হারানো খাতা/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

আশা রেখো মনে, দুর্দ্দিনে কভু নিরাশা হ’য়োনা ভাই,
কোন দিনে যাহা পোহবে না, হায়, তেমন রাত্রি নাই।
রেখো বিশ্বাস, তুফান বাতাসে, হ’য়ো না গো দিশাহারা,
মানুষের যিনি চালক, তিনিই চালান চন্দ্র তারা।
রেখো ভালবাসা সবার লাগিয়া ভাই জেনো মানবেরে,
প্রভাতের মত প্রভা দান করো, জন, জনে, ঘরে, ঘরে।

—তীর্থরেণু

 কলিকাতা মহানগরী এক্ষণে সুপ্তিমগ্ন। সেই নিয়ত কর্ম্ম কোলাহলময়ী রাজধানীর মধ্যে এক্ষণে কদাচিৎ একটা শব্দ শোনা যায়। পথ প্রায় জনহীন; ভাড়াটে গাড়ী ক্কচিৎ একখানা ষ্টেশনের পথে বাহির হইয়াছে, অথবা ফিরিতেছে। একটা মাতাল কোথাও স্খলিতপদে গ্যাসপোষ্টে ধাক্কা খাইয়া পড়িয়া গেল। দু’একটা পাহারাওয়ালার লাল পাগড়ী এবং হাতের ‘বেটন’ এক আধ বারের মত রাস্তার উপর দেখা গেল, তাহার জন্য কিন্তু গলির মধ্যের কোকেনের দোকানে কোন ব্যস্ততাই দেখা গেল না।

 বড় রাস্তার উপরকার প্রায় সকল দোকানই বন্ধ, একখানা ময়রার দোকানের সাম্‌নে তখনও আলো জ্বলিতেছে এবং ভিয়ান তখনও বন্ধ হয় নাই তার তাড়ু চালানর খরখরানি শোনা যাইতেছে। কোন সময় হয়ত একখানা চলন্ত মটর সাঁ করিয়া চলিয়া গেল, তাহার মধ্য হইতে থিয়েটার ফেরৎ নরনারীদের হাস্যকৌতুক অকস্মাৎ একবার যেন অন্ধকারের বুকে আলো ঠিক্‌রাইয়া পড়ার মতই উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কদাচ পকেটে ষ্টেথিস্‌কোপ রাখিয়া কোন ডাক্তারবিশেষ কোন রোগীর জন্য আহুত হইয়া ছুটন্ত মটরে বসিয়া আছেন দেখা গেল।

 বড় বড় সাহেবী হোটেলের ও দেশী বিদেশী থিয়েটার বাড়ীগুলার সাম্‌নে গাড়ী মোটর কতকগুলা করিয়া তখনও জমিয়া আছে। উর্দ্দিপরা আর্দ্দালীরা সোফারের পাশে বসিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। মুনীবদের দল আহার অথবা বিহারে মত্ত, তাঁদের কাছে রাত্রির খবর পৌঁছিতেছে না; দুরবস্থার একশেষ এই গরীব ভৃত্যের জাতির। তাদের রাত নির্জ্জন পথের ধারেই পোহাইবার উপক্রম করিতেছিল।

 আরও এক জায়গায় কিছু আলো, কিছু শব্দ পাওয়া যাইতেছিল। একটু বড় রকম বাড়ীর সামনে সামনে এক আধখান গাড়ী মোটও দাঁড়াইয়াছিল। সেগুলা ইংরাজ বাঙ্গালী মাড়ওয়ারি ভাটিয়া সকল জাতির।

 গঙ্গাতীরে এখন কল কারখানা ও ষ্টীমার ষ্টীমলঞ্চের ঝক্‌ঝকানি ফোঁসফোসানি সব, নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। দুই তীরের বড় বড় আফিস বাড়ীর জানালা দরজা সব বন্ধ, নিরালোক এবং স্তব্ধ। সারাদিনের কঠোর শ্রমের পর যেন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দৈত্যগুলা তাদের বিপুল দেহগুলাকে যেখানে সেখানে মেলিয়া দিয়া ঘুমে এলাইয়া পড়িয়া আছে। কে জানে কখন বাঁশীর উর্দ্ধস্বরে সারা সহরকে চকিত করিয়া দিয়া জাগ্রত হইবে।

 নিরঞ্জন এই সমস্ত দীর্ঘ পথ নীরবে অতিবাহিত করিয়া আসিল। এক পাশে বিপুলায়তন গড়ের মাঠ, হীরক ও মরকত মণির মালা গলায় দিয়া ঘুমাইয়া আছে। ‘অপ্সরজাতীয়’ নরনারীর রূপের আলো, পোষাকের চমক সেখানে আর ছিল না। ‘ইংরাজের স্বর্গোদ্যান’ স্তব্ধ স্থির। ‘কিন্নরের’, কণ্ঠরব আর তথা হইতে শ্রুত হইতেছিল না। গন্ধর্ব্বলোকের সকল জাঁকজমক ঘুমের কোলে চাপা পড়িয়াছে। কেবল জলের বুকে জাগিয়া আছে শুধু নৃত্যশীল তারার মালা, আর একখানা মহাজনী নৌকার বুকে জাগিয়া জাগিয়া একটা চাটগেঁয়ে মাঝি তাললয়বিহীন এক অপূর্ব্ব রাগিণীর সৃজন-তৎপর হইয়াছিল। নিরঞ্জন উৎকর্ণ হইয়া থাকিয়া সেই গীত সুধা উপভোগ করিল—

“এই কদম্বের মূলে নিয়ে গোপকুলে, চাঁদের হাট মিলাইত গো—
সেরূপ রয়ে রয়ে মনে পড়ে গো ও—ও—ও—।”

 রস ইহাতে যতই থাক না থাক, নিরঞ্জনের অন্তরের পিপাসা অকন্মাৎ যেন তাহাতেই ভরিয়া উঠিল। ওই যে পশ্চিম বঙ্গের নিকটে অনাদৃত উপহাসিত উহাদের পক্ষে একটুখানি দুর্ব্বোধ্য ভাষায় এই জনসম্পদশূন্য নিঃসঙ্গ রাত্রে ওই নিরক্ষর মাঝি নিজের মনের ভাবটী— কাহারও কাছে নয়, শুধু নিজের কাছেই প্রকাশ করিতেছিল; নিরঞ্জনের বোধ হইল উহার ভিতর দিয়া সে যেন সাহেবের আফিস হইতে বাহির হইয়া নিজের বাড়ীর অঙ্গনে প্রবেশ করিয়াছে। এই উচ্চারণের বৈসাদৃশ্য, এই শব্দ বিকৃতি, এ যে তার বুকের মণি, এই যে তার মায়ের দান। সে কাঙ্গালের মত উৎকর্ণ হইয়া রহিল কিন্তু গায়কের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বর শুধু ‘রহিয়া রহিয়া’ ঐটুকুকেই ফিরিয়া ফিরিয়া গাহিতে লাগিল। গান আর অগ্রসর হইতে পাইল না।

 নিরঞ্জন কিনারায় কিছুক্ষণ পাইচারী করিয়া বেড়াইয়া বেড়াইয়া শেষে ক্লান্ত হইয়া বসিয়া পড়িল। ততক্ষণে চাটগেঁয়ে মাঝির সঙ্গীতসাধনা সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে। এখন সম্পূর্ণভাবেই সমুদয় বিশ্বচরাচর নিঝুম নিস্তব্ধ এবং নিদ্রিত। ভোরের আলো লাগিয়া আকাশের তারাগুলা শুদ্ধ যেন ঘুমাইয়া পড়িতেছিল। গঙ্গার জল মূর্চ্ছাতুরের ন্যায় পাণ্ডুবর্ণ ও নিস্পন্দ হইয়া পড়িয়াছে।

 নিরঞ্জন একটা নিশ্বাস ফেলিল, আপনাকে আপনিই বুঝাইতে চাহিয়া সে মনে মনে বলিল, “কিছুতেই ভুলতে পারচিনে কেন? অথবা নাই বা ভুল্লেম, মন কেন আমার স্থির হচ্চে না? আমি তো তার অহিতাকাঙ্খা করিনি, তার ভালই চেয়েছিলেম, আমার জন্য— আমার সেবা করতে গিয়ে তার শোচনীয় মৃত্যু ঘটে গেল, এতে আমার তো কোন হাত ছিল না। তবে কেন নিজেকে তার হত্যাকারী বলে মন আমার নিজের কাছেও মহাপাপীর মনের মতন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে? জীবন দুর্ব্বহ হয়ে পড়েছে? চারিদিকে কেবল সেই ছায়া—সেই ছায়াই কেন দেখ্‌ছি? তার কণ্ঠ নিয়তই কেন আমার কানে বাজ্‌চে? একি হলো আমার? কালীপদ! ভাই! বন্ধু! তোমার শেষ অনুরোধ রাখতে পারিনি বলেই কি এমন করে পাগল হয়ে যাচ্ছি? চেষ্টা তো করেছিলুম, বিয়ে করবো, সুখে যথাসাধ্য রাখবো সেই ইচ্ছাই তো ছিল, পারলুম না সে কি আমার হাত? তবে কেন আমার এ দণ্ড? সব তো হারিয়েছি— নিজেকে শুদ্ধ, তবে শুধু তাকেই দেখি কেন? এবার আর স্বপ্ন নয়। বাস্তব মূর্ত্তি ধয়েই যে সে আমায় দেখা দিচ্চে। কিন্তু—কি কুৎসিত, কি জঘন্য, কি সঙ্কটের পথ দিয়েই তার ছায়া আমার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে! ওঃ কার মধ্য দিয়ে,—কার! আর কি কোন রাস্তা সে পেলে না? নাঃ, আর সইতে পারচিনে! পালিয়ে তো এসেছি, আর ফিরবো না, একেবারেই পালাই। কোন্ দিন হয়ত কি বলেই বসবো। নিজেকে তো আমার বিশ্বাস কত? হলে আমি—এই আমি— এই ডবল অনার নিয়ে বি এ পাশ, ফার্ষ্ট ক্লাশ এমে—

 অ্যাঁ—এই কি সেই আমি? নাঃ, নিশ্চয় না। নিশ্চয় সেই আগের আমি মরে গেছি। এ তার—কে?—”

 নিরঞ্জনের প্রতি লোমকূপটী পর্য্যন্ত খাড়া হইয়া উঠিল। নিঃসঙ্গ অবোধ শিশু যেমন ভূতের ভয়ে অন্ধকার হইতে আলোর দিকে ছুটিয়া যায়, তেম্‌নি করিয়া নিজের সঙ্গকে সে একান্ত ভয়ে অসহ্য বোধ করিয়া যেন নিজের কাছ হইতে পালাইতে চাহিয়াই ধড়মড় করিয়া উঠিয়া পড়িল। ছুটিতে আরম্ভ করিত, হঠাৎ তাহার কানে যেন দৈববাণীর মতই কোথা হইতে সেই বিজন নদীপুলিনে এক মানবকণ্ঠের সুর লহরী ভাসিয়া আসিয়া ঠেকিল। আকুল হইয়া কান খাড়া করিতেই বোঝা গেল, সে একটা গান এবং নদীতীরেই, তাহার নিকট হইতে সামান্য একটুখানি দুরে থাকিয়াই কেহ সে গান গাহিতেছে। বংশীরবাকৃষ্ট সর্পের মতই সে সেই শব্দ লক্ষ্যে সেই দিকে অগ্রসর হইল।

 গঙ্গায় তখন জোয়ার আসিয়াছে, শব্দ হইতেছিল কল কল কল। জল কিনারায় অনেক দূর অবধি উঠিয়া আসিয়াছে, স্রোতের মুখে দুরগামী পণ্যবাহী কয়েকখানি নৌকা ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে, তাদের দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল ছপাৎছপ্। নিরঞ্জনের ভয়ার্ত্ত বক্ষ চিরিয়া চিরিয়া একটা আশ্বাসের আর্ত্তশ্বাস উঠিয়া পড়িল।

 গান গাহিতেছিল একজন স্ত্রীলোক এবং ওই বিদ্যায় কোন অভিজ্ঞতা না থাকিলেও নিরঞ্জন স্পষ্টই বুঝিল এ শাস্ত্রে ইহার যথেষ্ট দখল আছে। সে গানটা এই—

“যে জানে আনন্দময়ী! তোমাকে।
ও সে কি অন্তরে কি বাহিরে আনন্দময় সব দেখে।
যারা দুঃখে হয় ব্যাকুল, ভাবে বিপদের নাই কুল,—
তারা জানে না বে গাছে কেবল ফুটিতেছে ফুল;—
সংসার নিরানন্দের ফুল—
শেষে আনন্দময় ফল পাকে।”—

 নিরঞ্জন এক পা এক পা করিতে করিতে কোন্ সময় একবারে ইহার গায়ের কাছ গিয়া পড়িয়াছিল। মেয়েটী ইহার সঘন নিশ্বাসের শব্দে বারেক চাহিয়া দেখিল; তারপর ঘাড় ফিরাইয়া হাত দশেক দূরের একটা গাছ তলায় তাহার বিশ্বাসী দ্বারবানকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া নিশ্চিন্ত মনে যে গান গাহিতেছিল তাহাই গাহিতে থাকিল। নিরঞ্জনকে প্রথম দৃষ্টিতেই তাহার পাগল ভিন্ন আর কিছুই বোধ হয় নাই। সে গাহিল—

“বিপদ সম্পদের তরে, দিতে পরম পদ তারে,
ওমা, বিপদ নৈলে জন্মান্ধ জীব ডাকে না তোরে;—
মা, তোর করুণার ফল, বিপদ কেবল, জাগায় অবোধ বালকে।”—

 এ গান শুনিয়া নিরঞ্জন চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া আচম্‌কা বলিয়া উঠিল, “একি সত্যি কথা, না খালি গান?”

 মেয়েটী গান বন্ধ করিয়া মুখ ফিরাইয়া মধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল “কি সত্যি কথা বাবা?”

 কম বয়সী মেয়েটীর মুখে এই গম্ভীর সম্বোধনটা তাপদগ্ধ ছন্নছাড়া নিরঞ্জনের আরও মিষ্ট লাগিল। সে মনে মনে পুলকিত হইয়া উঠিয়া আবার ছেলে মানুষের মতন প্রগলভ প্রশ্ন করিয়া বসিল। “ওই যে বল্লেন, ‘বিপদ সম্পদের তরে’, একি সত্যি?”

 নারী কহিল, “হ্যাঁ বাবা! খুব সত্যি।”

 নিরঞ্জন কহিল “আপনি কখনও বিপদে পড়ে কি এর সত্যতা যাচাই করে নিতে পেরেছেন?”

 সে কহিল, “পেরেচি বই কি। বিপদ সঙ্গে করে নিয়েই তো আমি জন্মেছিলুম, কিন্তু দিনকের দিন যত বিপদ ঘন হয়ে এল, ততই সম্পদও নিকটতর হতে লাগ্‌লো। শেষে যখন সর্ব্বনাশ এসে আমায় গ্রাস করতে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এম্‌নি সময়ে একেবারে তিনি নিজে ছুটে এসেই আমায় কোলে তুলে নিলেন। এই যে গাইচি শুনুন না।”—

 এই বলিয়া সে পুনশ্চ গাহিতে লাগিল—

“পড়ে বিপদের ফাঁদে, ছেড়ে সংসারের সাথে,
যখন কাতর প্রাণে, কুসন্তানে মা বলে কাঁদে—
তখন, ত্বরায় গিয়ে কোলে নিয়ে, স্তন্য সুধা দাও তাকে।
মাগো, তবে আর এ সংসারে আনন্দ নাই বলে কে?”

 নিরঞ্জন নিস্পন্দ হইয়া গান শুনিল, তারপর বিমোহিতভাবে সে ঐ অপরিচিতা মেয়েটীর দিকে মুখ ফিরাইয়া উহাকে বলিল, “তোমায় আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করচে! মার মতন তুমি আজ আমাকে, যে শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলুম, সেই মহাশিক্ষার মধ্যে হাতে ধরে টেনে এনে দিলে।”

 মেয়েটা জোড়হাত নিজের কপালে ঠেকাইয়া জবাব দিল, “মা হবার যোগ্যতা আমার একটুও নেই; তবে আপনি আমার বাবা হলেন। নিজের মেয়েকেও তো লোকে আদর করে ‘মা’ বলে, সেই হিসেবে আমায় আপনি ‘মা’ই বলবেন। আমার নাম সুষমা। আমি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে এক একদিন এখানের খোলা হাওয়া আর আমার বড় মায়ের রূপ দেখতে আসি। থাকি কিনা আদি গঙ্গার ছোট্ট মা-টীর বুকে। আপনিও হয়ত আমার মতই উদ্দেশ্য নিয়ে অথবা কোন উদ্দেশ্য না নিয়েই এসেছেন? আপনাকে আমার কিন্তু বড্ড ভাল লাগছে! হলে কি হয়, সকাল হয়ে এ’ল, আপনি এখন বাড়ী যাবেন তো? আমিও তাহলে এখন বাড়ী যাই।”

 নিরঞ্জন মুগ্ধ হইল, একটু যেন সে তৃপ্ত হইল। বিস্মিত হইল্পা বলিল, “তুমিও খুব বিপন্ন হয়েছিলে বল্লে না? তোমার কথার ভাবে বোধ হলো আজও তোমার সে বিপদের মেঘ সম্পূর্ণ কাটেনি। কিন্তু তুমি তো বেশ শান্তভাবেই সব কথা বল্‌চো,—সংসারকে শ্মশানের পরিবর্ত্তে আনন্দ-কানন বলেও উল্লেখ করতে তোমার বাধছে না! আমি যে তা ভাবতেও পারিনে।”

 সুষমা বলিল, “দেখুন, আনন্দ তো বাইরে পাবার জিনিষ নয়, আর কুড়িয়ে বেড়াবারও বস্তু নয়। ওটাকে নেই নেই ভাবতে ভাবতে ওটা একেবারেই মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যায়। আর আছে আছে জপ করতে করতে নিজের মনের মধ্য থেকে সে সহস্রদলে বিকশিত হয়ে ওঠে। আমার সাধুজী আমায় এই বকম করেই ভাবতে শিখিয়েছিলেন। আহা, আবার যদি আমি তাঁকে ফিরিয়ে পেতুম! সংসারে কতই যে শেখবার রয়েছে। কিছুই তো শিখতে পেলুম না। ছার মেয়ে হয়ে জন্মেছিলুম, তাও আবার একবারেই অধমের চেয়েও অধম হয়ে!”—

 ভোর না হইতেই কলিকাতা মহানগরীর নিদ্রা ভঙ্গ সাড়ম্বরেই আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। লোকজন গাড়ী ঘোড়া মটর রিক্‌সা হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতেছে। এখানে ঝাড়ুদার রাস্তা ঝাঁটাইতেছে, ওখানে আবর্জ্জনার স্তূপ বোঝাই হইতেছে। দোকান ঘরের দরজা জানালা খটাখট খোলা হইতেছে, গঙ্গাস্নানের যাত্রীরা আসা যাওয়া করিতেছে। রাতভিখারীরা ঘরের পানে এবং ভোরের কীর্ত্তন গাহিয়া বৈরাগী বৈষ্ণব বা বাউলেরা ফুটপাথের উপর চলাচল করিতেছিল। ফলের ঝুড়ি, মাছের বাজরা মাথায় লইয়া ও দুধের ভার কাঁধে বহিয়া মুটেরা বাজারের দিকে চলিয়াছে। নিরঞ্জনকে এত ভোরে বাড়ী ঢুকিতে দেখিয়া রাজবাড়ীর দ্বারবানেরা কিছুই বিস্ময় বোধ করিল না। এ বাড়ীর সবাই জানে সে পাগল।