স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সাজাহান বিনির্ম্মিত নব দিল্লীর মধ্য ভাগে জুমা মসজিদ। জুমা মসজিদের ঊৰ্দ্ধ হইতে দেখিলে দিল্লী নগর যেরূপে নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। বোধহয় যে ঐ মসজিদটীই নগরের নাভি স্থল। তাহা হইতে কিরণ জালের ন্যায় চতুর্দ্দিকে রাজবর্ত্ম সকল বাহির হইয়া গিয়াছে, এবং প্রতি রাজবর্ত্ম হইতে পরস্পর সমদূরে অন্যান্য পথ নিঃসৃত হইয়াছে। সমুদায়টী যেন একটী লূতাতন্তুজাল। ঐ জাল মধ্যভাগে জুমা মস্জিদ এবং প্রতিতন্তুর পার্শ্বদেশে প্রজাবর্গের আবাস গৃহ।
দিল্লীর রাজবর্ত্ম সকল জনতায় পরিপূর্ণ। জুমা মস্জিদে মন্ত্রিসভার অধিবেশন হইয়াছে। এই সভায় অভিনব সাম্রাজ্যের সংরক্ষণ পালনাদির ব্যবস্থা নিরূপিত হইবে। প্রজাদিগের কৌতূহলের পরিসীমা নাই। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়, জাঠ, মহারাষ্ট্র, মুসলমান প্রভৃতি নানা প্রদেশ বাসী জনগণ পথিপার্শ্বে স্থানে স্থানে মিলিত হইয়া পরস্পর কথোপকথন করিতেছে। সকলেরই মুখ প্রফুল্ল, অন্তঃকরণ উৎসাহ পূর্ণ। একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন “যে রাম সেই রহীম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়”। মুসলমান বলিতেছেন “ঠাকুর যথার্থ কহিয়াছেন, সমস্ত জগৎ সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই বিভূতি মাত্র, মানুষ ভেদে যেমন আচারভেদ—পরিচ্ছদ ভেদ—ভাষাভেদ—তেমনি উপাসনার প্রণালীভেদও হইয়া থাকে। সকলেই এক পিতার পুত্র। সেই পিতা ভিন্ন ভিন্ন পুত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরাইয়া দেখিতেছেন। কিন্তু সকলেরই চামড়ার নীচে লহু লাল বই কাহারোও কাল কাহারোও জরদ নহে।” একজন ক্ষত্রিয় ঐ কথায় যোগ দিয়া বলিল “তাবই কি—আসলে কিছুই তফাৎ নাই—আমরা হিন্দু বলিয়া কি মুসলমানের দেবতা মানি না? আমরাও প্রতিবর্ষেই তাজিয়া করিয়া থাকি”। একজন বাঙ্গালী কহিল—“আমাদিগের দেশে সকল কর্ম্মেই সত্যপীরকে সিন্নি দেওয়া হইয়া থাকে, যিনি সত্যপীর তিনিই সত্য নারায়ণ।” আর একজন মুসলমান বলিল, “তোমরাই যে আমাদের দেবতা মান, আমরা তোমাদের দেবতা মানি না, একথা বলিতে পারিবেনা। কোন্ মুসলমান হিন্দু দেবতার এবং ব্রাহ্মণ ঠাকুরদের যথোচিত সম্মাননা না করে? আমার জানত অনেক মুসলমান ব্রাহ্মণদিগকে খরচ পত্র দিয়া দুর্গোৎসব করান। দরাপ খাঁ “সুরধুণি মুনি কন্যে” বলিয়া কেমন ভক্তি সহকারে গঙ্গাদেবীর স্তব করিয়া গিয়াছেন, তাহা কাহার অজানত আছে?” নগরময় এইরূপ কথোপকথন, কোথাও হাস্য পরিহাস, কোথাও গান বাজনা, কোথাও প্রীতিভোজের সমারোহ।
জুমা মস্জিদের মধ্যে ভারতবর্ষের যাবতীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তি একত্র সমাগত। উত্তর দিকে মহারাষ্ট্র মন্ত্রিবর বালাজী বাজীরাও পেশোয়া, তাঁহার দক্ষিণে কিঞ্চিৎদূরে মলহর রাও হুলকার, তাঁহার দক্ষিণে মাদাজী সিন্ধিয়া, তাঁহার দক্ষিণে দম্মাজি গুইকবার, তৎপার্শ্বে জানোজী ভোঁসলা, তাঁহার পার্শ্বভাগে সদাশিব রাও। পেশোয়ার বামপার্শ্বে কিঞ্চিৎদূরে সলাবত জঙ্গ, তৎপার্শ্বে সুজাউদ্দৌলা তাঁহার পার্শ্বে নজিব উদ্দৌলা, তাঁহার পার্শ্বে সুর্য্যমল; পেশোয়ার সম্মুখভাগে উদয়পুর যোধপুর আজমীর জয়পুর প্রভৃতি প্রদেশের ক্ষত্রিয়রাণা সমস্ত এবং তাঁহাদিগের পশ্চাদ্ভাগে তজ্জাতীয় বীরাবয়ব ঠাকুর দল।
পেশোয়া কহিতেছেন “অদ্য আপনারা চিরস্থায়িনী কীর্ত্তি সংস্থাপন করিলেন। শত শত সহস্ৰ সহস্র বর্ষ পরে যাঁহারা এই ভারত ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করিবেন, তাঁহারাও আপনাদিগের যশঃ কীর্ত্তন করিবেন। সকলের অভিমতানুসারে রাজ্য স্থাপনের এই কয়েকটী মূল নিয়ম অবধারিত হইয়া সুবর্ণ ফলকে লিখিত হইল, সুবর্ণ যেমন সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ ধাতু, কখন কলঙ্কিত বা পরিবর্ত্তিত হয় না, এ নিয়ম গুলিও সেইরূপ অপরিবর্ত্তনীয়।
১ম। সাক্ষাৎ শিবাবতার মহারাজ শিবজীর বংশ সম্ভূত রাজা রামচন্দ্র, বৈদেশিক শত্রু পরাভূত করিয়া নিজ বংশমর্য্যাদা ও বীরতাগুণে প্রদেশাধিকারী, ভূম্যধিকারী এবং প্রজা সাধারণেৱ ভক্তি এবং কৃতজ্ঞতা ভাজন হওয়ায় ভারতবর্ষের প্রথম সম্রাট হইলেন।
২য়। তাঁহার বংশে ঔরসাদি জ্যেষ্ঠ পুত্রে চির কালের নিমিত্ত সম্রাজ্যাধিকার ন্যস্ত থাকিবে।
৩য়। সম্রাট আপনার মন্ত্রিসভা নিযুক্ত করিবেন, এবং সেই সভার দ্বারা রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করিবেন।
সাম্রাজ্যের রক্ষার হেতু কয়েকটী ব্যবস্থা স্থির হইয়া রৌপ্য ফলকে লিখিত হইল। এ নিয়মগুলি সৌবর্ণ নিয়মাবলীর ন্যায় অপরিবর্ত্তনীয় নহে—কিন্তু সম্রাট ভিন্ন অপর কেহ ইহাদিগের পরিবর্ত্তনের প্রস্তাব করতেও পারেন না। নিয়মগুলি এই—
১মতঃ। শিখ এবং মহারাষ্ট্রীয় মিলিত একটী সৈন্য দল সিন্ধু নদের উপকূলে শিবির সন্নিবেশ করিয়া থাকিবে। ঐ সৈন্যের ব্যয় সাম্রাজ্যের রাজকোষ হইতে প্রদত্ত হইবে। উহার অধিনায়ক বর্গের নিয়োগও সম্রাটের সাক্ষাৎ অধীন থাকিবে।
২য়তঃ। সমুদ্রোপকূলভাগে যে যে স্থানে বিদেশীয় লোক বানিজ্য করিবার নিমিত্ত আসিয়া আছে, সেই সেই স্থানেও সমাটের সাক্ষাৎ অধীন ঐরূপ এক একটী সৈন্য দল থাকিবে।
৩য়তঃ। কোন রাজা বা নবাব অথবা সুবাদার আপনার নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যের অধিক বা অল্প সৈন্য রাখিতে পরিবেন না।
৪র্থতঃ। তাঁহারা স্বয়ং কোন প্রকার সন্ধি বিগ্রহ কার্য্যে লিপ্ত হইতে পরিবেন না। যদি কোন কারণে পরস্পর মনোবাদ উপস্থিত হয়, সম্রাটের নিকট অভিযোগ করিয়া তৎকৃত মীমাংসা গ্রহণ করিবেন।
৫মতঃ। সম্রাট অনুজ্ঞা করিলেই সকলে সসৈন্যে আসিয়া তাঁহার সহায়তা করিবেন।
৬ষ্ঠতঃ। প্রতি প্রদেশাধিকারীর প্রধানতম দুর্গ মধ্যে সম্রাটের খাস কতক সেনা অবস্থাপিত হইবে।
রাজস্ব সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত স্থির হইয়া যাহা তাম্র ফলকে লিখিত হইল, তাহা পরিবর্ত্তনীয় এবং তাহার পরিবর্ত্ত করিবার প্রস্তাব সম্রাটের মন্ত্রিদল অথবা প্রদেশাধিকারী কিম্বা ভূম্যধিকারী সকলেই করিতে পারেন। নিয়মগুলি এই—
১মতঃ। প্রতি গ্রামের ভূমি কত, এবং তাহার উৎপন্ন কত, তাহা অবধারিত করিতে হইবে; অনন্তর ঐ উপস্বত্বের ষষ্ঠাংশ রাজকোষে প্রেরিত হইবে। যাহা থাকিবে, তাহার দ্বিষড়্ ভাগ ভূম্যধিকারী এবং প্রদেশাধিকারী উভয়ে সমান পরিমাণে ভাগ করিয়া লইবেন। অবশিষ্ট সমুদায় গ্রামিকদিগেরই থাকিবে। ভূমির উৎপন্ন বিভাগ সম্বন্ধে যে নিয়ম, অপর সর্ব্বপ্রকার রাজস্বের সম্বন্ধেও সেই নিয়ম চলিবে।
শান্তি রক্ষার ভার গ্রামবাসীদিগের প্রতি অর্পিত থাকিবে। তবে ভূম্যধিকারী এবং প্রদেশাধিকারীরা তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন।
ধর্ম্মাধিকরণের ভারও গ্রামবাসীদিগের প্রতি অর্পিত থাকিবে। তবে ভূম্যধিকারী এবং প্রদেশাধিকারীরা তাহার তত্ত্বাবধান করিবেন। ফলতঃ প্রতি গ্রাম যেন একটী স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র রাজ্য হইয়া থাকিবে। ভূম্যধিকারিগণ এবং প্রদেশাধিকারিগণ সেই ক্ষুদ্র রাজ্যের আভ্যন্তরিক শাসনের প্রতি হস্তার্পণ করিতে যথাসাধ্য বিরত থাকিবেন—গ্রাম গুলিকে আপনাপন শান্তিরক্ষা ও ধর্ম্মাধিকরণ এবং রাজস্ব প্রদান সম্বন্ধীয় ব্যবস্থা করিতে দিবেন। ভারত ভূমির চিরপ্রচলিত ব্যবহার এই এবং এই ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত এবং যুক্তি সঙ্গত।
নগরের শাসন-প্রণালীও ঐ রীতির অনুসারে নির্ব্বাহিত হইবে। প্রতি নগর কয়েকটী পল্লীতে বিভক্ত হইবে এবং যেমন গ্রামে গ্রামে মুখ্য মণ্ডলাদি থাকিবে পল্লীতেও সেইরূপ মুখ্য মণ্ডল নিযুক্ত হইবে।
ভারত সাম্রাজ্য পালনের নিমিত্ত এই কয়েকটী স্থূল স্থূল ব্যবস্থা এক্ষণে নিরূপিত হইল। পরে এই সকল মূল নিয়ম রক্ষা করিয়া বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা অবধারিত হইবে। তাহা করিবার নিমিত্ত অদ্য এই সূত্রপাত করা যাইতেছে—ভারতবর্ষের অষ্টাদশ প্রদেশাগত অষ্টাদশ জন সর্ব্বশাস্ত্র বিশারদ মহাপুরুষ এবং সম্রাটের মন্ত্রিবর্গ ইহারা সকলে সম্মিলিত হইয়া ভারত সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপক মহাসভার সদস্য হইবেন। এই সভার দ্বারা রাজ্য সম্বন্ধীয় প্রধান প্রধান সর্ব্ব বিষয়ের বিচার হইবে। সাম্রাজ্যের মধ্যে যাহার যে কোন নিয়ম প্রচলিত করিবার ইচ্ছা হইবে, এই সভায় তাঁহার প্রস্তাব গ্রাহ্য হইয়া বিচারিত হইবে। এই সভা হইতে ব্যবস্থাপিত এবং প্রচারিত হইয়া না গেলে কোন ব্যবস্থাই লোকের গ্রাহ্য হইবে না। যেমন ভগবানের বিরাট মূর্ত্তি ব্রহ্মাণ্ডব্যাপক তেমনি সম্রাটের শরীরও ভারতবর্ষব্যাপক। কৃষ্যুপজীবী এবং শিল্পব্যবসায়ী শ্রমশীল প্রজাব্যূহ সেই শরীরের নিম্নভাগ, বণিক সম্প্রদায় এবং ধনশালী ব্যক্তিগণ তাহার মধ্যদেশ, যোদ্ধৃগণ এবং রাজকর্ম্মচারিগণ তাহার হস্ত—পণ্ডিত মণ্ডলী তাহার শিরোদেশ—এই সভা তাহার মুখ।