স্রোতের গতি/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
প্রকৃতির পরিবর্ত্তন
বাড়ী ফিরিয়া অমিয়া সবচেয়ে বিস্মিত হইল মাসীমাকে দেখিয়া। তাঁহার কৃশ দেহের বাহ্যিক পরিবর্ত্তন বড় বেশী সংসাধিত না হইলেও, সমস্ত শরীর দিয়া যেন নির্ম্মল আনন্দের একটি স্নিগ্ধ জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হইতেছিল। কথায় হাসিতে দৃষ্টিপাতে একটি শান্ত সমাহিত ভাব। সংসার-বিদ্রোহীর বিদ্রোহভরা চিত্তের জ্বালাময় তীব্রতার লেশ মাত্র তাহাতে বর্ত্তমান ছিল না। সাবিত্রী দেবীর চরণস্পর্শিত সিন্দুর-কৌটা ও লোহাগাছি অমিয়ার হাতে দিয়া কহিলেন—“এ দু’টি আমি তোমার জন্যেই এনেছি। যত্ন করে তুলে রাখ।”
অমিয়া হাসিয়া কি একটা তামাসার কথা বলিতে গিয়া, তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া কিছু না বলিয়াই হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।
পূজার ঘরেও যথেষ্ট বৈচিত্র দেখা যাইতেছিল। আলিপনা চিত্রিত কাঠের ছোট চৌকিখানির উপর কাশী হইতে আনীত উজ্জ্বল পিতলের সিংহাসনে পুষ্পমাল্যে বেষ্টিত চন্দনচর্চ্চিত হইয়া শোভা পাইতেছিল—তাহার মৃত মেসো মহাশয়—সত্যবতীর স্বামীর চির-অনাদৃত, চিরঅবহেলিত অস্পষ্টপ্রায় ফটোখানি। এখানি বরাবর বাহিরে বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙ্গান থাকিত। ত্রিপুরাচরণের মৃত্যুর পর হইতে ছবিখানি অযত্নে মলিন অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। সত্যবতী কখনও ইহার প্রতি যত্ন লওয়া আবশ্যক মনে করেন নাই। পূর্ব্বপাপের প্রায়শ্চিত্তার্থেই অপরাধিনী যেন ক্ষমার আবেদন লইয়া এখন পূজাকালে অনেক সময় ধ্যানমগ্ন হইয়া ইহারই সম্মুখে বসিয়া থাকেন। ভূমে লুটাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রণাম করেন। আর একখানি চৌকির উপর একজন সৌম্য শান্ত মহাপুরুষের তৈলচিত্র সজ্জিত—ইনি বানপ্রস্থাবলম্বী, সংসারত্যাগী, সত্যবতীর গুরুদেব। ইঁহার নিকটে মন্ত্র লইয়া উপদেশ পাইয়া সত্যবতী নিজের ব্যর্থ জীবনে সার্থকতা অনুভব করিতে শিখিয়াছেন। আজকাল পূজা-শেষে তিনি যখন বাহিরে আসেন, অমিয়ার মনে হয় একটি স্বর্গীয় শান্তিপূর্ণ ভাব-জ্যোতিঃতে যেন তাঁহার মুখখানি প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।
মিস্ চৌধুরীর আবেদন পাইবার পূর্ব্ব হইতেই অমিয়ারই চিঠিতে সত্যবতী রণেন্দ্রের খবর কিছু কিছু জানিয়াছিলেন। এই ছেলেটির কথা অমিয়া তাঁহাকে প্রথম প্রথম চিঠিতে লিখিত। বেশ চাঁচাছোলা তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ মন্তব্য সকলও ইহার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করিত। ক্রমশঃ কিন্তু তাহা সংক্ষিপ্ত হইয়া, কোন্ সময় হইতে একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। সে সময় নিজের মানসিক বিপ্লবে উদ্ভ্রান্তচিত্তা সত্যবতী তাহার খবর লইতেও পারেন নাই। মীনার লেখা চিঠিখানি মিস্ চৌধুরী সত্যবতীকে দেখিতে দিলে, তিনি বুঝিয়াছিলেন শুধু রণেন্দ্র নয়, মতের বদল অমিয়ারও ঘটিয়া গিয়াছে। অমিয়ার সলজ্জ ভাব ও কথাবার্ত্তায় এ সন্দেহ তাঁহার মনেও জাগিয়াছিল; পরিবর্ত্তিত চিঠিতে কেবল স্থির নিশ্চয় হইয়া গেল। এ ‘বদ্লা’ মতের সংবাদে তিনি সুখীই হইয়াছিলেন। তিনি ত এখন খেয়াতরীর পথ চাহিয়া পরপারের যাত্রী হইয়া বসিয়া আছেন; এই পায়ের বেড়ী সংসারানভিজ্ঞা মেয়েটিকে সঙ্গে লইয়া কোথায় পাথেয় সঞ্চয়ে ঘুরিতে যাইবেন? কর্ম্মফল নিজ হইতে যে মুক্তি দিতে চাহিতেছে, এ ত ভালই হইল। মিস্ চৌধুরী বলিয়াছেন—“এ মিলনে দম্পতীকে কখন অনুতপ্ত হইতে হইবে না। এই যে দুইটি সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মতের নরনারী, ঠিক একই স্থলে গিয়া চিরদিনের বিদ্বেষবুদ্ধি ভুলিয়া পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হইল, ইহাতে বিধাতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতই দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না কি? ইহাকে অবহেলা করিলে সেই অলক্ষ্য মিলনকর্ত্তার শুভ আদেশ অমান্য করা হইবে।”
সত্যবতী যুক্তকরে ললাট স্পর্শ করিয়া মনে মনে কহিলেন—“হে সর্ব্বদশী, সর্ব্বনিয়ন্তা, তোমার ইচ্ছাই তবে পূর্ণ হউক। মানবের সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র জ্ঞান তোমার অসীম রহস্য কেমন করিয়া উদ্ভেদ করিতে সমর্থ হইবে?”
সত্যবতীর নিমন্ত্রণ পাইয়া অমিয়ার বাবা আসিলে, সত্যবতী যথাযোগ্য সম্মানের সহিত তাঁহার পরিচর্য্যার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। অমিয়ার বিবাহের কথা তুলিলে অমিয়ার বাবা মুখ টিপিয়া একটুখানি শ্লেষের হাসি হাসিয়া কহিলেন—“মেয়ে বড় হইয়াছে বলিয়া সত্যবতীর যে স্মরণ হইয়াছে, ইহাতেই তিনি তুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু এখন এ গ্রাজুয়েট্ কন্যার পাত্র সংগ্রহ করা ত আর তাঁহার ন্যায় গরীব গোবেচারি কেরাণীর দ্বারা সম্ভব নহে,সাধ্যও নহে। এখন কোর্টশিপ—অর্থে, স্বয়ম্বরের আয়োজন আবশ্যক। তাহা শিক্ষিতা কন্যা ও শিক্ষাদাত্রী মাসীমাতার পক্ষে হয় ত অসম্ভব না হইতেও পারে। তিনি এবিষয়ে নিরুপায়।”
পিতার মুখে নিজ কন্যার প্রতি ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া, রাগে সত্যবতীর সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। কিন্তু নীলকণ্ঠের ন্যায় সে ক্রোধবিষ তিনি নিজেই পান করিয়া লইলেন। বলিলেন না যে, মাসী তাহাকে যত কুশিক্ষাই দিক্, পিতাও ত তাঁহার কর্ত্তব্য পালন করেন নাই। অনাথা বিধবার হাতে মেয়ে ফেলিয়া রাখিয়া কখন উদ্দেশও ত লন নাই যে, মেয়ের কি গতি হইয়াছে বা হইতেছে? পয়সা খরচের ভয়ে বিবাহের নামও ত কখন করেন নাই।” এ সব কলহের কথা সত্যবতী একটিও উচ্চারণ করিলেন না। শুধু বলিলেন—“সে জন্যে আপনার কোন ভাবনা নেই। পাত্র আমি স্থির করেই রেখেচি। আপনি কেবল অনুগ্রহ করে দু’হাত এক কর্বার অনুমতিটি দিন্। আর কোন ভারই আমি আপনাকে দেব না।”
কন্যাদায় হইতে এত সহজে মুক্তি পাইয়া পিতা এবার আন্তরিক আনন্দ প্রকাশ করিয়াই কহিলেন—“বেশ ত তা’হলে আর বিলম্বের আবশ্যক কি? তুমি যখন পছন্দ করেচ, তখন ত আর কথাই নেই। ছেলেটি অবশ্য ভালই হবে। তোমার পছন্দ ত আর যেমন তেমন হ’তে পারে —সে আমি বিলক্ষণই জানি। তোমার কাছে মেয়ে রেখে যে আমি কত নিশ্চিন্ত ছিলাম, তা ত দেখ্তেই পাচ্চ। নৈলে কি আর নিয়ে যেতেম না, না—বিয়েই দিতেম না? ওর মা যে ওকে তোমাকেই দিয়ে গেছে, তোমায় একা রেখে ওকে নিয়ে যাওয়া ত উচিত হ’ত না, তাই না নিয়ে যাইনি? ওর এ মা ত রোজ বলেন—কবে আমায় মেয়ে এনে দেখাবে। তা বলি, গিন্নি! সবুর কর—শুধু মেয়ে কেন, একেবারে হরগৌরী এনে দেখাব। তা শুভকর্ম্ম এইখানেই হবে ত? নৈলে সে পাড়াগাঁ, সেখানে নানান্ গোল বাধ্বে আবার। গিন্নিও তাই বলেন যে, তুমি আমি না হয় মনে কর্ব এই ত সেদিনের মেয়ে, ওর আবার বয়স কি? কিন্তু লোকে ত তা বুঝ্বে না। মেয়ে গেলে, রথ দোল দেখ্বার ভিড় লেগে যাবে। আমাদের হিন্দুঘরে এখনও ত এগুলো তেমন করে চলন হয়নি।”
কথা শেষ করিয়া তিনি সন্দিগ্ধ-দৃষ্টিতে শ্যালিকার পানে চাহিয়া দেখিলেন। সত্যবতী শান্তমুখে কহিলেন—“বলেছি ত, ওর জন্যে কোন কষ্টই দেব না আমি আপনাকে। আমার অমি-মার বিয়ে এখানেই হবে বৈকি—আপনি নিশ্চিন্ত থাক্বেন।”
বিবাহের পরদিন অমিয়ার মাথার চুলের উপর হাত রাখিয়া সত্যবতী আবেগ-কম্পিত অশ্রুবদ্ধ গাঢ়স্বরে কহিলেন—“আমি তোমায় আশীর্ব্বাদ কর্ছি অমি, স্বামী-ভক্তিতে তুমি সাবিত্রীর সমান হও। তোমার মন্দভাগিনী মাসীর দেওয়া সব ভুল, সব কুশিক্ষা এইখানে ফেলে রেখে, তুমি যে সতীসাধ্বীর কন্যা, তাঁর আশীর্ব্বাদের যেন যোগ্য হ’তে পার। ভগবান তোমার মঙ্গল কর্বেন। নারীবিদ্রোহ কর্বার অধিকার নেই মা; শুধু ভালবাসা দিয়ে জয় করার সাধনা করাই তাদের কাজ। তোমর শিক্ষা, শুধু ঘরের কাজে নয়, সমস্ত বিশ্বের সেবায় যেন জয়যুক্ত হয়।