হারানো খাতা/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
হাসি খেলার অভিনয়ে অশ্রুজলে ঢাকি,
ভেবেছিলাম এম্নি করে তােমায় দিব ফাঁকি।
বুকে আমার যে সুর বাজে, গুঞ্জরে যা মর্ম্মমাঝে
ভেবেছিলাম সুখের সাজে রাখব তারে ঢাকি।
পড়াশােনা চুকাইয়া দিয়া নিরুপদ্রব শান্তি উপভােগ করিতে করিতে একদিন পরিমল হঠাৎ চমকভাঙ্গা হইয়া আবিষ্কার করিয়া ফেলিল যে নরেশের মুখ আজকাল বেজায় গম্ভীর হইয়া আছে এবং তিনি ইদানীং তাঁহার বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে একেবারেই নির্লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছেন। পরিমল যুক্তি দিয়া স্থির করিল যে ওটা ঠিক বৈরাগ্য নহে, ক্রোধই হইতেছে উহার উচিত অভিধান। নিরঞ্জনের ছাত্রাবস্থা হইতে ছুটী লওয়ায় তিনি তাহার উপর এবার একটু বিশেষ ভাবে চটিয়াছেন। স্বামীর ক্রুদ্ধ তিরস্কারকে সে অত্যাচার বােধ করিয়া মনে মনে নিজেও রাগ করিত, অভিমান করিত; কিন্তু তাহার নিছক ভয় ছিল তাহার ওই নিস্তব্ধ ক্রোধের মৌন অভিনয়কেই। সে জানিত, মনের ভিতর হইতে রাগ না করিলে তেমনটা প্রায়ই ঘটিত না। যেহেতু সমস্ত উদার স্বভাবের লােকের মতই নরেশের মনে বড় অল্পেই আঘাত লাগে। পরিমল ভয় পাইল।
‘কর্ণধার’ প্রেসের ম্যানেজার গাদাখানেক কাগজপত্র লইয়া আসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কি সব তর্কাতর্কি করিয়া এই সবে মাত্র চলিয়া গিয়াছেন। নরেশের একখানা ‘তরুণ’ নামক মাসিক পত্র এবং একখানা ‘নবীন জগৎ’ নামক সাপ্তাহিক ছিল। এই সাপ্তাহিকের সম্পাদকীয় মন্তব্য সম্বন্ধে দুজনে একটু মতের অনৈক্য ঘটিতেছে। ম্যানেজার সেদিন এমন একটুখানি আভাস দিলেন তার ভাবটা যেন নরেশ তাঁহার স্বাধীন ও নির্ভীক ভাব সর্ব্বদা বজায় রাখিতে চাহিলে উহার এখানে চাকরী করা একটু অসম্ভব হইয়া পড়িতেছে, এই রকমেরই। নরেশ এই বিষয়েই কিছু ভাবিতেছিলেন।
পরিমল আসিয়া প্রবেশ করিল।
“নিরঞ্জনের কাছ থেকে এই এক্ষুণি পড়া শেষ করে এলেম। ওর কাছেই আমি পড়বো, তুমি রাগ করো না।”
নরেশ একটা অপ্রিয় আলোচনার পরেই অপ্রিয় চিন্তার (এবং শুধু এই একটীই নয় আরও অনেক গুলারই) হাত হইতে মুক্তি পাওয়ায় হয়ত মনের মধ্যে একটুখানি স্বাচ্ছন্দ্যানুভবই করিলেন। চোখ না ফিরাইয়া মুখ তুলিয়া বলিলেন, “কই না, রাগ তো করিনি।”
পরিমল তাঁহার গা ঘেঁসিয়া কাঁধের উপর হাত রাখিয়া বলিল “তা বই কি, রাগ নাকি আর তুমি করতে বাকি রেখেছিলে! কদিন ধরে দেখাই পাইনে, কথাই কও না, আবার বলা হচ্চে, ‘রাগ করেননি!’ মাগো! এম্নি করেই কি তা বলে শাস্তি দিতে হয়? ওর চাইতে যে কান মলে দেওয়াও ঢের ভাল ছিল।”
নরেশ নিজের মনের চিন্তা তন্ময়তায় যে স্ত্রীর প্রতি কর্ত্তব্যে এতটাই ত্রুটী ঘটিতে দিয়া ফেলিয়াছেন, তৎক্ষণাৎ তাহা বুঝিয়া মনে মনে লজ্জিত ও ঈষৎ দুঃখিত হইয়া পড়িয়া তাহার হাত দুটি নিজের কণ্ঠে জড়াইয়া দিলেন ও তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লইয়া হাসিবারভাবে কহিলেন, “তাই নাকি? এসো তাহলে কান মলে দিই।” এই বলিয়া তাহার লজ্জায় রাঙ্গা কর্ণমূল দুই আঙ্গুলে ধরিয়া নাড়িয়া দিলেন।
পরিমল ওইটুকু আদরেই একেবারে গলিয়া পড়িল। তারপর অনেকখানি দানের একটু একটু প্রতিদান কাড়িয়া ছিনাইয়া লইয়া তাঁহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল “বল রাগ ভাল হয়েছে বল। রাগ, করোনি বল্লে তো আমি মান্বো না, আমি জানি যে তুমি আমার উপর খুব বেশী রকম রাগ করেছিলে। এত শীগ্গির যে আমায় আদর করবে সে আমি একবারে ভাব্তেই পারিনি!”
নরেশ তখন আদরের গৌরবে গরবিনীকে আর একটু উপরি পাওনা পাওয়াইয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আহা, এমন জান্লে না হয় একটু রাগ করেই থাকতুম যে! তা আমার রাগটা কেন হয়েছিল বলো তো? আচ্ছা দাঁড়াও মনে করি। নাঃ পারলুম না। তুমিই মনে করে দাও দেখি। কিন্তু দেখ, যেন মিথ্যে করে যা তা একটা বলে দিও না।”
পরিমলও এই কথায় অত্যন্ত কৌতুক বোধ করিয়া হাসিয়া উঠিল, এবং হাসিতে হাসিতে লুটোপুটি খাইয়া শেষে বলিল, “উনি রাগ করে জব্দ করবেন আমায়, আবার উল্টে তার হিসেব নিকেশ করতে হবে আমাকেই। এ মজা তো বড় মন্দ নয় দেখি! ঈস্, আমি বল্বো কেন?”
নরেশ গাম্ভীর্যের ভাণ করিয়া বলিল, “বেশ মশাই, বেশ। না হয় বল্বেন না। না হয় এবার থেকে আমার রাগের হিসাব রাখবার জন্যে আর একটা হিসাবনবিশই রেখে দেবো, তার জন্য আর হয়েছে কি।”
পরিমল আর এক চোট প্রাণ ভরিয়া হাসিল, তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিলে পর স্মরণ করাইয়া দিল যে, সেদিন সে নিরঞ্জনের কাছে আর পড়িবে না বলিয়াছিল, এবং তারপর হইতেই নরেশের মুখ বেজায় ভার ভার দেখা যাইতেছে।
নরেশ তখন যেন চমক ভাঙ্গা হইয়াই বলিয়া উঠিলেন “ওহো তাও তো বটে! তাহলে এখন তাকে নিয়ে কি করা যায় বলো দেখি? ওকে তুমি যদি বরখাস্তই করলে তাহলে না হয় ওকেই আমার রাগ কর্ব্বার হিসাব রাখবার জন্য রাখাই যাক্ না কেন? একটা কাজ তো ওকে দিতে হবে।”
হাস্যের কল ঝঙ্কারে চারিদিকে মুখরিত হইয়া উঠিল। পরিমল বেদম হাসি হাসিয়া বলিল “হ্যাঁ তাই দাও। আমি হরির লুট মেনেচি, তুমি ওকে যাতে নিজের কাজে লাগাও তারই জন্যে। তা হলেই তোমার হিসাবের কড়ি আর বাঘেও খেতে পারবে না।”
নরেশচন্দ্র ও প্রখমটা তাহার হাসিতে যোগ দিলেন, তারপর একটু আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিয়া বসিলেন “সত্যি কি নিরঞ্জন বড় বেশী অন্যমনস্ক?”
“তুমি দিন কতক পরীক্ষা করেই দেখ। আমার মাথা খাও।”
নরেশ কহিলেন “তাই দেখবো, প্রেসের ম্যানেজার বোধ হয় চল্লো। যে কদিন নতুন না পাই ওকেই সঙ্গে নিয়ে চালাব।”
পরিমল পরম পরিতোষ লাভ করিল, সম্বন্ধটা অন্য রকম না হইলে হয়ত বলা যাইত প্রাতর্বাক্যে তাঁহাকে রাজা হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করিল, এক্ষেত্রে তা অবশ্য করিল না; কিন্তু বিশেষ রকম যত্ন করিয়া সে স্বামীর কপালের ঘাম নিজের শান্তিপুরে সাড়ীর আঁচল দিয়া মুছিয়া দিল। ‘কত ঘামচো?’ বলিয়া ঘরে ইলেকট্রীক পাখা খোলা থাকা সত্ত্বেও নিজের আঁচল ঘুরাইয়া তাহাকে হাওয়া দিতে লাগিল এবং আরও পতি সেবার কি কি খুঁটিনাটি সমাধা করিতে মনোনিবেশ করিয়া দিল, তার খবরে কাজই বা কি?
কিন্তু দুদিন যাইতে না যাইতেই বুঝিতে পারা গেল যে, নিরঞ্জনের কাছে বিদ্যাশিক্ষা করিতে যাওয়ার মধ্যে অসুবিধা তার যতই থাক না কেন, বুঝি আনন্দও একটুখানি কোথায় যেন ছিল। সেই আপ্নাভোলা অসহায় ও নিঃসঙ্গ জীবটাকে সে যে ঘণ্টাখানেকেও একটুখানি কাজ দিয়া রাখে; এইটুকু হইতেও সেই কর্ম্মহীন দীর্ঘ অবসরের ক্লান্ত জীবনটকে বঞ্চিত করা তার কাছে হঠাৎ যেন চৌর্য্যের মতই অপরাধজনক ঠেকিল। আর এই অবসরে এই বিপুল রাজপ্রাসাদের অসংখ্য দাসদাসীবর্গের দ্বারায় উৎপীড়িত উপদ্রুত মানুষটাকে সে যে কতকটা রক্ষা করিয়াও চলিতেছিল, সেইটুকুকে হারাইয়া ফেলায় তার মন আজ পীড়া বোধ করিতে লাগিল। আহা, ভাগ্যচক্রের কঠোর নিষ্পেষণে কি নিপীড়িত—কি ভীষণরূপেই নিপীড়িত সে; আর কি তাকে পীড়ন করিতে দিতে আছে? নিজের স্বামীর মহত্ব অনুভব করিয়া সেদিন এম্নি চঞ্চল হইয়া উঠিল যে, রাত্রে নরেশ শয়ন করিতে গেলে, সেও তৎক্ষণাৎ আর এক দিক দিয়া সেই ঘরে ঢুকিল। নরেশের মন যদিও সে সময় পত্নী সম্ভাষণের ঠিক অনুকূল ছিল না,—বড়ই চিন্তাম্লান ও ভরাক্রান্ত—তথাপি স্ত্রীকে আসিতে দেখিয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ স্নেহ প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহার দিকে হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন “এসো।”
স্ত্রীর সম্বন্ধে মনের মধ্যে একটুখানি ত্রুটি বোধ থাকার কুণ্ঠাতেই তাহার পরে, সময় সময় আদরের মাত্রাটা কিছু বেশী করিয়াই বর্দ্ধিত করিতে হয়, সেখানে নিজের শরীর মনের আলস্যকে প্রশ্রয় দেওযা বুঝি একেবারেই চলে না!
পরিমল আসিয়া ঢিপ করিয়া তাঁহার পায়ে একটা প্রণাম করিল, আর এক দিনকার একটা অবিস্মৃত এম্নি দৃশ্যই স্মরণ করিয়া নরেশের হৃদপিণ্ড অমনি প্রমত্তবেগে দুলিয়া উঠিল, তিনি কষ্টে সংযত হইয়া উহা চাপা দিবার জন্য উহাকে নিজের বুকে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধিয়া ধরিলেন।
“ঈস্!-আজ হঠাৎ এত ভক্তি কেন?”
“অভক্তিই বা কবে ছিল? ভক্তিভাজনকে ভক্তি করব না?” বলিয়া পরিমল স্বামীর আদরটুকু নিঃশেষে উপভোগ করিয়া লইল। নরেশ তাহার ললাটে চুম্বন করিয়া হাসিমুখে বলিলেন—“আমি বলবো, কেন প্রণাম পেলুম?”
পরিমল বলিল “বল তো দেখি কেমন বল্তে পার?”
“আদর খাবার জন্যে।”
“যাও, হ্যাঁঃ,—তা বই কি? আমি এক্ষুনি চলে যাব।” পরিমল এই অনুযোগ জানাইলেও নিজের পাওনা গণ্ডী ছাড়িয়া যাইবার কোন ত্বরা দেখাইল না।
“তা’হলে নিরঞ্জনের চেলাগিরি ছাড়িয়ে দিয়েছি বলে? ঠিক কি না?”
“না, তাও না।—ভাল কথা! নিরঞ্জন তোমার কাজ করছে কেমন বল তো?”
“চমৎকার! নিরঞ্জন যে এতটাই বিদ্বান তা আমি কখন মনেও করতে পারিনি। ইংরাজীতে, বাংলায়, হিসাবে পত্রে, সকল দিক থেকেই ওর সমান শক্তি। বি, এ, এম, এ, পাশ না করলে কখনই অমন হতে পারে না,অন্ততঃ অতদুর পড়াও চাই। কে জানে ওর কি রহস্য! একি কোন দিনই জাতে পারা যাবে না?”
কথাগুলো নরেশচন্দ্র পরিমলের চেয়ে বোধ করি নিজের মনকেই শুনাইতে চাহিয়া বলিলেন।—
“যতই ওকে দেখ্ছি ততই যেন নূতন নূতন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্চি। ও যেন একটা জীবনযুক্ত সারনাথ বা সাঁঞ্চির ভগ্নস্তূপ। বাহিরেরটা সব মাটির ঢিপি হয়ে গেছে। কিন্তু যতই খুঁড়ে তোল, অভিনব অভিনব ভাস্কর্য্যের আবিস্কারে মন যেন বিস্ময় সাগরে কুলহারা হয়ে যায়! ও’কে? কে জানে ওর পরিণাম কেমন করেই অমন হলো!”
সহসা বিদ্যুৎ স্ফুরণের মতই কোন্ কথা স্মরণে আসিয়া পরিমল স্বামীর বক্ষে চঞ্চল হইয়া মুখ তুলিল, “দেখ ওর একখানা ডায়ারি আছে। আমি দেখছি ও বসে বসে তাতে কি সব লিখে রাখে। সেইখানা পেলে হয়ত ওর সম্বন্ধে কিছু কিছু জানা যেতে পারে।”
অবিশ্বাসের মৃদু হাস্যে নরেশচন্দ্রের অধর কুঞ্চিত হইল। “তুমি যেমন পাগল!—পাগলের আবার ডায়ারী! আর থাকলেই বা ও আমাদের সে দেখাবে কেন? তাই যদি দেখাবে, তাহলে তো সব বলতেই পারতো।”
পরিমলের মনের মধ্যে যাই থাক, তাহা প্রকাশ না করিয়া মুখে সেও স্বামীর কথায় সায় দিল, সংক্ষেপে বলিল, “তা বটে।” কিন্তু সেটা ঠিক তার মনের কথা নয়।