স্রোতের গতি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
খোকার বন্ধুত্ব
দিনের পর দিন যথানিয়মে চলিয়া যাইত। ফিরিয়া যাইবার একমাত্র ট্রেণখানি অমিয়াকে না লইয়া সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে যথানিয়মে ফিরিয়া যাইতেছিল। কেহ যদি এখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত যে সে ফিরিয়া গেল না কেন? নিশ্চয়ই সে তাহার কোন সদুত্তর দিতে পারিত না। যেদিন সে এখানে প্রথম আসে, সেদিন পথে আসিতে আসিতেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, পরদিন প্রাতেই এখান হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিবে। আর যদিই তাহা না ঘটিয়া উঠে, তবে সর্ব্বকর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া মিস্ চৌধুরীকে একখানা কড়া করিয়া চিঠি লিখিয়া জিজ্ঞাসা করিবে যে—কেন তিনি তাহার সহিত এভাবে শক্রতা সাধন করিলেন? সে তাঁহার কি ক্ষতি করিয়াছিল যে সীতার বনবাসের পুনরাভিনয়ের প্রয়োজন ছিল তাঁর? কিন্তু পনেরো দিনের মধ্যে সে চিঠি লিখিবার জন্য অমিয়ার মনের কাছে কোন ত্বরা দেখা গেল না। অবসর মত যখন লিখিল, তখন অন্যান্য অবান্তর কথার মাঝে বরং লিখিতে দেখা গেল—“রাজা হেরডকে তাঁর চিকিৎসক যে শুধু পাতা আর ঝর্ণার মধ্যে বিশ্রাম লইতে বলিয়াছিলেন, বাস্তবিক এও ঠিক সেই জায়গা। এখানে শ্যামলবক্ষ বসুমতী সুজলা সুফলা। পর্ব্বতের অনাবৃত উদার উন্নত মহামহিম ভাব-সৌন্দর্য্য মানবের ভাষাতীত। নদীর চঞ্চল ধ্বনি গীতি-মুখর। এখানে আমার সঙ্গী খরগোস্, হাঁস, ময়ূর, পাখী, হরিণ-শিশু আর এগারো মসের নাদুস নুদুস্ হাসিমুখো একটি খোকা! সারাদিন আমার কোন কাজ নেই, কোন দায়িত্ব নেই, অর্থাৎ আমি কিছুই করি না, কেবল খাই আর ঘুমুই, আর মনে মনে বলি—“কাল হইতে আমি একজন কাজের লোক হইব।”
ইহার উত্তরে মিস্ চৌধুরী তাহাকে চাঁচাছোলা ডাক্তারী ভাষায় একখানি পোষ্টকার্ড লিখিয়াছিলেন—“তোমায় আরো দু’মাস ওখানে থাকিতে হইবে। ওখানে ক’জনকে স্ত্রীস্বাধীনতা বা বিবাহ-বিরোধী মন্ত্রে দীক্ষিত করিলে?” চিঠি পড়িলে রাগ ধরে না? অমিয়া তাহার কার্য্যের শিথিলতা বেশ ভালই বুঝিতেছিল। নিশ্চয়ই সে কর্ত্তব্য পালন করিতে পারে নাই, কিন্তু বুঝিয়াই বা সে করিবে কি? এখানে আছে কে, যাহাকে সে তাহার ন্যায্য অধিকার লাভের পন্থা দেখাইয়া দিবে? মানুষের মধ্যে ত একমাত্র মীনা। তা সে এক অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়ে! নিজের ঘরসংসারের কাজ, ছেলে আর স্বামী লইয়াই আনন্দে দিনরাত মস্গুল হইয়া আছে। কখনো ভাবেও না যে সে একজন ক্রীতদাসী—পদদলিতা বিবাহিতা নারী! ঝীটি ও কি জুটিয়াছে তেমনি? স্বামী স্ত্রীতে দিনরাত খাটিয়া মরে, তাহাতেই যেন কত সুখী! মীনার স্বামী প্রাণতোষবাবু মানুষ অবশ্য মন্দ নহেন, দেখিতে শুনিতেও ভাল। কথাবার্ত্তা চাল চলনও সংযত স্নেহময়। সকল কাজে লোক দেখানো, মনভুলানো স্ত্রীর মতটি লওয়াও আছে। নিজেই যেন স্ত্রীর আজ্ঞাধীন—এমনি ভাব দেখাইয়া থাকেন,—কিন্তু ওসব ভূয়ো—সব ভূয়ো—আসল যা তাই। তিনি কাজের ছুতায় মধ্যে মধ্যে দূরে সহরে যান, দুই চারিদিন কাটাইয়াও আসেন। সেখানে—সভা-সমিতি ক্লাব, সবই হয়ত আছে। বেচারী মীনা—আহা নিজের অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করিবার শক্তিও তাহার নাই।
তবুও অমিয়ার সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অজ্ঞাতে তাহার চিন্তার ধারা যেন ধীরে ধীরে পরিবর্ত্তিত হইতেছিল। এই পদদলিত নারী দু’টির অনাবিল অকৃত্রিম সুখে সহানুভূতিতে সে যেন নিজের অজ্ঞাতেই একটুখানি তৃপ্তি পাইতেছিল। বাড়ীর বাহিরে কাছাকাছির মধ্যে তেমন কেহ বড় নাই। গোয়ালিনী যশীর মা, তাহার দুই যুবতী পুত্ত্রবধূ আর কৃষাণ বধূ অনঙ্গ। ইহাদের শোচনীয় দুরবস্থার বিষয় ইহাদের বোধগম্য করান এতই কঠিন ও বিপদসঙ্কুল যে, একদিনেই তাহাদের অজ্ঞানতা-অন্ধকার নাশের সাধ অমিয়ার মিটিয়া গিয়াছিল। বধূদ্বয়ের সহিত তাহাকে কথা বলিতে দেখিয়াই শ্বাশুড়ী সভয়ে মীনার আশ্রয় লইয়াছিল—‘মেম-দিদিমণি’র পরামর্শে তাহার শিশুবুদ্ধি বধূরা গির্জ্জায় গিয়া ‘কীষ্টান’ হইয়া না বসে! গ্রামে এমন দুর্ঘটনা আরও একবার ঘটিয়া ছিল। তাই অমিয়ার সাজসজ্জা, সকলের সহিত কথা বলা, একা যেখানে সেখানে বেড়াইতে যাওয়া এই সব অকাট্য প্রমাণ তাহাকে পল্লীনারীদের কাছে ‘কীষ্টান’ আখ্যা দিয়াছিল। হিন্দু মেয়ের নাকি এত বয়স পর্য্যন্ত বিবাহ হইতে বাকী থাকে?
এই সব নিরক্ষর বুদ্ধিহীনা মেয়েদের শিক্ষা দিয়া তাহাদের অবস্থার কথা বুঝান যে কত কঠিন, তাহা সে যেমন অন্তরে অন্তরে অনুভব করিতেছিল, সেই সঙ্গে একটা নূতন চিন্তার ধারাও যেন তাহার মনের ভিতর দিয়া অলক্ষ্যে বহিয়া যাইতেছিল। বুঝাইয়া লাভই বা কি? শিক্ষা দিয়া,— সাহায্য দিয়া সে ত ইহাদের নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিবে না। তবে মিছামিছি তাহাদের শান্তির সংসারে অশান্তি অভাব জাগাইয়া দুঃখ আনিয়া দেয় কেন? থাক্ যে যেমন আছে, সবাই শান্তিতে থাক্! এ আনন্দপূর্ণ শান্তির রাজ্যে সহরের অভাব অভিযোগের হাহাকার টানিয়া আনিয়া কাজ নাই।
* * * *
শীত কমিয়া আসিলেও রোদের তাতটুকু এখনও বেশ মিষ্ট লাগিতেছিল। বাগানে দেবদারু ও শিউলি গাছে দড়ীর ‘দোলনা’ টাঙ্গাইয়া, গায় মাথায় শাল ঢাকা দিয়া অমিয়া একখানি বই লইয়া সকালের দিকে প্রায়ই সেখানে শুইয়া থাকিত। কোন দিন বাগানে কোন দিন বা মটর সুটি সরিষা ও শাকের খেতের পাশ দিয়া মাঠে মাঠে খুব খানিক ঘুরিয়া আসিত; পাহাড় দূরে—ইচ্ছা থাকিলেও সঙ্গী অভাবে তাই যাইতে পারিত না।
আজকাল মীনার ক্ষেতের ফসল—গম, ধান, কড়াই, মটর, ছোলা প্রভৃতি সব ঘরে আসিতে সুরু হওয়ায় তাহার কাজ বাড়িয়া গিয়াছে। সেই সমস্ত ঝাড়ান বাছান, যথাস্থানে তুলাইয়া রাখা, এই সব কাজেই তাহার সময় কুলাইয়া উঠে না। তাই খোকাকে অনেক সময় সে অমিয়ার কাছে রাখিয়া যায়। প্রথম প্রথম সম্পূর্ণ ইচ্ছা না থাকিলেও দায় পড়িয়া অমিয়া খোকার তত্ত্বাবধানের ভার লইত,— কিন্তু এই দায়ে পড়ার ভাবটা কখন হইতে যে তাহার ভার না লাগিয়া হাল্কা হইয়া গিয়াছিল, তাহা সে বুঝিতেও পারে নাই। যেদিন সকাল বেলা খোকা দুধ খাইয়া তাহার কাছে না আসিয়া বাপের কাছে থাকিত, সেদিনকার সকাল বেলার সমস্ত মাধুর্য্যটুকুই অমিয়ার চোখে অঙ্গহীন হইয়া যাইত। সময় যেন কাটিতেই চাহিত না।
মীনার শিক্ষানুসারে খোকা এখন তাহাকে ‘মাচিম্মা’ বলিতে সুরু করিয়াছে। অমিয়ার মনে হয়, বাংলা ভাষার সবটুকু মধুর রস নিঙ্গড়াইয়া বাহির করিয়া বুঝি ঐ শব্দটি রচিত হইয়াছিল। ঐ মাসীমা শব্দটি মনে করিতে গেলেই মনে পড়ে, উপরে তাহার নিজের মাসীমা, আর নীচে হাস্যপ্রফুল্লমুখ অর্দ্ধস্ফুটবাক্ আনন্দনির্ঝর এই খোকা। বাগানে আসিবার সময় প্রায়ই সে একখানি ইব্সেন হাতে করিয়া আসিত, ইচ্ছা থাকিত বইখানি পড়ে, কিন্তু একজন স্ত্রীললাকের পক্ষে—তা সে যতই কেন মানসিক ক্ষমতাশালিনী হউক না—এক সঙ্গে, একটি কলহাস্য মুখর এগারো মাসের দুরন্ত খোকা ও ইব্সেন দুইয়ের প্রতি মনোবোগিনী হওয়া বোধ করি সম্ভবপর হয় না। খোকা যতক্ষণ জাগিয়া থাকিত, বেচারা ইব্সেনকে ততক্ষণ প্রায়ই একটা ফ্যাঁক্ড়া বাহির-করা পেয়ারা গাছের কোটরের মধ্যে আশ্রয়গ্রহণ করিতে হইত। খোকার জন্য সহর হইতে সে কতকগুলি খেলনা আনাইয়াছিল। অনেক সময় বাগানে ঘাসের উপর বসিয়া তাহারা বল লইয়া খেলা করিত। অমিয়া বল কুড়াইয়া আনিত, খোকা ছুঁড়িয়া গড়াইয়া দিয়া করতালি দিয়া হাসিত—কখন বা হামা দিয়া সে কুড়াইয়া আনিয়া দিত, অমিয়া গড়াইত, এমনি করিয়া দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্নরুচি অসমবয়সীর মধ্যে অত্যন্ত প্রগাঢ় বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়া গেল। খোকার একটু অসুখ করিলে এখন মীনার চেয়ে তাহাকেই অধিক ব্যস্ত ও চিন্তিত হইতে দেখা যায়। তাহার স্নানাহারের সময় সম্বন্ধেও অমিয়ার দৃষ্টি অধিক সজাগ।
খোকা কোন নূতন ভাষা বা খেলার অনুকরণ করিলে, অমিয়ার মুখেই আগে বিস্ময়ানন্দের হাসি ফুটিয়া উঠে। খোকাকে স্নান করান খাওয়ানর সম্বন্ধে এখনও তাহার হাত না পাকিলেও সে সময় প্রায়ই সে কাছে বসিয়া দেখিত। কোন দিন কাযের মধ্যে মীনা একসময় হয়ত বাহিরে বাগানে আসিয়া দেখিত, অমিয়ার দামী শালের বেষ্টনে তাহার কোলের কাছে দোলার ভিতর খোকার একরাশ কোঁকড়াচুলে ঢাকা প্রসন্ন ঘুমন্ত মুখখানি বাহির হইয়া আছে। দু'জনেই তাহারা আরামে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের মাথার চুলে, গায়ের শালের উপর, শেফালিফুল ঝরিয়া যেন পুষ্পাঞ্জলি দিয়াছে। মীনা মুগ্ধ হইয়া সেই বনদেবী-মূর্ত্তির পানে চাহিয়া থাকিত। সেই সঙ্গে একটা নূতন সাধও তাহার মনে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিত। আহা তা যদি হয়, বেশ-হয়। স্বামীর কাছে এ প্রসঙ্গ তুলিয়া কোন ফল হয় নাই; তিনি তাহার আশাতরু অঙ্কুরেই তুলিয়া ফেলিতে উপদেশ দিয়াছিলেন; বলিয়াছিলেন,—“তুমি ত জান না, পুরুষকে উনি কত ঘৃণা করেন। জান্লে—একথা বল্তে পারতে না।” তাই সে মনের ভিতরের গোপন আশাটিকে আর বাড়িতে দিতে সাহস করে নাই। তবু সেদিন মনে মনে সে প্রার্থনাও করিয়াছিল—ভগবান যেন একদিন এই দর্পিতা নারীর দর্পচূর্ণ করিয়া বুঝাইয়া দেন যে, দাসীত্ব নারীর জীবনের চরম দুঃখ নহে—তাহার প্রার্থিতও বটে।