স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আগরা নগরের ক্রোশৈক মাত্র পশ্চিমে আকবর সাহের সমাধি মন্দির—উহার নাম সেকন্দ্রা। সকলেই তাজমহলের শোভা অনুভব করিয়াছেন—এবং ঐ নির্ম্মাণ কীর্ত্তি যে পৃথিবী মধ্যে অতুল্য, তাহাও বলিয়া থাকেন। কিন্তু অনুমান হয়, নিজ চিত্তবৃত্তি পর্য্যালোচনে সক্ষম এমত প্রকৃতদর্শী পর্য্যাটকের চক্ষে তাজমহলের শোভা অপেক্ষা সেকন্দ্রার শোভা অধিক। তাজ মহলের অভ্যন্তরে গমন করিলে বোধ হয় যেন আকাশ-মণ্ডলের অনুরূপ-রূপ সংঘটন করিবার উদ্দেশেই নির্ম্মাতা উহার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সেকন্দ্রার প্রকোষ্ঠ হইতে প্রকোষ্ঠান্তরে ক্রমশঃ গমন করিতে করিতে গমনকারীর বোধ হইয়া যায় যেন তিনি পৃথিবী ত্যাগ করিয়া আকাশমার্গে উত্থাপিত হইতেছেন। নির্ম্মাতা তাঁহাকে মর্ত্ত্যভূমি হইতে স্বর্গারূঢ় করিবার সোপান-শ্রেণী বিন্যস্ত করিয়া দিয়াছেন। মহাত্মা আকবরের সমাধি-বিবরের উপরিভাগের প্রস্তরখণ্ডটী ফাটিয়া রহিয়াছে। লোকে বলে, বিদ্যুৎপাতে ঐরূপ হইয়াছে, তাহাই কি? না, ঐ মহাপুরুষের প্রভাময় আত্মা আবরণ প্রস্তরকে উদ্ভিন্ন করিয়া সমীপবর্ত্তিনী দিব্যভূমিতে বিচরণ করিতে গমন করিয়াছে? সেকন্দ্রার চতুর্দ্দিকে লোকারণ্য। হাতি, ঘোড়া, উট্, তামজান, রথ অসংখ্য। সম্রাট্ রামচন্দ্র সেকন্দ্রা দর্শনে আসিয়াছেন, এবং প্রধান মন্ত্রী পেশোয়াকে সমভিব্যাহারে করিয়া যে সর্ব্বোচ্চ প্রকোষ্ঠে আকবরের সমাধি স্থান, সেই স্থানে গমন করিয়াছেন। দুই জনে তথায় উপবিষ্ট, রাজা রামচন্দ্র কহিতেছেন—“পিতঃ, আমি আপনার আদেশের অনুবর্ত্তী হইয়া এই স্থানে আসিয়াছি— তাজমহল অপেক্ষাও এই স্থানটী অধিকতর রমণীয় বলিয়া আমার বোধ হয়।” বাজীরাও কহিতেছেন, “বৎস! তাজমহল একজন সমৃদ্ধিশালী বাদসাহের নির্ম্মিত বটে, কিন্তু যিনি সেকন্দ্রার নির্ম্মাতা, তিনি কেবল ধনশালী বাদসাহ ছিলেন না, তিনি এক জন সুদূরদর্শী মহাপুরুষ ছিলেন। আকবর সাহাই বুঝিয়াছিলেন, কেমন করিয়া অন্তর্বিচ্ছেদে বিচ্ছিন্ন মহাদেশটীকে একচ্ছত্র করিয়া রাখিতে হয়। ধর্ম্মবিদ্বেষ কখনই তাঁহার অন্তঃকরণে স্থান লাভ করে নাই। তিনি হিন্দু এবং মুসলমানকে একধর্ম্মসূত্রে সম্বদ্ধ করিবার জন্য কি বিচিত্র উপায়েরই সৃষ্টি করিয়াছিলেন। যিনি ঐ পথে না চলিবেন তিনিই ভারতবর্ষের সিংহাসন হইতে স্খলিতপদ হইবেন।” রামচন্দ্র কহিলেন, “মুসলমান সম্রাটেরা পরধর্ম্মবিদ্বেষী হইতে পারেন, হিন্দুসম্রাটেরা কখনই সেরূপ হইতে পারেন না।” বাজীরাও বলিলেন, “সে কথা সত্য। হিন্দুরা স্বধর্ম্মে ভক্তি করেন, অথচ পরধর্ম্মে বিদ্বেষ করেন না। কিন্তু যেমন পরধর্ম্ম-বিদ্বেষ নাই, তেমন আমাদিগের আর একটী দোষ আছে। আমরা আবহমানকাল সকল বিষয়ে যে প্রণালী অবলম্বন করিয়া আসিতেছি, তাহার কিছুমাত্র অন্যথা করিতে চাহি না। কিন্তু সকল সময়ে কি এক নিয়ম চলে? আমি সম্প্রতি বঙ্গদেশে গিয়া যাহা যাহা দেখিয়া আসিলাম, তাহা বলিতেছি শ্রবণ করুন। শুনিলেই বোধ হইবে যে, আমাদিগকে পূর্ব্বরীতির কিছু কিছু ব্যত্যয় করিতে হইবে—তাহা না করিলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা।”—বাজীরাও কহিতে লাগিলেন, “বাঙ্গালার সুবাদার তাঁহার অধিকারস্থ কতকগুলি বিদেশীয় লোকের একটী নগর লুণ্ঠন করিয়া তাহাদিগকে নানা প্রকারে যন্ত্রণা দিয়াছিলেন। ঐ বিদেশীয়েরা এক প্রকার ফিরিঙ্গী। তাহাদিগেরও বর্ণ সাদা ও চক্ষু কেশ লোম কটা। তাহারাও বিলক্ষণ সাহসী এবং সবল। ফিরিঙ্গীরা যে সবল এবং সাহসী, তাহা বলিবার অপেক্ষা কি? তাহা না হইলে কি মহা সমুদ্র পার হইয়া এই দূরদেশে আইসে? ঐ ফিরিঙ্গীদিগের নাম ইংরাজ। তাহারা যে নগরটিতে থাকে, তাহার নাম আলীনগর। শতাধিক বর্ষের মধ্যে তাহারা ঐ নগরটীকে বিলক্ষণ সমৃদ্ধিশালী করিয়া তুলিয়াছে। ঐ নগরে অন্যূন ৭০ সহস্ৰ লোকের বাস, এবং শুনিলাম উহার রাজস্ব বার্ষিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকারও অধিক। অতএব ইংরাজেরা শুদ্ধ সামান্য বণিক নহে, তাহারা রাজনীতিও বুঝে। যাহা হউক, বাঙ্গালার নবাব কলিকাতা লুঠ করিলে ইংরাজেরা যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হয়, এবং মাদ্রাজে তাহাদিগের যে অপর একটি আড্ডা আছে, তথা হইতে ৫।৬ খানি জাহাজে চড়িয়া তাহাদের অনেক লোক বাঙ্গালায় আসিয়া পৌছেন। আলীনগর ত তাহারা আসিবামাত্রই পুনরধিকার করে; অনন্তর কিছুদিনের মধ্যে সুবেদারকেও সম্মুখযুদ্ধে পরাস্ত করিয়া তাঁহারই সেনাপতিকে তাঁহার গদিতে বসায়। ঐ সেনাপতি সুবেদার হইয়া তাহাদিগকে অনেক ধন এবং কতক ভূমি জায়গীর দেয়। রাজ্যপালনে সক্ষম, সুহৃদ্ভেদে সমর্থ, নিতান্ত সাহসিক এবং অধ্যবসায়শালী ইংরাজ জাতি এইরূপে লব্ধ প্রবেশ হইতেছিল। আমি তাহাদিগের জায়গীর বাজেয়াপ্ত করিয়া লইলাম। কিন্তু ইংরাজ দিগের পূর্ব্ব অধিকার যাহা যাহা ছিল—তাহা সমুদায় তাহাদিগকে প্রত্যর্পণ করিলাম। উহাদিগের কর্ত্তার নাম ক্লাইব। সে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা এবং তেজস্বিতা অসাধারণ। তাহার কোন মতেই ইচ্ছা ছিল না যে, জায়গীর পরিত্যাগ করে। কলিকাতার দুর্গটীও পুনর্নির্মাণ করিতে তাহার একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু তাহারও সকল ইচ্ছা পূর্ণ করিতে দিতে পারিলাম না। আমাদিগের সৈন্যে তাহাদিগের বাণিজ্য কুঠীর রক্ষা করিবে, অতএব দুর্গ নির্ম্মাণে তাহাদের প্রয়োজন নাই —আর তাহারা বাণিজ্য করিতে আসিয়াছে, বাণিজ্য করুক, এদেশে ভূমি সম্পত্তি লওয়া তাহদের অনাবশ্যক, এই সকল যুক্তি প্রদর্শনে তাহাকে নিরস্ত করি। কিন্তু তাহার আকার ইঙ্গিতে বিলক্ষণ বোধ হইয়াছিল যে যদি সাম্রাজ্যের অবস্থা পূর্ব্বের ন্যায় বিশৃঙ্খল থাকিত, এবং আমার সহিত এত অধিক সুশিক্ষিত সৈন্য না থাকিত, তবে সে কখনই ঐ সকল যুক্তি গ্রহণ করিত না। সে একটী বাঘের বাচ্চা। কিন্তু যখন দেখিল যে, কোন ক্রমেই আমার অভিমতির অন্যথা হইল না—তখন তর্জ্জন গর্জ্জন ছাড়িয়া দিল, এবং আমার সহিত সৌহার্দ্দ বন্ধনে প্রবৃত্ত হইল। এক দিন আমাকে তাহার সিপাহীদিগের কাওয়াজ দেখাইল—এক দিন তাহার যুদ্ধপোতে লইয়া গেল। ঐ সমস্ত দেখিয়া আমার এই বোধ হইয়াছে যে, ফিরিঙ্গীরা আমাদিগের অপেক্ষা যুদ্ধ কৌশল এবং রণপোত নির্ম্মাণের প্রণালী উত্তমরূপে বুঝে। অতএব আমি মনে করিয়াছি কতকগুলি ফিরিঙ্গীকে নিজ কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া তাহাদিগের দ্বারা এ দেশীয় দিগকে যুদ্ধ কৌশলের এবং পোত প্রস্তুত করিবার রীতি শিখাইয়া লইব। তদ্বিষয়ে এই এক সুবিধা আছে, ফিরিঙ্গীরা নিতান্ত অর্থগৃধ্নু। উহাদিগকে মোটা মোটা মাহিয়ানা দিলে উহারা আমাদিগের নিকট চাকুরি করিবে।
ক্লাইবের নিকট আমি আর একটী দ্রব্য দেখিতে পাইয়াছিলাম। তাহার রণ পোতে তথায় এক খানি বৃহৎ পুস্তক দেখিয়া উহা কি জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল যে উহাতে নানা দেশের চিত্র আছে, এবং সেই চিত্র খুলিয়া তাহাদিগের নিজের দেশ কোথায়, এবং অন্যান্য ফিরিঙ্গীদিগের দেশ কোথায়, তাহারা কে কোন পথ দিয়া কেমন করিয়া এখানে আইসে, সমুদয় দেখিয়াছিল। পরিশেষে ঐ চিত্রময় পুস্তক আমাকে উপঢৌকন দিয়াছে। চিত্রগুলি যে সত্য, তাহা অপরাপর ফিরিঙ্গী এবং নাখোদা প্রভৃতি দেশীয় সওদাগরদিগকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছি। এক্ষণে আমার অভিপ্রায় এই যে, ফিরিঙ্গী কারিগর দিগের দ্বারা কয়েক খানি সমুদ্র গমনোপযোগী পোত প্রস্তুত হইলেই তদ্দ্বারা এদেশীয় কতকগুলি সদ্বংশজাত বুদ্ধি বিদ্যা সম্পন্ন যুবা পুরুষকে ফিরিঙ্গীদিগের ভিন্ন ভিন্ন দেশে পাঠাইয়া দিব। তাহারা সেই সকল দেশের ভাষাভিজ্ঞতা লাভ করিয়া ফিরিঙ্গীদিগের যাবতীয় বিদ্যা শিক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিবে। তাহাদিগের দ্বারা সাম্রাজ্যের যথেষ্ট উপকার দর্শিবে। এমত কার্য্যে সমুদ্র গমনের এবং ম্লেচ্ছ সংসর্গের দোষ জন্মিতে পারে না। ভগবান বশিষ্ঠ ঋষি যখন মহাচীনে গমন করিয়া ছিলেন—তখন স্বয়ং চীনাচার পরিগ্রহ করিয়া ছিলেন—তাহাতে তিনি ধর্ম্মভ্রষ্ট হয়েন নাই।
আমরা যদি কোথাও না যাই, বিদেশ দর্শন না করি —চির কাল এই নিজ গৃহের মধ্যে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকি—তবে আমাদিগের প্রকৃতি স্ত্রীলোকের প্রকৃতির ন্যায় হইয়া যাইবে। আমরা স্বয়ং সিদ্ধ হইয়া কিছুই করিতে পারিব না, এবং যেমন স্ত্রীলোক পুরুষের বশীভূত হয়, এ দেশীয়রাও সেইরূপ ফিরিঙ্গীর বশ হইয়া পড়িবেন—অতএব এই তিনটী ব্যবস্থা নিৰ্দ্ধারিত করিবার অভিলাষ করিয়াছি (১) অন্যূন ২ শত কৃত কর্ম্মা ফিরিঙ্গীকে বেতন দিয়া সৈনিক শিক্ষায় নিযুক্ত করিতে হইবে। ২য়তঃ অপর এক শতকে রণপোত নির্ম্মাণে নিযুক্ত করিতে হইবে। ৩য়তঃ, অন্যূন তিন শত এদেশীয় যুবককে রাজ কোষ হইতে বৃত্তি প্রদান করিয়া ফিরিঙ্গীদিগের দেশে তাহাদিগের ভাষা এবং বিদ্যা শিক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিতে হইবে।”
সম্রাট্ বিশেষ মনঃ সংযোগ পূর্ব্বক সমস্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন–পিতঃ আপনি যাহা অভিমত করিয়াছেন, তাহাতে অবশ্যই মঙ্গল হইবে। তাহা পরবর্ত্তী কয়েক পরিচ্ছেদে বিবৃত হইবে।