হারানো খাতা/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

না হয় দেবতা আমাতে নাই।—
মাটি দিয়ে তবু গড়ে তো প্রতিমা সাধকেরা পূজা করেত তাই?
একদিন তার পূজা হয়ে গেলে চিরদিন তার বিসর্জ্জন,
খেলার পুতলি করিয়া তাহারে আর কি পূজিরে পৌরজন?

—কাহিনী

 বিশ্বপ্রিয়কে নরেশ সুষমা সম্বন্ধীয় সমস্যার কথা জানাইয়া পরামর্শ চাহিলেন। বিশ্বপ্রিয় সব কথাই নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করিল কিন্তু সুষমার সঙ্গে নরেশের যে কখন কোন অসৎ সম্বন্ধ ছিল না, এই কথাটা সেও মনে মনে ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না! রাজা নরেশের যে প্রবল প্রতাপাম্বিতা ‘উপসর্গ’টার জন্য তিনি কলিকাতা মহানগরীর অনেকখানি আত্মীয়রূপে পরিগণিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, অর্থাৎ যথার্থ বড়লোকের ছেলের দলে স্থান লাভ করিবার নেহাৎই অযোগ্য নহেন বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিলেন এবং অন্যসকলের মত বন্ধু সমাজে তাঁর ‘নিজ জনের’ পরিচয় করাইয়া দিতে উহাকে পাশে লইয়া, কি বাঙ্গালা, কি ইংরাজী আর কি পার্শী থিয়েটায়ের রিজার্ভ বক্সে বসিয়া অভিনয় না দেখায়, বাগানের মজলিসে তাহার ‘মুজুরা’ না করানোয় ধনী মহলে যে নিন্দার সীমা ছিল না, এসব তো আর লুকানো কথা নয়। আজ হঠাৎ একেবারে জলজ্যান্ত সেই জীবটীকে বেমালুম উড়াইয়া দিতে চাহিলে সে উড়িবে কেন? বন্ধুদের মধ্যে নরেশের আড়ালে অনেকেই তাহার সম্বন্ধে—অবশ্য যাদের একটু কাব্য-রসোপভোগ সামর্থ্য ছিল— উল্লেখ করিতে হইলে ঠাট্টা করিয়া তাহাকে ‘বসন্ত সেনার চারু দত্ত’ বলিয়া উল্লেখ করিতেন। বিশ্বপ্রিয় নিজেও কখন কখন যে না করিয়াছে তা নয়। অতএব সে স্থির করিল, বিবাহিত ও নূতনের আস্বাদপ্রাপ্ত নরেশ সুষমাকে পুরাতন ও জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় ফেলিয়া দিতেই ইচ্ছুক হইয়াছেন। প্রবল অনুকম্পা পরবশ হইয়া সে তৎক্ষণাৎ বলিয়া বসিল—”কিচ্ছু ভাবনা নেই, আমি তার জন্য ভাল দেখে কাজ ঠিক করে দেবো। গান শেখাবার কাজের আবার ভাবনা। লোকে একটা শেখাবার লোক পায় না।”

 নরেশ বিশ্বপ্রিয়কে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলিয়া চিনিত। সে নিশ্চিন্ত হইয়া বাড়ী গেল এবং সুষমাকে লিখিল, স্কুলে সুবিধা নয়, তবে ভদ্র গৃহস্থ ঘরে কাজের জোগাড় শীঘ্র হইবারই সম্ভাবনা আছে। সংবাদ পাইলেই জানাইব।

 শীঘ্রই সংবাদ পাওয়া গেল এবং বিশেষ ভাবে অন্তরের সঙ্গে সায় দিতে না পারিলেও অগত্যা এক রকমে মনস্তুষ্টি করিয়া লইয়া নরেশ সুষমাকেও সেই খবর তৎক্ষণাৎ পাঠাইয়া দিলেন। সে চিঠি পাঠাইতে তাঁহার কণ্ঠভেদ করিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস উত্থিত ও পতিত হইল।

 কিন্তু সুষমার ইহাতে যেন আনন্দের আর অবধি রহিল না। কাঙ্গালে যেন কি নিধি কুড়াইয়া পাইয়াছে, এমন করিয়াই সে নেহাৎ সাত বছরের মেয়ের মতন আহ্লাদে প্রায় নাচিয়াই উঠিয়াছিল। এক বিলাতফেরৎ পরিবারে তাহাকে দু’ তিন ঘণ্টার জন্য দু’ এক রকম বাজনা শিক্ষা দিতে হইবে। বাড়ীতে কেবল স্বামী স্ত্রী। স্ত্রীটী উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের কোন ধনাঢ্য ও নব্য তন্ত্রের ছেত্রী কন্যা, স্বামীটী বাঙ্গালী।

 সুষমা উঠি পড়ি করিয়া রান্না খাওয়া সারিল, বরাবর সে নিজেই রাঁধিয়া খায়। নরেশ প্রথমাবধি ইচ্ছাপূর্ব্বকই এই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। যাহাতে বিলাসিনীর গর্ভ প্রসূত সুষমা বিলাস সুখকে তুচ্ছ বোধ করিতে শেখে সেই শিক্ষাই তিনি তাহার জন্য সর্ব্ব প্রযত্নে স্থির করিয়া দিয়াছিলেন। সুষমারও তাহাতে আনন্দ ভিন্ন বিরক্তিবোধ ছিল না।

 আহার সমাধা করিয়া তাড়াতাড়ি সে বেশভূষা সমাপ্ত করিয়া লইল। সুষমা বড় একটা লোকসমাজে বাহিৱ হয় নাই। ভদ্রলোকের বাড়ী যাওয়া জীবনের মধ্যে এই তার প্রথম। কাপড়ের ট্রাঙ্কটা খুলিয়া ফেলিয়। সর্ব্বপ্রথম তাহার ভাবনা হইল কি পরিয়া সে আজ বাহির হইবে? যতদিন সুষমা ছোট ছিল চাঁদনির বাজারে কেনা ফরিদপুরী ছিটের ফ্রক ই একমাত্র তাহার জন্য কিনিয়া দেওয়া হইত। বৎসরে একবার পূজার সময়ে একটা সিল্কের পোষাকের মুখ সে দেখিতে পাইয়াছে। তের বৎসর বয়স হইলে প্রথম সে সাড়ী পরার জন্য আবেদন জানায়, তারপর হইতে বঙ্গলক্ষ্মীর সবচেয়ে মোটা ও কম দামী সাড়ী, টাটা মিলের মার্কিণের সেমিজের সঙ্গে সে আটপৌরে পরিবার জন্য পাইয়া আসিয়াছে। পূজায় একখানা ঢাকাই, শান্তিপুরে নেহাৎ অল্প দামের বাজে বেনারসী এই রকমই কিছু পাইত। সেখনি সে দু’ একদিন পরিয়া সযত্নে ভাঁজ করিয়া গুছাইয়া তাহাতে দু’একটী কর্পূরের চাক্তি আনাইয়া দিয়া রাখিয়াছিল। এই শেষ তিন বৎসর নরেশ তাহাকে পূজার কাপড় কিনিয়া দেন নাই, খরচের টাকা এই তিন বৎসর তার নামে মনিঅর্ডারে আসে। রাজবাড়ীর সরকার দরওয়ানেরা আর তাহার মাসকাবারী বাজার করিয়া দিয়া যায় না। কাপড় সে পূর্ব্বের মতই কেনে, পূজার সময় নিজের চাকরদের কাপড় কিনিয়া দেয়, নিজের জন্য কেনে না। মনে মনে এই কথা বলিয়া মন তাহার বিমুখ হইয়া থাকে যে, ওরা আমার চাকর তাই ওদের আমি দিচ্ছি, আমি যার দাসী তিনি যখন আমায় দিলেন না, তখন আমার কাজ কি?

 তাই আজ বহুকাল পরে ধূলাপড়া ট্রাঙ্কের ডালা তুলিয়া সে চুপ করিয়া তার অনেক দিনের পরিত্যক্ত ঐশ্বর্য্য ভাণ্ডারটীর পানে অনেকক্ষণই চাহিয়া থাকিল। এক একটী সাড়ী জ্যাকেটের ভাঁজে ভাঁজে যেন তার এক একটি অতীত বৎসরের স্মৃতির স্তূপ সঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে। সে ঠেলিয়া উহাদের যেন নাড়া দিতেও তার বুকে বাজিতেছিল। তারপর অল্পে অল্পে সহাইয়া সহাইয়া এক একটি করিয়া সে সেগুলিকে মাটিতে নামাইতে লাগিল। এই গোলাপী ডুরে সাড়ীখানি সর্ব্বের প্রথম বৎসর তিনি নিজে হাতে করিয়া দিয়াছিলেন! সুষমা কাঙ্গালের মতন সেখানিকে গায়ে বুকে যেন আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া বারম্বার উহাতে চুম্বন করিল। যেন ইহাতে আজও সেই দাতার হাতের সৌরভ টুকু পর্য্যন্ত লাগিয়া আছে,—এমনি আগ্রহে উহার ঘ্রাণ লইল। সে কাপড় পরা চলিবে না— উহা আবার সযত্নে সাবধানে যথাস্থানে রক্ষিত হইল। আর একখানি সাড়ী তার সঙ্গের জ্যাকেটটীর উপর দৃষ্টি পড়িতেই সুষমার বুকের যুক্ত যেন হিম হইয়া আসিল। কালীঘাটের মহিলা সভার সেই জ্যাকেট সাড়ী! গভীর ঘৃণায় ন্যক্কারজনক জঘন্য বস্তুর ন্যায় সে তাল পাকাইয়া সে দুটাকে বাক্সের মধ্যে দু’ আঙ্গুলে ধরিয়া ঝুপ্ করিয়া ফেলিয়া দিল। সে দিনের দুষ্টা স্মৃতি তার দেহ যে দিন ভস্মাবশেষ হইয়া যাইবে, সেই ছাইএর মধ্য হইতেও বুঝি মিলাইবে না। নিজের জন্য যত না হোক, সে যে তার আশ্রয়দাতার কত বড় গ্লানির মূল, সে দিন বড় আঘাতেই সে পরিচয় যে সে পাইয়াছে! তার আগে, স্বপ্নেও যে তেমন সম্ভাবনা তার মনের কোণেও কখন জাগে নাই! জাগিলে—কি করিত?—বলা যায় না। তার দেবতার চিত্তে তার এই ব্যথা বোধ যে বিশেষভাবেই আছে, অন্ততঃ এটুকু জানিবার পূর্ব্বে এত বড় লজ্জাকর সংবাদটা তার কর্ণগোচর হইতে পারিলে নিঃসন্দেহ সে নিজেকে বাঁচিয়া থাকিতে দিতে পারিত না। কিন্তু এখন? আত্মহত্যার অধোগতি তার এই অধোগতিতে প্রাপ্ত জীবনের শেষ সঞ্চয় করিয়া লইতে যত না মায়া হয়, তার চেয়ে বেশী মনে লাগে, তার শোচনীয় মৃত্যু নিশ্চয়ই নরেশকে যে বেদনা দিবে তাই ভাবিয়া।

 একখানি ভোমরাপেড়ে শান্তিপুরে সাড়ী ও একটি সাদা সিল্কের ব্লাউজ পরিয়া নিজের গলায় পরা একমাত্র সম্পত্তি এক নল সরু গোট হারটুকু জামার উপর তুলিয়া দিতে হঠাৎ কি মনে হইল। ছোট আরসিখানি পাড়িয়া সে নিজের মুখ দেখিল। তারপর আবার কি ভাবিয়া সেই জ্যাকেট সাড়ী ও হারটুকু খুলিয়া ফেলিয়া আটপৌরে মোটা সাড়ীর সঙ্গে একটি পাবনা ছিটের চেককাটা রংজলা হাতাবড় অ্যাকেট পরিয়া সাজসজ্জা সমাধা করিল। হাতে রহিল দুই গাছি করিয়া ক্ষয়প্রাপ্ত ও হাতের সঙ্গে আঁটিয়া বসা সোনার চুড়ি। এক সময় উহাদের বরফির মতন কাটুনি ছিল, কিন্তু এখন সে সব নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে ও দু’ এক গাছার মুখ ছুটিয়া গিয়াছে।

 নূতন ও সম্পূর্ণরূপে অনাস্বাদিত জীবনের মধ্যে প্রবেশলাভ করিতে পাইয়া সুষমার আনন্দের আর অবধি রহিল না। এত দিনে যেন জন্ম সফল হইল বলিয়া তার মনে হইল। মায়ের শেষ ও প্রধান ইচ্ছা যে অংশতঃ পূর্ণ হইতে পারিয়াছে ইহা মনে করিয়া তাহার মনে সুখ ধরিতেছিল না। মা যে নিজের পথ হইতে সযত্নে তাহাকে দূরে সরাইয়া রাখিয়া তাহার আজিকার এক আনন্দময় জীবনের পথটুকু প্রস্তুত হইবার সুযোগ দান করিয়া গিয়াছেন এই মনে করিয়া সে তাহার উপর একটুখানি কৃতজ্ঞতা বোধ করিল। নতুবা মায়ের উপরের অভিলাষ যে তাহার কত বড় তাহা সে নিজেও যেন পরিমাপ করিতে সমর্থ হয় না। যাহারা নিজেদের পাপ দিয়া সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধে অপর জীবনকে কলঙ্ক কালি মাখাইয়া পৃথিরীর নগ্নবক্ষে কঠিন বন্ধুর ধুলিশয্যায় শোয়াইয়া দেয়, তাদের অপরাধের তুলনা আর কোন কিছুরই সঙ্গেই কি হইতে পারে? মানুষ নিজেকে লইয়া তার যা খুশী করিতে হয় করুক; কিন্তু আর একটি জীবনকে সে নিজের পথে আনয়ন করিতে কোন মতেই অধিকার প্রাপ্ত নহে। সেই মার কাছেই বোধ কবি জীবনে এই প্রথমবার সে মাথা নোয়াইল এই বলিয়া যে, যতই হোক যখন এই জাতীয় নারীর গর্ভেই পূর্ব্বজন্মের মহাপাপে তাহাকে স্থান লইতে হইয়াছিল, তখন ভাগ্যে তার মায়ের মনে ওই ধর্ম্মজ্ঞানের বীজটুকু রোপণ করিয়া ভগবান তাহাকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়াছিলেন, নহিলে আজ তার কি গতি হইত?

 চাকরীর প্রথম ধাক্কা খাইল সে চাকরী করিতে মুনিববাড়ী সর্ব্ব প্রথম পা দিয়া। কর্ত্রী এবং তাহারই ছাত্রী তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইতে আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন “আমি মিসেস গুহ;—তা জানেন বোধ হয়? আপনাকে আমি মিস বা মিসেস কি বলবো অনুগ্রহ করে আমায় আপনি বলে দেবেন। বিশ্বপ্রিয় বাবু সে কথা ওনাকে কিছুই তো বলেন নি?”

 সুষমার ললাটে অচিন্তিত সক্ষার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছিল, সে নতমুখে উত্তর করিল, “আমার নাম সুষমা দাসী।”

 “কিন্তু পদবীটা না জানলে আপনাকে আমি কি বলে উল্লেখ করবো তারই জন্য সেটা জানার—”

 “না না, আমায় আপনি সুষমাই বলবেন, সেই আমার বেশী ভাল লাগবে।”

 দ্বিতীয় দিনটা অম্‌নি কাটিল, তৃতীয় দিবসে আর একটা সমস্যা দেখা দিল।

 মিসেস গুহ মানুষটী বড়ই সাদাসিদে, ভাল মানুষ গোছের লোক মনের মধ্যে তাঁর ছল চাতুরী বড়ই কম। সে দিন সে আন্তরিকতার সহিতই সুষমাকে জানাইল যে, তাহার গান বাজনা শুনিয়া তাহার স্বামী ও তাঁর একজন বড়লোক মক্কেল বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছেন। আগত সপ্তাহের প্রথমেই তাঁদের বাড়ীতে একটা বড় রকম ‘পাটি’ হইবে তাঁদের বিশেষ ইচ্ছা সুষমা সেদিন নিমন্ত্রিত সভায় গান ও বাজনা শোনায়।

 সুষমা একথা শুনিয়া একটু পরে ঘাড় নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবিনয়ে উত্তর করিল “আমায় মাপ করবেন, আমি সে পারবো না!”

 মিসেস্ গুহ একটু ভুল করিয়া ফেলিয়া কহিলেন, “কেন পার্ব্বেন না? আপনাকে তো তেমন ‘নার্ভাস্’ বলে বোধ হয় না!”

 সুষমা মৃদু হাসিয়া কহিল “তা নয়, আমি অপরিচিত পুরুষদের সামনে গাইবো না তাই বলছি।”

 মিসেস গুহ একটু জিদ করিয়া বলিলেন “তাতে দোষ কি? গান গাওয়া কি কোন মন্দ কাজ? ওনার ভারি সাধ হয়েছে যে অতিথিদের আপনার এই চমৎকার গান শোনান।”

 সুষমাকে সম্মত করিতে পারা গেল না।

 দিন কয়েক বেশ আনন্দেই কাটিল। সুষমা নিজের মন প্রাণ ঢালিয়া দিয়া তাহার বয়স্কা ছাত্রীর শিক্ষাকার্য্য অতি সত্বরে উন্নতির পথে অগ্রসর করিয়া দিতে লাগিল। এইটুকু করিতে যে সুখ যে আত্মপ্রসাদ সে নিজের মধ্যে উপভোগ করিতেছিল, বঙ্গ বিহারের শাসনভার হাতে পাইয়াও তাহা লাট সাহেরেরা পাইয়া থাকেন কিনা সন্দেহ। মাস কাবারে যখন চল্লিশ টাকার হিসাবে দশ দিনের মাহিনায় সে ১৩৷৴ হাতে পাইল, বুক যেন গৌরবে তাহার ফুলিয়া উঠিল। নিজের স্বাধীন এবং সৎপথের উপার্জ্জনে সে এখন হইতে নিজেকে পোষণ করিতে পারিবে।—প্রথম মাসের টাকায় মা কালীর কিছু পূজা পাঠাইয়া দিল এবং ভিখারীর জন্য কিছু রাখিল।

 হাইকোর্ট বন্ধ ছিল; বাহিরের ঘরে দুই বন্ধুতে বসিয়া বসিয়া চাখিয়া চাখিয়া কোন সুপেয় পদার্থ পান করিতে নিযুক্ত ছিলেন। হঠাৎ বাজনার শব্দ ভেদ করিয়া সুর সঙ্গীত লহরী কাণের তারে ঝঙ্কার দিল। উৎকর্ণ হইয়াছিলেন দু’জনেই, কিন্তু অল্প পরে সুরেশ্বর সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল “একি! কে গাইচে বলতো? আশ্চর্য্য যে!”

 মিঃ গুহ বলিলেন “গাইচে আমার স্ত্রীর শিক্ষয়িত্রী সুষমা দাসী। আশ্চর্য্য বল্‌চো কেন? হ্যাঁ, তা বল্‌তেই পার।—হোয়াট্ অ্যান্ এক্সকুইজিট রীচ্ ভয়েস্! কিন্তু–”

 বন্ধু এসব কথাগুলো কাণে না তুলিয়াই তৎক্ষণাৎ এমনই সুরে উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন যে মিঃ গুহর মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। “কি হয়েছে? গলা ওর খুব ভাল নয়?”

 বন্ধু সহাস্যে উত্তর দিলেন “কে বল্‌চে ভাল নয়? তা নয় মাই ফ্রেণ্ড! আমি তোমার জোর কপালের জন্য তোমায় ‘কন্‌গ্রাচুলেট’ করচি। ‘রথ দেখা এবং কলা বেচা’ একসঙ্গে তাহলে দুইই বেশ চালাচ্চো? আছ মন্দ নয়।”

 “রেখে দে তোর হেঁয়ালি! তুই কি চিনিস ওকে?”

 সুরেশ্বর ব্যঙ্গ করিয়া বলিল তা আর চিনিনে, সুষমা দাসী যে আমার ‘নেক্সট্‌ডোর নেবার’। ও গলা শুনেই যে তাই ধরে ফেলেছি। কি করে বাগালে দাদা?”

 “আপনিই এসেছে। আচ্ছা ওর ব্যাপারখানা কি বলতো শুনি?

 “বল্‌চি! রাজা নরেশচন্দ্র বাহাদুরের নাম শুনেছ?”

 “উঁ হুঁ, কই মনে পড়ে না। তার?”

 “হুঁ”

 “তা’পরে?”

 “চিরন্তনী। খুব ধুমধাম, বন্ধুবান্ধব নিয়ে গান বাজনা, রাত্রি এগারটা পর্য্যন্ত মোটর দাঁড় করিয়ে রাখা। তারপর আর কি, ‘প্রস্থানং কুরু কেশব।’ কিছুদিন একলা একলা স্বর সাধনা করে করে ইদানীং বোধ হয় পেটের নাড়ীতে কিছু টান ধরে থাক বে, তাই বৃন্দাবনের পরিবর্ত্তে এই স্ট্রীটে এসে পৌঁছেছেন। তোমায় কিন্তু আমার ভারী হিংসে হচ্চে।”

 মিঃ গুহ বিস্ময়সহকারে মন্তব্য করিলেন, “কিন্তু ধরণ ধারণতো সে রকম মনে হয় না। আমার সাম নেই বার হতে চায় না।” বলিয়া গান শুনাইবার প্রস্তাব সম্বন্ধে সকল কথা বলিলেন।

 শুনিয়া সুরেশ্বর ব্যঙ্গ করিয়া হাসিয়া বলিল, “আরে রেখে দে ভাই ঢের দেখেছি। ওসব ওদের চাল। ওঁরাই ছুঁচ হয়ে ঢুকে’ আবার ‘ফাল হয়ে বার হন’। খুব দাঁও লেগেছেরে ভাই। খুব দাঁও। আমি তো এ পর্য্যন্ত কখন ‘তারে চোখে দেখিনি শুধু বাঁশী শুনেছি।— সেই সঙ্গেই ‘মন প্রাণ যা’ছিল তা দিয়ে ফেলেছি।”

 কয়েকদিন পরে সুষমা গাড়ী হইতে নামিয়া গাড়ী ও তার বিশ্বাসী দরওয়ানকে ছাড়িয়া দিয়া বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া ড্রইং রুমে ঢুকিয়া দেখিল ঘর খালি, মিসেস গুহ সেখানে নাই। অন্যত্র ব্যাপৃত আছেন মনে করিয়া নিজের আসনের কাছে আসিয়া সে তাঁহাকে নিজের আগমন জানা দেওয়ার ইচ্ছায় যেমন এসরাজ তুলিয়া লইয়াছে, অমনি পাশের ঘরের পর্দ্দা নড়াইয়া মিসেস গুহর পরিবর্ত্তে বাহির হইয়া আসিলেন মিঃ গুহ।

 সুষমা প্রথমতঃ মনে করিয়াছিল তাহার এ ঘরে অবস্থান না জানিয়াই গৃহস্বামী অকস্মাৎ এই ঘরে আসিয়া পড়িয়াছেন, তাহাকে দেখিতে পাইয়া এখনই প্রস্থান করিবেন। কিন্তু নিরতিশয় বিস্মিতা হইয়া দেখিল, তাহাকে দেখিতে পাইয়া গৃহত্যাগ করার পরিবর্ত্তে তাহারই দিকে অগ্রসর হইতে থাকিয়া তিনি তাহাকেই উদ্দেশ্য করিয়া সম্বোধন করিতেছেন।—

 “গুডমর্ণিং ম্যাডাম! আমার গাফিলিতে আপনাকে অনর্থক এই কষ্ট পেতে হোল। মিসেস গুহ আজ বোনের বাড়ী গেছেন, ফিরতে তাঁর রাত হবে, তিনি বলেছিলেন আর্দ্দালিটিকে বলে রাখতে যে আপনি আসা মাত্রে এই খবরটা জানায়, আমার সেটা কিন্তু আদৌ মনে ছিল না, মাপ কর্ব্বেন।” মি: গুহ ক্ষমা প্রার্থনা শেষ করিয়া অঙ্গুলি-ধরা চুরোট ঠোঁটে চাপিয়া সেকহ্যাণ্ডের জন্য নিজের হাত তাহার দিকে বাড়াইয়া দিলেন।

 সুষমা তাহা স্পর্শ করিল না। সে রাগে গুম্ হইয়া গিয়া কঠিন হইয়া রহিল; তার পর অন্যদিকে মুখ ও চোখ রাখিয়া তাহারই উদ্দেশ্যে এই কথা শুধু বলিল, “চাকরদের একখানা গাড়ী ডেকে দিতে বল্‌বেন।”

 মিঃ গুহ বড়ই বিপন্নভাবে জবাব দিলেন, “বেয়ারাটা আজ ছুটী নিয়ে গেছে, আর্দ্দালীটা এই মাত্র খেতে গেল, মালীটাও বাড়ী নেই, আপনি বসুন না, এক্ষুণি ওরা খেয়ে নিয়ে আসবে, ওরা এলেই গাড়ী আপনাকে আনিয়ে দেবো।”

 অগত্যাই ভয়বিপন্না সুষমা স্পন্দিতবক্ষে ও শঙ্কিতমুখে দূরের একটা আসনে আলগোছ ভাবে বসিয়া পড়িল। স্পষ্ট করিয়া ইঁহার অবাধ্যতা করিতেও তাহার ভরসায় কুলাইল না।

 মিঃ গুহ চুরোট টানিতে টানিতে সুষমার আপাদ মস্তক খুঁটিয়া খুঁটিয়া দেখিতেছিলেন। মনে কিছু বিস্ময় ও দ্বিধা জাগিতেছিল। রাজারাজড়ার অনুগৃহীতার মত রূপ তাহার শরীরে থাকিলেও বেশভূষায় সম্পূর্ণ বিপরীতই যে প্রমাণ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে মোটা ও অ-সুখস্পর্শ পোষাকে তাহার সুডোল গঠনের সবটুকুই যেন চেষ্টা করিয়া ঢাকা। তাহার হঠাৎ মনে হইল বাকলবসনা শকুন্তলা যেন তাহারই সম্মুখে! আবার মুগ্ধ মন সুরেশ্বরের ব্যঙ্গোক্তি স্মরণ করিল—'ওসব ওদের লীলা কলা, ঠাট ঠমক,—তা বুঝতে পারচো না!’

 মিঃ গুহ তখন দ্বিধাশূন্যভাবে উহার সহিত আলাপ সুরু করিয়া দিলেন—

 ”একটা গান্ না, চমৎকার গলা আর হাত আপনার।” এই বলিয়া তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাহার সত্যসত্যই সুগঠিত ও সুললিত হাত দু’টির পানে চাহিয়া রহিলেন। সেই দৃষ্টি চোখে না দেখিয়াও অনুভব করা যায়। সুষমার ললাট হইতে বক্ষ অবধি সেই অনুভূত মুগ্ধ দৃষ্টির লজ্জায় রং মাখান হইয়া গেল। কিন্তু চুপ করিয়া থাকিয়া উহাকে বেশী প্রশ্রয় দিয়া ফেলা হইবে বোধে সে অত্যন্ত বিনীত ও মৃদুকণ্ঠে উত্তর দিল, “আজ থাক, একটা গাড়ী যদি আমায় দয়া করে আনিয়ে দেন।”—

 মিঃ গুহ যথাপূর্ব্ব বসিয়া থাকিয়া উদাসকণ্ঠে উত্তর দিলেন, “ব্যস্ত হচ্চেন কেন, বলেছিতো চাকররা বাড়ী নেই, এলেই গাড়ী পাবেন। ততক্ষণ না হয় এসরাজটা একটু বাজান না। আমরা কি শোনবার যোগ্যই নই?”

 এরূপভাবে একজন অপরিচিত পুরুষকে তাহার সহিত কথা বলিতে দেখিয়া সে যত বিস্মিত ততই আহত হইল। আশ্চর্য্য দৃষ্টি ফিরাইয়া বারেক ইহার দিকে চাহিয়াই সে পরুষ কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, “আমার ক্ষমা করবেন; কিছুই আমি আজ পারবো না।”

 মিঃ গুহ তখন আর এক পথ ধরিলেন।

 “সুরেশ্বরকে আপনি জানেন? সুরেশ্বর বোস? আপনার পাশের বাড়ীতেই থাকে।”

 সুষমার রাঙ্গামুখ সাদা হইয়া গেল। বুকের ভিতর ধক্ করিয়া উঠিল; অস্পষ্টস্বরে সে বলিল “না”—

 “সে কিন্তু আপনার অনেক কথা বল্লে। আপনার গান শুনেই চিন্‌তে পেরেছিল। আদি গঙ্গার উপর·····রোডে ‘সুষমা কুটিরে’র ঠিক পাশেই হল্‌দে রংয়ের বাঁহাতি বাড়ীখানা তার।

 সুষমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় ধড়ফড় করিতে লাগিল। উঠিয়া পালাইয়া যাইবার প্রবল ইচ্ছায় তার পা তাহাকে টানিতে লাগিল, এই অপরিচিত পুরুষের চোখে তার মর্য্যাদা যে কোথায় গিয়া পৌঁছিয়াছে, সে কথা সে ভাল করিয়াই দেখিতে পাইল এবং এও বুঝিল যে তাহার অমন পরিচয় না পাইলে কখনই তিনি তাহার সহিত এই ভাবের সম্ভাষণ করিতে সাহসী হইতেন না। তার বুক ঠেলিয়া কান্না আসিল।

 “দেখুন, সংসারে এই রকমই নিত্য ঘটছে। সব মানুষ যদি ভদ্র হতো তাহলে আর ভাবনা কি? কিন্তু তা’বলে আপনার এ বয়সে এই রকম খেটে খাবার দরকারও তো দেখতে পাইনে কিছু। সবাই অবশ্য রাজা নরেশচন্দ্র না হতে পারে, কিন্তু আমাদেরও যে মনে কোনই সখ নেই, তাও তো নয়। যাতে তোমার কোন দিকে কষ্ট না হয়, হাতে দু’পয়সা জমে, দু’খানা গহনা গাঁটি গায়ে পরতে পারো, তার জন্য আমাদের বিশেষ চেষ্টা থাক্‌বে। আর এই একজোড়া মুক্তোর দুল এনেছি—”

 চেয়ার ঠেলার শব্দে মিঃ গুহকে উত্থিত বোধ করিয়াই তাড়িৎ স্পৃষ্টের ন্যায় লাফ দিয়া উঠিয়া দিক্ বিদিক্ জ্ঞানশূন্যের মতই সুষমা ঊর্দ্ধশাসে ছুটিয়া পলাইল। কোথা দিয়া এবং কেমন করিয়া—তার কোন হুঁস না রাখিয়াই সে বাড়ী ছাড়াইয়া বাগানের মধ্যে পড়িয়া প্রাণপণে ছুটিল। ইতিমধ্যে পিছনে একবারও চাহিয়া দেখিল না। তারপর সদর রাস্তায় আসিয়া যখন পড়িতে পড়িতে গ্যাস পোষ্ট ধরিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, তখন কাহাকেও অনুসরণ করিতে না দেখিয়া তাহার দেহে যেন প্রাণ ফিরিয়া আসিল ও তখন মনে হইল, অত জোরে না ছুটিলেও হয়ত বা চলিত। বাস্তবিক তো কেহই তাহাকে ধরিতে আসে নাই। অপর কেহ দেখিতে পাইয়া থাকিলে কি না জানি মনে করিয়াছে? তারপর কপালের ঘাম আঁচলে মুছিয়া, শুষ্ক অধর ও কণ্ঠ কোনমতে একটুখানি রসসিক্ত করিয়া লইয়া সে দ্রুতপদে যেদিকে চোখ যায় চলিতে আরম্ভ করিয়া দিল। তখনও তার মনের মধ্যে ভয় ও সন্দেহ তুমুল হইয়া রাহিয়াছিল।