স্রোতের গতি/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দোটানায়
সে রাত্রে অমিয়ার একটুও সুনিদ্রা হইল না। বিছানার মধ্যে অন্ধকারের আশ্রয়ে রণেন্দ্রেরে সহাস্য উজ্জ্বল মুখচ্ছবি কেবলি থাকিয়া থাকিয়া তাহার মনোদর্পণে ভাসিয়া উঠিতে ছিল। আজ বিদায়ক্ষণের সেই সুগভীর স্নেহভরা দৃষ্টি; সে দৃষ্টিতে সে কি দেখিয়াছিল তাহা যেন অনুভবের অতীত বলিয়াই তাহার মনে হইতেছিল। পৌঁছাইয়া দিবার জন্য তিনি বাগান পর্য্যন্ত সঙ্গে আসিয়াছিলেন, অমিয়া তখন লজ্জায় মানা করিতে পারে নাই। কিন্তু এখন মনে হইতেছিল ‘প্রয়োজন নাই’ বলিলেই বোধ হয় ভাল হইত। বিদায়কালে কেনই বা আর এ ভদ্রতার আদান-প্রদান! রণেন্দ্র তাঁহার নূতন কার্য্যক্ষেত্র বোম্বাই চলিয়া যাইবেন; হয় ত অমিয়ার জীবন-পথে তাঁহার ছায়াটিও আর কখনো পতিত হইবে না। তাহার কথা হয় ত তিনি চিরদিনের জন্যই ভুলিয়া যাইবেন। কেনই বা তা না যাইবেন? পথের এ দু’দিনের পরিচয়—কিসের বলে চিরদিনের স্মৃতিতে তাহাকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবে? নির্ব্বোধের ন্যায় সেই বা এমন আশাকে প্রশ্রয় দিবে কেন?
অমিয়া মনে করিতে চাহিল রণেন্দ্র তাহাকে ভূলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এ চিন্তায় সে সুখী হইতে পারিল না। তাহার মনে পড়িল—এমন একটা জিনিষ সে আজ রণেন্দ্রের জন্য রাখিয়া আসিয়াছে, যাহা কিছুতেই তাহার করা উচিত ছিল না। অবশ্য ভ্রমক্রমেই এটা ঘটিয়া গিয়াছে। মীনার জন্য আহরিত ফুলের তোড়াটি সে রণেন্দ্রেরে ফুলদানীতে সাজাইয়া দিয়া আসিয়াছে। তাহার এ অনিচ্ছাকৃত দানের খবর ত তিনি বুঝিতে পারিবেন না! হয়ত মনে করিবেন, সে উপযাচিকা হইয়া তাঁহার মনস্তুষ্টির জন্যই সেটি দিতে গিয়াছিল। ছিঃ ছি—কি ভোলা মন তাহার! তবু সেই আত্মধিক্কারের মধ্যে আত্মতৃপ্তির একটুখানি গোপন-আনন্দ সে মনের কাছে যেন লুকাইতে চেষ্টা করিতেছিল। আচ্ছা, ফুলটা তিনি যখন দেখিতে পাইবেন—কি ভাবে গ্রহণ করিবেন? খুসী হইবেন? তিনি পুষ্পভক্ত— খুসী হইবেন নিশ্চয়। ফুলটা ফুলদানীতেই থাকিবে বোধ হয়, অথবা আচ্ছা, যদি মনে করেন সেটা মালীরাই রাখিয়া গিয়াছে? আঃ! তাহা হইলে ত বাঁচা যায়। কিন্তু এ কি! এ সব কথা সে কেন ভাবিয়া মরিতেছে? এ ত তাহার চিন্তার বিষয় নহে! স্বাস্থ্যের উন্নতি-কামনায় আসিয়া সে কি তবে আত্মার অবনতি করিয়া বসিল না কি? এ ত তাহার গন্তব্য-পথ নহে? দিগ্ভ্রান্তের ন্যায় সে এ কি অজান রহস্যময় অপরিচিত অনভিপ্রেত পথে যাত্রা শুরু করিয়া দিল?
অমিয়া ভাবিয়া দেখিল, মানুষের এই যে দুর্ব্বলতা, লোকে যাহাকে বলে প্রেম, ইহাকে সে চিরদিন ঘৃণা করিয়া আসিয়াছে। সৃষ্টির আদিকাল হইতে নর এবং নারীর এই যে আকর্ষণ বিপ্রকর্ষণ বিরহ ও মিলন—ইহার বিবরণ সে কাব্যে উপন্যাসে যথেষ্টই পাঠ করিয়াছে। সংসারীজীবনে ইহার গতি লক্ষ্য করিয়াছে। এ বিষয়ে চিন্তা করিয়া, বিচার করিয়া, বহু গবেষণার ফলে একটা সিদ্ধান্তও সে করিয়া রাখিয়াছে—কেবল ইহার প্রয়োজনীয়তা বা সার্থকতাই স্বীকার করে নাই। সে জানিত, এগুলি কাব্য উপন্যাসের রমণীয় উপাদান হইলেও, বাস্তবজীবনে অপ্রয়োজনীয়। শুধু অপ্রয়োজনীয় নহে—ত্যজ্য। অত্যন্ত দুর্ব্বলচিত্ত সাধারণ নর-নারীদেরই ইহা নিজস্ব। সে কি আজ জানিয়া শুনিয়া অন্ধের মত, অজ্ঞের মত তাহার জীবন-নদীর গতি সেই ফেনিল ঘূর্ণ্যাবর্ত্তের মধ্যেই তবে মিশাইতে চলিয়াছে না কি? সে ত ইহা কোনও দিন কামনা করে নাই! তবে এমন ভ্রম করিল কেন? সত্যই কি সে তবে রণেন্দ্রকে ভালবাসিয়াছে? ছিঃ ছিঃ কি নির্লজ্জ সে! রণেন্দ্র তাহার কে? আত্মীয়, বন্ধু—এমন কি—এক পথের বা মতের যাত্রী পর্য্যন্ত নহেন তিনি। ইঁহাকেই সে কি না ভালবাসিল! ডুবিয়া মরিবার দড়ি কলসীও কি তাহার জুটিল না?
মনোভাবের এই অস্পষ্ট ইঙ্গিতে অমিয়া নিজেকে সহস্রবার ধিক্কার দিল। নিজ অপরাধের সে যেন সীমা খুঁজিয়া পাইতেছিল না। কেন সে তাহার নির্জ্জন মনোদুর্গে রণেন্দ্রকে প্রবেশের অনুমতি দিয়াছিল? দিয়াছিল ত সতর্ক থাকে নাই কেন? সে যখন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করিতে চাহিয়াছিল, তখন ত ভাবিয়া দেখে নাই যে, পরাজয়েই সে জয়ী হইয়া বসিবে।
অন্ধকারে সে তাহার প্রবাসিনী মাসীমার মুখখানি মনে করিতে চেষ্টা করিল। দেখিল—এই তিন মাসের ব্যবধানে সে মুখের ছবি যেন অনেকখানি অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। সেই অস্পষ্ট ছবিখানার পশ্চাতে এ কার উজ্জ্বল মূর্ত্তি— সহাস্য স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে? এ মুখে বিরক্তি বিদ্বেষের চিহ্ন কোথায়? এ চক্ষু যেন বলিতেছে— পৃথিবী কেবল ভালবাসিবার স্থান। কিন্তু ইহার চিন্তাকেও সে আর মনের মধ্যে প্রশ্রয় দিবে না ত—কিছুতে, কোন মতে না!
অমিয়া বিছানার উপর বসিয়া প্রার্থনার ভাবে মনে মনে কহিল—“আমার কর্ত্তব্য, আমার প্রার্থনা, আমি যেন ভুলিয়া না যাই। হে ভগবান! স্বর্ণমৃগের প্রলোভনে ভুলিয়া আমার মন যেন দিগ্ভ্রান্ত হইয়া না পড়ে। প্রভু, আমায় বল দাও।”
প্রার্থনা শেষে সে যেন অনেকখানি শান্তি অনুভব করিল। তবু অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতে তাহার চোখের জল ঝরিয়া পড়িল। মনে হইল—কর্ত্তব্যের কাছে সে যেন তাহার অনেক কিছুই বলি দিল।
ভোরের দিকে ঘুমাইয়া সে স্বপ্ন দেখিল। দেখিল, জাহাজে চড়িয়া রণেন্দ্র যেন কোথায় চলিয়া যাইতেছেন, সে যেন বিদায় দিতে গিয়াছে। রণেন্দ্র অভ্যস্ত মিষ্ট হাসির সহিত চোখের জল মিশাইয়া যেন বলিতেছেন—“বিদায়—বন্ধু—বিদায় তোমার কাছে চিরদিনের জন্যই বিদায়।” জল কাটিয়া সফেন তরঙ্গদল দলিত করিয়া ক্রমেই যেন জাহাজখানি অস্পষ্ট হইতে হইতে দিগন্তে মিশাইয়া গেল। কেবল কাণে বাজিতে লাগিল—রণেন্দ্রর সেই অশ্রুজড়িত হাসিমাখা কণ্ঠের ধ্বনি “বিদায়—বিদায়!”
ঘুম ভাঙ্গিয়া চোখ মেলিয়া তাকাইয়া সে দেখিল, খোলা খড়খড়ির ফাঁকে ফাঁকে রোদের আলো আসিয়া ঘর ভরাইয়া দিয়াছে। বাহিরে সকাল-বেলার পাখীর গান থামিয়া গিয়া কৃষাণ-বালকের বেসুরা গানের মিঠে আওয়াজের সহিত গরুর গাড়ীর শব্দ হাটের দিন জানাইয়া দিতেছে। অমিয়া হাত দিয়া দেখিল, মাথার বালিসটা তাহার চোখের জলে ভিজিয়া গিয়াছে।
সে লজ্জিতমুখে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল। দিনের আলো ও বাতাস, রাত্রের দুর্ব্বলতাগুলাকে স্বপ্নের মত ভুলাইয়া দেয়। লঘুচিত্তে সে ঘরের বাহির হইল। মনে করিল, রণেন্দ্রকে ভয় করিবার তাহার কোনই প্রয়োজন নাই। তিনি যখন দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছেন, আর সেও যখন এ দেশের অধিবাসী নহে, তখন যে দু’দিন একসঙ্গে রহিয়াছে, ভদ্রতার আদানপ্রদানে ক্ষতিই বা কি এমন? যাঁহার দয়ায় অপমৃত্যু হইতে রক্ষা পাইল, তাঁহাকে বন্ধু মনে না করিলে অকৃতজ্ঞ হইতে হয় যে! মানুষের পরস্পরের সহিত সন্ধি করিয়া চলাই ভাল— বিদ্রোহ বিবাদের প্রয়োজনই বা কি? দুর্ভাগ্য দেশে সাম্প্রদায়িক দলাদলির ত অভাব নাই। ইহার উপর আর নূতন দল সৃষ্টি করায় লাভই বা কি এমন? তাহাদের সভার এবারকার অধিবেশনে “পুরুষদের সহিত সম অধিকার” সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশে এবার একটু আধ্টু মনে হইল —পরিবর্ত্তন করা প্রয়োজন হইবে—অমিয়া মনে মনে ইহার একটা খস্ড়াও করিয়া রাখিল।
সে রাত্রিটি রণেন্দ্রেরে কি ভাবে কাটিয়াছিল, আমরা তাহার সঠিক বিবরণ অবগত নহি—মানুষটি ভারি চাপা কি না। তবে অমিয়ার পরিত্যক্ত পুষ্পগুচ্ছটি যে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত তাহার বিছানায় থাকিয়া পুনরায় ফুলদানিতে আশ্রয় লাভ করিয়াছিল, তাহার বিশ্বস্ত প্রমাণ আমরা পাইয়াছি; তা ছাড়া আরও একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল। অমিয়ার বিদায়ের দিন নিকটবর্ত্তী হইলে, মীনার নিভৃত প্রশ্নে আকর্ণলজ্জায় রাঙ্গা হইয়া সে এমন কোন কথা স্বীকার করিয়াছিল, যাহা শুনিয়া মীনা বলিয়াছিল, পৃথিবীতে এত বড় আশ্চর্য্য ঘটনা যে ঘটিতে পারে, ইতঃপূর্ব্বে তাহার সে ধারণাও ছিল না! সে কথা যথাসময়ে প্রকাশ পাইবে।