স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/প্রথম পরিচ্ছেদ
তখন মহারাষ্ট্রীয় সেনাপতির চৈতন্য হইল। তিনি বুঝিলেন যে, জাতিভেদে যেমন অন্যান্য বিষয়ের প্রভেদ হয়, তেমনি যুদ্ধ প্রণালীও ভিন্ন হইয়া থাকে। যে যাহার আপনার অভ্যস্ত প্রণালী অবলম্বন করিয়াই বিজয়ী হইতে পারে, তাহার অন্যথা করিলে পরাজিত হয়। যেমন চকিতের ন্যায় এই ভাব তাঁহার মন মধ্যে উদিত হইল, অমনি তিনি সেনানায়কগণকে সম্মুখ সংগ্রাম হইতে অপসৃত হইয়া শত্রুর পার্শ্ব ভাগ আক্রমণ করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। মহারাষ্ট্ৰীয়েরা তাঁহার অনুজ্ঞার সমগ্র তাৎপর্য্যই বুঝিল, ক্ষণমাত্রে আপনাদিগের ব্যূহের রূপান্তর করিল, এবং দেখিতে দেখিতে সেই প্রভূত সেনারাশি অৰ্দ্ধচন্দ্রের আকার হইয়া দাঁড়াইল। আহম্মদ সাহের পরাক্রান্ত অশ্বারোহি-দল সবেগে আসিতেছিল। কাহার সাধ্য যে সেই বেগ সহ্য করে? নদী স্রোতের অভিমুখে কোন্ প্রতিবন্ধক স্থির হইয়া দাঁড়ায়। এক পাষাণময় পর্ব্বত খণ্ড দাঁড়াইতে পারে, আর লঘু বালুকাস্তূপ যদিও স্থির হইয়া না দাঁড়ায়, তথাপি ক্রমে ক্রমে সমুদয় স্রোতোজল শোষণ করিয়া লইতে পারে। মহারাষ্ট্রীয়গণ প্রথমে মনে করিয়াছিল, অচলের ন্যায় হইয়া দাঁড়াইবে, এবং ঐ আক্রমণ বেগ সহ্য করিবে কিন্তু দৈবানুকূলতাবশতঃ তাহারা সে চেষ্টায় বিরত হইল। তাহারা বিশুষ্ক বালুকারাশির প্রকৃতি অবলম্বন করিয়া প্রবল স্রোতোমুখ হইতে সরিয়া যাইতে লাগিল, এবং তাহার উভয় পার্শ্ব ঘেরিয়া শোষণ করিতে আরম্ভ করিল। নদীর জল ক্রমে ন্যূন বেগ, ক্রমে হ্রস্ব, অনন্তর সমুদায়ই বালুকা মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
আহাম্মদ সাহ এই ভয়ানক ব্যাপার অবলোকন করিলেন। মনে করিলেন, আর স্বদেশে ফিরিয়া যাইবেন না; সংগ্রামে প্রাণ পরিত্যাগ করিবেন। এই ভাবিয়া তিনি আপন সহচর দুরানিদিগকে এবং স্বপক্ষ রোহিলাদিগকে, আর অযোধ্যার সৈন্যগণকে একত্রিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এমত সময়ে নবাব সুজাউদ্দৌলার অনুগৃহীত কাশীরাজ নামক একজন হিন্দু রাজা তাঁহার সমীপাগত হইয়া যথাবিধি নমস্কারপূর্ব্বক বলিলেন, “মহারাজ! আমি মহারাষ্ট্রীয়দিগের বন্দী হইয়া এক্ষণে তাহাদিগের দৌত্য কর্ম্মে আপনার নিকট আসিয়াছি। অনুমতি হইলে তাঁহাদিগের বক্তব্য নিবেদন করি।” “বল”।
“সাহেবুদ্দিন মহম্মদ ঘোরি প্রথমে ভারতবর্ষ আক্রমণ করিতে আসিয়া চোহান বংশাবতংস মহারাজ পৃথ্বীরাও কর্ত্তৃক বন্দীকৃত হইয়াছিলেন। পৃথ্বীরাও অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাকে ছাড়িয়া দেন। কিন্তু পরবর্ষে স্বয়ং বন্দীকৃত হইলে সাহেবুদ্দীন কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। পূর্ব্বে হিন্দুরা মুসলমানদিগের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিয়াছেন, এবং মুসলমানেরাও হিন্দুদিগের প্রতি কেমন আচরণ করিয়াছেন, তাহা ঐ বিবরণেই প্রকাশিত হইতেছে। কিন্তু ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া যদিও বরাবর অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তথাপি হিন্দুদিগের জাতীয় প্রকৃতির অন্যথাচরণ হইতে পারে না। হিন্দুরা পূর্ব্বের ন্যায় এক্ষণেও সদয় আচরণ করিতে প্রস্তুত। আপনি নিজ দলবল সহিত নির্ব্বিঘ্নে স্বদেশে গমন করুন। ভারতবর্ষ নিবাসী যদি কোন মুসলমান আপনার সমভিব্যাহারে যাইতে ইচ্ছা করেন, তাহাতেও কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। তবে তাদৃশ মুসলমানের পক্ষে পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত এ দেশে প্রত্যাগমন নিষিদ্ধ।” দূত এই পর্য্যন্ত বলিয়া স্বল্পক্ষণ নীরব থাকিয়া পুনর্ব্বার কহিল।—
“মহারাষ্ট্র সেনাপতি আরও একটী কথা বলিয়াছেন। এক্ষণে আপনি সসৈন্যে তাঁহার অতিথি। অতএব সিন্ধু পরপারে আপনার নিজ রাজ্যে যাইতে যে কয়েক দিন লাগিবে, আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিবেন। আপনার ঐ কয়েক দিনের ব্যয় তিনি নিজ কোষ হইতে নির্ব্বাহ করিবার অনুমতি প্রার্থনা করেন।”
দূত এই পর্য্যন্ত বলিয়া নীরব হইলে আহম্মদ সাহা ক্ষণকাল মৌনভাবে চিন্তা করিয়া পরে কহিলেন, “দূত! তুমি মহারাষ্ট্র সেনাপতিকে গিয়া বল, আমি তাঁহার উদার ব্যবহারে একান্ত মুগ্ধ হইলাম—আর কখন ভারতবর্ষ আক্রমণে উদ্যম করিব না।” এই কথা শুনিয়া দূত অভিবাদন পূর্ব্বক কহিল, “মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য্য। আমার প্রতি আর একটী কথা বলিবার আদেশ আছে। এদেশীয় যে সকল মুসলমান নবাব, সুবাদার, জমিদার, জায়গীরদার, প্রভৃতি আপনার সমভিব্যাহারী না হইবেন, তাঁহারা অবিলম্বে যে যাহার আপনাপন অধিকার এবং আবাসে প্রতিগমন করুন। মহারাষ্ট্রীয় সেনাপতি বলিয়াছেন, ‘ঐ সকল লোকের পূর্ব্বকৃত সমস্ত অপরাধ মার্জ্জনা হইল’।” দূতের এই কথা শেষ হইবামাত্র অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা, রোহিলখণ্ডের জায়গীরদার নজিবউদ্দৌলা, হায়দরাবাদের নিজাম সলাবতজঙ্গের সেনাপতি ও ভ্রাতা নিজাম আলি ইহাঁরা পরস্পর মুখাবলোকন পূর্ব্বক কহিলেন, “সেনাপতি মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া স্ব স্ব অধিকারে গমন করিতে হইলে আমাদিগের যৎপরোনাস্তি মনোভঙ্গ হইবে।” দূত সকলের নিকট প্রণত হইয়া বলিল, “তবে আপনারা দিল্লীনগরে গমন করুন, সেই স্থানে সাক্ষাৎ হইবে— আমার প্রতি এইরূপ বলিবারও অনুমতি আছে।”