “পূর্ব্বে ভারতবর্ষীয়েরা স্ত্রীলোকদিগকে গৃহের বাহিরে যাইতে দিত না। এক্ষণে তাহা অল্প পরিমাণে দিতে আরম্ভ করিয়াছে, অতএব বড় বড় ঘরওয়ানা অনেক স্ত্রীলোককে আমি দেখিতে পাইয়াছি। সে দিন একজন প্রদেশাধিকারীর ভবনে একটী নাট্যাভিনয় হইয়াছিল, তাহাতে নিমন্ত্রিত হইয়া গিয়াছিলাম। ঐ প্রদেশাধিকারীর পিতা মুসলমান ছিলেন—ইনি কি হইয়াছেন জানিতে পারি নাই। মুসলমানেরা কখনই স্ত্রীলোকদিগকে ঘরের বাহিরে আনিত না। ইনি সস্ত্রীক হইয়া সভাস্থলে বসিয়াছিলেন। আরও অনেকে সপরিবার সভাস্থলে আসিয়াছিলেন। এইরূপ পরিবর্ত্তের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে একজন আমাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘দেখুন স্ত্রীলোকেরা স্বভাবতঃই পুরুষদিগের অপেক্ষা দুর্ব্বলা অতএব পুরুষ কর্ত্তৃক অবশ্যই পরিরক্ষণীয়া হইবেন। যদি দুর্ভাগ্যবশতঃ কোন দেশের পুরুষেরাই আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইয়া পড়ে, তবে তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে গৃহ মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া আর কিরূপে রক্ষা করিবে; অতএব স্ত্রী নিরোধটী শুদ্ধ পরাধীনাবস্থার ফল। পরাধীনতা মোচন হইলেই স্ত্রী নিরোধও রহিত হইয়া যায়। হিন্দুরাও পূর্ব্বে স্ত্রীলোকদিগকে গৃহপিঞ্জর নিরুদ্ধ করিয়া রাখিতেন না। মুসলমানদিগের অধীন হইয়া পড়িলে তাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে গৃহে বদ্ধ করেন। মুসলমানেরাও চিরকাল যথেচ্ছাচারী রাজার অধীন, এবং বিশেষতঃ বহু বিবাহ পরায়ণ, এই জন্য তাঁহারাও স্ত্রী নিরোধে বাধ্য ছিলেন। এখন ভারতবর্ষীয়েরা পরাধীন নহেন। এইজন্য স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বের ন্যায় নিরোধও নাই। যত দিন কোন দেশের শান্তিরক্ষা এবং ধর্ম্মাধিকরণের ভার কি বিজাতীয় কি যথেচ্ছাচারী ব্যক্তিদিগের হস্তে থাকে, ততদিন সে দেশে স্ত্রীলোকদিগের সভারোহণ অথবা যথেচ্ছ বহির্গমন প্রচলিত হইতে পারে না। উল্লিখিত যুক্তি কতদূর যথার্থ, তাহার বিচার করিয়া কি ফল? পূর্ব্বে ইহারা বহু বিবাহ করিত, বোধ হয়, এখনও কতক করে, তবে অনেক কম হইয়া থাকিবে। এ বিষয়ে কোন রাজব্যবস্থা নাই।”

 একজন মার্কিন মিসনরী তাঁহার কোন বন্ধুকে ভারতবর্ষ হইতে যে পত্র লিখেন, তাহার কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইল।

 “ভারতবর্ষীয়দিগের মধ্যে খৃষ্ট ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসিয়া যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে নিতান্ত হতাশ হইতে হইয়াছে। ইহাদিগের ধর্ম্মোপদেষ্টৃ ব্রাহ্মণদিগের তুলনায় আমরা নিতান্ত অবিদ্য, অপবিত্র এবং অকর্ম্মণ্য লোক। ইহারা আমাদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রেও বিলক্ষণ ব্যুৎপন্ন। সুতরাং উহাদিগের ধর্ম্মের কোন ভাগ অযৌক্তিক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে গেলেই উহারা আমাদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রে তাদৃশ অযৌক্তিকতা দেখাইয়া দেয়, এবং এই কথা বলে, যদি ভক্তি মূল করিয়া আপনাদিগের শাস্ত্রের অযৌক্তিক কথায় বিশ্বাস করা যায়, তবে আমাদিগের শাস্ত্রের আপাততঃ প্রতীয়মান অযৌক্তিকতা কিজন্য ভক্তি মূলে বিশ্বসিত না হইবে? এরূপ বিচারে জয় লাভের সম্ভাবনা নাই। বিচারে ত এইরূপ। কার্য্যে ইহাদিগের যত্ন, অধ্যবসায় এবং স্বার্থশূন্যতা জেসুটদিগের অপেক্ষাও অনেক অধিক। ভারতবর্ষের প্রান্তভাগে যে সকল অসভ্য বন্যজাতীয় লোক থাকে, ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগের মধ্যে গিয়া বাস করিতেছে, এবং ক্রমে ক্রমে তাহাদিগকে শান্ত, ত্যাগী এবং নম্র স্বভাব করিয়া তুলিতেছে। একটী উদাহরণ দিতেছি। ভারত সাম্রাজ্যের উত্তর-পূর্ব্ব প্রান্ত সীমায় আসাম নামে একটী প্রদেশ আছে। সেই প্রদেশে প্রকৃত ভারতবর্ষীয় ভিন্ন অপর কতকগুলি বন্য জাতীয় লোক বাস করে, তাহাদিগের নাম মিকি, আবর, গারো, নাগা, মিস্‌মি প্রভৃতি। আমি ঐ প্রদেশে গমন করিয়া দেখি, ঐ সকল জাতীয়দিগের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা পর্ণকুটীর নির্ম্মাণ করিয়া আছেন, এবং নিরন্তর অকৃত্রিম ব্যবহার দ্বারা তাহাদিগের বিলক্ষণ প্রীতিভাজন হইতেছেন। আমি তাঁহাদিগের মধ্যে একজন বৃদ্ধ ঋষির কুটীরে অতিথি হইয়া তাঁহার কার্য্য দর্শন করিলাম। তন্মধ্যে বিশেষ বর্ণনীয় ব্যাপার এই।—তিনি আপন প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া বন্যদিগের গ্রাম মধ্যে গমন করেন, এবং উহাদিগের ক্ষেত্রাদির কর্ষণ কিরূপ হইয়াছে, স্বচক্ষে দেখিয়া যে ক্ষেত্রে যে বীজ বপন করিতে হইবে, তাহা বলিয়া দেন। অনন্তর যদি কাহারও কোন পীড়া হইয়া থাকে, তাহার চিকিৎসা করেন—পরে স্থূল স্থূল কথায় পরস্পরের মুখাপেক্ষিতা এবং পরিণাম দর্শিতার শিক্ষা দেন। কোন কোন বন্য ব্যক্তি প্রার্থনা করে, ঠাকুর আমাদিগকে মন্ত্র দান করিয়া উচ্চ জাতীয় করুন। এরূপ প্রার্থনা নিরন্তরই হইয়া থাকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ অমন সকল স্থলে জলসংস্কারাদি কোন বিধান দ্বারা কাহাকেও উচ্চ জাতীয় করেন না। তিনি বলেন যে, নীচ এবং অপকৃষ্টধর্ম্মক বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া কেহ মনে করিলেই উচ্চজাতীয় হইতে পারে না—তপস্যা করিতে হয়। এই বলিয়া বিশেষ বিশেষ তপশ্চরণ করিবার আদেশ দেন। কাহাকেও বলেন, তুমি বৎসরাবধি এই এই দ্রব্য খাইও না—কাহাকেও বলেন, তুমি যাহা কিছু উপার্জ্জন করিবে তাহার সিকি বা অৰ্দ্ধেক অন্যকে দান করিবে; কাহাকেও বলেন তুমি প্রত্যহ একজন অতিথির সেবা করিয়া তবে স্বয়ং অন্ন গ্রহণ করিবে। এইরূপ নানাবিধ উপায়ের দ্বারা ঐ সকল লোককে ইন্দ্রিয় সংযমন, লোভ সংবরণ, পরোক্ষদর্শন প্রভৃতি পুণ্য সম্পন্ন করা হয়। অনন্তর যে ব্যক্তি ঐ সকল আদেশ পালনপূর্ব্বক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাহাকে মন্ত্র দান করিয়া বলা হয়,—“এক্ষণে তোমার ম্লেচ্ছত্ব গেল। তোমার দেয় পানীয় জলাদি আমার গ্রাহ্য হইল, এবং তোমার প্রদত্ত সামগ্রীতেও দেব পূজা করা যাইতে পারে। এক্ষণ অবধি যদি ঐ মন্ত্রজপ সহকারে এক বৎসর এই এই নিয়ম পালন কর, তবে তোমাকে আরও উন্নত জাতির মধ্যে লওয়া যাইতে পারিবে।” ব্রাহ্মণেরা পূর্ব্বকালে ভারতবর্ষের সর্ব্ব স্থানে এইরূপ করিয়া ছিলেন। সম্প্রতি প্রত্যন্ত প্রদেশগুলিতেও ঐ প্রণালীর অনুসারে কার্য্য করিতেছেন। ব্রাহ্মণ ঠাকুরের স্থানে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বন্যেরা সংস্কৃত হইয়া প্রথমে কোচ নাম প্রাপ্ত হয়, অনন্তর পুনঃ সংস্কৃত হইলে তাহারা কলিতা নাম ধারণ করে, তৎপরে পুনর্ব্বার সংস্কার লাভ করিলে সৎশূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। কখন ব্রাহ্মণ হইতে পারে কি না জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, ‘প্রায়ই এক জন্মে পারে না, পরজন্মে পারে।’ ‘পর-জন্মে পারা আর না পারা তুল্য কথা, কাহার পরজন্ম কি হইল, তাহা ত কেহ জানিতে পারে না’ এই কথা বলাতে ব্রাহ্মণ ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, ‘পুত্ররূপেই মনুষ্যের পর জন্ম হয়। অতি অন্ত্যজও ক্রমে ক্রমে সংস্কারপূত হইয়া সৎশূদ্রত্ব প্রাপ্ত হইতে পারে। অনন্তর তাহার পুত্র তাদৃশ বিদ্যা, বুদ্ধি জ্ঞান সম্পন্ন হইলে ব্রাহ্মণত্বেরও অধিকারী হয়। ভারতবর্ষীয়দিগের সংস্কার প্রণালী এইরূপ। আর একটী চমৎকারের বিষয় এই, ব্রাহ্মণেরা স্বেচ্ছাতঃ এই দুরূহ ক্লেশকর কার্য্যে প্রবৃত্ত। কোথাও কোথাও ভূম্যধিকারীরাও তাঁহাদিগকে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত করেন। কিন্তু অধিক স্থলে ব্রাহ্মণেরা স্বয়ং উদ্যোগী হইয়াই আপনাদিগের ধর্ম্ম বিস্তার করিতেছেন।”

* * * * *

 নিশান্ধকার অপগত, পূর্ব্বাকাশ দীপ্যমান। আমি আর মর্ত্ত্য ভূমিতে অবস্থিতি করিতে পারি না। কিন্তু পাঠকের ভ্রম নিবারণার্থ সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দিয়া যাই। কাল পুরুষ, সূর্য্য ও চন্দ্ররশ্মি দ্বারা পৃথিবী পৃষ্ঠে যে ইতিবৃত্ত লিখিয়া যান, তাঁহার অনুগামিনী স্মৃতি দেবী তাহার কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ আবৃত্তি করিতে চেষ্টা করেন। আমি ঐ দেবীর ক্রীড়াসখী। ঐ ইতিবৃত্ত আবৃত্তি করিতে সখীর কষ্ট হইতেছে বুঝিতে পারিলেই পাঠ ভুলাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া থাকি। সকল সময়ে পারি না, রাত্রিকালে স্বপ্নাবস্থায় প্রায়ই কৃতকার্য্য হই।

 আমার নাম আশা। ঊষা আমার ভগিনী, আমি ঊষাসহ মিলিত হইতে চলিলাম।

সমাপ্ত।