হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/নব বধূদিগের প্রতি শ্বশ্রূগণের আচরণ এবং বধূগণের মনোগত ভাব

নব বধূদিগের প্রতি শ্বশ্রূগণের আচরণ এবং বধূগণের মনোগত ভাব।

 এই বঙ্গ বাসিনী ভামিনীগণ সদ্যোজাত নব কুমারকে অঙ্কোপরি ধারণ করিয়া তাহার সুধাংশু সদৃশ অতি শোভন আনন অবলোকন করিযা তাঁহাদিগের মন আকাশে অভিলাষ রূপ বগ্বাবাযু উমিত হইয়া তাঁহাদিগের আশা সমুদ্রে অতি ভীষণ তরঙ্গ মালা উত্তব করিতে থাকে, এবং সেই তরঙ্ তাঁহাদিগের কত প্রকার ভাব ও কত রঙরই যে উদয় হয় তাহা কি বলিব। তাঁহারা ঐ পুত্র করেডে লইয়া তাহার ভাবি ব্যাপার ভাবনা করিতে থাকেন; কখন তাহার বাল্যাবস্থার ক্রীডাদি, কখন তরুণাবস্থার বিদ্যাভ্যাস; কখন বা কৃতবিদ্য হইয়া অর্থ উপার্জ্জনাদি এবং কখন কখন তাহাদিগের বিবাহ ও নব বধূর পরম শোভাকর ইনদীবর বিনিন্দিত বদনেন্দু দর্শন করিয়া স্বর্গেপম সুখ ভোগের প্রত্যাশা করেন এবং সেই নবকুমারগণের বয়োবৃদ্ধির সঙ সঙ তাঁহাদিগের ঐ আশা লতারও বৃদ্ধি হইতে থাকে। কিন্তু ইহার মধ্যে যাঁহাদিগের ঐ বলবতী আশালতা পরম কারুণিক পরমেশ্বরের কৃপাদৃষ্টিতে ফলবতী হয়, তাঁহা- দিগের হৃদি শতদলে পূর্ব্ব ভাব বিলীন হইয়া আবার নতন ভাবের উদয় হয়। আহা! পরিতাপের বিষয়? ইহাঁরা যে পদার্থ প্রাপি লালসায় লালাযিত ও চাতকী সদৃশ তৃষ্ণা সহকারে সেই ভাবি পুত্রবধূ মুখমণ্ডল অবলোকন করণাশয়ে সেই পথ নিরীক্ষণ করিতেন, কিন্তু এক্ষণে সেই বন্ধু প্রাপ্ত হইয়া তাহাদিগের প্রতি যে রূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন, সেই ব্যবহার আদির কিয়দংশ এই হীনাবস্থায় প্রকাশ হইতেছে। শ্বশ্রূগণ বিবাহ কালে বধূগণকে ক্ষীরালক্ত মিশ্রিত করত এবং তদ্বারা প্রস্তরময় ভোজন পাত্র পরিপূর্ণ করিয়া তদুপরি ঐ নববধূদিগকে দণ্ডায়মানা করিয়া এবং ব্রীহি ব্যুহ পরিপূরিত বেত্রময় পাত্র তাহারদিগের মস্তকোপরি স্থাপন,হন্তে সজীব, লেঠা মৎস্য, পিঠালি এবং কক্ষে জলপূর্ণ ঘটাদি প্রদান করত, এবং শনি বাদ্য বাদনাদি মঙ্গলাচরণ সহকারে অতীব সমাদরের সহিত ঐ বধূদিগকে গ্রহণ করেন, কিন্তু তাহার কিছু কাল পরেই বন্ধুদিগের প্রতি তাঁহাদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই তদ্বিপরীত ব্যবহার করিয়া থাকেন। আহা! লোকে যে বস্তু প্রাপ্তি আশয়ে পূর্বে বহু কামনা ও দেবতাদির নিকট মাননা করে, তাহার সেই বস্তু প্রাপ্তি হইলে সে যে কতই প্রযত্ন সহকারে তাহা রক্ষণাবেক্ষণ করে, কিন্তু শ্বশ্রূগণ ঐ প্রার্থনীয় বন্ধুগণকে এতাদৃশ যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করেন যে তাহাতে ঐ বধূগণের অবিশ্রান্ত অশ্রুপাত ব্যতিরেকে আর কোন মতেই দিনপাত হইবার সম্ভাবনা থাকে না। শ্বশ্রূগণ ঐ বন্ধুগণের বয়স ও শিক্ষা অশিক্ষাদির বিষয়ে কিছুমাত্র বিবেচনা করেন না। কেবল তাহাদিগের চরিত্র ও সর্ব্ব কর্ম্ম নিপুণতাদির বিষয়েই সবিশেষ মনোনিবেশ করিয়া থাকেন। কিন্তু কি প্রকারে সেই পথবর্ত্তিনী হইতে সমর্থ হইবে, তদ্বিষয়ক কোন প্রকার সদুপদেশ প্রদান করেন না, এবং ঐ বধূগণের অণুপ্রমাণ দোষ দর্শন করিলে পর্ব্বত পরিমাণে বৃহৎ করিয়া তোলেন। কিন্তু স্বীয় পুত্র কন্যাগণ যদি গুরুতর দোষে দূষিত হয় ও সর্ব্ব বিষয়ে অকর্ম্মণ্য হয়, তথাপি তাহারা তাহারদিগের সেই সমুদ্র সদৃশ অলঙ্ঘনীয় দোষ সমূহকে গোস্পদ তুল্য অতি ক্ষুদ্র জ্ঞান করিয়া অগ্রাহ্য করেন। তাঁহারা বধূগণের প্রতি কিছুমাত্র স্নেহ প্রকাশ করেন না, কিন্তু বধূগণ তাঁহাদের প্রতি মাতাপেক্ষা স্নেহ ও অচলা ভক্তি না করিলে সাতিশয় বিরক্তি প্রকাশ করিয়া থাকেন। আহা! কি ভ্রান্তিমূলক কার্য্য, তাঁহাবা একবার ভ্রমেও বিবেচনা করিয়া দেখেন না যে ঐ অবলা বালাগণের প্রতি কিরূপ অন্যায় ব্যবহার করেন, আর স্বীয় সন্তান সন্ততিগণের প্রতিই বা কত দূর পরিমাণে স্নেহ প্রকাশ করিয়া থাকেন ও কত প্রযত্ন সহকারে তাহাদিগকে লালন পালন করেন। কিন্তু বধূগণের প্রতি তাহার বিপরীতাচরণ করিয়া কি প্রকারে সেই স্নেহের প্রত্যাশা করেন? বধূগণ কি প্রকারে তাঁহাদিগের প্রতি মাতার ন্যায় স্নেহ করিতে সমর্থ হইবে। অগ্রে মাতা সন্তানদিগকে বহু যত্ন সহকারে লালন পালন করেন, পরে সন্তানগণ সেই যত্নে বর্দ্ধিত হইয়া মাতার প্রতি যত্ন ও ভক্তি প্রকাশ করিতে শিখে, কিন্তু শ্বশ্রূগণ বধূগণের প্রতি কিছু মাত্র স্নেহ প্রকাশ না করিয়া কি প্রকারে মাতৃভক্তির প্রার্থনা করেন? দেখ যদি কোন পাষাণ হৃদয়া মাতা সদ্যঃ প্রসূত সন্তানকে পরিত্যাগ করে, এবং সেই শিশু যদ্যপি অন্য দ্বারা প্রতিপালিত ও বর্দ্ধিত হইয়া সেই গর্ব্ভধারিণীর সহিত সাক্ষাৎ করে, আর জননী যদি তাহাকে স্বীয় পুত্র বলিয়া যত্ন প্রকাশ করেন, তবে সেই সন্তানের কি ঐ মাতার প্রতি যথার্থ স্নেহ ও অচলা ভক্তির সঞ্চার হইতে পারে? কিন্তু কোন কোন নিষ্ঠুর হৃদয়া শ্বশ্রূ তদপেক্ষাও অধিক নিষ্ঠুরতাচরণ করেন, এবং কোন কোন ধর্ম্ম ভয় বর্জিতা বধূও শ্বশ্রূগণের অতি দুরবস্থা করিয়া থাকেন। এই প্রকারে অনেক গৃহস্থালয় একেবারে নরক তুল্য ঘৃণিত হইয়াছে, এবং এই অত্যাচার দূরীকরণাশয়ে কোন কোন মহাত্মারা কহেন, বধূগণের অবাধ্যতাই ইহার মূলীভূত কারণ হইয়াছে, অতএব সেই কারণ নিরাকরণ করিতে পারিলেই সম্পূর্ণ অভ্যুদয়ের সম্ভাবনা; নচেৎ ইহার আর উপায়ান্তর নাই; তাঁহারা এইরূপ বিবেচনা করিয়া ঐ বধূদিগকে সাতিশয় উত্তেজনা ও ভয়ানক তাড়না করিতে প্রবৃত্ত হয়েন।

 কিন্তু তাঁহাদিগের সেই তাড়নাই ভবিষ্যতে অতি অনর্থের মূল হইয়া উঠে। যেমন সমুদ্র মন্থন কালে পুনঃ পুনঃ মন্থন করাতে বিষম বিষ উৎপন্ন হইয়াছিল, তদ্রুপ ঐ মহাত্মারা পুনঃ পুনঃ তাড়না করিয়া বিপরীত ফল লাভ করেন। তাহারা শ্বশ্রূগণের নিকট দিবস শর্ব্বরী নানা বিষয়ে প্রপীড়িত হইয়া গৃহকর্ম্ম নির্ব্বাহ করে, এবং পরিজনস্থ সমস্ত জনগণের ভোজনাদি সমাপ্ত হইলে যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহাই গ্রহণ করিয়া যথা কথঞ্চিৎ রূপে প্রাণ ধারণ করে, তাহাই তাহাদিগের যথেষ্ট,আবার তাহার উপর তাড়না করিলে কাটা ঘায়ে লবণ নিক্ষেপবৎ অতি অসহ্য হইয়া উঠে। সেই যন্ত্রণা হইতে আশু পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত উহারা বিধিমতে উপায়ান্বেষণ করিতে থাকে, এবং সেই পীড়নকর্ত্তাদিগের প্রতি আরও স্নেহের অভাব হয়। কোন কোন অভাগিনী নিতান্ত উপায় বিহীনা হইয়া অতি নৃংশস ব্যাপার যে উদ্বন্ধনাদি তাহাতেও রত হয়, এবং কোন কোন জ্ঞান বিহীনা অবলা উভয় কুল দূষিত করিয়া কুমার্গে পদ নিক্ষেপ করিতেও বাধ্য হয়। হায়! কি আক্ষেপের বিষয়। যে শ্বশ্রূগণ বধূগণের প্রতি কন্যাগণের ন্যায় স্নেহ করেন না, এবং বধূগণও শ্বশ্রূগণ প্রতি মাতার ন্যায় ব্যবহার করে না, আর কর্ত্তৃপক্ষীয় মহাত্মারা উহার যথার্থ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন না। আহা! শ্বশ্রূগণ যদ্যপি বিদ্যারত্নে ভূষিতা হইতেন তবে তাঁহাদিগের সেই বিদ্যারত্ন প্রভাবে এই বিষম অজ্ঞানান্ধকার নষ্ট হইত, তবে বধূগণের আর এতাদৃশ দুর্দ্দশা ঘটিত না; এবং বধূগণও যদ্যপি বিদ্যাবতী হইতেন তবে সেই বিদ্যারূপ মহাদ্রুম অবলম্বন করিয়া ঐ বহু যন্ত্রণারূপ মহাবন্যা হইতে অনায়াসে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইতেন। ইহা কেবল মধ্যবিধ ও সামান্য গৃহস্থদিগের প্রতি লিখিত হইল।