স্রোতের গতি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
প্রবাসে
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় ট্রেণখানি তাহার মন্থরগতি একটি জঙ্গলময় ক্ষুদ্র ষ্টেশনের ধারে সংযত করিল। কোন আরোহীই সে ষ্টেশনে নামিল না। অমিয়া—কুলীর জন্য বারকতক ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া নীল বা খাকী রঙের জামাপরা কুলীবেশী কাহাকেও দেখিতে পাইল না। ক্ষীণ সুরে বারকতক “কোলী, কোলী” করিয়া উদ্দেশে হাঁকাহকির পরে, ট্রেণ বেশীক্ষণ দাঁড়াইবে না বুঝিয়া নিজের লাগেজ-পত্র টানাটানি করিয়া নিজেই নামাইয়া লইল; এবং পরক্ষণেই রক্তচক্ষু সর্পগতি ট্রেণখানি শব্দ করিয়া ষ্টেশন হইতে বাহির হইয়া গেল।
অমিয়া ইতস্ততঃ চাহিয়া দেখিল, ষ্টেশনে কেহই তাহাকে নামাইয়া লইতে আসে নাই। অবশ্য এজন্য তাহাকে কষ্ট করিয়া ষ্টেশনের বাহিরে খোঁজ লইতে যাইতে হয় নাই। কারণ—‘বাহির’ বলিয়া এখানে বিশেষ কোন আলাদা জায়গা ছিল না। একখানি মাত্র ঘর, আর তাহার সাম্নে খানিকটা জায়গা টিনের ছাদ দিয়া ঢাকা। ইহাই হইল ষ্টেশন। ঢাকা জায়গাটিতে মালপত্র নামান ওঠান বা রাখা হয়। যাত্রীরাও এইখানে বসিয়া থাকে। ষ্টেশনের বাহিরে কোথাও জন-মানবের চিহ্ন দেখা যাইতেছিল না। কেবল দূরে একজন বুড়ী-ধোপানী কাপড়ের মোট মাথায় লইয়া চলিতেছিল। দূরে যতদূর পর্যয়ন্ত দৃষ্টি চলে, শুধু সবুজ শস্যের ক্ষেত। আরও দূরে, মেঘের সঙ্গে মেশামিশি পাহাড়ের দৃশ্য। অমিয়া একটি নিশ্বাস ফেলিয়া নিজের জিনিষপত্রের পানে তাকাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মনে মনে বলিতেছিল—“এ একটি ঘুমের দেশ। না—দেশ বলাও ঠিক্ হবে না, ঘুমন্ত উপত্যকা।” সাদা ধুতির উপর আধময়লা ছিটের কোট গায়ে, আধবয়সী ষ্টেশনমাষ্টার-বাবুটি দড়িবাঁধা টিনের চশমাখানি, নাকে আঁটিয়া, মুখ নীচু করিয়া কতকগুলি কাগজপত্রের উপর ঝুঁকিয়া কি লিখিতেছিলেন। একখানি মাত্র কাঠের চেয়ার ও একটি বার্ণিশওঠা টেবিল মিলিয়া সবসুদ্ধ তাঁহার সম্পত্তি। অমিয়া উপায় না দেখিয়া অগত্যা তাঁহারই শরণ লইল। দরজার কাছে গিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল—“ঠিকা-গাড়ী কোথায় পাওয়া যায় মশাই?”
ষ্টেশন মাষ্টার অবাক্ হইয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন। কহিলেন—“শোন কথা,—ঠিকে গাড়ী! ওগো বুঝেচি—বুঝেচি, ঠিকে গাড়ী আর বুঝি নে? সে এখানে পাবেন কোথায়? সে প্রায় দশ মাইল দূরে পাওয়া যায়।”
অমিয়া উৎকণ্ঠিতভাবে কহিল—“বয়েল-গাড়ী?”
ষ্টেশন-মাষ্টার হাতের কাগজখানি সরাইয়া রাখিয়া আর একখানি কাগজ বাছিতে বাছিতে কহিলেন—“গরুর গাড়ী—ওঃ? তা, আজ ত হাটবার নয়! আজ আর কোথায় পাবেন? সে, হাটের দিন চেষ্টা কল্লে এক আধ খানা ধর্তে পারা যায় বটে।”
“কুলী—মুটেও কি মেলে না মশাই এ দেশে?”
ক্রমেই হতাশায় তাহার গলার স্বর ভাঙ্গিয়া আসিতে ছিল। ষ্টেশন মাষ্টার মুখ তুলিয়া মেয়েটির ক্রোধ বিরক্তি ও নৈরাশ্যপূর্ণ মুখখানির পানে একবার চাহিয়া একটু নরম সুরে কহিলেন—“কুলী ষ্টেশনেরই যা একজন আছে। তা, সে ত এখন রাঁধ্তে-খেতে বাড়ী চ’লে গেল, এখুনি ত তাকে আর পাওয়া যাবে না। তার বাড়ী সেই গাঁয়ে।”
“প্রাণতোষ-বাবুর বাড়ী কোথায় জানেন? না—তাও জানেন না? বেঙ্গল টিম্বরের এজেণ্ট্ প্রাণতোষ-বাবু?”— বলিয়া অমিয়া তাহার প্রশ্নের প্রতিকূল উত্তর শুনিবার জন্য বিরক্তমুখে উত্তরদাতার দিকে চাহিয়া রহিল।
ষ্টেশন মাষ্টার তাহার মনোভাব বুঝিয়া, শ্লেষপূর্ণ একটুখানি কৃপার হাসি হাসিয়া কহিলেন—“জানি বৈকি! তা সেখানেই যদি যাবেন, ত একটু আগে থাক্তে খবর দিলেই হ’ত। তাঁর নিজের দু-দু’খানা গরুর গাড়ী রয়েছে। একখানা এক পয়সার পোষ্টকার্ড লেখার ওয়াস্তা, ঠিক্ থাক্ত সব। এই কাল এখানকার ডাক্ বিলি হ’য়ে গেল। এখন ত দুদিন আর চিঠিপত্র বিলিও হবে না—রওনাও হবে না।”
এই নূতন খবর শুনিয়া অমিয়ার মুখখানি একেবারে পাঙ্গাস হইয়া গেল। সে তাহার শুভানুধ্যায়িনী উপদেশদাত্রী মিস্ চৌধুরীর উপর মনে মনে বড়ই রাগ করিতেছিল। ষ্টেশন-মাষ্টার তাহাকে সচেতন করিয়া দিলেন, কহিলেন—“ঐ যে ডানদিকের পথটা সোজা চলে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরেচে ঐটে ধরে চলে যান্—আপনিই পথ দেখ্তে পাবেন। এই রাস্তাটা পেরুলেই বাড়ীটা নজরে প’ড়্বে। হল্দে রঙের বাড়ী—সামনে গেটের উপর লতাগাছ দেওয়া। মালপত্র এখানেই সব প’ড়ে থাক্ না, কাল প্রাণতোষবাবু, গরুর গাড়ী পাঠাবেন অখন।”
ঘৃণা ও বিরক্তিতে নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া অমিয়া কহিল—“থাক্, তাঁকে আর অত কষ্ট কর্তে হবে না। ফের্বার গাড়ী কখন?”
“ভোর ছ’টায়। ঐ একমাত্র গাড়ী, আর ফের্বার গাড়ীটাড়ি নেই”—বলিয়া ষ্টেশন-মাষ্টার অপ্রসন্নমুখে নিজের কাজে মন দিলেন। অমিয়া অগত্যা তাঁহার নির্দ্দেশানুযায়ী পথেই অগ্রসর হইতে বাধ্য হইল। মালপত্র ষ্টেশনেই পড়িয়া রহিল। পথের বাঁক ফিরিতেই একটা ঝরণা দেখা গেল। ঝক্ঝকে রূপার পাতের মত, সরু জলধারাটি ধীরভাবে বহিয়া চলিয়াছে। দু’ধারে উচ্চ সবুজ ঘাসে ঢাকা তীরভূমি, যেন সবুজ ছাঁটা-পশমের আসনের মত সুন্দর দেখাইতে ছিল। স্বচ্ছ জল সান্ধ্য সূর্য্যালোকে কোথাও বা ঝক্ ঝক্ করিতেছিল—কোথাও বা ঘূর্ণ্যমান বীচিবিক্ষোভিত! পারাপারের জন্য ছোট একটি বাঁশের দোলা সেতু। তাহারই গায়ে, ছোট একটি লম্বা টিনের বাক্সের উপর লেখা “নেক্ষ্ট্ ক্লিয়ারেন্স্।” কলিকাতার ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাক বিলির কথা মনে করিয়া, ক্রোধ দুঃখ ও অভিমানে তাহার চিত্ত পূর্ণ হইয়া উঠিল, এখানকার লোকগুলার উপর অশ্রদ্ধায় তাহার এক মুহূর্ত্তও এখানে থাকিতে ইচ্ছা হইতেছিল না। হতভাগা ডাক্তার—কলিকাতায় ফিরিয়া সে আগে ডাক্তারকে দেখিয়া লইবে! কেন সে এমন করিয়া তাহার সহিত শত্রুতা সাধিল?
ঘণ্টাখানেক পথশ্রমের পর সে বুঝিতে পারিল, এই বার তাহার ঈপ্সিত স্থানের কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে। রাস্তা—সে কি সোজাসুজি সমতল পথ?—উঁচু-নীচু, নালা খাল, পাথরের ঢিবি, কোথাও ঝোপ-ঝাপ, কাঁটাগাছ, কত বাধা বিপত্তি যে দলন করিয়া চলিতে হইতেছিল; রেশমী শাড়ীর আঁচলে টান পড়ে, ফিরিয়া ছাড়াইয়া লইতে হয়। সুদৃশ্য পাম্প-সু জুতা-যোড়াটি রাস্তার ধূলায় আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। দুর্ব্বল শরীরে পথের ও মনের কষ্টে এক একবার তার মনে হইতেছিল যে, এত দুঃখ সহিয়া শরীর সারান’র চেয়ে কলিকাতায় ইন্ফ্লুয়েঞ্জায় মরিয়া যাওয়াও তাহার ঢের ভাল ছিল। এইবার সে সমতল জমি পাইয়াছে। বড় বড় খামার, গোশালা, ধানের গোলা, মরাই চোখে পড়িতেছিল। এ সব গোলা, মরাই তাহার অদৃষ্টপূর্ব্ব; কেতাবে পড়া থাকিলেও চোখে না দেখায় ইহাদের মর্ম্ম তাহার সম্পূর্ণ বোধগম্য হইতেছিল না। রাস্তার বাঁক ফিরিতেই সম্মুখে একটি বড় একতলা বাড়ী। তাহার গেটের উপর গোলাপী ছোট ছোট ফুলভরা, সবুজ লতাগাছগুলি চক্ষুকে তৃপ্তিদান করিতেছিল। গেটের দু’ধারে দুটি মোটাসোটা ধব্ধবে সাদা “পাহাড়ী গাই” যেন শত্রুকে দুর্গ-প্রবেশে বাধা দিবার জন্যই তাদের লম্বা বাঁকা শিং লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাদের বড় বড় চোখেও যেন বিস্ময়চিহ্ন ফুটিয়া রহিয়াছে। অমিয়া সভয়ে পিছু হটিয়া বলিয়া উঠিল—“ওমা, দেশের যে সবই চমৎকার, এ গরু দুটোকে আবার তাড়াবে কে?”
গেটের ভিতরে সুস্থদেহা একজন স্ত্রীলোক, ছোট একটি মোটাসোটা সুশ্রী ছেলেকে কোলে করিয়া বেড়াইতে ছিলেন। অমিয়ার সভয় মন্তব্য কাণে যাওয়ায় অথবা তাহাকে দেখিতে পাইয়া, তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“চিন্তে ত পাচ্চিনে আপনি কে? কোথা থেকে আস্ছেন বলুন দেখি?” রমণীর চোখে কৌতূহলের সহিত একটুখানি সম্ভ্রমও ফুটিয়াছিল। এমন দর্শনীয় মূর্ত্তি এখানে ত বড় বেশী চোখে পড়ে না! তা ছাড়া এখানকার অল্পস্বল্প নরনারী সকলেই প্রায় তাঁহার পরিচিত। অমিয়া নিরুৎসাহভাবে কহিল—“এখানেও তাহলে গলদ্ দেখ্চি! লেডি-ডাক্তার মিস্ চৌধুরী আপনাকে চিঠি লিখে আমার আস্বার খবর দিয়েছেন বলেই ত আমি জান্তাম্। এখন দেখছি তা দেন্ নি তিনি।”
রমণী সহাস্যে কহিলেন—“ওঃ—মাসীমা বুঝি পাঠিয়েচেন আপনাকে? না, না, গলদ্ আবার কিসের? এখানে ডাক্ ত রোজ বিলি হয় না,—চিঠি আস্বে’খন পরে। আসুন না, ভিতরে আসুন, বাইরে রইলেন কেন? ষ্টেশন থেকে পথটুকুও ত বড় কম নয়? কষ্ট হ’ল আপনার খুবই”—বলিয়া রমণী অবলীলায় গরু দুটির গায়ে হাত দিয়া একটুখানি ঠেলিয়া দিতেই তাহারা পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
অমিয়া রমণীর পশ্চাতে চলিয়া, লাল রংকরা সানের মেঝেওয়ালা বড় একখানি ঘরের ভিতর আসিয়া দাঁড়াইল। ঘরের ভিতর আস্বাব পত্র অল্প-স্বল্প, কিন্তু সবগুলিই সুরুচির পরিচায়ক। বড় বড় খড়খড়িওয়ালা জানালা দু’টি খোলা রহিয়াছে। তাহার বাহিরের দৃশ্য অমিয়ার এতক্ষণের দুঃখ যেন অনেকখানি ভুলাইয়া দিল। বাহিরে সুন্দর একটি ফুলের বাগান,—সবুজ গাছগুলি নানাবর্ণের অজস্র ফুলে-ফুলে ভরা, দুই চক্ষু জুড়াইয়া দিতেছিল। জানালার ধারে নরম গদির উপর সাদা কাপড়ের ঘেরাটোপ-মোড়া বড় একখানি তক্তাপোষ। গৃহকর্ত্রীর অনুমতির অপেক্ষামাত্র না করিয়াই অমিয়া তাহার উপর শুইয়া পড়িল। মনে মনে বলিল—কাল ভোর ছ’টার ট্রেণে যতক্ষণ না সে এই পাণ্ডব-বর্জ্জিত গ্রাম হইতে বাহির হইতে পারে, ততক্ষণের জন্য এই আরাম-শয্যা তাহারই; এখান হইতে কিছুতেই সে আর নড়িবে না।
রমণী কহিলেন—“আপনি বড় ক্লান্ত হয়েচেন দেখ্চি। খোকাকে একটু ধরুন দেখি, আমি এখনি এলুম ব’লে। আমার ঝিয়ের মেয়ের আজ বিয়ে, সে চারদিনের ছুটি নিয়েছে। ছেলেটা যা দুরন্ত হয়েচে, ওকে নিয়ে কিছু যে কর্ব তার যোটি নেই। আপনি একটু রাখুন, আমি টপ্ ক’রে কিছু খাবার নিয়ে আসি।”
উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়াই নির্ব্বাক্ অতিথির কোলের কাছে ছেলেটিকে বসাইয়া দিয়া তাহার মা তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির হইয়া গেলেন। অমিয়ার জীবনে সে আর কখনও কোন ছোট ছেলেকে কোলে করিয়াছে বলিয়া তাহার স্মরণই হয় না। একটুখানি গাল টিপিয়া, বা এতটুকু স্পর্শ করিয়া দু’টা যা-তা কথা বলিয়া নিতান্ত নিরুপায়স্থলে কাজ সারিয়া থাকিতেও পারে। কিন্তু তাই বলিয়া এই বাতাসা-রস-সিঞ্চিত, ময়লা জামা-পরা রোরুদ্যমান ছেলেটিকে লইয়া সে তখন কেমন করিয়া কি করিবে? মা চলিয়া যাইতেই ছেলেটি কান্না শুরু করিয়া দিল। ছেলেটির নরম নরম মোটা মোটা গড়ন, রাঙা রাঙা ফুলো ফুলো গাল দু’টি আর চক্চকে চোখ—এই সব সম্পত্তি থাকায় অমিয়ার মন্দ লাগিতেছিল না। কিন্তু ছেলেটি তার আশ্রয়দাত্রীর অপরিচিত মুখ পছন্দ করিতেছিল না, অত্যন্ত বিরক্তিপূর্ণ মুখে সে অমিয়ার পানে চাহিয়া ঠোঁট ফুলাইয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল। পাছে তাহার লালার রসে কাপড় চোপড় খারাপ হইয়া যায়, সেই ভয়ে অমিয়া তাহাকে আলগোছে ধরিয়া রাখিয়াছিল, ইহাও খোকার বিরক্তির দ্বিতীয় কারণ। অমিয়ার হাতে রিষ্টওয়াচের উপরও তাহার চক্ষু ছিল, কিন্তু তাহার অপরিচ্ছন্ন হাতে সেটি দিতে অমিয়ার মোটেই ইচ্ছা হইতেছিল না। এই সকল বাধা ও ঈপিত বস্তুটি না পাওয়ায় এবং অমিয়ার কোলে লইবার সঙ্কোচকুঞ্চিত ধরণে খোকা এমনি কান্না আরম্ভ করিয়া দিল যে, তাহাকে শান্ত করিবার জন্য দোলা দিয়া, চাপড়াইয়া, কখনো বসাইয়া, কখনো দাঁড় করাইয়া—নানা উপায়েও অমিয়া তাহাকে চুপ করাইতে পারিল না। সে কখনো কোনো ছোট ছেলেকে এমন ভাবে কাছে ডাকে নাই, বশীভূত করিতে পারে নাই, চাহেও নাই। ছেলেদের মন ভুলাইবার মন্ত্র ছড়া বা গান এ সব কখনও অনুশীলন করে নাই; করাটাকে সে বরাবর পাগলের কাণ্ড বলিয়াই মনে করিয়া আসিয়াছে। তাহার ন্যায় বিবাহনিবারিণী সভার সভ্যের কাছে অবশ্য এটা পাইবার আশা করাও কিছু উচিত নয়। কিন্তু ছোট ছেলেরা সর্ব্বদেশে ও সর্ব্বকালে আইন আদালতের বাহিরে। তাহারা উচিত অনুচিতের বোধ রাখে না—নিজেদের পাওনা সর্ব্বত্র পুরামাত্রায় আদায় করিয়া লইতে চায়। আজ এই ক্ষুদ্র শিশুটি অমিয়াকে বিলক্ষণরূপেই ইহা বুঝাইয়া দিতেছিল যে, প্রয়োজন না থাকিলেও অনেক বিদ্যার অনুশীলন করিয়া রাখিতে হয়। আর এই অভিজ্ঞতার ত্রুটি সংশোধনে অমিয়া ইংরাজী বাঙ্গালা হিন্দীতে যা খুসী শব্দ ব্যবহার করিয়া, সুর করিয়া তাহাকে যা কিছু বলিতেছিল, তাহার কোন অর্থ ছিল না। সে বিরক্ত হইয়া যখন বলিতেছিল—“খোকা—তুমি থামো—থামো—থামো,—আমি ঘুমপাড়ানি গান জানি না—জানি না— জানি না,— তুমি আমায় দয়া করে থাম”—তখন হয়ত তাহার মনের ভুল নয় ত সত্যও হইতে পারে—খোকা তাহার সেই সুরকরা কথার আওয়াজে এবং দোলা দেওয়ার ভাবে কান্নার বেগ কমাইয়া আনিয়াছিল। দেখিয়া আশ্বস্ত হইয়া সে উহারই পুনরাবৃত্তি সুরু করিল। “ঘুমপাড়ানির গান তোমার ভাল লাগে না—খুব বিশ্রী, খুব খারাপ— পিন্ফোটার মত লাগে!—কেমন খোকা, কেমন ' খোকা!” কথাগুলি গানের সুরে উচ্চারিত হওয়ায়— বিরক্তি ক্রোধ ও ঘৃণায় তাহার কণ্ঠস্বর বিকৃত হইয়া উঠিলেও খােকার তাহাতে কোন আপত্তি দেখা গেল না। সে তাহার কান্নামাখা চোখ দু’টিতে অমিয়ার বিরক্ত মুখের পানে আড়ে আড়ে চাহিয়া, পায়ের দোলা দিয়া ঐ গানের সুরই যেন বার বার শুনিতে চাহিতেছিল। “তােমরা তাহ’লে মা’দের কাছে কেবল এই চাও—ঘুমপাড়ানি ঘুমপাড়ানি পিসি মাসি, ঘুম-ঘুম—পাজী ছেলে, দুষ্ট ছেলে, বদ মাস ছুঁচো, আমায় দিয়ে তােমার এই করানো? এখন থেকেই রাজাগিরি, এখন থেকে জোর খাটান!”
এতক্ষণে খোকার মুখে হাসি ফুটিল। তাহারই জয় হইয়াছে। সে ধীরে ধীরে অমিয়ার বাদামী শিল্কের ব্লাউজের কলারে, তাহার সৌখীন মান্দ্রাজী শাড়ীতে ময়লা চটচটে বাতাসামাখা আঙ্গুলের ছাপ লাগাইয়া, একরাশ লালা ফেলিয়া, তাহার মাথার চুল ধরিয়া কাণ ধরিয়া টানাটানি করিয়া, সে যে গান শুনিয়া তুষ্ট হইয়াছে, তাহারই পুরস্কারস্বরূপ অনিচ্ছুক অমিয়ার নাসিকা ভক্ষণে এইবার উদ্যোগী হইল।
একখানি ফুলকাটা কাঁসার রেকাবীতে কতকগুলি ক্ষীরের লাড়ু, দু’খানি বাতাসা, খানিকটা দুধের সর, ও একবাটি গরম দুধ লইয়া খোকার মা হাসিমুখে ঘরে ঢুকিয়া এই অদ্ভুত দৃশ্যে কিছুক্ষণের জন্য অবাক্ হইয়া গিয়াছিলেন। খানিক পরে হাতের রেকাবী খানি ও দুধের বাটী মাটীতে নামাইয়া রাখিয়া, অমিয়ার ক্রোড় হইতে ছেলেকে তুলিয়া লইয়া কহিলেন—“এখন এই একটু কিছু মুখে দিন্, আমি উনুনে কাট দিয়ে এসেচি—সকাল সকাল খাবার ক’রে দেব আপনার। দোরের কাছে জল আছে, মুখ ধোবেন ত ধুয়ে নিন্। মা গো, ছেলেটা কি দস্যি! আপনার ভাল কাপড় চোপড় সব নষ্ট করে দিয়েছে যে একেবারে—যা নোংরা?”
নিজকে অমিয়ার এতই ক্লান্ত মনে হইতেছিল যে, ছেলের জন্য মীনার ক্রটি স্বীকারের পরিবর্ত্তে সুভদ্র বিনয় প্রকাশে খোকার অপরাধের অপলাপ বা অন্য কিছু সৌজন্য রক্ষার কথাও সে কহিল না। কাল ভোরে উঠিয়াই যে সে চলিয়া যাইবে, ইচ্ছা হইলেও সে কথাও বলিল না। মুখে হাতে জল দিয়া অল্পস্বল্প কিছু খাইয়া লইয়াই শুইয়া পড়িল। সমস্তদিন ট্রেণে আসিবার পর এইবার সে যথার্থ বিশ্রাম পাইয়াছে। কাল যতক্ষণ পুনরায় ট্রেণে চড়িয়া না বসিতেছে, ততক্ষণের জন্য এই বিশ্রাম শয্যা আর ত্যাগ করিবে না। চায়ের অভাব খুবই অনুভূত হইতেছিল, কিন্তু থাক্—সে কথা আর এখানে কেন?
পরদিন সকালে যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল, প্রথমেই ট্রেণের বাঁশীর সুর তাহার কাণে আসিয়া পৌঁছিল। এখান কার অদ্যকার একমাত্র ট্রেণখানি যে বাহির হইয়া গেল ইহা তাহারই সাঙ্কেতিক চিহ্ন। আজ আর কোন গাড়ী এখান হইতে রওনা হইবে না—সুতরাং ব্যস্ত হইবার প্রয়োজনও আর কিছু নাই। তখনও ভাল করিয়া চোখের ঘুম ছাড়িতে চাহিতেছিল না। ট্রেণের শব্দেও তাহার মনে কোন চাঞ্চল্য উপস্থিত হইল না—থাক্, যখন আসিয়া পড়িয়াছেই, তখন দু’এক দিন না হয় এখানেই একটু জিরাইয়া লইল!
পাখীর গান ও তাহাদের কিচ্কিচ্-কথার সুর তাহার কাণে ভাসিয়া আসিতেছিল। বিছানায় শুইয়াই সে তাহার ক্লান্ত চোখের ঘুম ছাড়াইয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল। খোলা জানালা দিয়া আকাশের বর্ণ দেখা যাইতেছে। কি আশ্চর্য্য মনোমুগ্ধকর নীল রঙ। ধোঁয়া বা কুয়াশার চাদর আচ্ছাদিত কলিকাতার পাংশু আকাশ নয়। তালগাছের পাতার আড়ালের ফাঁকে ফাঁকে অগ্নিচক্রের ন্যায় রাঙা আলোর স্রোত বহাইয়া সূর্য্যদেব ধীরে ধীরে নিম্ন হইতে ঊর্দ্ধে— ক্রমে আরও ঊর্দ্ধে উঠিতেছেন—কি চমৎকার দৃশ্য! বাহিরে বাগানে অজস্র ফুল ফুটিয়া সৌন্দর্য্যে গন্ধে মন ও চক্ষু পরিতৃপ্ত করিয়া দিতেছিল। একটা দোয়েল এই কতক্ষণ গাছের ডালে বসিয়া শিশ্ দিতেছিল, এখনি উড়িয়া গিয়াছে।
অমিয়াকে বিনিদ্র বুঝিয়া, ছেলে কোলে মূর্ত্তিমতী হাসির ন্যায় মীনা আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। সকালবেলার স্নিগ্ধ রোদটুকু খোলাপথ দিয়া দুরন্ত ঘরের ছেলেটির ন্যায় ছুটাছুটি লাগাইয়া দিল। মীনার হাতে পাতাসুদ্ধ দুটি মস্তবড় হলুদ রঙের গোলাপফুল। ছেলের হাতে ফুলের গুচ্ছটি দিয়া মা হাসিমুখে কহিলেন—“খোকামণি, তোমার মাসীমাকে ফুল দাও ত ধন!” খোকা একবার অপ্রসন্ন অনিচ্ছুক দৃষ্টিতে অমিয়ার পানে চাহিয়া, মার মুখের দিকে চাহিল। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া ঠোঁট্ ফুলাইয়া আপত্তি জানাইল। পুনরায় মার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। সেখানে সম্মতির কোন চিহ্ন না পাইয়া, ফুলগুলি অমিয়ার বিছানায় কেলিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে সুগোল হাত দু’খানিও অমিয়ার দিকে বাড়াইয়া দিল। তাহার সুন্দর মুখে সকাল বেলার স্নিগ্ধ রৌদ্রের আলোর ন্যায় হাসির আলো ফুটিয়া উঠিল। অমিয়া দুই বাহু প্রসারিত করিয়া তাহাকে কোলে তুলিয়া লইল।