হারানো খাতা/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছদে

মনের আবেগে উড়িতে চায়,  অক্ষম পাখা পড়িয়া যায়,
বেড়ে ওঠে শুধু হাহাকার।

—তীর্থরেণু

 নরেশচন্দ্রকে বিমনা ও ব্যথিত করিতেছিল সুষমার এই চিঠিখানা।

 প্রণাম শতকোটী নিবেদন

 পুজ্যতমেষু!

 সেদিন ডাকাইয়া আনিয়া সবকথা আপনাকে আমার বলা ঘটে নাই এবং সামনে বলার ভরসা না রাখিয়াই তাই আজ পত্রে সে কথা জানাইতে বসিয়াছি। এই সাহস ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতার জন্য চরণে সহস্রবার ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম। শিশুপালের শত অপরাধের চেয়ে বেশী স্বয়ং ভগবানের অবতার কৃষ্ণ ক্ষমা করিতে পারেন নাই; আর আপনি তো আমার সহস্র অপরাধকেও সহ্য করিয়া লইয়াছেন, তাই ভরসা আরও না লইয়া থাকিতে পারিবেন না.........

 সেদিনও আপনাকে জানাইয়াছিলাম, আমার বর্ত্তমান জীবনযাত্রার পদ্ধতি আমার পক্ষে অসহনীয় বোধ হইতেছে। পাখীকে খাঁচায় পুরিয়া মানুষে তার স্বাধীন জীবনের পক্ষে একান্ত অসম্ভব বিলাসে আদরে তাহাকে ভরাইয়া দিয়াও যেমন তার স্বাধীনতার স্মৃতিকে ভুলাইয়া দিতে পারে না, মানুষের মনকেও তেমনি তার পক্ষে দুষ্প্রাপ্য শান্তির ও অজস্র সুখের নীড়ে প্রতিষ্ঠিত করিয়াও বুঝি তাহার উদ্দাম উন্মুক্ত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকেও রোধ করিতে পারা দায় হয়। তার মন যখন কর্ম্মের জন্য উন্মুখ হইয়া উঠে, তখন বিশ্রাম শয্যা তার পক্ষে কণ্টকারণ্যের স্থানাধিকার করে। তার পরেও যদি জোর করিয়া তাহাকে সেখানে পড়িয়া থাকিতে হয়, তো সে কাঁটা শুধু তার শরীরকে নয়, তার মনকে শুদ্ধ তীক্ষ্ণ ধারে বিঁধিয়া বিঁধিয়া রুধিরাক্ত ও অসাড় করিয়া দেয় (তাই অধীন জাতির মধ্যে স্ত্রী পুরুষের দিনে দিনে দুর্ব্বলদেহ ও ক্ষীণ প্রাণ হইয়া ধ্বংসোন্মুখ হইয়া পড়া অনিবার্য্য)। আমারও সেই অবস্থা। শুধু নিজেকে লইয়া দিন কাটা নয়, নিজের কাছে নিজের দাম এতটাই কম হইয়া গিয়াছে যে সে কি বলিব,— এটা যদি আমার কোন তৈজস পত্রের সামিল হইত তো এটাকে জঞ্জালের সঙ্গে ঝাঁটাইয়া আমি কোন কালে আদি গঙ্গায় ভাসাইয়া দিতাম।

 আমায় কাজ দিন,—কোন—কোনও একটা কাজ দিন। কোন বালিকা বিদ্যালয়ের চাকরী আমি পাই না কি? বেশী না জানি ‘ক খ’ ও তো ছোট মেয়েদের শিখাইতে পারিব। কোন ভদ্র পরিবারে গান শিখাইবার অধিকার কি আমার আছে? যেখানে আমি আদরের সহিত অভ্যর্থিতা হইব, সেই আমার স্বজাতি-বর্গের মধ্যে পা দিবার কথা ভাবিতে গেলেও আমার বুক ভয়ে কাঁপে। অথচ আমি জানি সেইখানেই আমার প্রকৃত কার্য্যক্ষেত্র। যদি তাদের মধ্যের একটা জীবনও আমার দ্বারা রক্ষিত হয়! জানি আমার মত পুণ্য সঞ্চয়হীনার পক্ষে সে পুণ্যের প্রলোভন নেহ্যৎ সামান্য নয়। কিন্তু আমার তাহাতে ভরসা হয় না। মনের মধ্যে আমার প্রৌঢ়ত্ব দেখা দিলেও বয়সে আমি আজও ত কুড়ির সীমা ছাড়াইতে পারি নাই। নিজের উপরে বিশ্বাস আমার দৃঢ় হইলেও পরের উপর এখনও যে ভয় রাখতে হয়। তদ্ভিন্ন যাহাদের আমি পাপ পথ হইতে ফিরাইয়া আনিব, তাদের আশ্রয় কোথায়? সেও যে একটা মস্ত বড় অভাব রহিয়াছে। সবার মনেই কিছু এত বড় বৈরাগ্য জাগিবে না যে, কাশীবাসিনী হইয়া ভিক্ষার ঝুলি তুলিয়া লইতে পারিবে।

 তা’হলে আমার পথ কি? আপনি যদি অনুমতি করেন, আমি নিজেই একবার সে পথটা খুঁজিয়া দেখি? প্রথমে বাড়ী বাড়ী ঘুরিয়া দেখি যদি ভদ্র পরিবারে কর্ম্ম পাই, অন্যত্র চেষ্টা আমি করিব না। আমার মত অপবিত্রার পক্ষে নিতান্ত স্পর্ধা হইলেও চিরদিনই আমার বড় লোভ হয় যে উঁহাদের পবিত্র সঙ্গে নিজের এই শূন্য নিরালম্ব জীবনটাকে আমার একটুখানিও আমি পবিত্র করিয়া লই। মিশনরী মেমরা ও তাদের আয়ার যেটুকু পায়, জানি না সেটুকু পাওয়ার যোগ্যতা আমার মত হীনজনের আছে কি না?—কিন্তু একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিতে দোষ কি? বলুন, অনুমতি দিন, আদেশ করুন,— ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখি? চরণে কোটি কোটি ভক্তিপূর্ণ প্রণতি।

আপনার সেবিকাধন্যা 
সুষমা দাসী। 

 নরেশের মনের মধ্যে এই মিনতি ও বেদনাভরা আবেদন খানির প্রতি পংক্তিটী যেন বিছার কামড় মারিতেছিল। মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তার প্রতি একবার অভিমান হইল, অমন একটি জীবনকে কেন তিনি এমন ব্যর্থ করিবার জন্য অস্থানে পাঠাইলেন!—নিজের অক্ষমতার পরেও রাগ ধরিল; সে যদি উহার রক্ষাভারই গ্রহণ করিয়াছিল, তবে তাহার যশ অকলঙ্কিত রাখিতে পারিল না কেন? লোক চক্ষে তাহার মর্য্যাদাকে এমন নির্দ্দয়ভাবে, ক্ষুণ্ণ হইতে দেওয়া তাহার একেবারেই উচিত হয় নাই এবং পরিশেষে সেই অসহায় বালিকাকে তাহার বন্দীগৃহে একাকিনী দুর্ব্বহ জীবন বহনে বাধ্য করিয়া নিজে সে শত উদ্দীপনা ও আনন্দের জীবনে এই যে সরিয়া রহিল, এর মধ্যেও যে কত বড় কাপুরুষতা বিদ্যমান রহিয়াছে তা ভাবিয়াও লজ্জায় মাথা তাহার হেঁট হইয়া আসিল। আরব্ধ কর্ম্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া উঠিতে যাহার সাধ্যে কুলাইবে না, সে তেমন কাজের ভার মাথা পাতিয়া লয় কেন?

 বিস্তর ভাবিয়া চিন্তিয়া সে কয়দিন পরে এই পত্র লিখিয়া দ্বারবানের হাতে পাঠাইয়া দিল।

 শুভাশীর্ব্বাদ বিজ্ঞাপন

 সুষমা!

 তোমার পত্রে তোমার আগ্রহ ও উদ্যমের যে পরিচয় পাইলাম, তাহাতে এ সম্বন্ধে তোমায় আর নিবৃত্ত করিতে পারি না। তুমি বুদ্ধিমতী; নিজের ভালমন্দ সম্বন্ধে তোমার বিচার আমার চেয়ে তুমি নিজে ভালই করিতে পারিবে। তোমার অন্তরের পবিত্রতা এবং দৃঢ়তা আমার অবিদিত নয়; তোমায় আমি সর্ব্বান্তঃকরণেই বিশ্বাস করি। যাহা সঙ্গত এবং সম্ভব বোধ করিবে তাহাই করিও। যখন যে সাহায্যের আবশ্যক, অকুণ্ঠিতচিত্তে জানাইতে দ্বিধা করিও না। ঈশ্বর তোমায় কুশলে রাখুন এবং মঙ্গল করুন এই আন্তরিক আশীর্ব্বাদ করি।

তোমার চিরশুভার্থী 
নরেশচন্দ্র। 

 সুষমা এই পত্র পাঠ করিবার পূর্ব্বে একবার এবং পরে আর একবার দেবনির্ম্মাল্যের ন্যায় সম্ভ্রমে ও শ্রদ্ধায় উহা নিজের মাথায় ঠেকাইল। পাঠশেষে একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া চুপি চুপি চিঠিখানি নিজের বুকের ভিতর চাপিয়া ধরিল। তারপর গভীর চিন্তামগ্না হইয়া সে একেবারে তাহারই মধ্যে মগ্ন হইয়া রহিল। যে অনুমতি পাইবার অন্য কয়দিন দিবারাত্রে সে বারিপ্রত্যাশী উর্দ্ধমুখী চাতকের ন্যায় আশাপথপানে চাহিয়াছিল, সে প্রত্যাশা তো পূর্ণ হইল। কিন্তু কল্পনা—সুন্দর ও মধুর কল্পনা বাস্তবের বেশে যখন দেখা দিবে, তখন তার সৌন্দর্য্য এবং মাধুর্য্য যদি ঠিক সেই মানসীরূপে দেখা না দেয়, যদি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিরোধী হইয়া দেখা দেয়, তবে সে যে সহিতে পারা দায় হইবে! এই কথাই সে ভাবিতে লাগিল। তারপরে হঠাৎ সুষমার স্মরণ হইল যে, তার প্রাণে সবই সহিয়া যায়। তখন আত্ম-প্রতিষ্ঠ হইয়া সে নরেশ্চন্দ্রের পত্রোত্তর প্রদান করিল।

 প্রণাম শতকোটি নিবেদন

 পূজ্যতমেষু!

 আপনার কৃপাপত্র পাইয়া কৃত-কৃতার্থা হইলাম। এইবার চিরদিনের স্বপ্ন সফল করিতে সচেষ্ট হইব। কেমন করিয়া কাজ আরম্ভ করিব, কিছুই জানি না। আপনার অবশ্য অনেক বড় ঘর জানা আছে কিন্তু সে সব জায়গায় হয়ত আমার প্রবেশ নিষেধ। কারণ পরিচয় পত্রতে দিবার কিছুই নাই এবং দিলেও সুফলের পরিবর্ত্তে কুফলেরই আশঙ্কা অধিক। কোন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রীর নিকট আমায় পরিচিত করিয়া দিতে পারেন কি? যদি সম্ভব ও সঙ্গত হয় করিবেন।

আপনার সেবিকাধমা 
সুষমা দাসী। 

 এই পত্র পাইয়া নরেশ্চন্দ্র আরও একটু বিব্রত বোধ করিলেন। তিনি স্পষ্ট করিয়াই বুঝিতে পারিতেছিলেন যে এই প্রথম চেষ্টায় সুষমা অকৃত কার্য্য হইবে। তাহার হতাশাকাতর মর্ম্মব্যথা নিজের মনের মধ্যেও অনুভব করিয়া লইয়া তিনি তাহার জন্য অত্যন্ত উষ্ণ ও দীর্ঘ একটা নিশ্বাস মোচন করিলেন। তার সেই যে মুখ আধ অন্ধকারে অর্দ্ধাবরিত, মানসিক সংগ্রামে বিধ্বস্ত অথচ সুদৃঢ় চিত্ত বলে বলীয়ান সেই যে দুটী চোখের দৃষ্টি দীর্ঘ দীর্ঘকালের লেখাকেও পরাভব করিয়া দিয়া তাঁহার মানসনেত্রে যখন তখন ফুটিয়া থাকে, তাঁহাকে জাগ্রতে বা নিদ্রিতে অনুসরণ করিয়া বেড়ায়, আর একবার তাহাদের মধ্যে তীব্র হতাশার মর্ম্মন্তুদ যন্ত্রণার শিখা তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখিতে পাইলেন। সেদিনের ত্যাগে আত্মপ্রসাদ সব কিছু ক্ষতিকেই জয়যুক্ত করিতে পারিয়াছিল, কিন্তু এযে শুধুই আঘাত ও অপমান। অথচ জীবনের এই লক্ষ্য ধরিয়াই যে এতটা পথ অগ্রসর হইয়া আসিয়াছে,—শুধু স্বেচ্ছায় নয়—ইহারই জন্য যাহাকে গড়িয়া তোলা হইয়াছে,—আর তাই করিতে গিয়াই যে আরও বিশেষ করিয়াই লোকলোচনের ও জনরসনার তীক্ষ্ণ ও নির্দ্দয় সমালোচনার বিষয়ীভূত হইয়া দাঁড়াইয়াছে, আজ সে পথ হইতে অপরীক্ষিত ভাবেই বা তাহাকে ফিরিতে বলা যায় কেমন করিয়া?—বিশেষ সকল দিকের পথই যাহার সঙ্কীর্ণ।—কিন্তু কেমন করিয়াই বা উহার আকাঙ্খা পূর্ণ করা যায়? যখন মুমুর্ষা সুগন্ধা নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাহার আশার কথা জানাইয়াছিল, ভবিষ্যতে সুষমা একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন পূর্ব্বক গৃহস্থ কন্যাদের শিক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করে এই সাধ তাঁহার নিকট জ্ঞাপন করিয়াছিল, তখন সেটাকে নরেশচন্দ্রও খুবই সঙ্গত ও সহজ বলিয়াই বোধ করিয়াছিল, এবং সেই পথেই তিনি উহাকে অগ্রসর হইতে সহায়তা করিয়াছেন। তখন ভুলিয়াও তাঁহার মনে এ সংশয় জাগ্রত হয় নাই যে, তাঁহার আশ্রয়ে থাকিলে নিষ্কলঙ্ক সুষমাকে জনসমাজে কলঙ্কিতা হইতে হইবে এবং তাহার পক্ষে তখন শিক্ষয়িত্রীর আসন পাওয়া অধিকতরই কঠিন হইয়া পড়াও সম্ভর। সে ভুল ভাঙ্গিল বহুবিলম্বিত হইয়া।— যাহোক, এখনকার যেটুকু সদুপায় নরেশচন্দ্র তাহাতে আলস্য করিলেন না। সুষমার পত্রের উত্তর না দিয়া তিনি নিজেই প্রথমে এক-বালিকা বিদ্যালয়ে’র উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া গেলেন। সেখানের মহিলা-অধ্যক্ষ পরিচয় পাইয়া বিশেষ যত্নের সহিত তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া উদ্দেশ্যে জানিত চাহিলে নরেশের মন যেন সঙ্কুচিত হইয়া আসিল। কিন্তু দ্বিধার অবসর নাই। তিনি দু’একটা বাদ দিয়া প্রায় সব কথাই উঁহাকে খুলিয়া বলিলেন। মহিলাটি বিশেষ গাম্ভীর্য্যের সহিত পূর্ব্বাপর সমস্ত শুনিয়া লইয়া গম্ভীরমুখে উত্তর দিলেন, “মাপ করবেন মশাই! আমাদের স্কুলে বিশেষ ভদ্রসংসারের গ্র্যাজুয়েট মেয়েদের ভিন্ন কাজ দেওয়া হয় না।”

 নরেশ অন্তরে অন্তরে লজ্জানুভব করিলেও একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখিতে চাহিলেন, “যদি সেই মেয়েটী বিনা বেতনে এখানে দু’এক দিন মেয়েদের গান ও বাজনা শিখিয়ে যায়, তাতে আপনার আপত্তি আছে?”

 প্রবীণা মহিলা অবিচলিতস্বরে জবাব দিলেন, “সেরকম আমাদের নিয়ম নয়। চরিত্র সম্বন্ধে উচু রকম সাটিফিকেট্ অন্ততঃ দু’তিন জন বিজ্ঞ ও বিশেষরূপ সম্মানিত ব্যক্তির নিকট হ’তে না আন্‌লে স্কুলের মেয়েদের মধ্যে কাকেও মিশতে দেবার নিয়ম নাই।”

 সুষমার জীবন চরিতের সঙ্গে এই আপত্তিটার অকাট্য ও সুদৃঢ় সংযোগ দেখিয়া নরেশচন্দ্র সেখান হইতে নিরুত্তরে প্রস্থান করিলেন।

 আরও দু’এক স্থলে প্রায় একইরূপ উত্তর লইয়া তিনি ওদিকের চেষ্টা হইতে বিরত হইলেন। ছোট খাট অর্দ্ধঅচল প্রাইমারী স্কুলগুলিতে বিনা বেতনের সঙ্গীত শিক্ষয়িত্রীর সম্বন্ধে অবশ্য অতটা তাচ্ছিল্য ঘটা হয়ত সম্ভব ছিল না। কিন্তু বড়দের কাছে হতাশ হইয়া নরেশের আর ছোট দরবারে হাত পাতিতে প্রবৃত্তি হইল না। বিশেষ তাঁহার মনে হইল, যদি উচিতের দিক ধরিয়া বিচার করা যায়, তাহা হইলে এসম্বন্ধে বাধ্য করা বা লোভে ফেলা অনুচিতই হইবে। কারণ সুষমা-জাতীয় জীবদের বিশ্বাস করিয়া কতকগুলি অপরিণতমতি বালিকার শিক্ষার ভার দেওয়া কতদূর সমীচীন তাহা ভগবানই জানেন। সুষমা যদি তাঁহার এমন পরিচিত-তমা না হইত, তরে নিজেই তো তিনি ইহার বিরোধী হইয়া উঠিতেন। বড়ই সমস্যার বিষয়!—এদের পথ দিতে ছইবে, কিন্তু সে পথ দিতে গিয়া আবার অন্যের পক্ষে এতটুকু না তাহা পিচ্ছিল হইয়া পড়ে, তার উপরও যে দৃঢ়বদ্ধ দৃষ্টি রাখার একান্তই আবশ্যক।

 নরেশের এক উদারমতাবলম্বী বন্ধু ছিলেন। লোকে তাঁহাকে ‘বিশ্ব প্রেমিক’ নাম দিয়াছিল; আসল নাম তাঁর, বিশ্বপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়। নরেশের মোটর আমহার্ষ্ট স্ট্রীটের মোড় ফিরিতেছিল, বিশ্বপ্রিয় চীৎকার শব্দে ডাকিল, “রাজারাহাদুর!”

 নরেশ মনে মনে যেন ইহাকেই খুঁজিতেছিলেন, উল্লাসে ব্যগ্র হইয়া গাড়ী থামাইতে আদেশ করিলে গাড়ীখানা যতটা অগ্রসর হইয়াছিল ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।

 ততক্ষণে বিশ্বপ্রিয় নিকটবর্ত্তী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় চলেছেন?” নরেশ গাড়ীর দরজা নিজে খুলিয়া ধরিয়া উহাকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, আপনার কাছেই। আস্‌বেন একটু?”