স্রোতের গতি/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মীনার দৌত্য
অমিয়ার এইবার বাড়ী ফিরিবার সময় আসিল। সত্যবতী দেশে ফিরিয়াছেন। বাড়ী যাইবার পূর্ব্বরাত্রে মীনা তাহাকে নিরালায় পাইয়া সঙ্কোচ কাটাইয়া কহিল——“কাল ত সকালেই চলে যাবে ভাই, একটি ভিক্ষা দিয়ে যাবে? ভিখারীকে বিমুখ করা কিন্তু শাস্ত্র এবং মনুষ্যত্ব বিগর্হিত—অর্থাৎ কিনা ভয়ানক পাপ!”
তাহার বলার ধরণে অমিয়া সন্দিগ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু মুখে সে ভাব প্রকাশ পাইতে না দিয়া হাসিয়া কহিল—“তোমায় অদেয় আমার কিছুই ত নেই ভাই, প্রাণ পর্য্যন্ত দিয়ে বসে আছি যে, বক্তব্যটা কি শুনি?”
মীনা হাসিল। কহিল—“ঐখানেই ত মুস্কিল বাধালে ভাই! আমি ত প্রাণের ব্যবসায়ী নই। যা পেয়েছি তাই সাম্লাতে পারি না। মাল বাড়িয়ে আর কর্ব কি? তোমার প্রাণ আমি ফিরিয়ে দিলাম। আমি শুধু— উকীল!” বলিয়া সে সখীর ট্রাঙ্ক গোছানর কাজে সহায়তা করিতে লাগিল।
লজ্জিত ভাবটা গোপন করিবার অভিপ্রায়ে, কাজের ছুতায় ভাঁজ করা শাড়ীর ভাঁজ খুলিয়া পুনরায় ভাঁজ করিতে করিতে অমিয়া কহিল—“ওঃ! তা হলে ‘ফি’ পেয়েচ বল! আমি বলি ব্যাগার। ভিক্ষে নয় তা হ’লে!”
“না ভাই, ফি পাইনি এখনও, ধারে—ওকি গরম কাপড়গুলো সবই যে ভ’রে ফেল্লে? শালখানা আর রাগ্টা বাইরে থাক্, ট্রেণে দরকার হবে ত” বলিয়া সে ভ্রম সংশোধন করিয়া দিলে, অমিয়া মুখ নীচু রাখিয়া ট্রাঙ্কে জিনিষ ভরিতে ভরিতে হাসিয়া কহিল—“তারপর, কাণ্ডটা কি কর্তে হবে শুনি? প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে শেষ যেন দাতাকর্ণের দুরবস্থা করে ছেড় না।”
“নিশ্চয়ই না। আমায় কি তুমি এমনি অকৃতজ্ঞই ঠাওরালে শেষে? মা ভৈঃ!”
“তবে আমিও বরপ্রদা হ’লাম। বল কি কর্তে হবে—রণে বনে বাণিজ্যে ব্যসনে সহমরণে—কিসে তুমি আমার সাহায্য বা সঙ্গ চাও?” বলিয়া হাসিমুখে মুখ তুলিতেই মীনা তাহার ডান হাতখানা নিজ দুই করতলে চাপিয়া ধরিয়া কহিল—“বুঝ্তে তুমি ঠিক্ পেরেচ অমিয়া! তার কারণ, বিধাতা তােমায় নির্ব্বোধ করেন নি। তােমার মাসীমাকে রাজী কর্বার ভার আমার। মিস চৌধুরী—আমার মাসীমা—লিখেচেন, তিনি নিজে গিয়ে তাঁর সম্মতি আদায় করে নেবেন। শুধু তুমি বল ঠাকুরপােকে তুমি অযোগ্য মনে কর্ছ না—তাঁর ভালবাসাকে ভালবেসেই তুমি নিতে পার্বে?”
অমিয়া গলা ঝাড়িয়া মৃদুস্বরে বলিল—“আমায় তুমি মাপ কর ভাই মীনা। সত্যিই আমি এ দিক্ দিয়ে ভেবে দেখিনি। যদি রাখ্বার কথা হত”—বলিয়া কথা শেষ না করিয়া সে যেন নিজের সহিত বােঝাপড়া করিয়া লইবার জন্য মীনার হাত ছাড়াইয়া পুনরায় কাজে মন দিল। কাজ তাহাতে বিশৃঙ্খলই হইতে লাগিল। মীনা তাহার হাতের কাপড়গুলি টানিয়া ফেলিয়া দিয়া কহিল—“ভীষ্মদেবের প্রতিজ্ঞাই যদি ভাঙ্গলে—তাঁকে সুখী হবারও সুযােগ দাও। সত্যি বল্চি আমি, তুমি ঠক্বে না—যখন তাঁকে ভাল করে চেন্বার অবসর পাবে, দেখ্বে ভালবাসার শক্তি তাঁর কত বিস্তৃত। বাড়িয়ে বল্চি ভেবাে না। আমি যে তাকে কম বয়স থেকে বন্ধুভাবে দেখে আস্চি। আমার চেয়ে ত কেউ বেশী চিন্বে না? বল তুমি মত দিলে, বল বল—”
মীনার আদরের বেষ্টন হইতে নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া মৃদু জড়িত স্বরে অমিয়া কহিল—“কিন্তু তুমিও ত জান মীনা, আমার জীবনের যা ব্রত? এ আমি ব্রত হিসাবেই গ্রহণ করেচি। আমার সংকল্পে বাধা দিও না। আমায় মাপ কর।”
“জানি বৈকি, জানি বলেই ত বল্চি। ব্রত কি চিরদিনই কর্বে নাকি? এবার উদ্যাপনের পালা। স্বয়ং ভগবান যখন বরদাতা হয়ে মিলন চাইছেন, তখন ফেরাতে ত তুমি পার্বে না ভাই? না—কোন কথা নয়। প্রকৃতিও যে পুরুষের দাসী। আধখানা দিয়ে সত্যিকার কোন কাজ কি হ’তে পারে কখনও? যে রত্ন তোমায় দেব, জেনো তা অমূল্য। দাসী হ’তে না চাও—দেবীই হোয়ো, কিন্তু হেলায় হারিও না। এটি আমার অনুরোধ নয়—মিনতি। আমি বল্চি তোমার জীবন সার্থক হবে, সুখের হবে। বাইরের উচ্ছ্বাস নেই দেখে তুমি তাঁকে ভুল বুঝ না। এ আমার নয়, আবেদন যাঁর, উত্তর তাঁকেই দিও—বুঝে দিও। বল, মাসীমা রাজি হ’লে তুমি অসম্মত নও”—বলিয়া সে সাদরে অমিয়াকে জড়াইয়া ধরিল।
মীনার আলিঙ্গন-পাশ হইতে নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া সে কেবল নত হইয়া তাহার পা ছুঁইয়া প্রণাম করিল।
বয়সে সামান্য কিছু ছোট হইলেও, এপর্য্যন্ত সে মীনাকে কোনদিন প্রণাম করে নাই। আজ প্রণাম করিয়া, তাহার দেওয়া সম্বন্ধের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়া লইল কি না বুঝা গেল না। কেবল হাসিয়া কহিল—“ফিরে গিয়ে ঘটক-আফিসে তোমার ঠিকানাটা পাঠিয়ে দেব আগেই। ঘটকালিটি বেশ শিখেচ দেখ্চি। পেশাদার ঘটকদের চাইতেও বেশী। এক্ষেত্রে কিন্তু ওটা কেঁচে গেল। বুঝ্লে?”
“বুঝেছি”—আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাসটা অনেকখানি অমিয়াকে আদর করিয়া শমিত করিয়া লইয়া মীনা হাসিমুখে কহিল—“এবারকার কাজটা কিন্তু ভাগে, বাহাদুরি সবখানিই আমার প্রাপ্য নয়। এ কথা অস্বীকার না কল্লে প্রত্যবায়ভাগী হ’তে হবে। বিদায়টা কিন্তু নগদে চাই—ধারে কারবার আর কর্ব না। তুমি বাক্স গোছাও, আমি ততক্ষণ ওদিকের ঘরটা একবার দৌড়ে ঘুরে আসি ভাই”—বলিয়া হাসিয়া সে ছুটিয়া ঘরের বাহির হইয়া গেল। আকণ্ঠ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া, বিপন্ন বিব্রতভাবে অমিয়া তাহাকে কাজের ছুতায় আট্কাইবার চেষ্টা করিয়াও সফল হইল না। সে কেবল মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া কহিল—“শুধু ঘট্কালী নয় ভাই, ডাক্তারিও যে শিখ্চি এখন। রোগীর অবস্থা যে রকম কাহিল দেখে এসেচি, তাতে দেরী করে শেষে কি মানুষ খুনের মামলায় পড়্ব? রাগ কোর না ভাই, আমি এর পর সারাক্ষণটাই তোমার কাছে কাটাব। মানুষের মনটা ভারী বদ্। যেমন দুর্ব্বল, তেম্নি চঞ্চল, শুভবুদ্ধিকে তাই চট্ করে বেঁধে ফেলাই সদ যুক্তি।”
অমিয়ার মুখের পানে চাহিয়া তাহার মনের দোলায়িত অবস্থাটি বুঝিয়া লইতে বুদ্ধিমতী মীনার বিলম্ব হয় নাই। সে তাই বিষয়টিকে পাকা করিয়া ফেলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এ ভার সে রণেন্দ্রকে লইতে দিতে সাহস করে নাই—পাছে সে আনাড়ীর মত আরম্ভেই খেলা কাঁচাইয়া বসে! সে বেচারী যখন হার মানিয়াই লইয়াছে, তখন তাহাকে লইয়া আর খেলাইয়া ফল কি? একেই ত দেশ ছাড়িয়া সে তাহার নূতন ব্যবসায়ের কার্য্যে বিদেশে যাইতেছে, কেবল মীনার কাছে কোন গোপন আশার আশ্বাসবাণী পাইয়াই না যাওয়া স্থগিত রাখিয়াছে। এ সময় তাহার মানসিক গোলযোগের কালে আর অকারণ ভাবনা বাড়াইয়া দুঃখ দিয়া লাভ কি? স্নেহপাত্রকে প্রকৃত দুঃখ পাইতে দেখিলে নিজেও যে সুখী হওয়া যায় না, মীনা তাহা ভালই বুঝে।