হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/জাতিভেদ
জাতিভেদ।
অতি প্রাচীনকালে এই ভারতবর্ষে চারি বর্ণ মাত্র ছিল, যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। পুরাণে কথিত আছে যে, এই সকল বর্ণ ব্রহ্মার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হইতে উৎপন্ন হয়, এবং তাহাদিগের কার্য্যকারণেরও বিশেষ নিয়মাদি ছিল, যথা ব্রাহ্মণগণ বেদ অধ্যয়ন, ক্ষত্রিয়গণ রাজ্য শাসন, ও বৈশ্যগণ ব্যবসায়, এবং শূদ্রগণ দাসত্ব কর্ম্মে নিযুক্ত থাকিত। কিন্তু এক্ষণকার মত আচার ব্যবহারাদির কোন কঠিন নিয়ম তৎকালে প্রচলিত হয় নাই। কেহ কাহার অন্ন গ্রহণ করিলে তাহার জাতি নাশ হইত না, কেহ অন্য জাতীয় কন্যা গ্রহণ করিলেও পতিত হইত না। মহাভারতে ইহা বাহুল্যরূপে বর্ণিত আছে। অধিক কি কহিব তৎকালে ব্যভিচারাদি বিষম দোষও দোষ বলিয়া ধর্ত্তব্য হইত না, ইহা সম্ভব পর্ব্বে বিশেষ রূপে বর্ণিত আছে,তাহার কিয়দংশ এস্থলে উদ্ধত হইল। এই অবনীমণ্ডলে উদ্বালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁহার শ্বেতকেতু নামে এক পুত্র ছিল, এক দিবস ঐ ঋষি পুত্র কলত্রে পরিবেষ্টিত হইয়া উপবিষ্ট আছেন, এমত সময় সেই স্থানে অন্য এক ব্যক্তি আসিয়া ঋষিপত্নীর হস্ত ধারণ পূর্ব্বক লইয়া চলিল। তদ্দর্শনে ঋষি কুমার জিজ্ঞাসা করিল। পিতঃ! আমার মাতাকে ঐ ব্যক্তি লইয়া চলিল কেন? পিতা উত্তর করিলেন, ব্রহ্মার সৃষ্টির এইরূপ নিয়ম, ইহা শ্রবণ করিয়া ঐ কুমার একেবারে হুতাশনের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিলেন, এবং কহিতে লাগিলেন, ব্রহ্মা বেটা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার নিয়ম সংস্থাপন করে নাই, আমি তাহার সৃষ্টি নাশ করিয়া পুনর্ব্বার সৃষ্টি করিব, পরে সকলে তাঁহার এতাদৃশ ক্রোধ দর্শনে স্তুতিবাদ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, তুমি ব্রহ্মার সৃষ্টি নষ্ট করিয়া তাঁহার আবমাননা করিও না, তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন, তুমি তাহার নিয়ম সংস্থাপন কর, এবং অদ্যাবধি তামার নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিয়া যে কেহ কার্য্য করিবে, সে ধর্ম্ম হইতে পতিত হইবে ও লোক সমাজে অতি ঘৃণার পাত্র হইবে। পরে সেই ঋষিপুত্র এই নিয়ম সংস্থাপন করিলেন, যথা এই পর্য্যন্ত যে নারী আপন স্বামি ব্যতীত অপরকে স্পর্শ করিবে, তাহার উভয় কাল নষ্ট হইবে, এবং তাহাকে কেহ স্পর্শ করিলে সেও পতিত হইবে, পরে সেই নিয়ম অবলম্বন করিয়া একাল পর্য্যন্ত সকলেই চলিতেছে। জাতিভেদও প্রায় সেই রূপেই সৃষ্ট হইয়াছে। পুরাণে কথিত আছে যে, বলিরাজ-পুত্র বাণ মহাশয় অতি শৈব ছিলেন, তাঁহার রাজত্ব কালে বিবাহাদির কোন নিয়ম নির্দ্ধারিত ছিলনা, সুতরাং সকলেই যথেচ্ছাচারী হইয়া যাহা স্বেচ্ছা তাহাই করিত, এইরূপে নানা বর্ণে মিশ্রিত হইয়া বহু বর্ণ সঙ্কর উৎপন্ন হইতে লাগিল, পরে বাণ রাজা লোকান্তরিত হইলে তাঁহার পুত্র পৃথু রাজ্যেশ্বর হইলেন, এবং বর্ণ বিষয়ক অতি বিশৃঙ্খলতা দৃষ্টি করিয়া সুশৃঙ্খলা করণাশয়ে ছত্রিশ জাতির প্রভেদ করিলেন, এবং যে যেমন অংশে উৎপন্ন হইয়াছিল, তাহার সেই পরিমাণে মান প্রদান করিলেন,তদবধি এই নিয়ম যথাক্রমে চলিতেছে,কিন্ত এক্ষণে আমাদিগের এই বঙ্গদেশীয় নব্য সম্প্রদায়ী মহোদয়গণ এই নিয়ম উচ্ছন্ন করিবার নিমিত্ত অতিশয় ব্যস্ত হইয়াছেন, আর এই বিষয়ক অনেক প্রস্তাবাদিও লিখিত হইয়াছে, এবং অনেকে বলেন, এই জাতিভেদ আমাদিগের সকল সুখের প্রতিবন্ধক স্বরূপ হইয়াছে, যদি এই জাতিভেদ না থাকিত তবে আমাদিগের এতাদৃশ দুরবস্থা কখনই ঘটিত না, আমরা অনায়াসে দেশ বিদেশ ত্রমণ পূর্ব্বক সকল দেশের আচার ব্যবহার এবং রীতি নীতি পদ্ধতি অবলোকন করিয়া বু্দ্ধি বৃত্তি চরিতার্থ করিতাম, এবং সমুদ্র পথে পোতাদি জলযান সকল লইয়া বাণিজ্যাদি করিতে সমর্থ হইতাম, এবং সকলে এক জাতি হইলে পরস্পর ঐক্য স্থাপন হইত, আর সেই ঐক্য প্রভাবে আমরা এই পরাধীনতা শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইতাম, এবং এই জাত্যভিমান না থাকিলে সকলেই অভিমানি হইয়া প্রধান হইবার মানসে বিদ্যাভ্যাসে যত্নবান হইত, এবং সকল লোকের মনাকাশে জ্ঞান সুর্য্য প্রকাশ হইয়া অজ্ঞান তিমির নষ্ট করিত, এবং আমাদিগের দেশ হইতে মিথ্যা প্রতারণা চৌর্য্য ও হত্যা প্রভৃতি দোষ সমূহ একেবারে দূরীভুত হইত, ও আমাদিগের দেশে বিবাহাদির যে রূপ অনিয়ম আছে তাহারও অভাব হইত, কারণ যাহার কন্যা রূপবতী ও গুণবতী হইত সকলে তাহার কন্যাই গ্রহণ করিত, এবং যাহার পুত্র গুণবান হইত তাহাকেই সকলে কন্যা দান করিত, আর সকলে এক জাতি হইলে একাসনে উপবেশন করিয়া অন্ন আহার করিত, আহা! একান্ন আহারেতে যে কতদুর মিত্রতা জন্মায় তাহা কাহার অবিদিত আছে, এবং এই মিত্রতা বশতঃ একের বিপদ উপস্থিত হইলে অন্যে সহায়তা করিত, এইরূপে আমাদিগের এই বাঙ্গলা ধাম পরম সুখধাম হইত। এই প্রকারে অনেকেই এই জাতিভেদের অভেদ করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে যত্ন করিতেছেন, এবং এবিষযে কেহ কেহ কৃতকার্য্যও হইয়াছেন, কিন্তু এখনও প্রকাশ্যরূপে হইতে পারেন নাই, তাঁহারা গোপনে প্রদীপ নির্ব্বাণ পূর্ব্বক পর অন্ন ভক্ষণ করিয়া স্বদেশের পরম হিতসাধন করিলাম বলিয়া কতই শ্লাঘা করেন, কিন্তু ইহা সাধারণে প্রচলিত হইলে আমরাও শ্লাঘা করিব ও রন্ধন ক্লেশ হইতে মুক্ত হইয়া অনায়াসে ক্রয় করিয়া ভোজন করিব, এবং পুত্র কন্যাগণের বিবাহের নিমিত্তও বড় ভাবিতে হইবেনা অনায়াসেই ঐ কার্য্য সমাধা হইবে, কোথায় স্বজাতীয় পুত্র কন্যা চেষ্টা করিব? এই সহবে অনেক ধনাচ্য স্বর্ণবণিক বসতি করেন তাঁহাদিগের আলষেই উহাদিগের বিবাহ দিব। আহা! কি দুঃখের বিষয় যে আমাদিগের এই নব্যসম্প্রদায়ী মহোদয়গণ কেবল এই জাতিভেদের উপরেই বিরক্ত হইয়াছেন! কিন্তু ইহা অপেক্ষা যে কত গুরুতর দোষে এই দেশ একেবারে ছারখার হইতেছে, তাহার প্রতি ইহাঁরা একবারও দৃষ্টিপাত করেন না, এবং যে বিষয়ে অনায়াসে কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন ও যাহাতে স্বদেশের বিশেষ উপকার দর্শিবে তাহার চেষ্টা করেন না, ইহাঁরা এই জাতি ভেদের অভেদ হইলে কি প্রকারে স্বাধীন হইবেন তা ইহাঁরাই জানেন, ইহাঁদিগের কি পর অন্ন ভোজনে বল বিক্রম বৃদ্ধি হইবে? যদি তাহা হয় তবে ক্ষতি নাই, কেননা তাহা হইলে আমাদিগেরও এতাদৃশ দুরবস্থা থাকিবে না, আমরা স্বাধীন দেশের মহিলা হইয়া এই হীনাবস্থা হইতে উদ্ধার হইব এবং পরম সুখ সৌভাগ্যে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ হইব। এক অন্ন ভোজন করিয়া যে ঐক্য স্থাপন করিবেন তাহা কি প্রকারে সম্ভব, ইহাঁদিগের একান্নভোজী স্বজাতীয় ত অধিক আছেন, তাঁহাদিগের সহিত কত ঐক্য আছে; অগ্রে তাঁহাদিগের সহিত মিত্রতা স্থাপন করন, পরে সাধারণের সহিত করিবেন, সাধারণের কথা দূরে থাকুক, এই বঙ্গদেশীয়দিগের মধ্যে সহোদরের সহিতই বা কয় ব্যক্তির মিত্রতা আছে? হায়! যখন এক রক্তে উৎপন্ন হইয়া এক স্তন পান করিয়া এবং এক স্নেহে প্রতিপালিত হইয়া ঐক্য স্থাপন হইল না, তখন কি প্রকারে কেবল একান্ন ভোজনেই ঐক্য স্থাপন করিবেন। সহোদরের কথা দূরে থাকুক, কারণ তাহার সহিত বাল্যকালে এক্র থাকিয়া পরে এক প্রকার স্বতন্ত্র হইতে হয়; কিন্তু স্ত্রীপুত্রাদি পরিজন বর্গ যাহারা আপন অঙ্গের স্বরূপ, তাহাদিগের সহিত কত লোকের যথার্থ মিত্রতা আছে? হায়! যাহাদিগের সহিত আমরণ সহবাস করিতে হয়, যখন তাহাদিগের সহিত ঐক্য স্থাপন হইল না, তখন কি প্রকারে জগৎস্থ সমস্ত লোকের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিবেন। যখন জাতিভেদের অভেদ হইলেও ঐক্য স্থাপনের কোন উপায় দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, তখন কি প্রকারে বল বৃদ্ধি হইবে, যেহেতু ঐক্যই বলের এক প্রধান কারণ, তবে সেই ঐক্যাভাবে কি প্রকারে ঐ কার্য্য সমাধা হইতে পারে, যদি তাহাই না হইল তবে আর জাতিভেদের অভেদ করিবার কি প্রয়োজন। যদি বিবাহাদির নিমিত্ত হয় তবে বড় মন্দ নয়, কিন্তু অগ্রে আমাদিগের দেশে বিবাহ বিষয়ক যে সকল অনিয়ম প্রচলিত আছে তাহা নিবারণ করুন, পরে অন্য জাতীয়ের সহিত বিবাহ হইবে, আর যদি পান ভোজনাদির সুবিধার নিমিত্ত হয় তবে এই স্থলে বক্তব্য এই যে আমাদিগের দেশে কত লোক অন্নাভাবে কষ্ট পাইতেছেন, এবং সমুদ্র পথেই বা কত লোক গমনাগমন করিতেছেন, আর গমন করিয়াই বা ভোজনাভাবে কত লোকের প্রাণ বিয়োগ হইতেছে এবং এই বঙ্গদেশীয়দিগের মধ্যে কত ব্যক্তিই বা দেশ বিদেশ পর্য্যটন করিয়া জাতিভ্রষ্ট হইতেছেন। ইহাঁরা অগ্রে এই ভারতবর্ষের চতুর্দ্দিক ভ্রমণ পূর্ব্বক স্বদেশীয়দিগের আচার ব্যবহারাদি দর্শন করুন, পরে অন্যান্য দেশ দর্শন করিবেন, ভারতবর্ষের চতুর্দ্দিক দর্শন দূরে থাকুক, এই বঙ্গদেশের চতুর্দ্দিক দর্শন করুন, বঙ্গদেশের কথা দূরে থাকুক, ইহাঁরা যে নগরে বা গ্রামে বাস করেন তাহার চতুর্দ্দিক দৃষ্টি করিয়াছেন কি না সন্দেহ; অতএব অগ্রে ইহাঁরা এই সমস্ত দর্শন করত অত্রস্থ লোক সমূহের আচার ব্যবহারাদি পরিজ্ঞাত হউন, পরে অন্য দেশীয়দিগের আচার ব্যবহার দৃষ্টি করিবেন। আমার এই স্থলে নিবেদন এই যে কেহ আমার এই উক্তিতে বিরক্ত হইবেন না, বরং বিবেচনা পূর্ব্বক এই দেশের দুরবস্থার প্রতি দৃষ্টি করিবেন, এই বঙ্গদেশ নানা প্রকার অনিয়মে পরিপূর্ণ রহিয়াছে, পরিবর্ত্তন করিতে হইলে তাহার সমুদয় পরিবর্ত্তন করিতে হয়, নতুবা একের উপর টান পড়িলে অন্য আসিয়া উপস্থিত হয়; যেমন বিধবা বিবাহ প্রচলিত হইয়াছে, কিন্তু বাল্য বিবাহটি উঠিল না এবং বহু বিবাহ নিবারণের আইন প্রচলিত হইবে, কিন্তু কৌলীন্য মর্য্যাদাটি থাকিবে। বিধবা ও বহু বিবাহ ফল স্বরূপ কিন্তু কৌলীন্য মর্য্যাদা ও বাল্য বিবাহ বৃক্ষ স্বরূপ হইয়াছে। যেমন বৃক্ষ সত্ত কখনই ফল একেবারে নষ্ট হয় না, তেমনি কৌলীন্য মর্য্যাদা ও বাল্যবিবাহ সত্তে কখনই বৈধব্য যন্ত্রণা ও বহু বিবাহ নিবারণ করিতে পারিবেন না, যেহেতু কারণ থাকিতে কার্য্য কখনই একেবারে নিবারিত হয় না, তাহা প্রকাশ্যেই হউক বা অপ্রকাশ্যেই হউক অধিক পরিমাণেই হউক আর অল্প পরিমাণেই হউক অবশযই হইবে। অতএব আপনারা অগ্রে কারণ নষ্ট করিয়া, পরে কার্য্যের প্রতি দৃষ্ট করিবেন। এইস্থলে আমার নিবেদন এই যে, আপনারা বিশেষ রূপ বিবেচনা করিয়া দেখুন, কোন একটী নিয়ম পরিবর্ত্তন করিতে হইলে কত ক্লেশই সহ্য করিতে হয়, এবং সেই কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত কত লোকেরই উপাসনায় প্রবৃত্ত হইতে হয় এবং কত লোকেরই যে বিপক্ষ হইতে হয় তাহা বলা যায় না; অধিক কি বলিব ঐ কার্য্য সম্পাদকের প্রাণের উপরেও আঘাত পডিবার সম্ভাবনা। দেখ যখন বিধবা বিবাহের আইন প্রচলিত হয়, তখন কত লোকই যে তাহার বিরুদ্ধে খড়্গ ধারণ করিয়াছিল, এবং ঐ কার্য্য সম্পাদককে কতই যে গ্লানি সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না। কিন্তু যত পরিমাণে কষ্ট সহ্য করিয়াছিলেন, বিবেচনা করিয়া দেখিলে সকলে বুঝিতে পারিবেন যে ঐ কার্য্য সম্পাদক মহাশয় তদ্ধিষয়ে কত দূর কৃতকার্য্য হইয়াছেন। আমি বিবেচনা করি যে পরিমাণে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করিয়াছিলেন, এবং যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় করিয়া ছিলেন, তাহার শতাংশের একাংশও ফল লাভ করিয়াছেন কি না সন্দহ। দেখ তথাপি এই বিধবা বিবাহ শাস্ত্রমত ও যুক্তিসিদ্ধ এবং এই বিধবাবিবাহ প্রচলিত না থাকা প্রযুক্ত লোকে কতই কষ্ট সহ্য করিতেছে, তথাপি সর্ব্বপ্রকারে কর্ত্তব্য যে এই বিধবা বিবাহ ইহাতে সহসা প্রবৃত হইতে পরাঙ্মুখ হইতেছে। দেখ ঐ কার্য্য সম্পাদক মহাশয় এতাদৃশ ক্ষমতাবান যে উহাঁর তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি এই ভারতবর্ষে বর্ত্তমান আছেন কি না সন্দেহস্থল। বিধবাবিবাহের কথা দূরে থাকুক, অতি অনিষ্টকর এবং হৃদয় বিদারক সহমরণ ও শিকদিগের বালিকা হনন এবং পূর্ব্বদেশীয়দিগের সাগরে সন্তান বিসর্জ্জনাদি অতি গর্হিত কর্ম্ম সকল নিবারণ করিবার সময় ঐ নিবারকগণকে কতই যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইয়াছিল এবং কত লোকই বে তাঁহাদিগের বিপক্ষতাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল তাহা বলা যায় না, অধিক কি কহিব ঐ সহমরণ উঠাইবার সময় তদ্বিপক্ষে এক সভাও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এবং এই কার্য্য সম্পাদন করিবার নিমিত্ত রাজা রামমোহন রায় মহাশয় আপন প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়াছিলেন। অদ্যাবধি ঐ মহাত্মার নামোল্লেখ করিলে আমাদিগের হিন্দুধর্ম্মাভিমানী মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকই কর্ণ বিবরে অঙ্গুলি অর্পণ করিয়া থাকেন, এই ভয়ানক দোষাবহ কার্য্যসমূহ নিবারণ করিবার নিমিত্ত যেখানে এতাদৃশ যন্ত্রনা সহ্য করিতে হইয়াছিল এবং লোক সকলে এতাদৃশ বিপক্ষতাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, সেখানে অত্যল্প লোকের অনিষ্টকর এই জাতিভেদ কি প্রকারে বঙ্গদেশ হইতে উঠাইয়া দিবেন, যেহেতু ইহা পূর্ব্বোক্ত বিষয় সকলের ন্যায় সাধারণের বিশেষ কোন অনিষ্ট করিতেছে না, তবে কি প্রকারে সর্ব্ব সাধারণের হৃদয় হইতে ইহা তিরোহিত হইবে। এই জাত্যভিমান লোকের হৃদয় ভাণ্ডারে যে প্রকার দৃঢরূপে অবস্থিতি করিতেছে, আমি বোধ করি আর কিছুই সেরূপ হইতে পারে না, আমাদিগের দেশে যত প্রকার আচার ব্যবহার প্রচলিত আছে, সে সমুদয়ের মধ্যে যে কোন বিষয় হউক না কেন কেহ না কেহ অজ্ঞাত থাকিলেও থাকিতে পারেন, কিন্তু এই জাত্যভিমানটি সকলেরই হৃদয়ঙ্গম আছে, কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি বনিতা এবিষয় কেহই অজ্ঞাত নহে,তবে কি প্রকারে একেবারে সাধারণের মন হইতে হঠাৎ যাইতে পারে এবং কি প্রকারেই বা সকলের মন হইতে এই বৃহৎ অভিমান দূর হইবে, কি প্রকারেই বা লোক সমূহের চির সংস্কার নষ্ট হইবে, কি প্রকারেই বা পরস্পরের একান্ন ভোজনে অভিরুচি জন্মিবে। দেখ অতি নীচ জাতি হড্ডি ও চণ্ডালদিগকে দৃষ্টি করিবামাত্র যখন ঘৃণা উপস্থিত হয়, তখন কি প্রকারে তাহাদের অন্ন পানীয় গ্রহণ করিতে সকলের অভিরুচি হইবেক, দুই এক জন গ্রহণ করিতে পারেন করুন কিন্তু সাধারণে তাহাতে কখনই প্রবৃত্ত হইতে পারিবেন না, অতএব যাহা সাধারণে প্রচলিত না হইল, তাহার নিমিত্ত এত ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন কি? গোপনে কে কি না করিতেছেন, কিন্তু প্রকাশ হইলেই বিষম অত্যাচার বোধ হয়। জাতি, আচার, ব্যবহারাদি সকলই মনুষ্যের সৃষ্ট, যাহা দেখিতে উত্তম ও পদ্বতিক্রমে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ উপযোণী তাহাই কর্ত্তব্য, এই রূপ বিবেচনা করিয়া আমাদিগের পূর্ব্বতন মহাত্মাগণ এই নিয়ম আবলম্বন করিয়া লোক সকল চিরকাল অতিবাহিত করিবে এই মানসে উহার প্রতি দৃঢ় গ্রন্থি স্বরূপ এক এক অনুশাসন স্থাপন করিয়াছেন, সেই অনুশাসন ভয়ে ভীত হইয়া অদ্যাবধি হিন্দুগণ চলিতেছেন,অন্যান্য দেশে আমাদিগের মত অন্ন পানাদির উপর ঐ নিয়ম থাকুক বা না থাকুক, কুল মানাদির উপর আছে।
বহু দিবস অতীত হইল, আমি এতদ্বিষয়ে কিঞ্চিৎ বলিবার ইচছা করিয়াছিলাম। কিন্তু বামা জাতি সহসা কোন বিষয়ে সাহস করিতে সমর্থ হই নাই, কারণ বু্দ্ধি বাম বশতঃ পাছে বিজ্ঞ সমাজে উপহাসের পাত্রী হই, এই আশঙ্কায় নিরস্ত ছিলাম, এক্ষণে আমার এই হীনাবস্থায় তাহার উল্লেখ করিলাম।