হারানো খাতা/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

কহিলা তাপস চাহি মোর মুখে—কোন দেব আজি আনিলে দিবা?
তোমার পরশ অমৃত-সরস তোমার নয়নে দিব্য বিভা।

—কাহিনী।

 আট বৎসর আগের কথা;—বর্ষার ঝিপ্ ঝিপে বৃষ্টি কাদায় রাস্তা ঘাটের দুর্দ্দশা যেমন হইতে হয় তেমনি হইয়াছে। আকাশে ঘোলাটে, ঢলনামা গঙ্গার জলের মতই তাহারও যেন কর্দ্দমাক্ত ময়লা রং। সূর্য্যের দেখা শোনা পাওয়াই ভার, রাত্রে চাঁদ তারা যে কত দিনই ওঠেন নাই তার হিসাব ছিল না। এই রকম সময়ে একদিন চাঁপাতলার গলির মোড়ে একখানা মোটর গাড়ী কষ্টেসৃষ্টে প্রবেশ করিল, কিন্তু প্রবেশপথেই তার কল বিগড়াইয়াছিল, সে আর চলিল না। গাড়ীর আরোহী দুজন ইহাতে বেজায় বিরক্ত হইয়া কিছুক্ষণ মাদ্রাজী সোফারের সঙ্গে বকাবকি করিলেন ও শেষটায় অগত্যাই নামিয়া পড়িতে হইল।

 দুজনের মধ্যে একজন অপর জনকে বলিলেন, “ওহে ননি! আজ আর তাহলে হলো না, চলো ট্যাক্সি নিয়ে সিনেমা টিনেমা কোথাও একটা ঘুরে আসা যাক।”

 ননী একটু ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, “কিন্তু তার গানের খ্যাতি শুনে আপনি যে তার গান শুনতে আজ আসবেন, এ খবর আমি তাকে পাঠিয়েছি। ডালিম আপনার জন্য যে অপেক্ষা করে থাকবে। আমি তাকে খবর দিয়েছি যে থিয়েটারে তোমার গান রাজা বাহাদুরকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।”

 ‘রাজা বাহাদুর’ অপ্রসন্ন ভ্রূকুটী করিলেন বলিলেন “তা বলে তো আর কাদা মাখামাখি হয়ে যেতে পারিনে। তা ভিন্ন অত সব বল্‌তেই বা তুমি গেলে কেন? গান অবশ্য ভালই লেগেছিল, যেদিন হয় তখন একদিন শুন্‌লেই চল্‌তো। বিশেষতঃ ওদের বাড়ী গিয়ে গান শুন্‌তে আমার তেমন প্রবৃত্তিও হচ্ছিল না। এ হয়ত ভালই হলো।”—

 আর কি বলিতেছিলেন বলা শেষ হইল না, পথের পাশের কর্দ্দমাক্ত অন্ধকার হইতে,কে একজন বলিয়া উঠিল—বাবু! “বাবু মশাই গানশুনবেন?”

 নরেশচন্দ্র কি বলিতেছিলেন ভুলিয়া গিয়া মুক্তকণ্ঠে হাসিয়া উঠিয়া কহিয়া উঠিলেন, “ওই শােন হে ননীলাল! গান শুনবার আবার অভাব কি, যে তার জন্য এই গলির কাদা ভাঙ্গতে হবে? গান স্বয়ং এসেই আমাদের আমন্ত্রণ করছে!—কই কে গান শােনাতে চাইছিলে গা? এসাে না, গান আমি শুন্‌তে রাজী আছি।”

 মােটর গাড়ীর পাশ কাটাইয়া অর্দ্ধান্ধকার গলির ওধার হইতে একটি ছােট্ট মেয়ে এধারে আসিয়া দাঁড়াইল। মেয়েটার পরণে একখানি গােলাপ রংএর সন্তোষপুরের ডুরে, গায়ে একটি ঢলঢলে গােলাপী সিল্কের বাজারে কেনা জ্যাকেট, এক হাত কাঁচের ঝুরো চুড়ি, কপালে তেলেজলে চকচকানো চুলের পাতা নামানো এবং তাহারই নীচে একখানা বড় গুলপােকার টিপ। বয়স তাহার সাত আট বছরের বেশী মনে হয় না। পাতলা ও অপুষ্ট দেহ, কিন্তু রংটুকু দিব্য ফুটফুটে এবং মুখখানিও সুন্দর।

 এই বৃষ্টির রাত্রে জনবিরল অপরিচ্ছন্ন গলির মধ্যে একা এমন সুসজ্জ একটি ছােট বাঙ্গালীর মেয়েকে গান শুনাইতে ব্যগ্রভাবে উদ্যত দেখিয়া নরেশচন্দ্র কিছু বিস্ময় বােধ করিলেন। সাজ পোষাক চেহারায় তাহাকে ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হয়, ভিখারীর মেয়ে কখনই নয়। তবে এমন করিয়া সে পথের মধ্যে গান শুনাইতে চাহিল কি জন্য—এই কথাই তিনি মনে মনে ভাবিতেছিলেন। এমন সময় মেয়েটী ঈষৎ একটুখানি সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু! এইখানেই কি দাঁড়িয়ে গান শুনবেন? না আমার বাড়ীতে আসবেন?”

 ননী এই কথায় অত্যন্ত আমোদ বোধ করিয়া কৌতুকে উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, “ওহে, রাজা! খুকিমণিটি যে আবার বাড়ীতেও ডাকে হে! ব্যাপারখানা কি?”

 নরেশ কিছু ব্যথিতভাবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বাড়ী কতদুর? তোমার গান শুন্‌লে তোমাকে কি কিছু দিতে হয়?—না অম্‌নি গান শুনাও?”

 মেয়েটীর চোখে জল আসিয়াছে তাহা নিকটস্থ মোটরের আলোয় দেখা গেল, সে ঢোক গিলিয়া গিলিয়া সেই চোখের জলটাকে দমনে রাখিল ও কাঁপা ঠোঁটে জবাব দিল, “অম্‌নি ত শোনাইনে, পয়সা দিতে হয়।”— ক্ষীণ কণ্ঠে ইহা বলিয়াই তারপর হঠাৎ যেন চমক-ভাঙ্গা হইয়া উঠিয়া সমস্ত দুর্ব্বলতাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া ব্যগ্রকণ্ঠে কহিয়া উঠিল “অ-বাবু! আসুন না, গান শুনবেন, আসুন না। আমি খুব ভাল গাইতে পারি। আপনার দিব্যি—সত্যি বলছি।”

 ননী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া পুনশ্চ বন্ধুকে সম্বোধন পূর্ব্বক ইংরাজী ঝাড়িল, “হোয়াট এ লিট্‌ল উইচ সি ইজ!” তারপর সেই মেয়েটিকে বলিল “এই বয়স থেকেই খুব তো তৈরি হয়ে উঠেছ দেখছি। ঘরে তোমার আর কেউ আছে বল্‌তে পারো, না তুমিই?”

 মেয়েটী আবার জলভরা চোখে ঘাড় নাড়িল এবং আবার সেই রকম ঢোক গিলিতে গিলিতে অশ্রুজলে ভেজা অস্পষ্টস্বরে “আমার মা আছে, মার বড্ড ব্যারাম—”বলিয়াই হঠাৎ সে দুই করতলে মুখ ঢাকিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। “তৈয়ারি” সে যে এখনও হইতে পারে নাই—তাহাই যেন ওই রকমে সে ইহাদের কাছে প্রমাণ করিয়া দিল।

 একটী মুহূর্ত্তের মধ্যেই নরেশচন্দ্র সকল অবস্থা বুঝিয়া লইলেন। কি দারুণ দুর্ব্বিপাকে পতিত হইয়াই এই কচি বয়সের মেয়েটা আজ কি নিষ্ঠুর দুর্ভাগ্যের হস্তে নিজেকে ঠেলিয়া দিতে আসিয়াছে, সেই ভয়াবহ কাণ্ডটা যেন একটা প্রচণ্ড বিভীষিকার মূর্ত্তিতে নরেশের দুই চোখের সাম্‌নে অগ্নিময় হইয়া উঠিল। এই সমাজ-পরিত্যক্ত পতিত জীবগুলার শেষ দুরবস্থা তাহাদের পাপের ভার প্রায় এই রকমেই ভরাইয়া তােলে। কোন পতিতপাবন যদি নিজে আসিয়া এদের একটা সুব্যবস্থা করিতে পারেন, তবেই হয়ত এর একটু সদুপায় হয়। করুণায় একেবারে বিগলিত হইয়া পড়িয়া তিনি তৎক্ষণাৎ মেয়েটীর কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বাড়ী কি বেশীদূর? কাছে হয়ত আমি যাব।”

 মেয়েটী রুমালে চোখ মুছিয়া হাত দিয়া দেখাইয়া বলিল, “ওই বড় বাড়ীটার একতলার একটা ঘরে আমি আর মা থাকি, দূরে যেতে আমার ভয় করে, আমি পারি না।”

 নরেশ তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “চলো।”

 সােফার বলিল, “রাজা সাহেব! গাড়ী ঠিক হয়ে গেছে।”

 ননী উৎসাহিত হইয়া প্রস্তাব করিল, “ওহে, তাহলে এটিকে কিছু দিয়ে ডালিমের ওখানেই যাওয়া যাক্ চলো।”

 নরেশ কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়াই অগ্রসর হইতে থাকিয়া সঙ্গিনী মেয়েটীকে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার নামটা বলতো?”

 সে বলিল, “আমার নাম সুষমা। কিন্তু আমায় সবাই বেদানা বলে ডাকে।”

 “তুমি ক’ বছরের?”

 মেয়েটী বলিল, “ন’ বছরের।”

 “নয়! তা কিন্তু মনে হয় না। আচ্ছা গান গেয়ে তুমি রোজ কত করে পাও?”

 সুষমা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া তারপর আবার তেমনি সলিলার্দ্রকণ্ঠে উত্তর করিল, “এই তিনদিনে এক টাকা বার আনা পেয়েছি, তাতে আর এক শিশি ওষুধ বই হয়নি।”

 নরেশ কিছু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “অত-কম কেন? একটা গানে কত নাও?”

 সুষমা বোধ হয় নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল, সে এবার তাহা গোপন চেষ্টা না করিয়াই জবাব দিল, “কত আর নিই, যে যা দেয়। কেউ শুন্‌তেই চায় না, অনেকে এমন ঠাট্টা করে যে আমার গাইতে ভালও লাগে না। আজ তাই সারাদিন আসিনি, এখন মার বড় ক্ষিধে পেয়েছে—কি করি তাই এলুম। না হলে—”

 মেয়েটী আর কিছু বলিতে পারিল না, কেবল তাহার ক্ষুদ্র শরীরটুকু দুলিয়া দুলিয়া উঠিয়া তাহার অসহ্য দুঃখ জানাইয়া দিতে লাগিল।

 পাপের পরিণাম যেমন সচরাচর ঘটিয়া থাকে এ ক্ষেত্রেও তাহার অতিরিক্ত কিছু নয়। বয়সে বৃদ্ধা না হইলেও তরঙ্গিনী রোগে রোগে এমন দশা হইয়াছিল যে চোখে সে যেন দেখা যায় না। সেঁৎসেঁতে ঘরের মেজেয় ছেঁড়া ময়লা দুর্গন্ধ বিছানায় কঙ্কাল মূর্ত্তির মত মা পড়িয়া পড়িয়া যন্ত্রণায় আর্ত্তনাদ করিতেছে, গৃহসজ্জার মধ্যে দু একটি ওষুধের শিশি, একটা জলের ঘটি ও এক পাশে দু একটা হাড়িকুঁড়ি ও ময়লা কাপড় চোপড় পড়িয়া আছে। এই ভয়ানক দুরবস্থাপন্ন গৃহের মধ্যে গৃহস্বামিনীর কন্যা আসিয়া যখন দাঁড়াইল, এই ঘরের গৃহবাসিনীর সহিত তুলনায় তাহার সাজসজ্জাকে তখন কত বড় যে কৃত্রিম বলিয়াই বোঝা গেল, সে যেন বাহিরে থাকিতে অনুভবও করা যায় না। মেয়ের সাড়া পাইয়াই সেই কঙ্কালাবিশিষ্ট মুমূর্ষু ক্ষীণ কণ্ঠ হইতে প্রবল তীক্ষ্ণ স্বর বাহির করিয়া বদ্ধ জন্তুর অনুপায় হিংস্র গর্জ্জনের অনুকল্পে চেঁচাইয়া উঠিল, পোড়ারমুখি! অ-পোড়ারমুখি। এরই মধ্যে যে আবার ছুটে চলে এলি বড়? এবার যদি পয়সা না নিয়ে আমার ঘরে ঢুকেছিস তো এই মরতে মরতে উঠেও খেংরার চোটে পিঠের চামড়া খানা তুলে নেবো জেনে শুনে ঢুক্‌তে আসিস্। পোড়ারমুখী তোর আবার ভদ্দরআনির অত পটপটানি কেন্‌লা শুনি? লোকে ঠাট্টা করলে ওঁর লজ্জায় মাথা কাটা যায়। ওরে আমার লজ্জাবতী লতারে! এর পরে খাবি কি করে? দাসীগিরি করলেও যে কোন ভদ্দর লোকের ঘরে তোকে ঠাঁই দেবে না তা জান্‌চিস কিছু?”—

 সুষমা ছলছলে চোখে মায়ের কাছে ঘেঁসিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়া অশ্রুগাঢ়স্বরে কহিল “রাজাবাবু গান শুনতে এসেছেন।”

 “ওমা! তাই বল! আসুন আসুন, কি সৌভাগ্য আমার, যে আমার মতন দীনের কুটীরে আজ পূর্ণচন্দ্রের উদয় হলো! ওমা, ও বেদানা। আসনখানা এনে রাজা বাবুকে পেতে দাও মা, পেতে দাও! আঃ এমন আধমরা হয়ে পড়ে আছি যে, উঠে বসে আপনাদের মতন মহাজনদের একটু সম্বর্দ্ধনা করে নেবো সেটুকুও শক্তি আমার পোড়াদেহে নেই।”

 নরেশ ও ননীলাল আসন গ্রহণ করিলেন, সুষমার গানও একটার পর একটা করিয়া তিন চারটে শোনা হইয়া গেল। গলা শুনিয়া নরেশের তো বটেই, এমন কি ননীবাবুরও আর এই সন্ধ্যাটাকে নিতান্তই ব্যর্থ বলিয়া বোধ হইল না। গান শুনিয়া নরেশ তরঙ্গিনীকে বলিলেন, “সুষমার এমন গলা ওকে কেন কোন থিয়েটারে দাওনি?”

 তরঙ্গিনী ফোঁস করিয়া একটা জ্বলন্ত নিশ্বাস ফেলিল, “দেখুন, রাজা সাহেব! পাপের পথে যতই এগিয়ে গেলুম, পাপের ভারে মন আমার ততই অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। সুখ খুঁজতেই বাড়ীর বাইরে এসেছিলাম, খুঁজে দেখলুম,— তার একটা কণাও পেলুম না। আমার সেই কুঁড়েঘরে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, এই বাড়ীর তেতালাতেও তা পাইনি, তাই বড় সাধ ছিল ওকে ও পথে আর যেতে দিব না। ওর গলার জন্যে বছরখানেক আগে থেকেই ওর জন্যে ওরা দর দিচ্ছিল, আমি যেতে দিইনি। কি মনে করেছিলুম জানেন? আমার সব টাকা দিয়ে ওর জন্যে কোম্পানির কাগজ কিনে দেবা, তার আয়ে ওর খাওয়া পরে চলবে, আর ওকে খুর গান বাজনা শেখাব, বড় হয়ে ও একটা সঙ্গীত বিদ্যালয় খুলবে, তাই থেকে ওর নামও হবে, পয়সাও হবে, আর ধর্ম্মও থাকবে। তা হলো না। তা হলো না,—ভগবানের ইচ্ছে নয়—তা হলো না।”

 নরেশ এই রূঢ়ভাষিণী নিষ্ঠুর প্রকৃতির পতিতা মায়ের মনের ভিতরের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সন্তানের হিতাকাঙ্ক্ষার পরিচয়ে সেই মুহূর্ত্তেই তাহার জন্য অনেকখানি সহানুভূতিপূর্ণ হইয়া উঠিলেন, তারপর ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার টাকা ছিল, তাহলে এমন হলো কেন?”

 তরঙ্গিনী বলিল “ঠকিয়ে নিলে মশাই! ঠকিয়ে নিলে। ভদ্রলোক মনে করে শ্যামলাল পাইনের হাতে দশ হাজার টাকা কোম্পানির কাগজ কিনতে দিলুম। সেই টাকা নিয়েই সে ফেরার হলো! উল্টে তার পিছনে পুলিসে ডিটেকটিভে কত রকমে কত টাকাই আমার খরচ হয়ে গেল মশাই! ধনে প্রাণে আমায় সে মেরে গেল। তা যদি ধর্ম্ম থাকেন, তা হলে একদিন ঐ টাকা নেওয়া তার বেরুবে, ওম্‌নি হজম করতে পার্ব্বে না।—” আরও অনেক কটূক্তি সে তাহার নিজের ধনের অসৎ পথের অংশীদারের উদ্দেশ্যে ফোয়ারার মতই উৎসারিত করিয়া দিল। তারপর মনের জ্বালা, গালির বন্যায় অনেকখানি প্রশমিত হইয়া আসিলে পরে, কথঞ্চিৎ শান্তভাবে পুনশ্চ নিজের কাহিনী ফিরিয়া আরম্ভ করিল। অনেক আড়ম্বরে নিজের সুখ-ঐশ্বর্য্যের দিনের সবটুকু খবর দিয়া মোট কথা সে এইটুকু জানাইল যে, সেই চৌর্য্য ব্যাপারের পর হইতেই মনের অত্যন্ত আঘাতেই তার বাতজ্বর হয়; তার উপর উকিল বাড়ী, পুলিস থানায় ছুটাছুটি ইত্যাদিতে রোগ বাড়িয়া যায়। উপার্জ্জন বন্ধ,—চিকিৎসার খরচ প্রথমে গহনা, শেষে আসবাবপত্র বেচিয়া চলিতে থাকে। কালের ধর্ম্মে গহনাগুলায় সোনার ভাগ কমই ছিল, বিলাতি সোনা, পাথর, মতি এই সবই কিনিবার সময় দাম লাগে বেশ, বেচার বেলায় সিকি হইয়া যায়। শেষে বেচিতে বেচিতে যখন সবই ফুরাইয়া গেল কেবল প্রাণটাই বাকি রহিল, ডাক্তারও ঔষধ বন্ধ করিয়া দিলেও শুধু পথ্য মেলা পর্য্যন্ত ভার হইল। প্রথম কিছুদিন ধার কর্জ্জ বন্ধু বান্ধবের দয়াধর্ম্মে চালাইয়া—শেষে সে সবও যখন শেষ হইয়া গেল, তখন অনুপায়েই সুষমাকে রোজগার করিতে পাঠাইতে হইল। তাহাকে থিয়েটারে পাঠানই স্থির হইয়াছে, কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। কাঁদিয়া উঠিয়া পা জড়াইয়া ধরে, বলে অত লোকের সামনে গান তাহার গলা দিয়া বাহির হইবে না;—বরং সে পথে পথে ভিক্ষা করিয়া পয়সা অনিয়া দিবে, তবু ওখানে যাইতে পারিবে না।

 তরঙ্গিনী বলিল, “দেখুন রাজাবাবু! মেয়েটার ঐ কথা শুনে আমারও কি আর বুক ফেটে যায়নি? আমিই তো ওকে সেই একরত্তি বেলা থেকে পাপকে ঘেন্না করতে শিখিয়ে এসেছি। আমার পাপ আমার সঙ্গেই বিদায় হোক, ওকে আমার সে যেন কিছুতেই স্পর্শ করে না’,—এই যে আমার ঠাকুরের কাছে একমাত্র কামনা ছিল। কিন্তু কি করবো বলুন, পোড়া পেটের দায়ে শেষকালে তাই আমায় করতে হলো। আপনি বলুন তো ও রকম ভিখিরির মতন পথে বার হওয়ার চাইতে এখন থেকেই থিয়েটারে ঢোকা ওর পক্ষে ভাল নয় কি? আপনি বরং  দয়া করে ওকে নিয়ে গিয়ে ম্যানেজারকে একটু বলে কয়ে দেন,— দেবেন কি?”

 নরেশ সুষমার মুখের দিকে চাহিতেই তাহার ভয়ত্রস্ত দুটি চোখের সঙ্গে তাঁহার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মিলিত হইয়া গেল। সেই শিশুর মত বালিকা-চক্ষের ভীতিপূর্ণ দৃষ্টিটুকু নরেশের পুরুষ চিত্তকে বিপুলবলে আকর্ষণ করিল। আহা এই কুপথ অনুসরণে একান্ত অনিচ্ছুক এই একান্ত অসহায় জীবনটাকে সে যদি আজ তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া যায় তাহা হইলে সে কি ইহার ভবিষ্যতের সমুদয় পাপ এবং তাপের জন্য সম্পূর্ণরূপেই দায়ী হইয়া থাকিবে না? তাহার বুদ্ধি তাহার বিবেক উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিল, “নিশ্চয়—নিশ্চয়—নিশ্চয়, তাহাকে,—শুধু একমাত্র তাহাকেই এই অসহায় জীবটীর সমস্ত দুর্দ্দশার জন্য এখানে নাই হোক, আর এক লোকের সব চেয়ে বড় দরবারে জবাবদিহী করিতে হইবেই হইবে। তখন সে বলিবে কি? ঘৃণা করিয়া সে ইহার দিকে চাহে নাই,এই কথা কি জোর করিয়া বলিতে পারিবে? ঘৃণা বাস্তবিকই তো ইহাদের তাহার করে না! তা করিলে ডালিমের গান শুনিতে এই বর্ষার রাত্রে বাহির হইয়াছিল কিসের জন্য? অবজ্ঞায় তুচ্ছ করিয়া চলিয়া আসিয়াছিলাম,—এমন কথাটা মুখ দিয়া বাহির করিতে, লজ্জায় কি মুখ ঢাকিতে ইচ্ছা করিবে না? তিনি যে এর আসন্ন বিপদের ঠিক সন্ধিক্ষণেই তাহার রক্ষা-হস্তের মধ্যেই এই অনন্যসহায় ভীরু দুর্ব্বল ক্ষীণ হস্তখানি টানিয়া আনিয়া তুলিয়া দিয়াছেন! কেমন করিয়া সে ইহার এত বড় দুর্দ্দশার দিনে ইহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া চলিয়া যাইবে? না সে তাহা পারে না।—মনুষ্যত্বের দিক দিয়া তো নয়ই, অমানুষ হইলেও নয়। সৃষ্টির মধ্যে যে কদর্য্য সৃষ্ট কাক,—তারাও সহায়চ্যুত কোকিল শিশুকে নিজের কুলায়ে লালন করে, ফেলিয়া দেয় না।

 নরেশ একটু পরেই বিদায় লইলেন, আসিবার সময় সুষমার হাতে দশটী টাকা দিয়া তার মাকে বলিয়া আসিলেন, “সময় মত তিনি আবার আসিবেন, তাহাদের খরচ তিনিই দিবেন কিন্তু আজ হইতে সুষমা তাঁহার মতানুবর্ত্তী হইয়া চলিবে এবং তাঁহাকে না জানাইয়া বাড়ীর বাহির হইতে পাইবে না।”

 সুষমার বয়স যদি ন’বছর না হইয়া চৌদ্দ হইত তো তরঙ্গিণী বা ননীবাবু কিছুই বিস্মিত হইত না। তাহা নয় বলিয়াই দুজনেই একটু একটু বিস্ময় বোধ করিল। কিন্তু তখনি কি ভাবিয়া লইয়া পতিতা করজোড়ে কহিল, “কিন্তু আমারও একটি নিবেদন আছে রাজাবাবু! আপনি দেবতা মানেন?”

 “কেন?”

 “তা হলে দেবতার নাম নিয়ে শপথ করতে হবে, বেদানাকে আপনি কোন দিনই ত্যাগ করতে পারিবেন না।”

 নরেশ শুধু বলিলেন, “আচ্ছা।”