স্রোতের গতি/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

মীনার দুষ্টামি

খোকা চুপ করিয়া বিছানায় পড়িয়াছিল। চোখ মেলিয়া তাকাইতেছিল না—কেমন নির্জ্জীব ভাব। অমিয়া রণেন্দ্রের পানে চাহিয়া ব্যাকুল স্বরে কহিল—“খোকা যে ভারী দুর্ব্বল হয়ে পড়্‌ল!”

 রণেন্দ্র কাছে আসিয়া ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া কহিল—“ভয় নেই, ভালই আছে। খালি দুর্ব্বল—ফুডের সঙ্গে ফোঁটাকতক ব্রাণ্ডি দিলেই ও ভাবটা সেরে যাবে” বলিয়া আস্তে আস্তে ঘরের বাহির হইবার ইচ্ছায় অগ্রসর হইতেই অমিয়া কাতর অনুনয়ের সুরে পুনরায় কহিল—“একবার ডাক্তারকে খবর দিলে হত না? খেতেও যে পাচ্ছে না কিছু!”

 রণেন্দ্র ফিরিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া তাহার উদ্বেগব্যাকুল মুখের পানে চাহিয়া, যেন সান্ত্বনা দিবার ভাষা খুঁজিয়া পাইতেছিল না। তবু সহজ সুরেই কহিল—“কেন ভয় পাচ্চেন? হঠাৎ জ্বরটা ছাড়ায় অমন কাহিল হয়ে পড়েছে, ভয়ের কোন কারণই ত নেই?” বলিয়া সে বাহিরে না গিয়া, একখানা ডাক্তারী বই খুলিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল। অমিয়া যে একান্ত নির্ভরে আজ তাহার কাছেই সাহায্য চাহিতেছে, ইহা সে মনে মনে বেশ বুঝিতেছিল। তবু আশ্চর্য্য এই—আজ আর সেই পুরুষ-বিদ্বেষিণী স্বাধীনতা প্রয়াসিনী অহঙ্কৃতা নারীর পরাজয়স্বীকারে বিজয়-গর্ব্ব অনুভবের পরিবর্ত্তে, সে যেন তাহার ব্যথার অংশটুকুই কেবল মনের ভিতর অনুভব করিতেছিল।

 খোকা যেমন আরোগ্যের পথে দ্রুত অগ্রসর হইতেছিল, রণেন্দ্রও সেই অনুপাতে নিজকে তাহার সঙ্গবিচ্যুত করিয়া লইতেছিল। এখন ডাকিয়া না পাঠাইলে সে আর বাড়ীর ভিতর প্রায় আসে না। আসিলেও মন খুলিয়া কাহারও সহিত কথা কহে না। মীনার সহিত যাহা লইয়া তাহার নিত্যকার বিবাদ ছিল, সেই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব লইয়া এখন আর কোন তর্ক উঠে না। মীনা তুলিলেও সে এড়াইয়া যায়।

 সে যেন চেষ্টা করিয়া নিজেকে সুদূর গণ্ডীর ভিতর বদ্ধ করিয়া রাখিতেছিল। তবু মন যে তাহার স্বচ্ছন্দ নহে— তাহা গোপনতার প্রয়াসেই প্রকাশ হইতেছিল। অমিয়ার সহিত খোকার সম্বন্ধে যদিই কোন ডাক্তারি আলোচনার প্রয়োজন ঘটে, সে তাহা যথাসম্ভব সংক্ষেপে ও সম্ভ্রমের সহিত সারিয়া লয়। মীনার সঙ্গে আজকাল আর কৃত্রিম কলহের তাহার অবকাশই মিলে না। মীনা তাহার নির্লিপ্ত দূরত্বে রাগ করিলে গম্ভীর মুখে বলে—“দাদার হিসেবপত্র দেখচি, সময় কোথা বলুন গল্প কর্‌বার?” প্রাণতোষবাবু কিন্তু একদিন মীনাকে চুপি চুপি বলিয়াছিলেন—“রণেন্‌কে দিয়ে আজকাল যদি কোন কাজ পাওয়া যায়। দেড় হপ্তা হল একটা হিসেব চেক কর্‌তে দিয়েছি, আজও তা শেষ হল না। কি করে বল দেখি সারাক্ষণ? সর্ব্বদাই কেমন অন্যমনস্কভাব।” মীনা হাসিয়া স্বামীকে জবাব দিয়াছিল— “আমি কি ‘স্পাই’—যে তোমার ভাইয়ের কাজের উপর চৌকী দেব?”

 আমরা কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হইয়াছি যে, এই নিন্দনীয় অসৎ কর্ম্মটিই সে আজকাল অনেক সময় গোপনে সম্পাদন করিয়া থাকে। রণেন্দ্রের অনুপস্থিতির সুযোগে সে তাহার খাতাপত্র বই কাগজগুলি নাড়াচাড়া করিয়া দেখে নিজের অনুকুলে কোন গোপন রহস্য সেখানে আবিষ্কার করিতে পারা যায় কি না। সে কেতাবে পড়িয়াছে প্রণয়ীরা বইয়ের মলাটে, খাতাপত্রে মনের ভাব লিখিয়া রাখে। অনেক সময় অকারণে তাহার মনে আঘাত দিয়া সে যেন অমিয়ার উপর তাহার মনের ভাবটুকু বাহির করিয়া লইবারও প্রয়াস পায়।

 একদিন কাছে পাইয়া সে রণেন্দ্রকে ধরিয়া বসিল— “ঠাকুরপো, তুমি যে হঠাৎ এমন দুর্ল্লভ হ’য়ে উঠ্‌লে— ব্যাপারখানা কি বল দেখি?”

 অমিয়া আসিয়া পড়ায় রণেন্দ্রেরে মুখ কাণ সমস্তই রাঙ্গা হইয়া উঠিল। মীনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছে সে যে নিজেকে লুকাইতে পারে নাই তাহা বুঝিয়াও কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ ভরিয়া কহিল—“সুলভ ছিলেম তা হলে বলুন। আশ্চর্য্য! আমি কিন্তু চিরদিনই এর উল্টো কথা শুনে আস্‌চি আপনার মুখে। আপনার উদ্ভাবনী শক্তির চেয়ে বিস্মরণী শক্তিই প্রশংসনীয়—সন্দেহ নেই” বলিয়া পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতে মীনা কহিল—“সব কথা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিলেই ত আর উড়্‌বে না! সেদিন তোমার সঙ্গে ঝরণা দেখ্‌তে যাবার কথা বলায় অমিয়া বল্লে—‘তিনি কি যাবেন? তিনি ত এদিকেই আর ঘেঁসেন না’—জিজ্ঞাসা কর না ঐ ভদ্রলোককে—উনি আর মিথ্যে সাক্ষী দেবেন না?” বলিয়া দ্বার সমীপাগত অমিয়ার পানে চাহিয়া সে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।

 খোথোকার খোঁজে আসিয়া রণেন্দ্রকে দেখিয়া অমিয়া ফিরিয়া যাইবে কি না তাহাই ইতস্ততঃ করিতেছিল। সে তাহাদের আলোচনা শুনিতে পায় নাই। মীনার আহ্বানে ভিতরে আসিলে রণেন্দ্র একটুখানি হাসিল। সে হাসিতে উত্তাপ ছিল না—ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ছিল না। তৃপ্তির স্নিগ্ধ মধুর হাসি! অমিয় যে তাহার সঙ্গ চাহিয়াছিল, তাহার অভাব অনুভব করিয়াছিল, ইহারই আনন্দ হয়ত সে হাসির ভিতর প্রচ্ছন্ন হইয়াছিল। সে হাসিটুকু মীনার মনে অন্ততঃ এই অর্থ ই জানাইল। অমিয়ার হাতে একটি গোলাপ ফুল ছিল। ফুলটি খোকার কাছে ধরিয়া সে তাহাকে প্রলোভিত করিতেছিল।

 মীনা সহসা পুরাতন প্রসঙ্গ তুলিয়া কহিল—“খোকার অসুখে তখন সব কথা চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেদিন রাত্রে অমিয়া তোমাকে কি বিপদেই ফেলেছিল—আমি এখন কেবল সেই কথাই ভাব্‌চি। জলের উপর বেচারী যখন অজ্ঞান হয়ে পড়্‌ল, তখন তোমাকে আচ্ছা নাকালই হতে হয়েছিল ত? অবশ্য তোমার সঙ্গে অবস্থা বদল কর্‌তে পেলে তখন অনেকে হয়ত ভাগ্য মনে কর্‌তে পারত। কিন্তু আমাদের জাতটা যে দয়ারও যোগ্য নয় এই না তোমার ভাষ্য”?

 মীনার এই অতর্কিত নিষ্ঠুর আক্রমণের জন্য কেহই প্রস্তুত ছিল না। রণেন্দ্র লজ্জিত ও অপ্রতিভের ভাবে অমিয়ার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল; তাহার মুখখানি ছাইয়ের মত বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। সে অনুতপ্তভাবে কহিল—“এ আপনার বাড়িয়ে বলা বৌঠাকরুণ আমি ঠিক্ সে কথা বলিনি। যাঁরা আমাদের সাহায্য চান্— আমাদের সবল বাহু আনন্দের সঙ্গেই তাঁদের সাহায্য কর্‌তে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু যাঁদের মনের বল বেশী, আমাদের সাহায্য ত তাঁদের দরকার হয় না?”

 কথা-শেষে সে আর একবার অমিয়ার দিকে চাহিল— মুখখানি ভাল দেখা গেল না। আলোর দিকে আড়াল করিয়া সে তখন খোকার জামার বোতামে গোলাপ-ফুলটি পরাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছিল। খোকাও পরাইতে দিবে না, হাতে লইবে—সেও হাতে দিবে না, বোতামে লাগাইবে। কাজেই দুই জনে ছোটখাট একটু যুদ্ধ বাধিয়া উঠিয়াছে। মীনা কহিল—“এত ছেলেমানুষিও তোমার আসে ভাই! ঐ জন্যেই ত ছেলের মার চেয়ে ভাল হয়েচেন মাসী। কিন্তু ঠাকুরপো, তোমরা ফিলজফারের দল—ওর চুম্বকার্থ যাই বিশ্লেষণ করে বার ক’র, আমাদের সরল বাঙ্গলায় আমরা ত বুঝি—‘যারে বলে চালভাজা তারেই বলে মুড়ি’—কি বল ভাই অমিয়া?” বলিয়া সে অমিয়ার পানে হাসিয়া চাহিল।

 “খোকার দুধ খাবার সময় যে পেরিয়ে গেল, ওর কি ক্ষিধেও নেই আজ?” বলিয়া অমিয়া খোকাকে কোলে তুলিয়া লইয়া ঘরের বাহির হইয়া গেল।

 রণেন্দ্রেরে নিষ্ঠুরতার আঘাতে সে যে কতখানি বেদনা পাইয়া গেল অথবা পাইল কি না, তাহা বোঝা গেল না। কিন্তু রণেন্দ্রেরে অনুতপ্ত মনের ব্যথা আত্ম-হৃদয়ে অনুভব করিয়া, তাহার বিষন্ন মুখের পানে চাহিয়া মীনার নিজের উপর রাগ ধরিতেছিল। এ সময় এ কথা না তুলিলেই ভাল ছিল। কিন্তু হাতের ঢিল একবার ছুঁড়িয়া মারিলে আর ত তাহাকে ফিরাইয়া লওয়া যায় না? প্রায় সমবয়সী এই দেবরটিকে সে যথার্থ ভালবাসিত। তাহার নারী-বিদ্বেষে তাই রাগ না করিয়া কৌতুকই অনুভব করিত। প্রাণতোষ বাবু ভাইয়ের বিবাহের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করিলে সে নিরুদ্বিগ্নভাবে কহিত—“দরকার পড়্‌লেই মত বদ্‌লে যাবে—ভাইটি তোমার ভীষ্মদেব নন্ গো, সে ভয় নেই।” তাহার বিশ্বাস—মানুষ চিরদিন অবস্থার সহিত সন্ধি করিয়া চলিতে বাধ্য। প্রকৃতির নিকট পরাজয় স্বীকার করান’ কেবল পাত্র নহে—স্থান ও কালের সাপেক্ষ। ইক্ষুদণ্ডকে পিষ্ট করিয়া তাহার মিষ্ট রস বাহির করিতে গেলে তাহাকে ব্যথা দেওয়া যে অনিবার্য্য, কেবল এইটুকুই সে ভুলিয়া গিয়াছিল।