হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বঙ্গ দেশীয় ভঙ্গ কুলীনদিগের বিষয়
বঙ্গ দেশীয় ভঙ্গ কুলীনদিগের বিষয়।
যাঁহারা আপন হস্তেই ঐ পবিত্র কুল ভঙ্গ করিয়া ভক্ষণ করেন, তাঁহাদিগকে স্বকৃতভঙ্গ বলা যায়, এই স্বকৃতভঙ্গদিগের মানের আর পরিসীমা থাকে না; ইহারা ত্রিদশাধিপতির ন্যায় অতি আধিপত্য করিয়া থাকেন, ইহাঁরা প্রথমে কোন ধনাঢ্য বংশজ গৃহে আপন কুল ভঙ্গ করিয়া পরে অনেকানেক রমণীর পাণি গ্রহণ করেন, এবং লোকে ইহাঁদিগকে অতি আদর পূর্ব্বক আপন কন্যাগণকে প্রদান করেন। এই স্বকৃতভঙ্গদিগের সন্তানেরা দ্বিপুরুষে ও তাহাদের সন্তানগণ তিন পুরুষে, এইরূপ চারি পাঁচ ছয় ও সাত পুরুষ অবধি কুল থাকে, তাহার পর ঐকুল একেবারে নষ্ট হইয়া যায়। এই কুলীনেরা বহু সঙ্খ্যক বিবাহ করিয়া থাকেন, এবং ইহাঁদিগের বিবাহই উপজীবিকা, ইহাঁরা নবম বা দশম বর্ষ বয়সে বিবাহ করিতে আরম্ভ করেন এবং আয়ুঃ শেষ হইলে তাহারও শেষ হয়। ইহাঁরা মন্ত্রদাতা গোঁসাইদিগের মত তল্পী ও ভৃত্য সঙ্গে করিয়া দেশ দেশান্তর ভ্রমণ করেন, গোঁসাইগণ যেমন নতন শিষ্যদিগকে মন্ত্ দান ও পুরাতন শিষ্যের নিকট হইতে বার্ষিক গ্রহণ করিবার নিমিত্ত শিষ্যালয়ে গমন করেন, ইহাঁরাও তেমনি পুরাতন শ্বশুরালয়ে স্ত্রীদিগের নিকট হইতে পূজা গ্রহণ এবং নুতন আলয়ে বিবাহের নিমিত্ত গমন করেন, ইহাঁদিগের নিকট এক এক খানা খাতা থাকে, তাহাতে কাহার কত গুলি বিবাহ হইয়াছে ও কোন বৎসর কোন স্থানে কাহাকে বিবাহ করিয়াছেন তাহা লিখিত থাকে; কিন্তু ইহাঁদিগের মধ্যে যাঁহাদের কিঞ্চিৎ সঙ্গতি থাকে, তাঁহারা আর শ্বশুরবাটীর প্রত্যাশা রাখেন না এবং তাহাদিগের মানও অধিক, তাঁহারা দশ বার মুদ্রা পূজা স্বরূপ প্রাপ্ত না হইলে শ্বশুরালয়ে গমন করেন না, এবং শ্বশুরেরাও প্রায় অনেকেই সামান্য গৃহস্থ, তাহারা কি প্রকারে এত ব্যয় করিয়া জামাতাকে লইয়া যাইতে পারে, সুতরাং ঐ কামিনীগণ চিরকালই এক অবস্থায় পিত্রালয়ে অবস্থিতি করে, এবং স্বামি সহবাস অভাব প্রযুক্ত কেহ কেহ অতি ঘৃণিত বিষয়েও প্রবৃত্ত হইয়া থাকে। এই কুলীন মহাশয়দিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই একবার বিবাহ করিয়া আবার পুত্রের বিবাহের সময় স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া থাকেন, সেই পুত্রও বিবাহের সময় পিতৃ দর্শন করেন। আহা! কি ঘৃণিত কার্য্য, ইহাঁরা ব্যভিচার দোষকে দোষ বলিয়া ঘৃণা করেন না বরং শ্লাঘা করিয়া বলেন, আমরা কুলীন সন্তান আমাদিগের উহাতে লজ্জা কি? কুলীনদিগের কাহার ঘরে এরূপ নাই এবং আমাদিগের পিতা পিতামহ ও প্রপিতামহ প্রভৃতি সকলেরই এইরূপ হইয়াছে, তবে আমারই বা ইহাতে অপমান কি, আমরা কুলীন গঙ্গার তুল্য পবিত্র, গঙ্গায় যেমন বিষ্ঠা মড়া প্রভৃতি নানাবিধ ঘৃণাজনক দ্রব্য পতিত হইলেও তিনি অপবিত্র হন না, আমরাও তদ্রূপ। আহা! কি অজ্ঞানতার বিষয় ইহাদিগের পত্নীগণ ব্যভিচারিণী হইলেও অপমান হয় না, পুত্রগণ জারজ হইলেও মানের হানি হয় না, কেবল শ্বশুরালয়ে গিয়া পূজা না পাইলেই অতিশয় মানের লাঘব হইয়া থাকে। এই বিষয়ক একটী গল্প স্মরণ হইল, কৃষ্ণনগর জিলার অন্তঃপাতি কোন এক গ্রামে এক কুলীন গৃহস্থের জামাতা আসিয়াছিল, গৃহে তখন আর কেহই ছিল না, কেবল তাঁহার স্ত্রী একামাত্র বসিয়াছিল, সে বহু দিবসের পর স্বামি সন্দর্শন করিয়া অতিশয় সন্তুষ্টচিত্তে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অভ্যর্থনাদি করিল, তাহার স্বামি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আমার জন্য কিছু রাখিতে পারিয়াছ কি না? ইহা শ্রবণ করিয়া তাহার স্ত্রী কহিল, আমি ময়েমানুষ কোথায় কি পাইব যে তোমার জন্য রাখিব, স্বামিগণই স্ত্রী দিগকে প্রতিপালন করিয়া থাকেন ও অলঙ্কার বস্ত্রাদি প্রদান করেন, তুমি আমার জন্য কি আনিয়াছ বল, এই রহস্যজনক কথা শ্রবণ করিয়া তাহার স্বামি কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন; প্রস্থানকালে ঐ নারী অতিশয় নিষেধ করিতে লাগিল, তিনি কিছুতেই নিবৃত্ত হইলেন না, পরে সেই নারী অতিশয় দুঃখিতমনে চিন্তা করিতে লাগিল, আমি বিবাহের পর ইহাঁকে একবারও দৃষ্টি করি নাই এবং আমার বয়স প্রায় বিংশতি বৎসর অতীত হইল, স্বামি আমার চরিত্রের বিষয়ে কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া কেবল অর্থের আশা করিলেন। আমি যদ্যপি কখন অর্থ সংগ্রহ করিতে পারি তবে ইহাঁকে অবশ্যই পাইব। এইরূপ চিন্তা করিয়া কুলে জলাঞ্জলি প্রদান করত কলিকাতা নগরে আসিয়া বাস করিল। এই ঘটনার পর কিছু দিন গত হইলে এক দিবস সে আপন গৃহের গবাক্ষদ্বারে দণায়মান হইয়া রাজপথ নিরীক্ষণ করিতেছিল, ইতি মধ্যে তাহার সেই স্বামি তাহার দৃষ্টিপথে পতিত হইলেন, এবং সে তাঁহাকে দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিল ও আপন দাসীকে কহিল, তুমি ঐ ব্রাহ্মণটীকে ডাকিয়া আন, দাসী তৎক্ষণাৎ তাহাই করিল, ব্রাহ্মণ ঐ বাটী বেশ্যার বলিয়া জানিতেন না, সুতরাং সেই স্থানে গমন পূর্ব্বক তাহার আতিথ্য গ্রহণ করিলেন, পরে সায়ংকাল উপস্থিত হইলে ঐ নারী এক খানি রজতময় পাত্রে বহু সংখ্যক মুদ্রা স্থাপন পূর্ব্বক তাহা হস্তে লইয়া সেই ব্রাহ্মণের সম্মুখে রাখিল, ব্রাহ্মণ তদ্দৃষ্টে অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া ঐ নারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? আর কি নিমিত্তই বা আমার প্রতি এত সদয় হইয়াছ, তাহা বিস্তারিত রপে বর্ণনা কর। ইহা শ্রবণ করিয়া সেই নারী কহিল, আমি অমুক দেশের অমুক বংশের দুহিতা আমার নাম গৌরমণী; এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র ব্রাহ্মণ একেবারে বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইলেন এবং আপন দুষ্কর্ম্মের নিমিত্ত মনে মনে অনুতাপ করিতে লাগিলেন ও সে স্থান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু সেই বাররমণী কহিতে লাগিল। আমি তোমার জন্যই এরূপ দুষ্কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তুমি অর্থ না পাইলে আমার সহিত সহবাস করিবে না, এখন এই অর্থ গ্রহণ করিয়া সহবাস কর। ব্রাহ্মণ এই কথা শ্রবণ করিয়া একেবারে দুঃখার্ণবে পতিত হইলেন, এবং এই প্রতিজ্ঞা করিলেন এই পর্যন্ত আমাদিগের বংশে যাহারা জন্ম গ্রহণ করিবে তাহারা যদ্যপি বহু নারীর পাণি গ্রহণ করে তবে ধর্ম্ম হইতে পতিত হইবে। পরে ব্রাহ্মণ স্বদেশে গমন করিলে পর বেশ্যাও ধন সম্পত্তি যাহা কিছু ছিল সদ্ব্যয় করত পরম পুণ্যধাম বৃন্দাবনে প্রস্থান করিল। হে পাঠকবর্গ! আপনারা এই স্থলে বিবেচনা করিয়া দেখুন কিরূপ ঘটনা হইল, কেবল কৌলীন্য মর্য্যাদাই ইহার মূলীভুত কারণ, এই কৌলীন্য মর্য্যাদার বশীভূত হইয়া রাঢ়ীয় শ্রেণীর কুলীন মহাশয়েরা কি দুষ্কর্ম্মই না করেন, আপন প্রাণ সদৃশ কুমারীগণকে এক অতি শীর্ণ জীর্ণ কলেবর বৃদ্ধের হস্তে দান করেন এবং সেই বৃদ্ধের মৃত্যু হইলে সকল কুমারী একেবারে বিষম বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়, সেই দশার যে কত ক্লেশ তাহা কে না জানেন, ইহা জানিয়াও পিতা, মাতা, ভ্রাতা প্রভৃতি আত্মীয় জনেরা তাঁহাদের সদৃশ কুলীন একজন পাত্র প্রাপ্ত হইলেই কন্যা ভগিনী ভ্রাতৃপুত্রী প্রভৃতি সকল গুলিকেই ঐ এক বৃষে উৎসর্গ করিয়া দেন। হায়! ইহা কেবল বল্লালসেনই ঘটাইয়াছেন, তিনি যদ্যপি এই বঙ্গদেশে বিষ বৃক্ষ তুল্য কুলবৃক্ষ রোপণ না করিতেন, তাহা হইলে আর সেই বিষবৃক্ষের ফল স্বরূপ এই ব্যবহার দোষে বঙ্গদেশ দূষিত হইত না।