স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
লাহোর নগর হইতে পূর্ব্ব-দক্ষিণাভিমুখে অনুমান দেড় ক্রোশ পথ আসিলেই একটী অতি অপূর্ব্ব স্থানে উপস্থিত হওয়া যায়। ঐ স্থানটীর নামক “শালেমার বাগ” উহা সাজাহান বাদসার কর্ত্তৃক নির্ম্মিত। উহার নির্ম্মাণ-প্রণালী এই—সম্মুখে একটী প্রশস্ত উদ্যান, নানা জাতীয় বৃক্ষে পরিপূর্ণ—তাহার অভ্যন্তরে কিয়দ্দূর প্রবেশ করিলেই একটী সোপান-শ্রেণী দৃষ্ট হয়—ঐ সোপানদ্বারা উঠিলে আর একটী প্রশস্ত উদ্যান মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়া যায়, তাহারও প্রান্ত-সীমায় আবার একটী সোপান-শ্রেণী আবার একটী উদ্যান। এইরূপ ক্রমে ক্রমে এবং উপর্য্যুপরি অনেকগুলি বৃক্ষবাটিকা অতিক্রান্ত হইলে সুরম্য রাজভবন এবং স্নানাগার শ্রেণী দৃষ্ট হয়। যাঁহারা সুবিখ্যাত রাণী সেমিরেমিস বিনির্ম্মিত বেবিলন নগরের নিরলম্ব উদ্যানের বিবরণ পাঠ করিয়াছেন, “শালেমার বাগ” দর্শন করিলে তাঁহাদিগের সেই কথা মনে পড়িতে পারে।
সম্রাট্ এবং প্রধান মন্ত্রী সর্ব্বদাই ঐ স্থানে যাইতেন। বৈদেশিক রাজপ্রতিভূদিগের দরবার প্রায় ঐ স্থানেই নির্ব্বাহিত হইত। কোন বর্ষের ফাল্গুন মাসে অতি সমারোহ পূর্ব্বক ঐ স্থানে দরবার হইয়াছিল। ফ্রান্স, অষ্ট্রিয়া, রুসিয়া, ইংলণ্ড, আমেরিকা, তুরষ্ক, পারস্য, চীন, ব্রহ্ম প্রভৃতি নানা দেশীয় প্রতিভূগণ সমাগত। ফ্রান্স প্রতিভূর ইচ্ছা, তাঁহার দেশে যে প্রজাতন্ত্র-শাসনপ্রণালী প্রবর্ত্তিত হইয়াছে, ভারত-সম্রাট্ তাহার অনুমোদন করেন, এবং তাহা করিয়া রুসিয়া, অষ্ট্রিয়া ইংলণ্ডের বিরূপতা নিবারণ করেন। মাসাবধি ঐ বিষয় লইয়া অনেক বাদানুবাদ এবং তর্ক বিতর্ক হইয়া আসিতেছে। পরে সম্রাটের অভিমতি প্রকাশের নিমিত্ত, ঐ দিন সভা হইয়াছে, এবং পেশোয়া প্রতিভূবৰ্গকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন— “দেশভেদে মনুষ্যের আচারভেদ, ব্যবহারভেদ, ধর্ম্মভেদ এবং শাসন প্রণালীর ভেদ হইবে। যাহারা নিতান্ত অবিবেচক এবং অপ্রকৃতদর্শী তাহারাই সকলকে একরূপ করিতে চায়। সকলেই কখন একরূপ হইতে পারে না। একরূপ হইলেও ভাল হয় না, ভাল দেখায়ও না। এই যে বিচিত্র পুষ্পোদ্যানটী সম্মুখে দেখিতেছি, ইহাতে নানা জাতীয় ফল ফলিয়াছে—ঐ বিভিন্নতাটী না থাকিলে—সকল পুষ্পই একরূপ হইলে কি এত সুন্দর দেখাইত? ভিন্ন ভিন্নরূপ ফল যত প্রকার উপকারে আইসে, একরূপ হইলে কি তত উপকারে আসিত; অতএব ফ্রান্সের শাসন-প্রণালী যদি প্রজাতন্ত্র করাই সেখানকার লোকের অভিমত হইয়া থাকে, তাহার প্রতি ব্যাঘাত করা আমাদিগের কর্ত্তব্য নহে। ফ্রান্স একটী স্বতন্ত্র বৃক্ষ—উহাতেও যে ফুল ফুটিতে হয় ফুটুক, যে ফল ফলিতে হয় ফলুক, রুসীয় অষ্ট্রীয় ইংলণ্ডীয় সম্রাটেরা আমাদিগের সহিত এক মত হইয়া ফ্রান্সের প্রতি হস্তক্ষেপ করায় নিবৃত্ত হউন।
তবে একটী কথা এই, ফ্রান্সবাসীর সুদ্ধ নিজ দেশের শাসন প্রণালী পরিবর্ত্ত করিতে চাহিতেছেন না। তাঁহারা পর রাজ্যে লোক প্রেরণ করিয়া তত্রত্য প্রজাবর্গকে বিদ্রোহ ব্যাপারে প্রোৎসাহিত করিতেছেন। এ কার্য্যটী ভাল নয়। আমরাও যেজন্য ফ্রান্সের শাসন প্রণালীর পরিবর্ত্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিব না, ফরাসীরাও সেই কারণে আমাদিগের রাজ্য মধ্যে বিদ্রোহবীজ বপন করিবেন না। অতএব আমাদিগের অভিপ্রায় এই, কোন ফরাসী যদি আমাদিগের কাহারও অধিকার মধ্যে আসিয়া বিদ্রোহবীজ বপন করিতেছে—এমত প্রমাণ হয় তবে তৎক্ষণাৎ তাহাকে দেশ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া হইবে। আর একটী কথা আছে, ফ্রান্সের দৃষ্টান্ত রাজ্য-তন্ত্র-তার পক্ষে ভয়াবহ বলিয়া কাহার কাহার বোধ হইতে পারে। যাঁহাদিগের সেরূপ ভয় হইবে তাঁহারা এক কর্ম্ম করুন, সাবধান হইয়া সত্বরে আপনাপন প্রজা পালনের সুশৃঙ্খলা সম্পাদন করিয়া লউন—আর কোন ভয়ই থাকিবে না। আর একটী কথা আছে, কেহ কেহ ভয় করিতেছেন, ফরাসী গ্রন্থকারেরা যে সকল নাস্তিক্যবাদে ও রাজবিদ্রোহ কথায় পরিপূরিত পুস্তক প্রণয়ন করিতেছেন, তাহা অন্য দেশের লোক অধ্যয়ন করিলে তাহাদিগেরও মত-পরিবর্ত্ত ঘটিবার সম্ভাবনা। এ ভয়ও কোন কাজের ভয় নহে। এই ভারত সাম্রাজ্যে উদ্ভাবিত, বিচারিত, এবং প্রচারিত না হইয়াছে এমত মতবাদই নাই। বৌদ্ধেরাও ঈশ্বর স্বীকার করিত না—বর্ণভেদ মানিত না—বৈদিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠানকে নিন্দা করিত। অনেক রাজাও তাহাদিগের মতানুগামী হইয়াছিলেন; কিন্তু তাহাতে কি হইয়াছে?—জাতীয় ধর্ম্ম রক্ষার এক মাত্র উপায় সেই ধর্ম্মের প্রচারক এবং উপদেষ্টৃবর্গের বিদ্যাবত্তা, বুদ্ধিমত্তা এবং পবিত্রতা—আর কিছুই নহে। যদি ধর্ম্মের উপদেষ্টৃ বর্গ তাদৃশ সক্ষম ও সদাচার হয়েন, তবে ধর্ম্মব্যাঘাতের কোন ভয় থাকে না। তাঁহাদিগের উপদিষ্ট ধর্ম্ম সজীব থাকে। সেই ধর্ম্ম অভিনব তথ্য সংগ্রহ দ্বারা সবল থাকিয়া সংসার রক্ষা করে। ফরাসী গ্রন্থকার দিগের পুস্তক সমুদায় আমাদিগের ছেলেরা অনেকেই অধ্যয়ন করে—তাহারা বলে বৌদ্ধদিগের গ্রন্থে যাহা যাহা আছে তাহা ছাড়া ঐ সকল গ্রন্থে বড় কিছু নূতন নাই। যাহা হউক, আমার বিবেচনায় আমাদিগের ভ্রাতৃসন্নিভ রুসীয়, অষ্ট্রীয়, ইংলণ্ডীয় সম্রাট্দিগের ফ্রান্স দেশের প্রতি এই মতানুযায়ী ব্যবহার করা বিধেয়। ভারত সম্রাট্ এইরূপই করিবেন।” সভা ভঙ্গ হইল।
ঐ সভায় যিনি রুসীয় সম্রাটের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি আপন স্বামীকে যে পত্র লিখিয়া পাঠান, তাহার কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইল।
“ভারত সম্রাটের সর্ব্বপ্রধান মন্ত্রী আজিকার দরবারে যে সকল কথা বলিয়াছেন, সে সকলের অবিকল অনুবাদ প্রেরিত হইল। অন্যান্য রাজপ্রতিভূদিগের সহিত কথাবার্ত্তায় বোধ হইতেছে—তাঁহারা ঐ সারবতী কথায় একান্ত শ্রদ্ধান্বিত হইয়া তাহারই মতানুযায়ী কার্য্য করিবার নিমিত্ত স্ব স্ব কর্ত্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করিবেন। ভারত সম্রাটের অভিমতির বিপরীতাচরণ শ্রেয়ঃ নহে।”