হারানো খাতা/নবম পরিচ্ছেদ

নবম পরিচ্ছেদ

ছােটরে করিয়া ঘৃণা করিছ যে পাপ,
তােমারে করেছে নীচ তারি অভিশাপ।
তাদের না কর যদি উচ্চাসন দান,
ঘুচিবে না কভু তব ‘নীচ’ অপমান।

—প্রবাসী

 সুর্য্যের আলােভরা অলস মধুর মধ্যাহ্নে কলিকাতার এই কোলাহলবিরল অংশ প্রায় পল্লীবিজনতা প্রাপ্ত হইয়া একখানি দৃশ্যের মতই প্রশান্ত হইয়া আছে। এই দীপ্ত স্নিগ্ধ দিনটীর দিকে চাহিয়া নিরঞ্জন তাহার নিরালা ঘরে চুপ্‌টী করিয়া একটি চৌকির উপর খােলা জানালার ধারে বসিয়াছিল।

  এই জানালার নীচের বাগানের রং বেরংএর কৃষ্ণকলি, জিনিয়া আর রজনীগন্ধা একেবারে প্রচুরতররূপে ফুটিয়া আছে। ইহারই ঠিক সাম্‌নাসাম্‌নি বাড়ীর সীমাবিভাগের প্রাচীরের গায়ে একটা বক ফুলের গাছ আধহেলা হইয়া রহিয়াছে; তাহার ডালপালার মধ্য হইতে একটা লুকানাে পাখীর তীক্ষ মধুর শিষ্ দেওয়ার শব্দ বাহির হইয়া আসিতেছিল। মধ্যে মধ্যে ইহারই ঠিক পাশের অপরাজিতার ঝােপটাকে নাড়া দিয়া কয়েকটা শালিক কি যেন খুঁটিয়া খাইতেছিল, এবং কিচির মিচির শব্দে আনন্দ বা নিরানন্দ প্রকাশ করিতেছিল, সেটা কিন্তু বেশ বােধগম্য হইতেছিল না। বাগানের জমিটি নববর্যার কয়েকটি বর্ষণ পাইয়াই নয়নসােভন শ্যামলতায় যেন চিকণ হইয়া উঠিয়াছিল এবং সেই আর্দ্র তৃণ হইতে একটা অতি মৃদু সজল গন্ধ যেন সঙ্কুচিতভাবে উত্থিত হইয়া অনিচ্ছামন্থরভাবে বাতাসের সহিত মিশ্রিত হইয়া গিয়াছিল। প্রকৃতির বাহ্য জগতের এই স্তব্ধ আত্ম-সমাহিতভাব নিরঞ্জনের মনের ভিতরে প্রবেশ করিয়া তাহার নিয়ত অশান্তি ও নিরানন্দে ভরপূর চিত্তটিকে শুদ্ধ যেন তাহার সেই শান্তির মাধুর্য্যে পরিপূরিত করিয়া তুলিয়াছিল। সে যেন ইহাদের হইতে একটা অনির্ব্বচনীয় প্রশান্তি লাভ করিয়া তাহার ভিতরেই মগ্ন হইয়া গিয়াছিল। অহোরাত্র, জাগ্রতে এবং নিদ্রাতেও যে সান্ত্বনাবিহীন শান্তিহীন দুশ্চিন্তা বা দুষ্ট স্মৃতির তাড়নায় তাহার প্রত্যেক দণ্ড পলটুকু পর্য্যন্ত দারুণ দুঃখভারাক্রান্ত সে সবই যেন তাহার মনের মধ্য হইতে এই শান্ত মধুর প্রকৃতির শান্তিধারা এই মুহুর্ত্তে ধৌত করিয়া দিয়াছে।

 ঘরের দরজার কাছে খুট করিয়া একটু শব্দ হইল; দোরটা খুলিয়া গেল, পেঁচোর মা মুখ বাড়াইয়া ঘরের মধ্যটা ভাল করিয়া দেখিয়া তারপর ভিতরে প্রবেশ করিল। একপাশে শয়নের নেয়ারবোনা খাট, আর এক ধারে একটি ছোট টেবিল। টেবিলের উপর দোয়াত, কলম, কাগজ আর তারই মধ্যে কয়েকখানা ছোট বড় নোট একখানা লেফাপার মধ্যে খোলাই পড়িয়া আছে। পেঁচোর মা প্রায় নিঃশব্দে সেইখানে আসিয়া উহার মধ্য হইতে একখানা দশ টাকার নোট বাহির করিয়া লইয়া আবার তেমনিভাবে বাহির হইয়া চলিয়া গেল, গৃহাধিকারী ইহার বার্ত্তা কিছুই জানিতে পারিল না। টাকাগুলা তাহাকে নরেশচন্দ্রেরই খাজাঞ্চির বেতন হিসাবে দিয়াছিল।

 বাবুর খানসামা সাতকড়ি আসিয়া ডাকিয়া উঠিল “ম্যাষ্টর মশাই!”

 প্রথম ডাকে নয়, দু তিন ডাকের পর নিরঞ্জন মুখ না ফিরাইয়াই জবাব দিল, “উঁ?”

 —“বলি মাইনে পেলেন, তা আমরা যে আপনার অসুখে বিসুখে এতটাই করলুম, বলি আমাদের বকশিষ কই?”

 নিরঞ্জন তদবস্থাতেই উত্তর দিল “নাওনা ভাই! ঐখানেই তো আছে।” সাতু এই উত্তরই আশা করিয়া পেঁচোর মার হেয় নীতি অবলম্বন করা অনর্থক বোধে উহা হইতে বিরত ছিল। খাম হইতে নোট কয়খানা বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিল “কত নিই?”

 “যা তোমাদের খুসী।”

 “তাহলে এই পঁচিশের মধ্যে পনের আমরা বকশিষ নিলুম, আর এই দশটা টাকা আমার কাছেই আমানত রইলো, দরকার হ’লে বলবেন বার করে দেব। বাড়ীর দাসী চাকরদের কারু কারু যে বেশ একটু হাত টান আছে, সে ত আমার কাছে ছাপা নেই, কে কখন গেঁড়া দিয়ে দেবে বইতো নয়, কি বলেন মাষ্টর মশাই। রাখবো কি আমার সিন্ধুকে তুলে? তাতে খুব ভাল বিলিতি তৈরি কুলুপ লাগান আছে।”

 নিরঞ্জন সবকথা—সব কেন একটা কথাও—কানে না তুলিয়া অমনি অমনিই জবাব দিয়া চুকিল, “বেশ।”—

 বোকারাম মাষ্টারের নির্বুদ্ধিতা এবং নিজের বুদ্ধিমত্তার তুলনা করিতে করিতে প্রসন্নমনে সাতকড়ি টাকাগুলি লইয়া চলিয়া গেল। মনে মনে বলিল “বাবু তো পঁইত্রিশ টাকা দিয়েছিলেন, আর দশটা কোন চিলে এর মধ্যেই ছোঁ মারলে? অ্যাঁ! আমার মুখের গরাস কেড়ে খায়, সে ত সামান্যি নয়। যা হোক সন্ধান করতে হচ্ছে।”

 বক ফুলের গাছের ডালে সুখসমাসীন পাখীটা একটা তীক্ষ্ণ উচ্চরব করিয়া ডানা ঝাড়া দিতে দিতে উড়িতে আরম্ভ করিয়া কোথায় উধাও হইয়া গেল। সেই আকস্মিকশব্দে চকিত হইয়া উঠিতেই নিরঞ্জনের কর্ণে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত কণ্ঠের আহ্বান-ধ্বনি প্রবেশ করিল, “মাষ্টার মশাই!”

 আহ্বান নারী-কণ্ঠের, এবং তাহা যে ‘পেঁচোর মা’ শ্রেণীর কাহারও নহে, তাহা নিরঞ্জনের স্বাভাবিক বুদ্ধিই তাহাকে জানাইয়া দিল। সে তার স্বভাবের বিরুদ্ধ একটু বিস্মিত ও উত্তেজিত ভাবে মুখ ফিরাইতেই এক সুদর্শনা নারীর সহিত মুখামুখী হইয়া গেল। রমণীর সাজসজ্জায় ও হাবভাবে তাহাকে উচ্চ জগতের জীব বলিয়া চিনিয়া লইতে উহার বিলম্ব ঘটিল না এবং এই পরিচয়ে একাধারে বিপন্ন, বিরক্ত ও বিজড়িত হইয়া পড়িয়া নিরঞ্জন যেন আড়ষ্ট হইয়া গেল, হাত তুলিয়া ইহার উদ্দেশ্যে সে একটা ভদ্রতার নমস্কার পর্য্যন্ত জানাইতে সমর্থ হইল না।

 ঘরে আসিয়া ঢুকিয়াছিল বাড়ীর কর্ত্রী স্বয়ং। স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তর্ক করিয়াছিল বলিয়াই সে নিজের সেই ভুল শোধরাইয়া লইবার সদিচ্ছায় তাঁহার দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা না রাখিয়াই নিজেকে প্রায়শ্চিত্ত করাইতে আনিয়াছিল,— কিন্তু সে যে এত কঠিন, এ ধারণা তার একটু পূর্ব্বেও ছিল না। নিরঞ্জনের মুখের দিকে সে চাহিতে ভরসা করে নাই, তাহার জুতাখোলা পায়ের দিকেই তার চোখ ছিল। বসন্তের গভীরতর ক্ষত চিহ্নের সেখানেও অভাব ছিল না। তার উপর সেই দুর্ব্বল শীর্ণ পা দুখানি থর থর করিয়া কাঁপিতেছে লক্ষ্য করিয়া কিছু দয়ার্দ্র ভাবেই বলিয়া ফেলিল “আমি আপনার কাছে পড়তে এসেছিলুম, যদি আপনার শরীর ভাল না থাকে, তাহলে আজ থাক।”

 এই বলিয়াই সে উহার দিকে পিছন ফিরিতে গিয়া পশ্চাত হইতে এমন একটা সুর শুনিতে পাইল এবং তাহাতে এমন করিয়াই সে চমকাইয়া উঠিল যে, যেন সেই ক্ষীণ দুর্ব্বল ও ত্রস্ত কণ্ঠস্বর একটা আকস্মিক বর্শার মতই আসিয়া পড়িয়া তাহার পিঠের হাড়ের মধ্যে তার তীক্ষ্ণ ফলাটাকে সবেগে বিঁধিয়া দিয়াছিল। ভয়ার্ত্ত মুখের পাংশু ছবি লইয়া আবার সে চকিতভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইল।

 সাম্‌নে তাহার কীটদষ্ট পুরাতন জীর্ণ পুঁথির মতই এক বসন্তক্ষত বিকৃত এবং আগুনে বা অপর কোন দাহ্য পদার্থের দ্বারায় অধিকতর বিকৃতিপ্রাপ্ত অপরিচিত মুখ। তবে সেই তাহার পরিচিত সুরের লেখা কোথা হইতে অকস্মাৎ এই অজানাকে আশ্রয় করিয়া আজ এত দিন পরে আবার এই জাগ্রত মধ্যাহ্নে ভাসিয়া আসিল? সেকি স্বপ্ন না সত্য? পরিমলের বুকের মধ্যে সন্দেহ আশঙ্কা ও তার সঙ্গেই মিশ্রিত একটুখানি যেন আগ্রহও এক সঙ্গে একটা অজানা তরঙ্গে তরঙ্গিত হইয়া উঠিতে লাগিল। স্বপ্ন—স্বপ্ন ইহাকে সে কেমন করিয়া বলিবে? মানুষ কখন জাগিয়া থাকিয়া স্বপ্ন দেখিতে পারে? সে উৎসুক-নেত্রে উৎকণ্ঠা ভরিয়া নিরীক্ষণ করিয়া করিয়াই নিরঞ্জনের নতমুখ দেখিতে লাগিল এবং অন্তরে অন্তরে শিহরিয়া পর্য্যবেক্ষণ দৃষ্টিকে ভূমিলগ্ন করিয়া ফেলিয়া পূর্ণ অবিশ্বাসে, দীর্ঘ করিয়া একটা শ্বাস গ্রহণপূর্ব্বক কহিল, “বই তো আমি কিছুই আনিনি, যাহোক একটু পড়ান; ইনি বলে গেছেন, আপনার কাছে পড়তে।”

 নিরঞ্জনের যে কথার স্বরে সে চমকিয়া উঠিয়াছিল,তাহা এই “আপনি কি পড়তে চান বলুন, আমি পড়াচ্ছি।”

 এবার নিরঞ্জন এই কথাটার মধ্য দিয়া অনেকখানিই অনুভব করিল। তাহার চাকরীটা যে কি, এতদিনের পর সেইটাই এবার তাহাকে বুঝাইয়া দিবার সময় আসিয়াছে, তা সেটা যে এমন মূর্ত্তিতেই দেখা দিবে,এ সংশয় সে অভাগার মনের কোনেও কখন উদিত হয় নাই। নরেশ অবশ্য কাজটাকে খুব কঠিন বলিয়াই স্বীকার করিয়া প্রথমাবধি এতৎসম্বন্ধে তাহার কৃতকার্য্যতারও সন্দেহ প্রকাশ করিয়া রাখিয়াছেন, তাঁহাকে অবশ্য দোষ দেওয়া চলে না, কিন্তু সেটা যে এমনই কঠিনরূপে প্রকাশ পাইবে তাহা জানা থাকিলে, নিরঞ্জন হয়ত—তা’জানা থাকিলেই বা নিরঞ্জন কি করিতে পারিত? জীবন ও আশ্রয়দাতাকে সে কি মুখের উপর বলিতে পারিত যে, তাঁহার এই সামান্য কাজটুকুও তাহার দ্বারায় ঘটা সম্ভব নয়? প্রাণপণে নিজের সকল সঙ্কোচকে সে মনের মধ্যেই চাপিয়া ফেলিল, আবেগরুদ্ধ কণ্ঠের কম্পনকে যথাসাধ্য নিরোধ-চেষ্টার সহিত সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “তা’হলে লাইব্রেরি থেকে কোন বই বেছে দেবেন চলুন; এখানে তো কোনই বই নেই।”

 পরিমলের পায়ের তলা হইতে মাথার চুলের গোড়া পর্য্যন্ত প্রবলবেগে একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ বহিয়া চলিয়া গেল। সে আবার বৃথাই দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সেই ভস্মস্তুপবৎ ভীষণদর্শন দগ্ধমুখের রহস্য-জটিলতা যেন উলটিয়া উলটিয়া দেখিতে চেষ্টা করিল। কিছু না, কোন নিদর্শনই ত নাই। তবে কোথা হইতে, কেমন করিয়া সেই পরিচিত,—বড় পরিচিত কণ্ঠের শব্দটুকু, আজ বারেবারেই সুদূর অতীত, করুণ কঠিন ভয়াবহ অতীতের—মধ্য হইতে তার সমস্ত বিস্মৃতির ধূলি জঞ্জাল ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিতে চাহিতেছে? একি তবে পরিমলের কল্পনা মাত্র? একি সত্য নয়? একি তার মনের মধ্যের স্মৃতির তারে যে অবিস্মৃত অতীত আজিও দিনে রাত্রে সকল সময় সকল সুখ-সম্পদের মধ্য দিয়াও করুণ ও কাতর মূর্চ্ছনায় ঝঙ্কার দিয়া উঠিতে থাকে, তারই একটা রেস, আর কিছুই নয়? আবার একটা দীর্ঘতর নিশ্বাস সে মোচন করিল এবং তারপর নিজের মনকে শান্ত করিবার জন্যই ইহার সান্নিধ্য ছাড়াইতে চাহিয়া বলিয়া ফেলিল, “আজ থাক, কাল বই নিয়ে আসবো,”—এই বলিয়াই সে তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া ফিরিয়া চলিয়া গেল।

 তখন প্রায় রুদ্ধশ্বাসে নিজের পরিত্যক্ত আসন খানার উপর সবেগে বসিয়া পড়িয়া ঊর্দ্ধমুখে শ্বাসগ্রহণ পূর্ব্বক নিরঞ্জন আর্ত্তকণ্ঠে আত্মগত কহিয়া উঠিল, “আবার সেই ছায়া! সে নয়—তবু যেন সেই! নাঃ, মানুষ আমায় আর থাক্‌তে দিলে না। আবার দেখছি পাগল করে আমায় পথে বার করে দেবে।”