স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
কান্যকুব্জের চতুষ্পাঠী।

 গঙ্গা কল কল শব্দে চলিতেছেন। পূর্ব্বোপকূল অতিশয় উচ্চ—ত্রিংশৎ হস্তের ন্যূন হইবে না। মধ্যে মধ্যে ঐ কূলের ধার ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। ভগ্ন স্থানের অতি নিম্ন প্রদেশও কোথাও মনুষ্যাবাসের চিহ্নশূন্য নহে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইষ্টক নির্ম্মিত প্রাচীর—কূপের পাট—মৃৎকলসাদি কৃত্রিম পদার্থ সকল সর্ব্বদাই বাহির হইয়া পড়িতেছে। ঐ স্থানটী সুপ্রসিদ্ধ কান্যকুব্জ নগর। উহার প্রান্তে যে অত্যুচ্চ প্রাসাদ একটী দেখা যাইতেছে, তাহার নাম “সীতাকারসুঁই”। প্রথিত আছে, সীতাঠাকুরাণী শ্রীরামচন্দ্র কর্ত্তৃক বর্জ্জিত এবং বনে প্রস্থাপিত হইলে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে আসিয়া যেখানে বাস করেন, সেটী ঐ স্থান। ঐ স্থানে তিনি রন্ধন করিয়া বানপ্রস্থ ঋষিবৰ্গকে ভোজন করাইতেন। পূর্ব্বে ঐ স্থানে একটী দেবালয় ছিল। অনন্তর ঐ দেবালয় ভগ্ন করিয়া একটী মসজিদের নির্ম্মাণ হয়। পরে ঐ মসজিদ স্থানে স্থানে ভগ্ন হইয়া উহার প্রস্তর সকল গ্রন্থিবিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতেছে। এক্ষণে দেখা যাইতেছে যে, প্রস্তরগুলিতে লক্ষী, গণেশ, নারায়ণ প্রভৃতি দেব দেবীর যে সকল প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত ছিল—সেই মূর্ত্তিগুলিকে ভিতরে দিয়া মসজিদের প্রাচীর নির্ম্মিত হইয়াছিল, প্রাচীর ভগ্ন হওয়াতে সেই মূর্ত্তি সকল আবার বাহির হইয়া আসিতেছে।

 সীতাকারসুঁয়ের সর্ব্বোচ্চ ভাগে উঠিলে সমস্ত নগরটীকে একখানি সতরঞ্চের ছকের ন্যায় দেখিতে পাওয়া যায়।

 পল্লী গুলি স্বতন্ত্র; দুইটী পল্লী পরস্পর মেশামিশি হইয়া নাই—মধ্যে মধ্যে বৃক্ষ-রাজী দ্বারা বিভিন্নীকৃত। এইরূপ হওয়াতে নগরটী সমধিক বিস্তীর্ণ—যত লোকের বাস তাহা অপেক্ষা আয়তনে অনেক অধিক বোধ হয়। কনোজের বিভিন্ন পল্লীগুলির নাম অনুসন্ধান করিলে ইহাই বোধ হয় যে, বিভিন্ন বর্ণসম্ভূক্ত জনগণ প্রায়ই বিভিন্ন পল্লীতে বাস করিয়া থাকে। মনুসংহিতায় নগরাদি নির্ম্মাণের যেরূপ বিধি আছে, কনোজ যে সেই বিধানের অনুসারেই প্রথমে নির্ম্মিত হইয়াছিল, এবং এখনও সেই নির্ম্মাণের কতক প্রকৃতি ধারণ করিয়া আছে, তাহার সংশয় নাই।

 কান্যকুব্জ সম্প্রতি একটি প্রধান সমাজ স্থান। এখানে পৃথিবীর যাবতীয় সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন ভাষার সমগ্র চর্চ্চা হইতেছে। নগরের ঠিক মধ্যভাগে একটী চতুষ্পাঠী। তাহার সর্ব্বপ্রধান অধ্যাপক সর্ব্বপ্রধান সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা প্রদান করেন। দ্বিতীয় অধ্যাপক গ্রীক ভাষা শিক্ষা করান—তৃতীয় অধ্যাপক লাটিন ভাষার শিক্ষা দিয়া থাকেন—চতুর্থ অধ্যাপক আরবী ভাষার শিক্ষা দেন। এই সকল প্রধান প্রধান অধ্যাপকের সহকারী অধ্যাপক অনেকগুলি করিয়া আছেন। ছাত্রেরা ভারতবর্ষের নানা স্থান হইতে কতকগুলি আরব পারস্য এবং তুর্ক স্থান হইতে, আর কয়েকটি ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশ হইতে, বিশেষতঃ জর্ম্মণি এবং রুসিয়া হইতে, এখানে আসিয়া পাঠ সমাপন করিতেছেন। অধ্যাপক এবং ছাত্রদিগের নিমিত্ত বৃত্তি নিৰ্দ্ধারিত আছে। উল্লিখিত কয়েক ভাষার প্রাচীন এবং নব্য, মুদ্রিত এবং অমুদ্রিত প্রায় সকল পুস্তকই ঐ চতুষ্পাঠীতে সংগৃহীত হইয়া আছে।

 প্রাচীন পুরাবৃত্ত সম্বন্ধে যিনি যে গ্রন্থ রচনা করেন, তাহা সর্ব্বাগ্রে কনোজের চতুষ্পাঠীতে প্রেরিত হয়। চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকেরা তাহার তথ্যাতথ্য বিচার করিয়া যেরূপ অভিমতি প্রকাশ করেন, গ্রন্থকার রাজকোষ হইতে তদনুযায়ী পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। নূতন কাব্য নাটকাদির গুণাগুণও এই চতুষ্পাঠীতে বিচারিত হইয়া থাকে। এখানকার একটী ছাত্র সম্প্রতি একখানি গ্রন্থ লিখিয়া সপ্রমাণ করিয়াছেন যে, জর্ম্মণ, গ্রীক, এবং হিন্দু—তিনটি জাতিই এক মূল জাতি হইতে সমুৎপন্ন। আর একটী ছাত্র একখানি গ্রন্থ লিখিতেছেন; ঐ গ্রন্থ এখনও শেষ হয় নাই। তাহার উদ্দেশ্য এই যে, জেন্দভাষার সহিত কাল্ডীয় এবং হিব্রু ভাষার সংযোগ সপ্রমাণ করিয়া পারসীক আবেষ্টা এবং য়িহুদীয় বাইবেলের পরস্পর একান্ত সংস্রবের নির্দ্দেশ করা। এই গ্রন্থের সমুদয় অংশ সংসাধিত হইলে প্রমাণিত হইবে যে, বেদপ্রমাণক হিন্দু, আবেষ্টা প্রমাণক পারসীক, বাইবেল প্রমাণক য়িহুদী ও খ্রীষ্টান এবং কোরাণ প্রমাণক মুসলমান, ইহাঁরা সকলেই মূলতঃ একই ‘কেতাবী’ জাতি। ভারতবর্ষীয় কি হিন্দু কি মুসলমান সকলেই ঐ গ্রন্থ সমাপ্ত দেখিবার জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছে। এই রূপ নানা গ্রন্থ প্রণীত হইতেছে, সে সকলের উল্লেখ করা বাহুল্য; কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা সুপ্রসিদ্ধ যে মহাকাব্য সম্প্রতি প্রণীত হইয়াছে তাহার উল্লেখ করা নিতান্ত আবশ্যক। এই চতুষ্পাঠীর সর্ব্বপ্রধান সংস্কৃতাধ্যাপক মহর্ষি সঞ্জীবন ঐ মহাকাব্যের প্রণয়ন করিয়াছেন।—উহা এক্ষণে পৃথিবীর সকল সভ্য জাতীয়ের ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছে। ইহাতে ভারত-সাম্রাজ্যের “পুনরুত্থান” ব্যাপার যথাযোগ্য রূপেই কীর্ত্তিত হইয়াছে। বাল্মীকির করুণা—হোমরের ওজস্বিতা, বৰ্জ্জিলের প্রসাদবত্তা—মিলটনের গভীরতা—ব্যাসের লৌকিকতা, মহর্ষি সঞ্জীবন প্রণীত “পুনরুত্থান” নামক মহাকাব্যে যে সংক্রান্ত হইয়াছে, ইহা সর্ব্বদেশীয় সকল আলঙ্কারিকেরা একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন।