হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/কুলীন মহাশয়দিগের পুত্র কন্যাগণের প্রতি ব্যবহার

কুলীন মহাশয়দিগের পুত্র কন্যাগণের প্রতি ব্যবহার ও তাহাদিগের বিবাহাদির নিয়ম।

 কুলীন মহোদয়গণের মধ্যে যাঁহারা সাতিশয় অর্থ পিশাচ না হন এবং ভবিষ্যতে তাঁহাদিগের বংশে যাহারা জন্ম গ্রহণ করিবে তাহাদিগের প্রতি কৃপাবান হইয়া তাহাদের চির দুঃখ রূপ কুল ভঙ্গ পথের পথিক না হন তবেই মঙ্গল, নচেৎ ভবিষ্যতে তাঁহারদিগের বংশজদিগকে বংশজ দোষে দুষিত হইয়া অতিশয় যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়।

 যাঁহাদিগের পূর্ব্ব পুরুষগণ স্ব স্ব মান মর্য্যাদা যত্ন পূর্ব্বক রক্ষা করিয়া থাকেন তাঁহাদিগকে নৈকষ্য সন্তান কহে। এই নৈকষ্য সন্তানগণ প্রথমে কোন প্রধান বংশীয় শ্রোত্রিয়ের আলয়ে বিবাহ করেন, পরে কুলমর্য্যাদা রক্ষার নিমিত্ত এক কুলীন তনয়ারও পাণি গ্রহণ করিয়া থাকেন, কিন্তু তাহাকে লইয়া সংসার ধর্ম্মাদি কিছুই করেন না, সে চিরকাল পিতৃ গৃহে অবস্থিতি করে এবং তাহার গর্ভে যে সকল সন্তান সম্মতি জন্মায় তাহার পৈতৃক ধন ভোগ করিতে পায় না, এবং তাহারা যাবজ্জীবন মাতুলালয়ে বাস করে। শ্রোত্রিয় কন্যারাই তাঁহাদিগের অতিশয় প্রিয় পাত্রী হইয়া থাকেন। এবং তাহাদের গর্ভে যে সকল সন্তান সন্ততি জন্মায় তাহারাই পৈতৃক ধন ভোগ করে। আহা! কি অসঙ্গত কার্য্য, তাঁহারা ঐ কুলকামিনী সমুহের পাণি পীড়ন করিয়া তাহাদের গর্ভে সন্তানাদি উৎপাদন করেন, কিন্তু তাহাদের ভরণ পোষণের কোন প্রকার উপায় করিয়া দেন না। তাহারা মাতুল গৃহে অতি কষ্টে যথা কথাঞ্চিৎ রূপে প্রতিপালিত হইয়া থাকে, এবং অভিভাবক অভাবে তাহাদের বিদ্যা বুদ্ধিরও অভাব হয়। সেই বিদ্যাভাব প্রযুক্ত তাহাদের অতিশয় অর্থাভাবও ঘটে, সুতরাং সেই বিষম অভাব হইতে নিস্তার পাইবার নিমিত্ত অন্য উপায় পাইয়া কেবল বল্লালী মানের উপরেই নির্ভর করে। তাঁহারা কোন সম্ভ্রান্ত বংশজদিগের আলয়ে বহু অর্থ গ্রহণ পূর্ব্বক তাঁহাদের কন্যাগণকে বিবাহ করেন, ইহাকেই কুল ভঙ্গ বলে।

 আহা! কি বিষাদের বিষয় ঐ কুলীন কুমারগণ পিতৃ সাহায্যাভাবেই ভবিষ্যতের অশুভকর বর্ত্তমান সুখে রত হন্‌। হায়! অগ্নি যেমন আপনিই আপনার মৃত্যুর হেতু হইয়া থাকে ঐ কুলীন বংশীয়েরাও তদ্রূপ। যেমন অগ্নি হইতে ধূম উৎপন্ন হইয়া মেঘ রূপে পরিণত হয় এবং ঐ মেঘ হইতে বারিবর্ষণ হইয়া আপন বংশকে ধংশ করে, তেমনি এই কুলীন মহাশয়েরাও আপনা হইতেই আপনাদিগের কুল নাশের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের কুল অগ্নি স্বরূপ, ঐ কুল কামিনীগণ ধূম স্বরূপ, এবং তাহাদের গর্ভস্থ সন্তানগণ মেঘ স্বরূপ, ঐ মেঘ রূপ পুত্রগণ হইতে কুল ভঙ্গ রূপ বারিধারা পতিত হইয়া সেই অগ্নি স্বরূপ কুলকে একেবারে নষ্ট করে। হায়! ঐ কুলীন সন্তানগণেরা যদ্যপি কুলকামিনীদিগের পাণি গ্রহণ না করেন অথবা গ্রহণ করিয়া আপন আলয়ে আনয়ন করিয়া আপনাদিগের শ্রোত্রিয়া স্ত্রীদিগের ন্যায় তাহাদের সহিত ব্যবহার করেন এবং তাহাদিগের সন্তানগণকে যত্ন সহকারে লালন পালন করেন ও তাহাদিগকে বিদ্যাভ্যাস করান, আর আপন বিবাদির অংশ প্রদান করেন, তবে তাঁহাদের সন্তানগণকে এই কুল ভঙ্গরূপ বিষম বিপদে পতিত হইতে হয় না।

 এই নৈকয্যদিগের মধ্যে যাঁহাদিগের ভগিনী না থাকে, তাঁহাদের মানের প্রভা কিছু মলিন হয়, এবং যাঁহাদিগের ভগিনী থাকে, তাঁহারা আত্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বংশে অথবা ভুল্য বংশে ভগিনীদিগকে দান করিয়া থাকেন এবং কন্যাগণেরও সেই ঘরে বিবাহ দিয়া থাকেন। সেই বিবাহে ইহাদিগের অতিশয় গৌরব বৃদ্ধি হয়, যাঁহারা ঐ গৌরব বৃদ্ধি করণে অক্ষম হয়েন তাঁহাদের কুল রঙা দোষে দুষিত হয়, ঐ কুলীন মহাশয়েরা এই মান রক্ষার নিমিত্ত অতি কুৎসিত কদাকার ও অন্ধ, কুব্জ, খঞ্জ, মূক, বধির প্রভৃতি এবং গঙ্গাযাত্রীকেও কন্যা ও ভগিনীগণকে দান করেন। আহা! কি নিষ্ঠুরতার কার্য্য, তাঁহারা কেবল আত্ম হিতের নিমিত্ত কুমারী ও ভগিনীগণের প্রতি যেরূপ কুব্যবহার করেন তাহা বলিবার নহে।

 একদা শ্রবণ করিয়াছিলাম, কোন গ্রামে ঐরূপ প্রধান বংশীয় এক ব্যক্তিকে গঙ্গাযাত্রা করাইয়াছিল তাহা শ্রবণ করিয়া এক নৈকষ্য সন্তান মনে করিলেন এই ব্যক্তি অতিশয় প্রধান বংশীয় এবং আমাদের করণীয় ঘর, ইহার মৃত্যু হইলে আমার দুহিতাগণের আর বিবাহ হইবার সম্ভাবনা নাই এবং কন্যাগণের বিবাহ না হইলেও পুত্রগণের মান রক্ষা হয় না। কিন্তু ইহার সহিত বিবাহ হইলে অচিরাৎ বিধবা হইবে, তবে ইহারা কুলীন কন্যা ইহাদিগের বিবাহ হওয়া আর না হওয়া অথবা বিধবা হওয়া সমান। কিন্তু বিবাহ দিলে পুত্রগণের মান রক্ষা হয় সুতরাং ইহাদিগের বিবাহ দেওয়া কর্ত্তব্য, এইরূপ বিবেচনা করিয়া ঐ মুমুর্ষ অবস্থাপন্ন বরের সহিত স্বীয় তনুজাদিগের বিবাহ দিলেন।

 হে সর্ব্ব জন হিতৈষী মহোদয়গণ! আপনারা এই স্থলে বিবেচনা করিয়া দেখুন ইহাতে আর শিখদিগের কন্যা হত্যাতে কি বিশেষ রহিল? তাহারা একেবারে নষ্ট করে, ইঁহারা চিরকাল দগ্ধ করেন এই মাত্র বিশেষ। তাহারা কন্যা দান করিবার নিমিত্ত অপরের নিকট ন্যূনতা স্বীকার ভয়ে ঐ দুষ্কর্মে রত হয়, ইহারা কুল না-শঙ্কায় এই ঘৃণিত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়।

 এই বিষয়ে আরো একটী দৃষ্টান্ত স্মরণ হইল, সুরতরঙ্গিণীর পশ্চিম তীরস্থ এক গ্রামে ঐরূপ প্রধান বংশীয় এক ব্যক্তি বাস করিতেন, তাঁহার এক মাত্র ভগিনী ছিল, সেই ভগিনীর উদ্বাহের নিমিত্ত তাঁহার পিতৃ স্বসার সপত্নী পুত্রের সহিত সম্বন্ধ নির্ব্বন্ধ করিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে সেই কন্যার অতি শঙ্কটাপন্ন পীড়া উপস্থিত হইল, পরে সেই পীড়ার কিঞ্চিৎ উপশম হইলে তাঁহার পিতৃ স্বসৃপতি তাঁহাদিগের আলয়ে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া ঐ কন্যার মাতা ভ্রাতা প্রভৃতি আত্মীয়গণ বিবেচনা করিলেন, ইহার যেরূপ পীড়া হইয়াছিল তাহাতে বাঁচিবার সম্ভাবনা ছিল না, কি জানি আবার কোন সময়ে ইহার মৃত্যু কাল উপস্থিত হইবে এবং ইহার বিবাহ না হওয়া প্রযুক্ত এত বড় মানটা একেবারে নষ্ট হইবে, অতএব আর অধিক বিলম্বের আবশ্যক নাই, পিশে মহাশয়ের সঙ্গেই ইহার বিবাহ দেওয়া যাক। এইরূপ কথা বার্ত্তার পর তাহারা সেই অশীতী বর্ষ বয়স্ক বরকে বিবাহের কথা জ্ঞাপন করিল। তাহাতে সেই বর অতিশয় বিরক্ত হইয়া বলিল, আমার সহিত বিবাহ দিও না, আমার সহিত বিবাহ দিয়া মেয়েটাকে কেন একেবারে নষ্ট করিবে, আমার পুত্রকে আলিতে আজ্ঞা করিয়াছি তিনি শীঘ্রই আসিবেন তাঁহার সহিত বিবাহ দিও। কিন্তু তাহারা কিছুতেই ক্ষান্ত হইল না, বুদ্ধের সহিত সেই কন্যার বিবাহ দিল, কন্যা বয়ঃ প্রাপ্ত হইবামাত্রই অতি ঘৃণিত কর্ম্মে রত হইল, তাহার মাতা ভ্রাতা প্রভৃতি বন্ধু জনেরা তাহার সেই দোষ অনায়াসে সহ্য করিতে লাগিল। এই প্রকারে কিছু কাল গত হইলে পর ঐ বৃদ্ধের মৃত্যু হইল, তাহাতে ঐ কন্যার বেশ বিন্যাসের কিঞ্চিৎ ব্যাঘাৎ জন্মিল, এই জন্য সে ভ্রাত্রালয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক নদী পারে গিয়া বসতি করিল। আমি অতি শৈশব কালে ঐ বরকে দেখিয়া ছিলাম তাহাতে কিঞ্চিৎ স্মরণ হয়, তাহার আকার ঠিক এক খানি নারিকেল কোরা কুরাণীর মত।