হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/ভাব ও অভাব
ভাব ও অভাব
কবিবর কুঞ্জবিহারীবাবু ও বশংবদবাবু
কুঞ্জবিহারী। কী অভিপ্রায়ে আগমন?
বশংবদ। আজ্ঞে, আর তো অন্ন জোটে না; মশাই সেই যে কাজের—
কুঞ্জবিহারী। (ব্যস্তসমস্ত হইয়া) কাজ? কাজ আবার কিসের? আজ এই সুমধুর শরৎকালে কাজের কথা কে বলে?
বশংবদ। আজ্ঞে, ইচ্ছে করে কেউ বলে না, পেটের জালায়—
কুঞ্জবিহারী। পেটের জালা? ছিছি ওটা অতি হীন কথা— ও-কথা আর বলবেন না।
বশংবদ। যে আজ্ঞে, আর বলব না। কিন্তু ওটা সর্বদাই মনে পড়ে।
কুঞ্জবিহারী। বলেন কী বশংবদবাবু, সর্বদাই মনে পড়ে? এমন প্রশান্ত নিস্তব্ধ সুন্দর সন্ধ্যাবেলাতেও মনে পড়ছে?
বশংবদ। আজ্ঞে, পড়ছে বই কি। এখন আরও বেশি মনে পড়ছে। সেই সাড়ে দশটা বেলায় দুটি ভাত মুখে গুঁজে উমেদারি করতে বের হয়েছিলুম তার পরে তো আর খাওয়া হয়নি।
কুঞ্জবিহারী। তা না-ই হল। খাওয়া না-ই হল।
বশংবদবাবুর নীরবে মাথা চুলকন
এই শরতের জ্যোৎস্নায় কি মনে হয় না যে, মানুষ যেন পশুর মতো কতকগুলো আহার না করেও বেঁচে থাকে! যেন কেবল এই চাঁদের আলো, ফুলের মধু, বসস্তের বাতাস খেয়েই জীবন বেশ চলে যায়! বশংবদ। (সভয়ে মৃদুস্বরে) আজ্ঞে, জীবন বেশ চলে যায় সত্যি কিন্তু জীবন রক্ষে হয় না— আরও কিছু খাবার আবশ্যক করে।
কুঞ্জবিহারী। (উষ্ণভাবে) তবে তাই খাও গে যাও। কেবল মুঠো মুঠো কতকগুলো ভাত ডাল আর চচ্চড়ি গেলো গে যাও। এখানে তোমাদের অনধিকার প্রবেশ।
বশংবদ। সেগুলো কোথায় পাওয়া যাবে মশায়! আমি এখনই যাচ্ছি।
কুঞ্জবাবুকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইতে দেখিয়া
কুঞ্জবাবু, আপনি ঠিক বলেছেন, আপনার এই বাগানের হাওয়া খেলেই পেট ভরে যায়। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।
কুঞ্জবিহারী। এ কথা আপনার মুখে শুনে খুশি হলুম, এই হচ্ছে যথার্থ মামুষের মতো কথা। চলুন, বাইরে চলুন; এমন বাগান থাকতে ঘরে কেন?
বশংবদ। চলুন।
আপন মনে মৃদুস্বরে
হিমের সময়টা— গায়েও একখানা কাপড় নেই—
কুঞ্জবিহারী। বা— শরৎকালের কী মাধুরী!
বশংবদ। তা ঠিক কথা। কিন্তু কিছু ঠাণ্ডা।
কুঞ্জবিহারী। (গায়ে শাল টানিয়া) কিছু মাত্র ঠাণ্ডা নয়।
বশংবদ। না ঠাণ্ডা নয়।
হিহিহি কম্পন
কুঞ্জবিহারী। (আকাশে চাহিয়া) বা বা বা— দেখে চক্ষু জুড়োয়। খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘগুলি নীল আকাশে সরোবরে রাজহংসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে আর মাঝখানে চাঁদ যেন— বশংবদ। (গুরুতর কাশি) খক খক খক।
কুঞ্জবিহারী। মাঝখানে চাঁদ যেন—
বশংবদ। খন খন খক খক।
কুঞ্জবিহারী। (ঠেলা দিয়া) শুনছেন বশংবদবাবু— মাঝখানে চাঁদ যেন—
বশংবদ। রসুন একটু— খক খক খন খন ঘড ঘড়।
কুঞ্জবিহারী। (চটিয়া উঠিয়া) আপনি অত্যন্ত বদলোক। এ-রকম করে যদি কাশতে হয় তো আপনি ঘরের কোণে গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকুন। এমন বাগান—
বশংবদ। (সভয়ে প্রাণপণে কাশি চাপিয়া) আজ্ঞে, আমার আর কিছু নেই। (স্বগত) অর্থাৎ কম্বলও নেই, কাঁথাও নেই।
কুঞ্জবিহারী। এই শোভা দেখে আমার একটি গান মনে পড়ছে। আমি গাই—
সু-উ-উন্দর উপবন বিকশিত তরু-উগণ মনোহর বকু—
বশংবদ। (উৎকট হাঁচি) হ্যাঁচ্ছোঃ
কুঞ্জবিহারী। মনোহর বকু—
বশংবদ। হ্যাঁচ্ছো। হ্যাঁচ্ছো—
কুঞ্জবিহারী। শুনছেন? মনোহর বকু—
বশংবদ। হ্যাঁচ্ছোঃ হ্যাঁচ্ছোঃ।
কুঞ্জবিহারী। বেরোও আমার বাগান থেকে।
বশংবদ। রসুন— হ্যাঁচ্ছোঃ।
কুঞ্জবিহারী। বেরোও এখেন থেকে—
বশংবদ। এখনি বেরোচ্ছি—আমার আর এক দণ্ডও এ বাগানে থাকবার ইচ্ছে নেই— আমি না বেরোলে আমার মহাপ্রাণী বেরোবেন। হ্যাঁচ্ছোঃ। শরৎকালের মাধুরী আমার নাক-চোখ দিয়ে বেরোচ্ছে। প্রাণটা সুদ্ধ হেঁচে ফেলবার উপক্রম | হ্যাঁচ্ছো হ্যাঁচ্ছো। খক খক। কিন্তু কুঞ্জবাবু সেই কাজটা যদি— হ্যাঁচ্ছোঃ।
কুঞ্জবাবুর শাল মুড়ি দিয়া নীরবে আকাশের চাঁদের দিকে চাহিয়া থাকন
ভৃত্যর প্রবেশ
ভৃত্য। খাবার এসেছে।
কুঞ্জবিহারী। দেরি করলি কেন? খাবার আনতে দু-ঘণ্টা লাগে বুঝি?
দ্রুত প্রস্থান