হারানো খাতা/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

গগন ব্যবধান, তবুও মন-প্রাণ, না সঁপি যদি বুক না ফাটে
তাহার নিষ্ঠায় রাখিয়া বিশ্বাস স্বপন ভরে দিন নাহি যায়,
ভাঙিলে সে স্বপন—মরিতে নার যদি—ব’লনা ‘প্রেম’ তবে কভু তার

—তীর্থরেণু

 সুষমার মা মাসখানেকের মধ্যেই মরিল। তখন সুষমাকে লইয়া নরেশ একটু বিপন্ন বোধ করিলেন। পতিতার গর্ভজাত কন্যাকে নিজের ঘরে আনিয়া রাখা সঙ্গত নয়; অথচ থাকেই বা সে কোথা? তাহার শিক্ষা ও চিত্তবৃত্তির যে পরিচয় তিনি পাইতেছিলেন তাহাতে তাহার প্রতি মমতায় চিত্ত তাঁহার পরিপূর্ণ হইয়াই উঠিতেছিল, এমন জীবনটী যেমন করিয়াই হোক তাহাকে নির্ম্মল করিয়া রাখিতে হইবে; পাঁকের মধ্যে জন্মিলেও তাহাকে পঙ্কজরূপে ফুটিয়া উঠিতে সহায়তা করিতে হইবেই। ভাবিয়া চিন্তিয়া ভবানীপুরের প্রান্তে এই ছোট্ট বাড়ীখানি তাহার নামে কিনিয়া দিলেন। একটী বুড়ী দরওয়ান ও একটী বুড়া চাকর রাখিয়া তিনি সেই বাড়ীতে এই ভিন্ন জগতের মেয়েটীকে এক রকম বন্দীদশাতেই প্রতিষ্ঠিত করিলেন। ঝি প্রভৃতি ইচ্ছা করিয়াই রাখিলেন না। কারণ, ইহার পরিচর্য্যা করতে স্বীকৃত হইবে এমন দরের যে ঝি, অসৎ শিক্ষা দিবার গুরুমহাশয় তাদের মত অল্পই পাওয়া যায়—এই রকমই নরেশের বিশ্বাস ছিল।

সুষমার মায়ের সাধ ছিল মেয়ে সঙ্গীত কলাটা ভাল রকমে আয়ত্ত করিয়া তাহারই চর্চ্চায় ও শিক্ষায় জীবনোৎসর্গ করিতে পারে। নরেশচন্দ্রের ইহা অসঙ্গত ঠেকিল না, এই রকমই একটা কোন পথ ইহাদের জন্য তোর করিয়া না দিতে পারিলে এদের জীবনই বা আশ্রয় পায় কোথায়? আজকাল তো অনেকেই মেয়ে বউদের গানবাজনা শিক্ষা দিতেছেন, এদের মধ্যে যারা পাপের পথ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া সুপথে জীবিকার্জ্জন করিতে চায়, তাদের লইয়া যদি একটা সঙ্ঘ তৈরি করা যায়, অবশ্য বিশেষভাবে পরীক্ষা লইয়া,—তবেই ইহাতে প্রবিষ্ট করাইতে হইবে। তাহারা অন্তঃপূরিকাদের গানবাজনা শিখাইতে পারে। বৈষ্ণবীরা তো অন্তঃপুরে ভিক্ষা লইতে যায়, মিসরী মেমেদের সঙ্গে যে সকল দেশীয় খৃস্টান মেয়েরা যিশুর গান গহিয়া ও শেলাইবোনা একটু আধটু শিখাইয়া বেড়ায় তাদের মধ্যেও তো ঢের জিনিষ ছিল, ধর্ম্মশিক্ষার ও সঙ্ঘ-মধ্যের শাসন সংযমতায় তারাও সংযতভাবে চলিতে শিখিয়া অন্তঃপুর-শিক্ষার অধিকার লাভ করিয়াছে। তেম্‌নি এদের লইয়াও যদি একটা কর্ম্মশালা খোলা যায় মন্দ হয় কি? অত্যন্ত উৎসাহের সহিত নরেশচন্দ্র ওস্তাদ রাখিয়া সুষমাকে গানবাজনা ভাল রকমেই শিখাইতে লাগিলেন।

 হরিধন ঠাকুদ্দা তাহার তানপুরা সেতারের ওস্তাদ হইল, ননীবাবু হইল হারমোনিয়ম ও এসরাজের এবং একজন বুড়া হিন্দুস্থানী আসিয়া বীন্ শিখাইতে লাগিয়া গেল। ইংরাজী বাংলা লেখাপড়া শিখাইবার ব্যবস্থাও হইল। সমস্ত মনপ্রাণ ঢালিয়া দিয়া নরেশচন্দ্র আবর্জ্জনা ঠেলিয়া ফেলিয়া ধূলা ময়লা কাটাইয়া ইহার ভিতরকার খাঁটী সোনাটুকু ধুইয়া বাহির করিতে চাহিতেছিলেন। কয়েক বৎসর কাটিয়া গেলে দৈবাৎদৃষ্ট একটী বৃদ্ধ সাধুর প্রতি তাঁহার বড়ই শ্রদ্ধা জন্মিলে তিনি তাঁহাকে ইহার নিকট টানিয়া আনিলেন। মেয়েটীর ভিতরকার আগ্রহ ও সদিচ্ছা সাধুটীকেও বিগলিত করিল, তিনি সানন্দে ও সাগ্রহে উহাকে যখন তখন আসিয়া সংস্কৃত পরিচয় করাইতে আরম্ভ করিয়া মুখে মুখে নীতিশাস্ত্রের অনেক শিক্ষাদানই করিলেন। ইঁহাকে পাইয়া সুষমা নিজেকে যেন কৃতার্থ বোধ করিল। এমন মহৎ সঙ্গ ও প্রকৃত স্নেহ সে ত কল্পনাতেও কখন পায় নাই।

 এদিকে কিন্তু বাহিরে বাহিরে নরেশ ও সুষমা সম্বন্ধে অনেক কিছুই রটিয়া উঠিতেছিল। নরেশ—অবিবাহিত ধনী ও নিরভিভাবক নরেশ একটা কম বয়সের—সে যে কত কম সে হিসাব রাখিতে কার গরজ পড়িয়া গিযাছে—মেয়েকে একখানা সাজান বাড়ীতে রাখিয়া তার উপর বিস্তর খরচপত্র করিতেছেন, তাঁর বন্ধু বান্ধবেরা আসিয়া সেখানে গানবাজনার মজলিস জমাইয়া তুলে;—আবাব সে মেয়েও দেখিতে ভাল, গায় ভাল, বাজায় উৎকৃষ্ট!—এসব যোগাযোগের মধ্যে সাধারণতঃ মানবকল্পনা কিসের সন্ধান পাইয়া থাকে! কাজেই চারিদিকে সুষমা সম্বন্ধে যে গুজব রটিল, সে তার বেশ অনুকূল নয়। নরেশের বাকি বন্ধু যারা, তারা ননীবাবুদের প্রতি তীব্র ঈর্ষা প্রদর্শন করিয়া নরেশকেও তাঁহার একচোখোমীর জন্য ঠাট্টা বিদ্রূপ ও অনুযোগ করিতে থাকিল। নরেশ ব্যস্ত হইয়া সকলকেই অল্প বিস্তর বুঝাতে চেষ্টা করিলেন যে, তাহাদের আন্দাজ একেবারেই ভিত্তিহীন, সুষমা তাঁহার আশ্রিতা।—আর কিছুই নয়। সে নেহাৎ ছেলেমানুষ এবং অত্যন্ত নির্ম্মল। বন্ধুরা মুখ টিপিয়া চোখের ইসারা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “বেশতো, হোক না সে সতীত্বের শ্বেতপদ্ম! আমাদের তাতে তো কোনই আপত্তি নেই। আমরা শুধু তার দুটো গান শুনে আসতে চাই এই বৈতো নয়।”

 অগত্যা গান শুনাইতে হইল এবং আরও দুচারবার বিশেষ অনুরোধ রক্ষা না করিয়া পার পাওয়া গেল না। ইহাঁদের মধ্যের দু একজন গূঢ় রহস্য করিয়া সুষমার সঙ্গে কথা কহিতে যাইতেই নরেশ চোক রাঙ্গা করিয়া চাহিলেন এবং সেই হইতে তাঁহাদের বন্ধুত্বের অবসান হইল। নিজের সম্পত্তির উপরে উঁহার প্রবল আধিপত্যের চেষ্টা বোধ করিয়া বাকি সকলে কদাচ সুষমার গান শুনিতে চাহিলেও, তাহাকে অসম্মানের ভাবে সম্ভাষণ করিতে ভরসা করে না। কিন্তু তবুও সুষমা হঠাৎ একদিন নিজের সম্বন্ধে লোকমতটা ভালরূপেই জানিতে পারিল।

 সাধুটি বদরিনাথ চলিয়া গিয়াছেন, সুষমার বয়স এখন ষোড়শ পূর্ণ; ননীবাবু ও হরিধন এখন শুধু সপ্তাহে একদিন করিয়া আসে, বাকি দুজন একদিন অন্তরে। সুষমার মনটা আজকাল বড়ই শূন্য শূন্য বোধ হইতেছিল; নরেশ ইদানীং আর তেমন ঘন ঘন আসাযাওয়া করেন না। আসিলেও আর যেন তেমন প্রাণখোলাভাবে তাহার সহিত না মিশিয়া চুপচাপ গানের বুলিই শুনিয়া যান এবং গানের শেষে সবার সঙ্গেই, কোন দিন সকলের চেয়ে আগে উঠিয়া, নিঃশব্দে প্রস্থান করেন। কে জানে কেন সঙ্গতই হোক আর অসঙ্গতই হোক সুষমার প্রাণ ইহাতে ব্যথিত হয়, তাহার বুকের মধ্যে আঘাত লাগে।

 একদিন সে ইহার কারণ বুঝিতে পারিল। কালীঘাটে মহিলা সমিতি হইল। স্বদেশী সম্বন্ধে কোন ভদ্র মহিলা কি বক্তৃতা করিবেন। নরেশকে পত্র লিখিয়া তাঁহার অনুমতি লইয়া সে সেই সমিতিতে গেল। সে যেখানে বসিয়াছিল, কমবয়সী কতকগুলি বৌ ঝির সেইখানে সমাবেশ হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ তাহার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। একজন, অপরকে বলিল, “দেখেছিস্ ওর মুখের সঙ্গে আমাদের ছোট বৌদির একটু যেন আদল আসে। কে ভাই ও?”

 “জ্যাকেটটির ছাঁট তো বড় সুন্দর! জিজ্ঞেস্ কর্ না কাদের বাড়ীর মেয়ে না বউ?”

 “ওমা, বউ কি বলছিস্ লো! সিঁতেয় নাকি সিঁদুর আছে। জান্‌না ভাই—ও কে?”

 অবশেষে জানাজানি হইল। সুষম উহাদের প্রশ্নে প্রশ্নে বিব্রত হইয়া স্বীকার করিল, তার বিবাহ হয় নাই, তার বাপকুলের কেহ নাই। তার বাপের নাম জিজ্ঞাসায় সে নিরুত্তর রহিল। তারপর কার কাছে থাকে জিজ্ঞাসায় সে যখন বলিল, একাই থাকে, তখন সেই তরুণী মেয়েরা যেন দিশাহারা হইয়া পড়িল। একটী মেয়ে বুদ্ধি করিয়া প্রশ্ন করিল “তোমরা কি ভাই ব্রহ্মজ্ঞানী? তাদের ঘরের মেয়েরা মেমেদের মতন পড়াশোনার জন্যে বোডিং টোডিং-এও তো থাকে শুনেছি। সেই রকমই কি এখানে এসেছ?”

 সুষমা স্নান ও বিপন্নভাবে ঘাড় নাড়িল।

 এই সময়েই একটী প্রৌঢ়া উহাদের কথাবার্ত্তায় একটুখানি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়া তাহাদের সামনে আসিয়া সুষমার মুখের কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিয়া উঠিলেন, “দেখি কার পরিচয় শোধান হচ্ছে। ওমা! এ যে ওই ‘সুষমাকুটিরে’র সুষমা গো! অবাক্‌ কল্লি তোরা। ও আবার নিজের পরিচয় কি দেবে তোদের শুনি? চল্ চল্ ওদিকে গিয়ে বস্‌বি চল্। ছুঁড়িগুলোয় যদি কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে! হরিবলো মন!—”

 নিজেদেব কাণ্ডজ্ঞানের অভাবটা কোথায় ঘটিয়াছিল ভালমতে বুঝিতে না পারিলেও কোথাও যে ঘটিয়াছে সেইটুকু বুঝিয়া লইয়া সেই অনুসন্ধিৎসাপরায়ণ তরুণীর দল দুমদাম করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং ঝন্‌ঝন্ শব্দে অলঙ্কার বাজাইয়া সভামণ্ডপের অপর প্রান্তে চলিয়া যাইতে যাইতে পূর্ণ কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করিয়া বলিল, “কেন গা! ওকে কি আপনি চেনেন?”

 প্রৌঢ়া হাতমুখ নাড়া দিয়া কহিয়া উঠিলেন, “ওমা, তা আর চিনিনে? ও যে কোথাকার এক খেতাবী রাজার রাখা মেয়েমানুষ। ওর সঙ্গে কি আর ভদ্দর ঘরের মেয়েদের কথা কইতে আছে মা?”

 সুষমার মনে হইল, তাহার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা ঘুরিতেছে। আলোকময় জগৎ যেন তমসাবৃত হইয়া গেল।

 নরেশচন্দ্র ও কিছুদিন হইতে এই সম্বন্ধীয় জ্বালা নেহাৎ কমও ভুগিতেছিলেন না। বন্ধু বান্ধবদের কথা ছাড়িয়া দিলেও সুহৃদ ও হিতকামীর দলও তাঁহাকে মধ্যে মধ্যে অল্প বিস্তর ভৎসনাপূর্ব্বক এই সর্ব্বনেশে নেশার হস্ত হইতে মুক্ত করিতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছিলেন। দেশ হইতে বিমাতা হঠাৎ এক চিঠি লিখিয়া পাঠাইছেন—তাহার মর্ম্ম এইরূপ—বিশ্বস্তসূত্রে জানিলাম তুমি একটা পতিতার সঙ্গ লইযা উন্মত্ত হইয়াছ, তাহার পায়েই সর্ব্বস্ব ঢালিয়া দিতেছ, তাকে রাণীর বাড়া করিয়া রাখিয়াছ। এ সব কি ভাল? অবশ্য তোমাদের মত বড় লোকের ঘরে সবই সাজে, তথাপি বিবাহ না করিয়া শুদ্ধমাত্র হীনসঙ্গে কাটাইলে চলিবে কেন? বংশবক্ষা করা ত চাই। ও সব যা আছে থাক্; তা না হয় এর সঙ্গে একটী বউ আন, সব গোল চুকিয়া যাক্। যদি তোমার মত হয় আমার বোনঝি চামেলীর সঙ্গে তোমার বিয়ের দিন স্থির করি। চামেলীকে ছোটবেলায় বোধ করি দেখিয়াছ? বড় হইয়া আরও সুন্দরী হইয়াছে। দিব্য ডাগর মেয়ে, তোমার সঙ্গে অসাজন্ত হইবে না।

 এই চিঠি পাইবার পর নরেশের দ্বিধাগ্রস্ত মন যেন সম্পূর্ণরূপেই তাহার নূতন চিন্তাধারারই অনুবর্ত্তন করিয়া একেবারে স্থিরসঙ্কল্পে দৃঢ় হইয়া উঠিল। নিরপরাধিনী সুষমার প্রতি যে অবিচার হইয়াছে ইহাই তাহার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত।

 সন্ধ্যাবেলায় একাকিনী সুষমা বসিয়া অর্গানের বাজনার সঙ্গে নিজের মধুর কণ্ঠের যোগ করিয়া গাহিতেছিল——

“ওহে জীবনবল্লভ! ওহে সাধব-দুর্ল্লভ।
আমি মর্ম্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব,
শুধু নীরবে যাব, হৃদয়ে লয়ে প্রেম মুরতি তব।—”

 হঠাৎ খুব কাছেই জুতা-পায়ের শব্দে মুখ তুলিয়া দেখিল, নরেশচন্দ্র।

 তৎক্ষণাৎ বাজান বন্ধ করিয়া সে উঠিয়া পড়িতে গেল। মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া পায়ের কাছে প্রণাম করিল।

 নরেশ ব্যগ্র হইয়া বারণ করিলেন, বলিলেন, “বেশ মিষ্টি লাগছিল, জান তো গান শুনতে আমি বড় ভালবাসি। যা গাচ্ছিলে গাও, আমি শুনি।”

 সুষমা আজ্ঞা পালন করিল। গাহিতে তার উৎসাহ বর্দ্ধিত হইল। সে গাহিতে লাগিল—

সুখ দুঃখ সব ত্যজ করিনু, প্রিয় অপ্রিয় হে,
তুমি নিজ হাতে যাহা দিবে তাহা মাথায় তুলে লব।”

 গান থামিলে তাহার দিকে —একটু নত হইয়া নরেশ কোমলকণ্ঠ কহিলেন—“নিজে হাতে ‘যা’ দেব, তা মাথায় তুলে নেবে কি? ‘তোমার মর্ম্মের কথা’ আমি না জানি তা’ নয়; আজ ‘আমার মর্ম্মের কথা’ আমি তোমায় জানাতে এসেছি, তুমি শুন্‌বে কি বেদানা?”

 সুষমা এমন সুর ইঁহার কণ্ঠে কোন দিনই শুনে নাই। আর এই সব কথা! সে ত্রস্ত বিস্ময়ে অবাক হইয়া তাঁহার মুখের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিল।

 নরেশ তাহা বুঝিতে পারিয়া কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করিলেন ও তাহার দৃষ্টি হইতে নিজের চোখ সরাইয়া লইয়া তাহার কাঁধের উপর হাত রাখিয়া মৃদু অথচ আবেগপূর্ণ কণ্ঠে কহিলেন, “আমি তোমায় ভালবাসি।”

 সুষমা দুই হাতে মুখ ঢাকিল। নরেশ দেখিলেন সে হাত দুখানা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। তিনি দুই হাতে তাহার মুখ তুলিতে চেষ্টা করিয়া বলিতে লাগিলেন—

 “অনেকদিন থেকেই তোমায় আমি ভালবেসেছি, দূরে সরে যাবার চেষ্টা কর্‌ছিলাম, পার্‌লাম না, তুমিও তো আমায় ভালবাস—আমার হও। আমি তোমায় চাই।”

 সুষমা জোর করিয়া তাঁহার হাতের মধ্য হইতে নিজের মুখ ছিনাইয়া লইয়া পিছু হটিয়া গেল, বারেক মাত্র তাহার শান্ত, সন্ধ্যাতারার মত স্নিগ্ধ দৃষ্টি দীপ শিখার মতই প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার ললাটের শিরা সকল স্ফুরিত হইয়া ধূমকেতুর মত দেখাদিয়াছিল, কিন্তু সে একটা মুহূর্ত্তের জন্য। পরক্ষণেই অসহায় ও অবসন্নভাবে নরেশের পায়ের তলায় জানু পাতিয়া বসিয়া পড়িয়া সে দুটা হাত জোড় করিয়া বলিল—

 “আপনার আদেশ লঙ্ঘন করবার সাধ্য আমার নাই; কিন্তু ইহলোকে আপনিই যে আমার একমাত্র আশ্রয়—আমার দেবতা। আপনার প্রতিও শ্রদ্ধা হারালে কি নিয়ে আমি বাঁচবো আমায় তাই বলুন?—“বলিতে বলিতে থবথর করিয়া বায়ুতাড়িত পুষ্প-পেলবের ন্যায় দুখানি ঠোট কাঁপিয়া উঠিল, ঝর ঝর করিয়া চোখের জল পাতায় জমা শিশিরের মত ঝরিয়া পড়িল।

 নরেশ তাহার কথার ভাবার্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়াই নিতান্ত দুঃখিতভাবে কহিয়া উঠিলেন, “তুমি আমায় ভুল বুঝেছ বেদানা! তেমন করে তোমায় আমি পেতে চাইনি। আমি স্থির করেছি তোমায় আমি বিয়ে করবো।”

 বিদ্যুৎছটার মত দীপ্ত হইয়া উঠিয়া সুষম উচ্চকণ্ঠে কহিয়া উঠিল আপনি আমায় বিয়ে করবেন! আমাকে! নিশ্চয়ই আপনার মাথার ঠিক নেই; কিম্বা—”

 নরেশ মনের মধ্যে ঈষৎ লজ্জানুভব করিলেও তাহা গোপন রাখিয়া সপ্রতিভভাবেই হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমি পাগলও হইনি, নেশাও করিনি, সহজ সজ্ঞানেই এই প্রস্তাব করছি এবং এ সম্বন্ধে আমার সঙ্কল্প স্থির হয়ে গেছে,—তা আর বদলাবে না।”

 শুনিয়া সুষমার মুখের ভাব অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল, সে তাহার শানিত ছুরিকার মতই উজ্জ্বল ও তীক্ষ দৃষ্টি নরেশের আবেগময় নেত্রের উপর স্থির করিয়া তেমনি নির্ম্মমকণ্ঠে জবাব দিল—“কিন্তু আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত নই। আমি আপনার স্ত্রী হতে চাইনে।”

 নরেশের মুখের ছবি বিস্ময় ও বেদনাহত হইয়া উঠিল “সে কি!— সুষমা! তুমি কি আমায় তবে ভালবাস না?”

 বন্দুকের গুলি খাইয়া ছোট পাখীটী যেমন ঘুরিয়া পড়ে, তেমনি করিয়াই মুহ্যমান সুষমা আবার নরেশের পায়ের তলায় ফিরিয়া বসিয়া পড়িল। অনাহত চোখের জলকে প্রাণপণে রোধ করিতে করিতে অর্দ্ধব্যক্তস্বরে সে কহিল, “আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সঙ্গত কিনা ভগবানই জানেন। কিন্তু জ্ঞানতঃ আমার শরীর মন দিয়া এজন্মে আমি কোন পাপই করিনি, তাই মনের মধ্যে আপনার পূজো করাকে আমার পক্ষে দুঃসাহস বোধ করিলেও তাতে পাপ করেছি বলতে পারি না। আপনি আমার দেবতা,—আমার দেবতারও বাড়া—আমার ঈশ্বর! আপনাকে মিথ্যা আমি কেমন করে বল্‌বো? কিন্তু যদি কখন জন্ম বদলে আবার মানুষের দেহ—মেয়েমানুষের দেহ—পাই, তবেই তা আপনাকে দিতে পারবো। কিন্তু এ পাপ দেহ—আমি বরং একে খণ্ড খণ্ড করে ফেলব,—তবু আপনার পায়ে দিতে পারবো না।”

 নরেশচন্দ্র এই গভীর বেদনাপূর্ণ আত্ম প্রকাশে গভীরতর সহানুভূতি ও ব্যথানুভব করিলেন। নত হইয়া সুষমার একখানি হাত হাতে লইয়া সান্ত্বনাপূর্ণ আদরের সহিত কহিয়া উঠিলেন, “তোমার দেহ পাপ দেহ কিসে সুষমা? কোন পাপই তো এ শরীরে তুমি করোনি, তবে কেন অন্যের পাপের কলুষে নিজেকে তুমি ময়লা করে দেখচো? জন্ম সম্বন্ধে তোমার হাত ছিল না, সেজন্য তুমি দায়ী নও। তোমার যা সাধ্য তাতে তুমি উচ্চ সম্মানের সঙ্গেই উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছ!”

 সুষমা নিজের হাত যথাস্থানেই বদ্ধ থাকিতে দিয়া মর্ম্মপীড়িতের ব্যাকুল বেদনার সহিত তীব্র বিলাপপূর্ণ-কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, “আপনি ভুল করচেন। আমার এ দেহ পাপ প্রসূত, পাপ পুষ্ট, এই শরীর দিয়ে আমি আর সব হতে পারি, শুধু গৃহস্থের বউ, আর—”সুষমা নীরব হইল!

 নরেশ তাহার হাতে একটু চাপ দিয়া অধীরভাবে প্রশ্ন করিলেন, “আর?”

 জোর করিয়া দ্বিধাশূন্য হইয়া সুষমা নতচক্ষে উত্তর করিল,—“সন্তানের মা হতে পারি না। সমাজের বাইরে দেশের দশের ধর্ম্মের কর্ম্মের আর আর অনেক প্রকার প্রতিষ্ঠানের কার্য্যে আপনারা আমাদের নিয়োগ করে আমাদেরও বাঁচান আর নিজেরাও বেঁচে থাকুন, শুধু ড্রেনের মধ্য থেকে তুলে অন্তঃপুরে নেবেন না; কার মধ্যে কতখানি বিষ যে থেকে যায় তার কি কিছু স্থিরতা আছে?”

 নরেশ অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলেন। তাহা লক্ষ্যে সুষম আরও একটু জোর দিয়া দিয়া বলিতে লাগিল—“যেমন ব্যাধিগ্রস্ত স্ত্রী বা পুরুষের বিবাহ করা অনুচিত, এবং দুষ্ট ব্যাধিগ্রস্তদের বিয়ে করা মহাপাপ, তেমনি আমাদেরও এই বিষাক্ত শরীরের রক্ত দিয়ে জীব সৃষ্টির মত মহাপাপ আর সংসারে কোন কিছুই নেই। আমার মায়ের রক্ত আমার মেয়ের মধ্যে যদি—”

 জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া সুষমা দু হাত দিয়া মুখ ঢাকিল।— “আর বলবেন না, আমি পারচি না, হয়ত দুর্ব্বল সামান্য স্ত্রীলোক লোভে পড়ে যাব। কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনার সন্তান আমার রক্তের দোষে হয়ত—হয়ত—হয়ত ঐ পাপপথে ঐ হীন বৃত্তিতে—ওঃ ভগবান! ভগবান! এমন যেন না হয়।”

 সুমার সুগভীর হতাশার মর্ম্মান্তিক বিলাপ, মর্ম্মের একান্ত প্রাণফাটা অসহায় আর্ত্ততার মধ্যে মিশিয়া অস্ফুট হইয়া গেল। দুহাত-দিয়া-ঢাকা মুখ সে নিজের দুই জানুর মধ্যে লুকাইল।

 সুষমা চাহিয়া দেখিল না; কিন্তু তাহার অঙ্কিত এই ভয়াবহ চিত্র নরেশের বুকের মধ্যেও বোধ করি একটা সংশয়ের আঘাত করিয়াছিল। তাঁহার এতক্ষনকার সতেজ দৃষ্টি ও প্রসন্ন ভাব পরিবর্ত্তিত হইয়া আসিয়া এক্ষণে তাহার স্থলে কেমন যেন একটা সন্দেহাকুল চলচ্চিত্ততা জাগিয়া উঠিয়াছিল।

 কতক্ষণই এইভাবে কাটিয়া গেল। দেয়ালে একটা বড় ঘড়ি টাঙ্গান ছিল। তার পেণ্ডুলেমটা একটা ভ্রমরের গঠনের, একটা পদ্ম ফুলের কাছে সেই ভ্রমরটা ক্রমাগত ডানা মেলিয়া আনাগোনা করিতেছে, কিন্তু যেন প্রত্যাখাত হইয়া হইয়া ফিরিয়া যাইতেছিল, তাহারই ব্যাকুল আবেদনের সুরে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল।

 তখন যেন নিদ্রোত্থিত হইয়া উঠিয়া নরেশচন্দ্র সুষমার দিকে চাহিয়া ডাকিলেন “বেদানা!”

 “আজ্ঞে!”

 “কিন্তু সুষো! দুটো জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য জিনিষটা কি একেবারেই তুচ্ছ করবার? এ বিয়েতে আমরা দুজনেই কত সুখী হতেম সেটাও ভেবে দেখ।”

 সুষমা হয়ত এই কথাটাই তখন ভাবিতেছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গেই সে ইহার জবাব দিল,—“এ বিয়েতে আপনাকে স্বজনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যেতে হবে, সমাজে হেয় হতে হবে,আর তা ছাড়া সবচেয়ে বড় যা’ তাতো আগেই বলেছি। এ অবস্থায় সে সত্যকার ভালবাসে, সে কি কখন সুখী হতে পারে?—না মরে যায়? কেমন করে জানলেন যে দুজনেই সুখী হবে?”

 “তাহলে কি তোমায় চিরদিন এই অমর্য্যাদার মধ্যে ফেলে রেখে দেওয়াই আমার কর্ত্তব্য বলে তুমি স্থির করচো?”

 ‘আমার জন্মই যে এই অমর্য্যাদার মধ্য দিয়ে, আপনি কি তা এত করেই বদল করতে পারলেন —যে আরও আশা করচেন? লাভে হতে এখন যেটাকে ‘পুরুষোচিত দুর্ব্বলতা’ বলে লোকে আপনাকে করুণার সঙ্গে মাপ করে চলে, তখন তা করবে না। আর আমি? আমি লোকের চোখে যেমন আছি তাই থাকবো। শুধু তারা ঘৃণার সঙ্গে এই কথাই বলে আমার সান্নিধ্য ছেড়ে সরে যাবে যে ওটা এতদিন রাজা নরেশ্চন্দ্রের নরেশ্চন্দ্রের—” যে লজ্জাকর শব্দটা মুখ দিয়া উচ্চারিত হইতেছিল না, তাহার দুশ্চেষ্ট অধ্যবসায় হইতে উহাকে মুক্তি দিয়া নরেশ্চন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, “তোমার কথাই হয়ত ঠিক।”

 সুষমা মুখ তুলিয়া বলিল, “আর একটা ভিক্ষা চাইবো?”

 নরেশ শুধু ম্লানমুখে চাহিয়া রহিলেন, কোন প্রশ্ন করিলেন না।

 সুষমা কহিল, “আপনাকে খুব শীঘ্র বিয়ে করতে হবে। আর যত দিন না আপনি আপনার সেই স্ত্রীকে ভালবাসতে পারবেন, ততদিন আমায় দেখা দেবেন না।”

 নরেশ গভীরতর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচনপূর্ব্বক ভারাক্রান্তচিত্তে মৃদুস্বরে কহিলেন, “আচ্ছা।”

 দুজনে পাশাপাশি অর্দ্ধ অন্ধকার সিঁড়ি বাহিয়া নিঃশব্দে নামিয়া আসিল। রাত্রি তখন গভীর হইতে আরম্ভ করিয়াছে। উঠানভরা চাঁদের আলো যেন থমথমে নিঝুম হইয়া আছে। অঙ্গনের এক পার্শ্বে পেয়ারা গাছটায় একটা পাখী সেই প্রস্ফুট চন্দ্রালোককে দিবালোক ভ্রম করিয়া ঘুমভাঙ্গা ভাঙ্গাগলায় মিনতি করিয়া বলিতেছিল—“বউ কথা কও! বউ কথা কও!”

 বহির্দ্বারের কাছাকাছি আসিয়া হঠাৎ সুষমা দাঁড়াইয়া পড়িল, নরেশচন্দ্র নিতান্ত বিমনা থাকিলেও তাহার এই আকস্মিক অচলতা তিনি অনুভব করিলেন। চলা বন্ধ করিয়া ফিরিয়া চাহিতেই কাছে আসিয়া তাঁহার পায়ের কাছে নত হইয়া সুষমা হঠাৎ কান্নধরা দীর্ঘশ্বাসের সহিত তাড়াতাড়ি কহিয়া উঠিল, “অত্যন্ত লোভ হলেও বড় হয়ে অবধি কখনও আপনাকে স্পর্শ করে আপনার পায়ের ধূলো আমি মাথায় নিতে সাহসী হইনি। শুধু আজকের মতন একটীবার আমায় সেই অধিকারটুকু নিতে দিন।”

 এই বলিয়াই অনুমতির অপেক্ষা না রাখিয়া সে উপুড় হইয়া উহাঁর দুই কম্পিত পায়ের উপরে মাথা রাখিল এবং বিলম্বে সেখান হইতে নিজের মাথার চুলে মুছিয়া জুতার ধুলা তুলিয়া লইয়া মাথায় দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

 নরেশ তাহার মুখ দেখিতে পাইলেন না, দেখিতে চেষ্টাও করিলেন না, দ্রুতপদে বাহির হইয়া গিয়া গাড়িতে উঠিলেন।

 তারপর তিন বৎসরের পরে এই দেখা।