হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/বংশজদিগের বিষয়

বংশজদিগের বিষয়।

 এই কুলীন মহাশয়দিগের সাত পুরুষ অতীত হইলে ঐ বংশে যাঁহারা জন্ম গ্রহণ করেন, অথবা যাঁহাদিগের দুরদৃষ্ট বশত কন্যাগণ ক্ষুদ্র বংশে পতিত হয়, তাঁহাদিগের আর পূর্ব্বের মত মান সম্ভ্রম কিছুই থাকে না। তাঁহারা একেবারে স্বর্গ হইতে মর্ত্য লোকে পতিত হন,এবং তাঁহাদিগের পূর্ব্বপুরুষেরা যেরূপ আধিপত্য করিয়াছিলেন তাহা করা দূরে থাকুক বরং তাহার বীপরিতই হয়,তাঁহারা যেমন বহু নারীর পাণি গ্রহণ করিতেন ও তাহাদিগকে অতি ঘৃণা করিতেন, ইহাঁরা তেমনি এক নারী লাভ করিবার নিমিত্ত বহু অর্থ ব্যয় ও বহু লোকের উপাসনা করিয়া থাকেন,তাঁহারা পরম রূপবতী ও গুণবতী ভার্য্যাগণকে অতিশয় তাচ্ছিল্য করিতেন, ইহাঁরা সেরূপ পাওয়া দূরে থাকুক খাঁদা বোঁচা যাহা কিছু পান তাহাই অতি যত্ন পূর্ব্বক গ্রহণ করেন, এবং এই বিবাহ করিবার জন্য অনেকেই জন্মাবধি মৃত্যু পর্য্যন্ত মধু মক্ষিকার ন্যায় ধন সঞ্চয় করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া লোকযাত্রা সম্বরণ করেন। কেহ বা তিন চারি বৎসর বয়স্কা বালিকাকে দুই তিন শত টাকা মূল্য দিয়া ক্রয় করিয়া থাকেন ও তাহার দ্বাদশ বা চতুর্দ্দশ বৎসর বয়স না হইতেই আপনি পটল তোলেন। কেহ কেহ বা এরূপ দুই তিন বর্ষীয়া বালিকাকে বিবাহ করিয়া তাহার গর্ব্ভধারিণীর সহিত তাহাকে আপন আবাসে আনিয়া রাখেন,তাঁহারা এক প্রকার মন্দ করেন না, ফলে উপকার হউক বা নাহউক গাছে উপকার আশু হইবার সম্ভাবনা। কেহ কেহ স্থাবর অস্থাবর যাহা কিছু সম্পত্তি থাকে, তাহা বিক্রয় করিয়া পিশাচ জন্ম হইতে পরিত্রাণ পান, এবং ইহাদিগের মধ্যে যাঁহারা চারি পাঁচ ভাই, তাঁহারা প্রায় অনেকেই পঞ্চ পাণ্ডবের ন্যায় বিবাহ করেন, এবং ইহাঁদিগের ঘরে আইবড় বঠ্‌ঠাকুর অনেক দেখিতে পাওয়া যায়। প্রায় অনেকেই বংশ রক্ষার নিমিত্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতাটির বিবাহ দিয়া আপনি আইবড় বঠ্‌ঠাকুর হইয়া বসিয়া থাকেন, কেহ আপন কন্যাগণকে পরিবর্ত্ত করিয়া পুত্রগণের গতি করেন। এই প্রকার বিবাহের নিমিত্ত তাঁহাদিগের যে কত দু্দ্দশা ঘটিয়া থাকে তাহা বলা যায় না, জাতি নাশ, অর্থ নাশ, মান নাশ প্রভৃতি সর্ব্বনাশ ঘটে, এবং প্রতারক ঘটকগণ অর্থ লোলুপ হইয়া ব্রাহ্মণ কন্যা বলিয়া সামান্য জাতীয় কন্যাগণকে ঐ ব্রাহ্মণদিগের পুত্রের সহিত বিবাহ দেয়, বরকর্ত্তাগণ বিশেষ অনুসন্ধান করেন না কেবল কন্যাটি বড় ও সুলভ দেখিয়া একেবারে আহলাদে আট্খানা হইয়া যান; পরে সেই বঞ্চনা প্রকাশ হইলে একেবারে বিষম বিপদে পতিত হন। এই অর্থ লোভে কুলীন দয়িতাগণ আপন দুহিতাগণকে ঐ বংশজ গৃহে বহু অর্থ গ্রহণ পূর্ব্বক বিক্রয় করিয়া ভরত্তৃকুল দূষিত করেন এবং ঐ কন্যাগণকে প্রাপ্ত হইলে তাহার পিতা ভ্রাতা প্রভৃতি আত্মীয়েরা পুনর্ব্বার বিবাহ দিয়া আপন কুল রক্ষা করেন, কেহ বা অতি অপ্রতুল বশতঃ এক কন্যার দ্ধিবার বিবাহ দেন, কেহ কেহ সপ্ততি বা অশীতি বর্ষীয় বরের সহিত সপ্তম বা অষ্টম বর্ষীয়া বালিকার বিবাহ দিয়া বহু মুদ্রা গ্রহণ করেন ও ইহাদিগের মধ্যে যদ্যপি কাহারও তনয়া ক্ষয়-কাশাদি রোগে রুগ্ন থাকে তবে সেই রোগ গোপন করিয়া দুই তিন শত মুদ্রা পণ গ্রহণ করিয়া তাহার বিবাহ দেন, পরে সেই কন্যা দুই তিন মাসের মধ্যে মৃত্যু মুখে পতিত হয় এবং যাহারা কন্যা গ্রহণ করিয়াছিল তাহারা বিষম বিপদে পড়ে। এই বংশজদিগের বিবাহ বিষয়ক কতিপয় ঘটনা স্মরণ হইল, তাহা সর্ব্ব সাধারণের বিদিতার্থ এই স্থলে বর্ণনা করিতেছি। এক জনের নিকট শ্রবণ করিয়াছিলাম ত্রিবেণীর পশ্চিম দেবানন্দপুর নামক গ্রামে এক ব্যক্তি কন্যা গ্রহণ করিবার নিমিত্ত আসনে উপবেশন করিয়াছেন এমত সময়ে সেই কন্যা কহিল আমার সহিত ব্রাহ্মণের বিবাহ দিও না আমি সদাপের কন্যা, এই কথা শ্বণ করিয়া সকলে চমৎকৃত হইল এবং সম্বন্ধ কর্ত্তা ঘটককে উত্তম মথ্যম রূপে পুরস্কার দিল। কোন গ্রামে এক ব্রাহ্মণ অতি ইতর জাতীয় কন্যার সহিত স্বীয় পুত্রের বিবাহ দিয়াছিলেন, বহু দিবসাবধি তাহা জানিতে পারেন নাই, পরে এক দিবস ঐ ব্রাহ্মণের বাটীতে তাহার পরিবারেরা পৈতা প্রস্তুত করিতেছিল, ইতিমধ্যে ঐ বধূ কহিল, তোমরা এমন করিয়া টানা করিতেছ কেন? ইহাতে কি কাপড় বোণা হইবে? আমার বাপ এমন করিয়া টানা করে না, ইহা শুনিয়া তাহারা কহিল তুমি কি তাতির মেয়ে? সে তাহাতে কিছুই উত্তর করিল না, পরে তাহারা বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিল সে জোলার কন্যা। এক জন ব্রাহ্মণ ও তাহার উপপত্নী এক ব্রাহ্মণী এই উভয়ে একটি নাপিত কন্যাকে স্বীয় তনয়া বলিয়া এবং আপনাদিগকে দম্পতীরূপে পরিচয় দিয়া এই মহানগরস্থ এক গৃহস্থকে বঞ্চনা করিয়াছিল। সেই গৃহস্থেরা বহু কালাবধি ঐ ব্যাপার অবগত হন নাই, পরে কোন সময়ে ঐ বধূর অতি শঙ্কটাপন্ন পীড়া উপস্থিত হইল, তাহাতে সেই বাটীর এক ব্যক্তি কহিল, আহা! ইহার এমনও পিতা মাতা যে ইহাকে একেবারে সীতা নির্ব্বাসনের ন্যায় নির্ব্বাসন করিয়া দিয়াছে, ইহার এতাদৃশ পীড়া উপস্থিত হইয়াছে তাহারা একবার উদ্দেশ করিল না। এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র সেই বধু বলিল, আমার মা বাপ আবার কে? তাঁহারা ব্রাহ্মণ আমি নাপিত কন্যা, এই কথা শুনিয়া সকলে মনে করিল ইহা বিকারের প্রলাপ হইবে। পরে ঐ বধূ রোগ মুক্ত হইলে তাঁহারা বিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা জানিতে পারিলেন যে সে যথার্থই নাপিত কন্যা, কিন্তু জানিয়াও ঐ বহুমূল্যের বধূটীকে ত্যাগ করিতে পারিলেন না, সে দাসীর মত গৃহে রহিল, পরে তাহার গর্ব্ভে অনেক সন্তান সন্ততিও জন্মিল। দেখ আবার বর্ণ সঙ্কর উৎপন্ন হইল, এখন এজাতির কি উপাধি হইবে?