স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
প্রাচীন দিল্লির মধ্যে যে স্থানের নাম ইন্দ্রাপৎ (ইন্দ্রপ্রস্থ) তাহার অনতিদূরে একটি সভামণ্ডপের মধ্যভাগে পৃথ্বীরাওয়ের আয়সস্তম্ভ নিখাত ছিল। পূর্বে পৃথ্বীরাওয়ের প্রার্থনাক্রমে যজ্ঞবিদ্ ব্রাহ্মণেরা ঐ শুভ স্তম্ভ নিখাত করিয়া বলিয়াছিলেন যে, ইহা বাসুকীর শিরোদেশ স্পর্শ করিল—ইহার উপর যে সিংহাসন অধিষ্ঠিত হইবে, তাহা চিরকাল অচল থাকিবে। আজি আর সেই স্তম্ভ দৃষ্ট হইতেছে না, ভূমি-মধ্যে আরও বসিয়া গিয়াছে, এবং তদুপরি একট অত্যুচ্চ দিব্য সিংহাসন প্রতিষ্ঠাপিত রহিয়াছে। সভামণ্ডপের যে অকাল জীর্ণ প্রাচীর ছিল তাহাও আর সেরূপ নাই, সমস্ত নবীকৃত হইয়াছে। ভারতবর্ষের যাবতীয় রাজা, নবাব, সুবাদার প্রভৃতি সকলে ঐ সভামণ্ডপে আপনাপন যোগ্যস্থানে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। সভার কি শোভা! রাজাধিরাজ যুধিষ্ঠিরের ময়দানববিনির্ম্মিত সভাগৃহ ইন্দ্রের সভা অপেক্ষাও উজ্জ্বল এবং মনোহর বলিয়া বর্ণিত। এই স্থানেই সেই সভাগৃহ ছিল—তাহাই কি এতদিন কাল তরঙ্গে মগ্ন থাকিয়া পুনর্ব্বার ভাসিয়া উঠিয়াছে! সভামণ্ডপের মধ্য ভাগে যে সিংহাসন স্থাপিত হইয়াছে, তাহার দুই দিকে দুইটী সোপান-শ্রেণী। সর্ব্ব নিম্ন-সোপানে এক জন গম্ভীর প্রকৃতি মধ্য-বয়স্ক পুরুষ দণ্ডায়মান হইয়া বলিতেছেন—
“আমাদিগের এই জন্মভূমি চিরকাল অন্তর্বিবাদানলে দগ্ধ হইয়া আসিতেছিল, আজি সেই বিবাদানল নির্ব্বাপিত হইবে। আজি ভারতভূমির মাতৃ-ভক্তি-পরায়ণ পুত্রেরা সকলে মিলিত হইয়া ইহাকে শান্তিজলে অভিষিক্ত করিবেন।
“ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দিগেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইহাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইহাঁর পর নহেন, ইনি উহাঁদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া অসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইহাঁর পালিত সন্তান।
“এক মাতারই একটী গর্ভজাত ও অপরটী স্তন্যপালিত দুইটী সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়—সকলের শাস্ত্র মতেই হয়। অতএব ভারতবর্ষ নিবাসী হিন্দু এবং মুসলমান দিগের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ জন্মিয়াছে। বিবাদ করিলে সেই সম্বন্ধের উচ্ছেদ করা হয়। আর আমাদিগের মধ্যে কি পূর্ব্বের মত বিবাদ চলিবে? আমরা কি চিরকালই জ্ঞাতিবিরোধে আপনাদিগকে সর্ব্বস্বান্ত এবং অপরের উদরপূরণ করিব? (এই পর্য্যন্ত বলা হইলেই সভ্য হইতে “না না”—“না না” “না না”—এই ধ্বনি উঠিল) কি অমৃতধারাই আমার কর্ণে বর্ষণ হইল—! আমার কর্ণে?—আমি কে?— ভারতভূমির কর্ণে—ঐ মৃত্যু সঞ্জীবনী মন্ত্র প্রবেশ করিল। দেখ—তাঁহার চক্ষু উন্মিলিত হইল—মুখমণ্ডলে হাস্যপ্রভা দেখা দিল—তিনি মৃত্যুশয্যা হইতে উঠিলেন—এবং পূর্ব্বের ন্যায় প্রভাময়ী হইলেন।
“এক্ষণে সকলকে সম্মিলিত হইয়া মাতৃদেবীর সেবার ভার গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু সকলের কর্ত্তা এক জন না থাকিলেও সম্মিলন হয় না। কোন্ ব্যক্তি আমাদিগের সকলের অধিনায়ক হইবেন। দৈবানুকূলতায় এ বিষয়েও আর বিচার করিবার স্থল নাই। রাজাধিরাজ রামচন্দ্রের নিমিত্ত এই যে সিংহাসন প্রস্তুত হইয়াছে, তাহার ভিত্তিমূল পৃথিবী ভেদ করিয়া বাসুকির শীর্ষদেশ সংলগ্ন হইয়াছে, পৃথিবী টলিলেও আর ইহা টলিবে না—আর ঐ দেখ, মহামতি সাহ আলম বাদসাহ স্বেচ্ছাতঃ রাজা রামচন্দ্রকে আপন শিরোভূষণ-মুকুট প্রদান করিয়া তাঁহার হস্তে সাম্রাজ্য পালনের ভার সমর্পণ করিবার নিমিত্ত আসিতেছেন।”
সভামণ্ডপের দক্ষিণ এবং উত্তর প্রান্তবর্ত্তী দুইটী প্রশস্ত পটমণ্ডপ হইতে একেবারে দুইটী ভেরীরব বিশ্রুত হইল—দক্ষিণদিক্ হইতে একজন গৌরকান্তি, দীর্ঘচ্ছন্দ, ম্লানবদন মধ্য বয়স্ক পুরুষ সভামণ্ডপে প্রবিষ্ট হইয়া কিঞ্চিৎ সত্বর-পদে সিংহাসন সমীপে উপনীত হইলেন, এবং পূর্ব্বোক্ত বক্তার হস্তাবলম্বন পূর্ব্বক এক এক পা করিয়া সিংহাসনের সর্ব্বোচ্চ ভাগে উঠিতে লাগিলেন। তিনি যে সময়ে উঠিতেছিলেন, তৎকালে উত্তর দিকস্থ পটমণ্ডপ হইতে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মধ্যচ্ছন্দ এক জন কৃশাঙ্গ যুবা পুরুষ সুগভীর চিন্তাবনত মুখে শনৈঃ শনৈঃ পাদচারে সিংহাসনাভিমুখে আসিয়া বিনা সাহায্যে তাহার সোপান অতিক্রমপূর্ব্বক সর্ব্বোচ্চ ভাগে উপস্থিত হইলে, দুই জনেই একেবারে সিংহাসনের উপর পরস্পর সম্মুখীন! গৌরাঙ্গ পুরুষ তৎক্ষণাৎ আপনার শিরস্ত্রাণ হইতে মহামূল্য হীরক-মণ্ডিত সুবর্ণময় মুকুট খুলিয়া অপরের মস্তকোপরি বসাইয়া দিলেন, এবং তাহা করিয়াই পশ্চাদ্বর্ত্তী হইয়া সিংহাসনের একটী সোপান নিম্নে আসিবার উপক্রম করিলেন। যুবা উভয় হস্তদ্বারা তাঁহার উভয় হস্ত ধারণ পূর্ব্বক আলিঙ্গন করত তাঁহাকে নামিতে দিলেন না।
সভা মধ্যে কি হিন্দু কি মুসলমান দ্রষ্টৃমাত্রেরই চক্ষু বাষ্পাকুলিত হইল—সকলেরই কণ্ঠ হইতে গদগদ স্বরে “সম্রাট রাজা রাম চন্দ্রের জয়—সাহা আলম বাদসাহের জয়” এই বাক্য নিঃসৃত হইল। সকলেই স্ব স্ব স্থানে প্রণত হইয়া পড়িল।
নিমেষ মধ্যে সকলের প্রতি গাত্রোত্থানের আজ্ঞা হইল। উঠিয়া আর কেহই সাহ আলমকে দেখিতে পাইলেন না। দিল্লীর সিংহাসনোপরি শিবজী বংশ সম্ভূত রাজা রামচন্দ্র একাকী—উপবিষ্ট তাঁহার শিরোদেশে সাহ আলম প্রদত্ত সেই রাজমুকুট!