স্রোতের গতি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মিস্ চৌধুরীর ডাক্তারী
রাত্রে অমিয়ার জ্বর একশো পাঁচ ডিগ্রী উঠায়, সত্যবতী ভীত হইয়া ডাক্তারকে ডাকিতে পাঠাইলেন। পুরুষবিদ্বেষী সংসারে প্রাইভেট ডাক্তারের কার্য্য করিতেন মিস্ চৌধুরী। ডাক্তার কহিলেন—“জ্বরটা ইন্ফ্লুয়েঞ্জা! রেষ্ট নেওয়া ভারী দরকার। সময়টা বড়ই খারাপ প’ড়েচে কি না। ইন্ফ্লুয়েঞ্জা থেকে টপ্ করে নিউমোনিয়া হ’য়ে পড়্চে। আজ কাল আমরা তাই নিউমোনিয়া ধ’রেই চিকিৎসা করে থাকি। সে যাক্—তোমার কিন্তু তা মনে হ’চ্চে না। এই মিক্শ্চারটা লিখে দিচ্ছি, দু’ ঘণ্টা অন্তর বার-চারেক খাবে। কিন্তু আমি তোমায় বল্চি, তুমি ভাল ক’র্চ না অমিয়া। বাতি দুদিকে জ্বেলেচ, এত পরিশ্রম সইবে না ত তোমার। দিনকতক বিশ্রাম নাও। না হয় কোথাও একটু চেঞ্জে ঘুরে এস। খুব উপকার পাবে।”
অমিয়া মৃদু হাসিয়া, মাথার বালিসের নীচে হইতে ছোট নোটবুকখানি বাহির করিয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে কহিল—“তা ত হ’তে পারে না এখন—এই দেখুন না কতগুলি এন্গেজমেণ্ট র’য়েছে আমার এ মাসে। এই— সভারই য়্যানিভার্সারির সময় এসে গেল। নাঃ—কল্কাতা ছেড়ে এখন এক পাও আমার যাবার উপায় নেই।”
মিস্ চৌধুরী নিজেও স্বাধীনা নারী। জীবনযাত্রার জন্য এই শিক্ষিতা মেয়েটি এই পথই বাছিয়া লইয়াছিলেন, পুরুষদের সহিত সমকক্ষতা লইয়া বিবাদ ঘোষণার তাঁহার কোন প্রয়োজন হয় নাই। অমিয়ার কথায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া তাচ্ছীল্যের ভঙ্গীতে কহিলেন—“এঃ— হবে না আবার? খুব হবে! আমি বল্চি হবে। দু’মাস সহর ছেড়ে বাইরে গেলেই তোমার কুমারী-সভা ভেঙ্গে টুক্রো টুক্রো হ’য়ে প’ড়ে যাবে না গো? আর যাই যদি, তবে তা’কে ভাঙ্গতেই দাও। যাতে ভাঙ্গন ধ’রেচে, তাকে মাটী ফেলে ফেলে কাঁহাতক্ আর আটকে রাখবে?”
অমিয়া অপ্রতিভের ক্ষীণ হাসি হাসিয়া কহিল—“আচ্ছা ভেবে দেখি, সম্পাদিকা দার্জ্জিলিং যাচ্চেন, না হয় তাঁরই সঙ্গী হওয়া যাবে।”
মিস্ চৌধুরী বাধা দিবার ভাবে কহিলেন—“তবেই হ’য়েছে মনিকাঞ্চনযোগ! না না—অমন কাজটি কোরো না। তার সঙ্গে যাবার অর্থ—তোব্ড়া তুব্ড়ী খাতাপত্র ঘাড়ে ক’রে যাওয়া ত? তা হ’লে বিশ্রাম পাচ্চ কোথায়? তিনি না হয় নির্ব্বাণ-চিন্তায় ব্যাকুল হ’য়ে শরীরের উপর জুলুম চালাচ্চেন। সকলের ত তা ক’ল্লে চল্বে না। তোমরা ছেলেমানুষ, তোমাদের শরীর মন তাজা রাখা চাই, তবে না—ঘরে বাইরে কাজে লাগ্বে।”
সত্যবতী এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, এইবার অবকাশ বুঝিয়া কহিলেন—“যা বলেচ ভাই। ওঁর ধরণধারণ পোষাক আসাক দেখলে আমাদেরও অস্বস্তি লাগে। যেন পৃথিবীর সঙ্গে কোন খোঁজখবর নেই, পৃথিবীর মানুষই নন্। মাথার চুলগুলি ত বাবুইয়ের বাসা হয়ে উড়্চে। চিরুণী ছোঁয়ানও বোধ হয় নির্ব্বাণ-পথের বাধা! কিন্তু মানুষটা লেখে বড় সুন্দর। ঐ যে বৌদ্ধধর্মের কথাটথা গেল-মাসে ওঁদের কাগজে বেরিয়েছিল না, চমৎকার লিখেছিল, কি নামটা রে অমি?” বলিয়া অমিয়ার পানে কটাক্ষে চাহিয়া লইয়া পুনরায় মিস্ চৌধুরীর দিকে ফিরিয়া কহিলেন—“তা, তুমি ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে যা হয় ক’রে দাও ভাই। ওর চেহারা দেখে ভয়ে ত আমার মুখে অন্নজল যেতে চাইচে না। খেতে পারে না কিছু মাথার যন্ত্রণা ত চব্বিশ ঘণ্টা। এত বলি যে লেখাপড়ার কাজ দিন কতকের জন্যেও না হয় বন্ধ রাখ্—তা কথা কি শোনে, না গ্রাহ্য করে? ঐ এক বুলি—চল্বে না, সম্পাদিকা বেজার হবেন। এমন ক’ল্লে বাঁচ্বি কেমন কোরে বাপু?”
কথা-শেষের সঙ্গে সঙ্গে সত্যবতীর চোখেও জল আসিয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার দুঃখময় জীবনের একমাত্র আশাজ্যোতিঃ এইটুকুকে অবলম্বন করিয়াই—যে তাঁহার বাঁচিয়া থাকা।
মিস্ চৌধুরী তাঁহার স্থূল দেহখানি দুলাইয়া অবজ্ঞাভরে কহিলেন—“সম্পাদিকা বেজার হবে—ওঃ ভারী ত।— তোমায় জিরেন্ নিতে হবে। কোথায় যাবে বল দেখি? আচ্ছা দেখ—মিনার ওখানে যেতে পারত। এক্কেবারে সেকেলে জায়গা—চমৎকার স্বাস্থ্যকর, তোমার পক্ষে ঠিক্ উপযোগী হবে। আধুনিকতার গন্ধও সেখানে নেই। সত্যিকারের বিশ্রাম পাবে।”
অমিয়া কহিল,—“কিন্তু তাঁদের ওখানে সে মেয়েদের থাক্বার মত—”
“না গো লক্ষ্মি, স্যানিটেরিয়ম ট্যাম নেই কিছু সেখানে। তা হলই বা, তারা ভারী অতিথিপরায়ণ। বল্চি কি তবে, একেবারে পৌরাণিক—দেশটিও—দেশের মানুষগুলিও। আমার অবশ্য আপন জন,—সেজ্দির মেয়ে; গত বৎসর সেখানে গিয়ে দু’মাস যখন থেকে এলুম—ইচ্ছে হ’চ্ছিল না যে ফিরে আসি!”
সত্যবতী তাঁহার স্থূল দেহের প্রতি ইঙ্গিত করিয়া হাসিয়া কহিলেন—“তা মিথ্যে বলনি ভাই, দেহখানি যা গ’ড়ে এনেচ, একেবারে পৌরাণিক কালের ইট্ দিয়েই গাঁথা, অল্প ঝড়ে ভাঙ্গচে না।”
দুই বন্ধুতে বেশ একটু হাসিতামাসা চলিল। মিস্ চৌধুরী কহিলেন—“মাসীর আঁচল ছেড়ে দু’দিন বাইরে একটু ঘুরে এস অমি, বেশ সেরে যাবে। খাসা জায়গা।” —ইহার পর সুন্দর হল্দে রঙ্গের একটি ছোট বাড়ী, লতাপাতা-ঘেরা ছবির মত একখানি বাগান, গোচারণের সবুজ মাঠ, স্বল্পতোয়া বঙ্কিমগতিশালিনী নদীটির পর্য্যন্ত এমন একটি মনোরম বর্ণনা দাখিল করিলেন যে, সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অমিয়ার “না” বলিবার সাধ্য রহিল না। থাকার সম্বন্ধে বন্দোবস্তের ভার ডাক্তার নিজেই লইলেন। হোটেলখরচা তাহারা নাই বা লইল? ইচ্ছা থাকিলে ঋণ পরিশোধের উপায়ের অভাব হয় না। উঠিবার সময় সত্যবতীকে কহিলেন—“আস্চে শনিবার ওকে আমি নিজে গিয়ে ট্রেণে তুলে দিয়ে আস্ব—সেখানে দু’একদিনের ভেতরেই চিঠি দেব। এর মধ্যে সেরে ওঠা চাই।”
নির্দ্ধারিত দিনে মাসীমাকে প্রণাম করিয়া, অমিয় তাহার অল্পস্বল্প লগেজপত্র লইয়া যাত্রা করিল। মিস্ চৌধুরী প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাহাকে ট্রেণে তুলিয়া দিতে আসিয়াছিলেন। অমিয়াকে কহিলেন—“মিনাকে আমি চিঠি দিয়েছি, তার বাড়ীর গাইয়ের খাঁটী দুধে, আর যত্নে সে যেন তোমাকে মোটাসোটা ক’রে ফেরৎ পাঠাতে পারে।”
অমিয়া হাসিয়া আপত্তির সুরে কহিল—“দুধ—বাঃ, দুধ কি আমি কক্ষণো খাই নাকি? জিজ্ঞেস্ কর্বেন মাসীমাকে, ওটা আমি কত পছন্দ করি।”
মিস্ চৌধুরী হাসিমুখে উত্তরে কহিলেন— “দুধ কখনও খেয়েচ কি যে পছন্দ কর্বে? স্বোয়াদ্ জান্বে কোত্থেকে?” কলিকাতার বাজারে ও গোয়ালারা যে দুগ্ধ বা নানাদ্রব্য মিশ্রিত শ্বেতবর্ণের জলীয় পদার্থ বিক্রয় করিয়া থাকে, তাহার প্রতি কটাক্ষ করিয়াই ডাক্তার এই মন্তব্যটি প্রকাশ করিলেন। কহিলেন—“দু’মাস সেখানে থেকে ত এসো, দেখ্বে—সব কাজের জন্যেই উপযুক্ত হ’তে পার্বে। কিন্তু মনে থাকে যেন, সুধু বিশ্রাম, আর কিছু না—বেশ ক’রে গরম কাপড় টাপড় ঢাকা দিয়ে ঘরের বাইরে বাগানে, মাঠে যেখানে খুসী কেবল বেড়িয়ে বেড়াবে, বসে থাক্বে, শুয়ে থাক্বে। তার পর ফিরে এসে যে বইখানি বার কর্বে, তাতে স্ত্রীর বিদ্রোহঘোষণার সঙ্গে এমন চমৎকার রং ফুটে উঠ্বে যে, তাতে করে তোমার স্বপক্ষ বিপক্ষের দল মুগ্ধ হয়ে যাবে।”
অমিয়া ঈষৎ প্রতিবাদের সুরে কহিল—“তাতে যে পল্লীচত্র দেব এমন ত কোন সঙ্কল্প নেই আমার।”
“তা ত নিশ্চয়ই। এই চাকার তলায়ই ঘুর্চ কিনা! পল্লীচিত্রের কল্পনা কর্বে কোত্থেকে? দেখ বাছা, একবার বাইরে বেরোবার দরকার হ’য়েছে তোমার। ভারী সহুরে মেয়ে তুমি! তোমাদের বিশ্বাস, সহরের ভোগের জন্যেই ভগবান কেবল পাড়াগাঁয়ের সৃষ্টি ক’রেচেন। সহরের বাইরে যাওনি ত কখনও? বড় যদি গিয়েচ ত বালীগঞ্জ ভবানীপুর বা বেহালা—ব্যস্, এই ত তোমাদের পল্লীর আইডিয়া? ওখানে যাও ত একবার দেখ্বে কত নূতন নূতন লেখার জোগাড় আপনি হয়ে যাবে। তোমরা যে সব ‘পদদলিত স্ত্রীজাতি’র দুঃখের কান্না কাঁদ্চ, তারা কারা গো? এই সব সহুরে মেয়ে, যারা গান-বাজ্না, সভা-সমিতি করে বেড়াচ্চেন, থিয়েটার বায়স্কোপ দেখ্চেন, বক্তৃতা দিচ্চেন, নভেল লিখ্চেন, তাঁরা? না, যারা পৃথিবীর মাখন যোগাচ্চে, ধান ভান্চে, সূতো কাট্চে! বোঝাও না তাদের গিয়ে?”
হুইসিল্ দিয়া ট্রেণ চলিতে আরম্ভ করিল। স্পষ্টবাদিনী মিস্ চৌধুরীর বক্তৃতার বাকী মন্তব্যটুকু অব্যক্তই রহিয়া গেল। অমিয়া কথার উপর জোর দিয়া কহিল—“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই তা আমি বোঝাব! নমস্কার!”
মিস্ চৌধুরীর তোব্ড়া গাল দুটি বিদ্রূপের হাসিতে আরও যেন তুবড়িয়া গেল। “পৌঁছেই একটা চিঠি দিও, বুঝ্লে?”
“নিশ্চয়ই—মাসীমার খবর নেবেন, ভারী একা হয়ে গেলেন তিনি। আবার বল্চি, নিশ্চয়ই তা আমি বোঝাব। সেখানেও আমি নিশ্চেষ্ট থাক্ব না।”
অমিয়ার কথার সঙ্গে সঙ্গেই, মিস্ চৌধুরীর মুখের হাসি মিলাইতেই, ট্রেণখানি ভস্ ভস্ শব্দ করিয়া প্লাট্ফরম ছাড়াইয়া ক্রমে দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।