স্রোতের গতি/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
খোকার পীড়া
পরদিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গিয়া গায়ের ব্যথায় অমিয়া বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারিল না। তিন ঘণ্টা জলের উপর মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকা যে মরণের চেয়ে কম কষ্ট নহে, তাহা সেইদিন সে অনুভব করিয়াছে। কঠিন মৃত্তিকার দেওয়ালের উপর দিয়া গড়াইয়া পড়ায়, পিঠে কোমরে বেদনাও বেশ হইয়াছিল। কিন্তু শুইয়া থাকিয়াই যখন সে পার্ব্বতীর কাছে খোকার খবর লইয়া শুনিল, রাত্রে তাহার ভারী জ্বর আসিয়াছে এবং এখন পর্য্যন্ত সমভাবেই আছে, তখন বিছানায় নিশ্চেষ্টভাবে পড়িয়া থাকা আর সম্ভব হইল না। খোকাকে সত্যই সে বড় ভাল বাসিয়াছিল। নারী চিরদিনই নারী। বাহিরে নিজেকে সে যতখানি কঠিন করিয়া তুলিতে চেষ্টা করুক্—শিক্ষাতাহাকে যে পথেই চালিত করুক্—তবু তার অন্তরের গোপন অংশে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার লইয়া যে সেবা-পরায়ণা নারী-হৃদয়ে বাস করিতেছিল, তাহাকে সে অন্তরের বাহির করিয়া দিতে সমর্থ হয় নাই। সেই ক্ষুদ্র শিশুর স্নেহপাশে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে নিজেকে সে যে এমনভাবে বন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে, তাহা সে কখন কল্পনাও করিতে পারে নাই। খোকার পীড়ার সংবাদ পাইয়াই আচম্কা প্রথমেই তাহার মনে হইল—‘সর্ব্বনাশ! পীড়া যদি বেশী হয়! খোকা যদি না বাঁচে।’ নিজের এই হীন আশঙ্কায় নিজের প্রতিই সে মনে মনে বিরক্ত হইতেছিল। ছি ছি—এত দুর্ব্বলচিত্ত সে? তবু ভয় কমিতেছিল না।
পার্ব্বতী বলিল—“বাবু সহর থেকে ডাক্তার আন্তে গিয়েচেন। কাকাবাবু বল্চেন জ্বরটি সোজা নয়, বাঁকা পথে যাবে।” তবে? অমিয়া ভাবিয়া পাইল না যে খোকার অসুখের সংবাদে সে এত ব্যাকুল হইতেছেই বা কেন? সংসারে ত অনেক খোকারই অসুখ হইয়াছে, কৈ, সে ত তাহাদের জন্য এতটুকুও ব্যস্ত হয় নাই। মনের এই দুর্ব্বলতাটিকে প্রশ্রয় দিবে না বলিয়াই সে আজ চেষ্টা করিয়া অনেক বিলম্বে খোকাকে দেখিতে গেল। কিন্তু মনের কাছে এ ছলনা সে বেশীদিন রাখিতে পারিল না। খোকার রোগের গতি ক্রমেই যেন বাঁকা পথে চলিতেছিল। বাড়ীর লোকে ভয় পাইলেন।
খোকার অসুখের সময় তাহার সান্নিধ্য ছাড়িয়া দূরে দূরে থাকা অমিয়ার পক্ষে যে কতখানি কষ্টকর, তাহা সেই যে কেবল বুঝিতেছিল এমন নহে—মীনাও তাহা সর্ব্বান্তঃকরণে অনুভব করিতেছিল। তাই প্রথমে এদিকটা কেন ভাবিয়া দেখে নাই বলিয়া নিজেরই তাহার লজ্জা বোধ হইতেছিল। এক সময় কাজের ছুতায় বাহিরে গিয়া সে অমিয়াকে খোকার কাছে পাঠাইয়া দিল। এবং পরেও তাহাকে আর সে কাজে ছুটি দিল না; কহিল—“ছেলে নিয়ে আটকে বসে থাকলে কি আমার চলে ভাই? ও তোমার ছেলে তুমিই ওকে দেখ।”
তৃষ্ণার্ত্তকে শীতল জলাশয় দেখাইয়া দিলে সে তাহার সান্নিধ্য ছাড়িয়া যাইতে চাহে না। অমিয়া তাহার স্নেহাধারের পার্শ্বে যে অচল আসন পাতিয়া বসিল, সেখান হইতে উঠিবার কথা তাহার যেন আর মনেই পড়িল না। নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতীত সে একবারও স্বেচ্ছায় খোকাকে ছাড়িয়া যাইত না। ইহাতে প্রথম প্রথম রণেন্দ্রের কিছু অসুবিধা হইতেছিল। তবু সঙ্কোচ ঠেলিয়া অনেক সময়ই তাহাকে সেখানে উপস্থিত থাকিতে হইত। অমিয়ার গায়ে পড়িয়া সেবার ভার লওয়া প্রথম দৃষ্টিতে তাহার অপ্রীতি আনিয়াছিল। কিন্তু সেবিকা যে কতখানি আন্তরিকতার সহিত রোগীর প্রতি মনোযোগিনী, তাহা অনুভব করিতেও তাহার অধিক বিলম্ব হয় নাই। সন্দেহ হইত—মীনাও হয় ত এমন নিপুণতার সহিত রোগীর সেবা করিতে পারিত না। অমিয়ার প্রতি একটুখানি সম্ভ্রমের সহিত রণেন্দ্রর মনে তাই অনেক খানি বিস্ময়েরও সঞ্চার হইতেছিল। এই মেয়েটিকে সে কি তবে এতদিন সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়া অবিচার করিয়া আসিতেছে? কয়দিনের অনাহার অনিদ্রা, দুশ্চিন্তায় তাহার শুষ্ক কৃশমুখে যে মাতৃমূর্ত্তি ফুটিয়াছিল, তাহাকে যে অশ্রদ্ধা বা অস্বীকার করা যায় না—ইহা সে মনের কাছে স্বীকার না করিয়া পারিল না।
বিছানার দুই পাশে বসিয়া এই দুইটি সম্পূর্ণ বিরুদ্ধমতের নরনারী যখন সেই একখানি যন্ত্রণাকাতর মুখের পানে চাহিয়া সমান ব্যাকুলতায়, তাহার যন্ত্রণা নিবারণের প্রয়াস পাইত—তাহার এতটুকু কণ্ঠস্বরে—একটুখানি অবস্থা পরিবর্ত্তনে সমান উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিত, তখন বাহিরের কোন লোক দেখিলে মনে করিতে পারিত না যে ইহাদের পরস্পরের মধ্যে মতের এতটুকুও অনৈক্য থাকিতে পারে। হয় ত ভাবের উত্তেজনায় সমান স্বার্থে তাহারাও নিজেদের চিরদিনের বিদ্বেষ তখনকার মত ভুলিয়া গিয়া থাকিবে। অনেক সময় পালা করিয়া তাহাদের খোকার কাছে থাকিতে হয়—সে সময় অমিয়ার তুলনায় শিশুর সেবায় নিজের অপটুত্ব রণেন্দ্র পদে পদেই অনুভব করিয়া থাকে। গ্রামে ডাক্তার নাই; দূরান্তর সহর হইতে ডাক্তার আনিতে হয়। ডাক্তারের আদেশ মীনাকে জানাইতে গেলে সে স্বচ্ছন্দে অমিয়াকে নির্দ্দেশ করিয়া বলে—“আমায় কেন ও সব, শেষ কি এক কর্তে আর করে বস্ব? ওঁকে বলুন।” অমিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সমস্ত শুনিয়া লয় এবং এমনি স্নেহের সহিত যথাকর্ত্তব্য সম্পন্ন করে যে, রণেন্দ্র আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া মনে ভাবে—‘অমিয়া না থাকিলে খোকার সেবাযত্ন কেমন করিয়াই না জানি চলিত!’ কিন্তু এই একান্ত ঘনিষ্ঠতার ফলে তাহারা যে পরস্পরে মনের মধ্যেও কতখানি কাছাকাছি আসিয়া পড়িতেছিল—সে সংবাদ তাহারা মোটেই জানিতে পারে নাই।
এমন সময় প্রাণতোষ বাবুর ক্ষেতের কাজ পড়িয়াছে, সহরে জিনিষ চালান দেওয়া হইতেছিল। পূর্ব্ব হইতে বন্দোবস্ত করিয়া মাল পাঠাইবার গাড়ী ভাড়া করা হইয়াছে। চালান বন্ধ রাখিলে এ বৎসর আর গাড়ী পাওয়া যাইবে না; সারা বৎসরের একান্ত পরিশ্রমের ফল নষ্ট হইয়া যাইবে। তিনি কাজের মানুষ। কাজকে উপেক্ষা করা তাঁহার স্বভাবও নহে। তা ছাড়া আর একটা কারণ ছিল—রণেন্দ্র ও অমিয়া যেভাবে তাঁহার ছেলের ভার লইয়াছিল, তাহাতে তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজনও সেখানে ছিল না। সেখানে দখল লইতে গেলে এই দুইটি একনিষ্ঠ সেবাব্রতধারী তরুণ তরুণীর মনের উপরও হয়ত অলক্ষ্যে দাবীদারের কঠিন হস্তের স্পর্শ লাগিয়া অন্যায় হইতে পারে। তাই বাপ মা সসঙ্কোচে দূরে দূরেই থাকিতে চেষ্টা করিতেন। হয় ত মনের গোপন প্রান্ত হইতে সেই সঙ্গে একটা লুব্ধ আশার বাণীও শুনিতে পাইতেন—তাঁহাদের ভাগ্যে ছেলে যদি নাই বাঁচে উহাদের পুণ্যেও কি রক্ষা পাইবে না?